করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্স

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রহমত মোল্লার পাঁচ মেয়ে আর আট ছেলে। এ সব ছেলেমেয়ে সবার জন্ম ১৯৬৫ সালের আগে। ১৯৬৫ সালের কথা। পাকিস্তানের সমকালীন সামরিক সরকারপ্রধান, যিনি ৬৪’র ভোটে অভিনয় করে বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, শোনা কথা সাজানো যুদ্ধ জয়ে হয়েছেন ফিল্ড মার্শাল, মৌলিক গণতন্ত্র তার এক বিশেষ প্রিয় শব্দ। গণতন্ত্রের বিশ্ব মডেলে রূপান্তরের জন্য তার খয়েরখাঁদের কাজে লাগিয়েছেন- জাতিসংঘ যদি এটি মডেল হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তিনি পেতেও পারেন এমন সম্ভাবনা তার চাটুকারেরা হরহামেশা জানাচ্ছেন। দেশের মেধাবী আমলারা প্রেসিডেন্টকে বল্লেন, ‘স্যার মাথায় এক জবর বুদ্ধি আইছে-পূর্বের লোকেরা সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠের গোঁ ধরে সব কাজে ভাগ বসাতে চায়, ভাগাভাগিতে হরহামেশা বেশিটা চায়। কারণ পূর্বেরা জনসংখ্যায় বেশি। এখন পশ্চিমের জায়গা জমি বেশি অথচ জনসংখ্যা অনুপাতে কম। আর পুবের লোক বেশি অথচ জায়গা জমি কম। তাই গলার জোর তাদের বেশি। এটা কমানো থামানোর একটা ভালো উপায় আছে।’ প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন-কী?
‘পরিবার পরিকল্পনা’
এ আবার কী? গণতন্ত্রের আগে ‘মৌলিক’ জুড়ে দিয়ে গণতন্ত্রের যেমন নতুন সুখ ও সুরে সাধতে চাইছি তেমনি পরিকল্পনার আগে ‘পরিবার’ জুড়ে দিয়ে পরিকল্পনারে কল্পনার বাড়ি ছাড়া করতে চাওয়া হচ্ছে নাকি প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন রাখেন।
বিজ্ঞ আমলারা, যারা মেকলের ভাষায় রক্তে মাংসে শক্তিশালী, জ্ঞান গরিমায় চৌকশ দেওয়ানা আর চালাক, চতুরতায় সুন্দরবনের বনেদী মামা সম্প্রদায়ের স্বগোত্রীয় নাম পরিচয়ে সুশীল সেবক, কাজ কামে প্রভু প্রভু ভাব। আর যে কারণে প্রেসিডেন্ট মহোদয় একখানা মশহব কেতাবই লিখেছিলেন ‘প্রভু নয় বন্ধু’। ঋৎরবহফং ঘড়ঃ গধংঃবৎং এর এমনই অনুবাদ করেছিলেন পূর্ববঙ্গের এক সৈয়দ সাহেব। প্রেসিডেন্টকে বোঝালেন মহোদয় এটি পরিকল্পনাকে লম্বা খাটো কিংবা বিশেষায়িত করার জন্য নয়, এটি একটি ‘পরিবার’কে সাইজ করার কেরামতি। পুবের দেশে পরিবার সাইজ করতে পারলে ৩০-৪০ বছরের মাথায় দেখা যাবে তারা সংখ্যায় পশ্চিমের চাইতে কমে গিয়েছে, সংখ্যাগুরুরা হয়েছে সংখ্যালঘু। পশ্চিমের পরিবার সাইজ করার দরকার হবে না কেননা এখানে জমি জায়গা বেশি লোকসংখ্যা কম। এভাবে চললে দেখা যাবে ৩০-৪০ বছর পর পশ্চিমে লোকসংখ্যা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে এমন জায়গায় গেছে আর পুবের লোকসংখ্যা কমে হয়ে গেছে সংখ্যালঘু, আর পশ্চিমের লঘুরা হয়েছে গুরু। তখন দেখা যাবে পুবের লোকেরা ভাগ চাওয়া চাওয়াতিতে আর পেরে উঠছে না। চোখ ট্যারা আরেক কূটনৈতিক আমলা বলল, ‘স্যার, আর একটা মজার ব্যাপার ঘটবে পুবের সংসারে।’
