করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

কবিয়াল রমেশ শীল : দুঃখের অনল থেকে উৎসারিত আলোক শিখা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মনস্বিতায় সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭)। তাই তো তার অন্তর্ধানের ৫৫ বছর পার হলেও জ্ঞান এবং সংগীত সৃজনের স্রোতধারায় তিনি এখনো বরণীয়। তার স্মৃতির সলতে সমভাবে সমুজ্জ্বল, সজীব, বর্ণময় ও দীপ্যমান। রমেশ শীলের জীবনের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই শৈশবেই তিনি বাদ্যযন্ত্র ও গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এতে পিতার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো উল্লেখ করার মতো। তার আগ্রহের তরঙ্গ দেখে পিতা তাকে বিভিন্ন গানের পুস্তিকা সংগ্রহ করে দেন। পিতার উৎসাহ তাকে উদ্দীপ্ত করে তোলে এবং সমবয়সীদের সাথে নিয়ে তিনি কবি গানের চর্চায় মনোনিবেশ করেন। সে সময় অকস্মাৎ পিতৃ বিয়োগে তার জীবন অন্ধকারে ঢেকে যায়। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে ধোঁয়াশার মধ্যে বালক রমেশকেই ধরতে হয় সংসারের হাল, বাইতে হয় মস্ত এ তরী। ফলশ্রæতিতে তিনি প্রাথমিকের পাঠ শেষ করতে পারেননি; বন্ধ হয়ে যায় কবি গানের অনুশীলনও। তার বাবার জীবৎকালেই পরিবারের অন্যরাসহ তিনি মামা বাড়িতেই থাকতেন, কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর সেখানে আর থিতু হওয়া সম্ভব হয়নি। মাতৃকুলের আত্মীয়স্বজনের ষড়যন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এক সময় তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। পালিয়ে দেখা হলো শাকপুরার এক যুবকের সঙ্গে, তিনি বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) যাচ্ছিলেন। সে সময় চট্টগ্রামের লোকেরা ভাগ্যান্বেষণে বার্মার রেঙ্গুন ও আকিয়াবে যেতেন। এসব নিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা সে সময় ছড়া কাটতেন এভাবে-

গুন্নি বাছার গুন্নি ঠ্যাং
ক্যানে বাছা রঙ্গুম গ্যাল…
(অর্থাৎ ছোট্ট ছেলের ছোট্ট পা, সে ছেলে কি করে রেঙ্গুন গেলো।)

রমেশ শীল ওই যুবকের সঙ্গে রেঙ্গুন চলে যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত থাকেন বলে জনশ্রæতি রয়েছে, ছিলেন প্রায় সাত বছর। চট্টগ্রামে প্রবল এক ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের খবরে তিনি পরিবারের সবার জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন এবং দেশে ফিরে আসেন। সে সময় রমেশ পুরোদস্তুর যুবক। দেশে ফিরে শুরু করেন কবিরাজি চিকিৎসা। এতে আয়-উপার্জনও ভালো হচ্ছিলো, প্রতিষ্ঠাও পান। কিন্তু যে মন পড়ে থাকে গানের সুর ও ছন্দের আনন্দ-উচ্ছ¡াসে তাকে কি বেঁধে রাখা যায়? তিনি ছুটতে থাকেন বিভিন্ন কবি গানের আসরে। তার উৎসাহে জোয়ার তোলেন প্রতিবেশী কবিয়াল দীনবন্ধু সরকার। সে সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কবি গানের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। প্রযুক্তির অগ্রগতি ও আধুনিক যন্ত্রপাতির কাছে হার মেনে