প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন সেটা কী? এই আমলা হারভার্ড থেকে অর্থ-সমাজতত্ত্বে বড় ডিগ্রিধারী। তিনি বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘স্যার, পরিবার সাইজ করার যে সব ব্যবস্থা দেয়া হবে তা পুবের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী সংসারের লোকেরাই ব্যবহার করবে। অশিক্ষিত, বেকার ও বুদ্ধুরা ব্যবহার করবে না কেননা তারা ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ জাতীয় সাইনবোর্ড পড়তে পারবে না। তাদের রেডিও থাকবে না, টিভি নেই যে পরিবার সাইজের নানান এড দেখবে। ফলে তারা পরিবার সাইজ করবে না। তারা বরং ছেলেমেয়ে বেশি হলে বেশি আয় রোজগার করতে পারবে একটা দুটো মারা গেলেও অসুবিধা হবে না- এসব চিন্তা থেকেই ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়াতে থাকবে। অন্যদিকে শিক্ষিতরা, সম্পন্ন পরিবারের লোকেরা পরিবার সাইজ মন্ত্র মেনে নিয়ে ছেলেমেয়ের সংখ্যা কমাবে। ফলে তাদের পরিবার থেকে সমাজে আসবে স্বল্প পরিমাণ সদস্য আর বস্তি বা অশিক্ষিত পরিবার থেকে আসবে বেশি সদস্য। এক পর্যায়ে সমাজে একটা ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। সম্পন্নরা তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্যদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে নইলে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে, কেননা বাইরের হানাহানিতে নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তার প্রশ্নে শঙ্কিত হয়ে উঠবে। এ রূপ পরিবেশে একসময় পুবের সংসারে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে পুবের লোকেরা রাজনীতি শিক্ষা-দীক্ষায়, চাকরি-বাকরিতে পশ্চিমের সঙ্গে আর পেরে উঠছে না। তখন আমরা হব আরো লাভবান, বলিয়ান ও কামিয়াব।
প্রেসিডেন্ট বললেন আর বলতে হবে না। সাচ্চা প্রস্তাব।
রহমত মোল্লার পাঁচ মেয়ে আর আট ছেলের ঘরে নাতিপুতি (টুজি-সেকেন্ড জেনারেশন, থ্রিজি-থার্ড জেনারেশন) মিলে প্রায় শ খানেক হবে। সেই সব নাতিপুতির আবার পোলাপান হয়েছে তার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে মোটামুটি শ তিনেক। আপন চাচাতো মামাতো ফুপাতো খালাতো ভাইবোন বা এক কথায় ইংরেজিতে ফার্স্ট কাজিন নামে পরিচিত। বাঙালির হাতে অনেক সময় তাই তাদের শব্দমালায় চাচাতো মামাতো ফুপাতো খালাতো কত সহশব্দ আছে- ইংরেজের হাতে সময় কম- ‘ফার্স্ট কাজিন’ বলেই খালাসের ভেতর ওরা সবাই। ইংরেজরা যেমন ‘ুড়ঁ’ এই শব্দের মধ্যে তুমি তোমরা সবাইকে গাদাগাদি করে ভরিয়েছে। আর বাঙালিরা সম্বোধনের বেলায়ও জাতপাত, মান সম্মান দেখানোতেও দরাজ দিল- তুই, তুমি, আপনি।
রহমত মোল্লা অবস্থাপন্ন মানুষ। যদিও করোনাকাল চলছে তবুও এবারের শীতে তার সখ হলো নাতিপুতিসহ সবাইকে নিয়ে তার বিরাট মঞ্জিলে মেহফিল বা সম্মেলন বা মেজবান করবেন। মেয়েদের নায়রী আনবেন তারা ও তাদের ছেলেমেয়েদের তস্য তস্যদের নিয়ে আসবে। রহমত মিয়া তার বড় ছেলের বড় মেয়ের বড় ছেলে মহিবুলকে দায়িত্ব দিলেন তালিকা তৈরিতে-টুজি থ্রি জি পর্যন্ত কত সদস্য হয়। মহিবুল চৌকশ ছেলে- পরিসংখ্যানে পড়াশোনা করছে সে, মিন মিডিয়া এসব করতে করতে তার দাদুকে বারবার এটা সেটা প্রশ্ন করছে। রহমত মোল্লা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিকুলেট। আজকালকার নাতিপুতিদের ফেসবুক, ইউটিউব, ওয়াটসআপ ভাইবার এসব অতশত তিনি বোঝেন না। গুগল নামে কি এক সবজান্তা আছে কম্পিউটারে তার কাছে, যা কিছুই জানতে চাওয়া হোক না কেন- নিমিষের মধ্যে এনার তথ্যভাণ্ডার নিয়ে হাজির। মহিবুলের প্রথম সমস্যা ফাস্ট কাজিনদের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে। তার চাচা ফুফুরা সিনিয়র ফার্স্ট কাজিন আর তার নিজের মামাতো ফুফাতোরা জুনিয়র কাজিন। সে রহমত মিয়ার সঙ্গে আলাপ করে সিনিয়রদের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ এবং জুনিয়রদের নিম্নকক্ষ এমন ধরনের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে ফেলল। সিনিয়রদের বয়স বেশি-অনেকেরই স্বাস্থ্যগত সমস্যা-ডায়াবেটিস আছে, কারো কারো চোখে ছানির অপারেশন হয়েছে। করোনার টার্গেট হওয়ার ভয়ে কাতর এনাদের অনেকে চাকরি থেকে অবসরও নিয়েছেন। খাওয়া-দাওয়ার রেস্ট্রিকশন- এসব দেখতে হবে, এরা রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, মান্না দে আঙুর বালা, হেমন্তর গান বড়জোর সাবিনা পর্যন্ত এদের চলে। কিন্তু জুনিয়রদের কাছে ব্যান্ড সংগীত ছাড়া চলবে না। খেতে হবে টাইগার জাতীয় এনার্জি ড্রিংস, ওয়াই ফাই ফেসবুক দেখার সুবিধা চাই এন্তার দাবি সবার। দুই জেনারেশনের ফার্স্ট কাজিনদের এক জায়গা করার বিস্তর ঝামেলা। মহিবুল প্রমাদ গোনে। কিন্তু রহমত মিয়া যত সমস্যা দেখেন তত তাতে আনন্দ পান, উৎফুল্ল বোধ করেন। তিনি দেখতে চান সমাজ কীভাবে বদলাচ্ছে। কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে রুচিতে। চিন্তা চেতনার স্তরে- কী কী পরিবর্তন। বোঝা পড়ায় কী বিস্তর ফাঁক। পৌরসভার খাতায় বিয়েবিচ্ছেদের হিসাব করোনায় সংক্রমণ-সংহার সংক্রান্ত হিসাবের চেয়ে বেশি বৈ কম না। করোনা যদিও জানিয়েছে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ সমস্যা আগে থেকেই ছিল। প্রেসনোটের উপান্তে কোভিড-১৯ সব কিছুতেই করোনা দায়ী দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
২৪ পৌষ, জানুয়ারির আট ঠিক হয়েছে ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্সের। পৌষ মেলার মতো, পিঠা উৎসবের মতো রহমত মঞ্জিলে মিলবে সবাই। থিম সং ঠিক করা হয়েছে ‘পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন ফিরে আর আসবে কি কখনো’- মান্নাদের এই গানটি রহমত মোল্লার বড় ছেলের বড় মেয়ে ময়নার খুব পছন্দ। মহিবুল এই মুহূর্তে যদিও জুনিয়র ফার্স্ট কাজিন গ্রুপের (জেএফসিজে) আহ্বায়ক তার পছন্দ একটু আধুনিক একটু পপ একটু বিটলেস একটু দলছুট একটু ডিফারেন্ট টাস জাতীয় কোন গান। যাহোক রহমত মোল্লা মনে করেন মান্নাদে এখনো টপে, তার গানই ভালো। মান্নাদে ঘরানার শিল্পীরা তো প্রায় সবাই ওপারে এখন। যাক থিম সং নিয়ে এত মাতামাতি মতান্তর করে লাভ নেই- মহিবুল রণে ভঙ্গ দেয়। সবাইকে ইনভাইট আই মিন দাওয়াত পাঠানো হয়েছে- আপামর বাংলাদেশের ভূ-সীমায় যারা আছে তারাই আসবে। মার্কিন মুলুকের কানেকটিকাট থেকে ডা. জাহির আর তার দু মেয়ে দু গ্রুপে তারা- কিন্তু করোনার বাধানিষেধ মাড়িয়ে তাদের আসার সুযোগ নেই, এ ধরনের হঠাৎ আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারলেও তারা দূর থেকে শুভেচ্ছা জানাল। মেলবোর্ন থেকে মল্লিকা আর তার তিন ছেলে তমাল, কামাল ও জামাল মন খারাপ করে ইমেইল পাঠিয়েছে। স্কাইপে কথা বলেছে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মতো তারা বলেছে নিয়মে ও নিয়ন্ত্রণে সব কিছু করাকে তারা ভালোভাবে নিতে পারছে না। রহমত মোল্লা বলেছেন সবার কথা এক সঙ্গে শোনা সম্ভব না। জাপানের টোকিও থেকে নাবিলা আর তাদের মা জুলিয়েট জানিয়েছে সম্মেলন হচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু যারা যোগ দিতে পারছে না তাদের জন্য যেন কিছু একটা গিফট পাঠানো হয়। এ ধরনের হরেক রকম দাবি দাওয়া লন্ডন, টরেন্টো, সৌদি আরব আর কাতার কুয়েত থেকে। রহমত মোল্লা ভাবেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে তার রক্তের সম্পর্কের সবাই। বাঙালি ঘরে বসে নেই। এই বাংলাদেশের ভেতরেও জেলা উপজেলা বাছ বিচার নেই। সব খানে ছাগলনাইয়া ডোমার কিংবা গাংনী জকিগঞ্জ শ্যামনগর সবখানে রহমত মোল্লার কেউ না কেউ আছে। এক সময় চট্টগ্রামের লোকেরা চাঁটগায়ের বাইরের তাবৎ জগতকে নোয়াখালী বলে ব্যঙ্গ করত এবং পারতপক্ষে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতাতে চাইত না। আর এখন খাইছনির সঙ্গে ‘গম আছ’র সম্পর্ক হচ্ছে।
২৪ পৌষের দুদিন আগ থেকে সবাই আসা শুরু করল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চে ইস্টিমারে সড়কে সবাই আসছে। এবারও কুয়াশা বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। লঞ্চ রাতে চলতে পারে না-ইস্টিমার চরে আটকে যায়। প্লেন ল্যান্ড করতে না পেরে উড়াল দিয়ে যায়, রাস্তায় ফগলাইট জ্বালিয়েও চলতে পারে না ময়নার ড্রাইভার। সে আসছে ঢাকা থেকে। রহমত মঞ্জিলে সাজ সাজ রব। প্রথম ফার্স্ট কাজিন সম্মেলন-২০২১ উদ্বোধনের আর মাত্র একদিন বাকি। খালা ফুফুদের শোরগোলে এলাহি কারবার। রংপুর থেকে আসছে নাসি খালার পরিবার। তার মেয়েরা বিদেশে খালা খালু একা আসছেন। রংপুরে শীত একটু বেশি-ওনাদের বয়সও বেশি। অনেকদিন তাদের রহমত মঞ্জিলে আসা হয় না। এটা একটা ভালো উপলক্ষ।
রহমত মঞ্জিলে যাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল তারা অধিকাংশই সিনিয়র ফাস্ট কাজিন গ্রুপের (এসএফসিজি) সদস্য। দেখা গেল তাদের আড্ডাটা যেন জমছে বেশি। কেননা এরা সবাই সমবয়সে একটি শান্ত সমাহিত সুমধুর পরিবেশে এখানে বড় হয়েছিলেন। তখন সমাজ সংসারে এত টানাপড়েন শুরু হয়নি। ভাই বোনেরা গলাগলি করে চলত। খুনসুটি যে ছিল না তা নয়-তখন সুখ দুঃখ আনন্দ সর্বনাশের সংবাদ সবাই শেয়ার করত। সমবেদনা জানাতো। সহমর্মিতা বোধটা বেশ জাগ্রত ও দৃশ্যমান ছিল। এখন প্রত্যেকে কেমন যেন একা একা। নিজেদের সবকিছু পাসওয়ার্ড দিয়ে আড়াল করতে চাইছে। নেটওয়ার্কেও সব কিছু শেয়ার করতে চায় না। পাছে ভাইরাস এসে তার ফাইল ক্রাশ করে এই ভয়ে। আগে এই ভয় যে ছিল না তা নয় কিন্তু তখন কেনা জানাজানির জগৎ এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল না বলে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা বোধটা গাঢ় ছিল- আর এখন তথ্য আদান প্রদানের বলয় বিশ্বব্যাপী এবং স্বল্পতম সময়ে সব কিছু হাতের নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় মনোনিবেশে তাড়া নেই। গাঢ়তা নেই বন্ধুত্বে ছাড়াছাড়িতেও লাগে না সময়। যা গড়ে ওঠে সহজে তা ভাঙেও সহজে। গড়ে ওঠার সময় তো কম এখন গাঢ় হওয়ার সুযোগও কম সুতরাং ভাঙাভাঙিও ফাটাফাটি।
শীতকালে ইলিশে মজা নেই যদিও ইলিশ রপ্তানির জন্য রেডি।
শহর চষে জোগাড় হলো ৭০ ইলিশের চালান। যাহোক ফার্স্ট কাজিন কনফরেন্স উদ্বোধন আগামীকাল। রহমত মোল্লা আর তার স্ত্রী রোমেনা বেগম কাল সকালে পিঠা পুলি সহযোগে উদ্বোধন বা সূচনা ঘটাবেন এই সম্মেলনে, রোমেনা বেগমের শরীরটা ভালো না। ডায়াবেটিস আদৌ কন্ট্রোলে নেই- এই বয়সে হাঁটাচলা তেমন নেই আর খাওয়া দাওয়ায় এত বাচ বিচার করে চলাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। আশি বছরের বেশি বয়স তার। স্বামীর ঘরে এসে ছিলেন সেই বার বছর বয়সে সে হিসেবে সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঘর করছেন। সামলিয়েছেন সংসার। মহিবুল একটা ‘সারপ্রাইজ’ তার কাছে গোপনে পুষছে। আজকাল বিভিন্ন কনফারেন্সে বিশেষ ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা দেয়ার রেওয়াজ আছে। এ জাতীয় কিছু আছে। ‘এর বেশি এখন কিছু বলা সমীচীন হবে না’ সম্মেলনের আগের রাতে ‘মিট দা প্রেস’ জাতীয় মহড়ায় বলল মহিতুল। রহমত মঞ্জিলের নিচতলার বৈঠক ঘরে সন্ধ্যা ৭টায় মিনি সংবাদ সম্মেলন করে মহিতুল ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্সের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। দৈনিক হয়রানি পত্রিকার প্রতিনিধির এক প্রশ্নের জবাবে মহিতুল জানান এ সম্মেলন হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং এখানে পরিবেশিত সব খাবারই ফরমালিন মুক্ত। ডজনকে ডজন মাস্ক কেনা হয়েছে। হাত ধোয়ার সাবান অঢেল, ডেটল স্যানিটাইজার সবকিছু। ম্যাজিস্ট্রেটকেও ভূরিভোজে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, যাতে ভ্রাম্যমাণ কোন ঝামেলা তিনি পাকাতে না পারেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই সরকারি চাকুরে, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থাকবেন ও বেকার ব্যক্তিত্ব থাকবেন বিধায় এখানে খোলামেলা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ জাতীয় কনফারেন্স এবারই প্রথম আয়োজকরা আশা করছেন অনেক ইতিবাচক চিন্তাভাবনা বেরিয়ে আসবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল ৪২০-র রিপোর্টার রঞ্জন জানতে চান কনফারেন্সে কোনো ঘোষণা বা চুক্তি, গঙট জাতীয় কিছু স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে কিনা। রহমত আলী মোল্লা সংবাদ সম্মেলনে শেষের দিকে এসে যোগ দেন। তিনি জানান ‘মামা ভাগ্নে যেখানে’ জাতীয় একটা ঘোষণা পত্র তৈরির পরিকল্পনা আছে- নেপোটিজম ফেরারিটজম হওয়ার যে ক্রনিক রোগ সবখানে দেখা যায় কনফারেন্সে তার ওপর ধারণাপত্র ও ধরনা দেয়ার আধুনিক পদ্ধতি পেশ হতে পারে। সেখানেও এ ব্যাপারে কিছু বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মতামত বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন। রহমত মোল্লা আরো মনে করেন পুরনো গানের দিকে পুরনো ছবি দেখার পক্ষে সিএফসিজিদের তরফ থেকে দাবি উঠতে পারে এবং সঙ্গত কারণে জেএফসিজিদের পক্ষ থেকে তার বিপরীত বক্তব্য আসবে। তিনি এ দুটোর মধ্যে সমন্বয়ের সূত্র আবিষ্কারের আভাস দেন। পুরনো গান নতুনদের মুখে রিমেক করার কথার দিকে তিনি ইঙ্গিত দেন। সংবাদ সম্মেলনের এ সময়টাতে পাশের রুমে ‘আরো কিছুটা সময় না হয় রহিলে কাছে’ জাতীয় গান ব্যান্ডে তোলার সুর ভেসে আসছিল।
কনফারেন্সে খাবার দাবারে বৈচিত্র্য প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। নতুনরা জাঙ্ক ফুড খেতে চাইছে কোকা কোলা ড্রিংকস এসব জামপেস জমবে। পুরাতনরা অধিকাংশই নানান রোগ বাতিকগ্রস্ত। তারা ডায়েট ড্রিংক, ভেজিটেবলস খেতে ও রেড মিট জাতীয় খাবার না খাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। খাবার দাবার আয়োজনকারী কমিটির প্রধান সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক এবং সিএফসিজির সদস্য রোমিও হক সংবাদ বন্ধুদের জানালেন-আমরা ডেলিগেটদের কাছ থেকে যেসব ফরমায়েশ পেয়েছি তাতে নানা বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করেছি। কেউ চেয়েছে চ্যাপা শুঁটকি আবার হ্যাম বার্গার পেতে চেয়েছেন অনেকে। এত আকাশ পাতাল কিভাবে সমন্বয় হবে বুঝছি না। খেজুরের রস পেতে চেয়েছেন ২৬ শতাংশ ডেলিগেট। চিকিৎসক বন্ধুরা জানিয়েছেন নিপাহ ভাইরাসের ভয় আছে তাতে। আমরা দুটো উপায় বিবেচনায় রেখেছি এ ব্যাপারে (১) এই শহরের সব বাদুড়কে দুদিনের জন্য ‘গৃহবন্দি’ (যেমন বড় শহরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পরিবেস্টন করে রাখা হয়) রাখা অথবা (২) প্রতিটি রসের পাত্রের কাছে একজন করে দারোয়ান দাঁড় করিয়ে রাখা বাদুড় তাড়াবার জন্য (যেমন এটিএম বুথ এ একজন পাহারাদর সব সময় বসিয়ে রাখা হয়)। দৈনিক টাকা পয়সা প্রতিদিন এর প্রতিনিধি মুখের ওপরই মন্তব্য করলেন- এতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাবে না? রোমিও হক বললেন সদস্যদের সুস্থতা আমাদের কাছে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কনফারেন্সে কোনো নাশকতামূলক কিছু ঘটা বা ঘটানো আশঙ্কা তারা করছেন কিনা এমন প্রশ্ন রাখলেন সাপ্তাহিক সুনীতি সম্ভারের প্রতিনিধি। রহমত মোল্লা বললেন এটা আপন রক্তীয় সম্পর্কীয় স্বজনদের সম্মেলন এখানে রাগারাগি মান অভিমান পর্যন্ত ব্যারোমিটার উঠতে পারে তার পর কিছু নয়। আর তাছাড়া এক কারণের জন্য অন্য সব কারণকে টেনে আনার কোনো পরিকল্পনা এখানে থাকবে না এখানে কোনো হাইব্রিড নেতৃত্ব, বর্ণচোরা ব্যক্তিত্ব, সংস্কারবাদী কিংবা ফরমালিন যুক্ত মনোভাবের কারো সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা দেখছি না- সেহেতু আমার মনে হয় না এখানে নাশকতার কোনো সম্ভাবনা থাকবে। তবে সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস কিংবা ইদানীং কালের ভোটে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে চলমান বিতর্কের একটা পরোক্ষ প্রভাব কনফরেন্সে আলাপ আলোচনা পরামর্শ পর্বে ফস করে ঢুকে পড়লে আমাদের করার কিছু থাকবে না। তবে কনফারেন্সের আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রধান তিনি নতুন এসেছেন কিছুক্ষণ আগে-তার বাচনভঙ্গি ও শব্দ চয়নের নয়নে নাচনে আশা করা যার যা মেসেজ পাওয়ার তা তারা পাবে। আজকাল কাজের চাইতে বাক্যবাগিশের জয় জয়াকার তবে কারো কারো শব্দ অপব্যবহারের খেসারত যে দিতে হয় না তা নয়। সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয় এ কনফারেন্সকে কেন্দ্র করে রহমত মোল্লার নাতি নাতিনদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে এই পঁচাশি বছর বয়সে তিনি তাতে বিশেষ উৎফুল্ল বোধ করছেন। যদিও কনফারেন্সের সাফল্য কামনা করে ছোট বড় ছবি দিয়ে এখনো কোন পোস্টার চোখে পড়েনি। রহমত মোল্লা চোখ নামিয়ে প্রসঙ্গটি তুললেন আজকাল পোস্টার ফেস্টুনের নতুন চল চালু হয়েছে। সেখানে উপরে আগে একজন এখন দুজন তিনজনের ছবি ছোট হচ্ছে আর বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়র মতো নিচে থাকে আসলের চাইতে নকলদের ছবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়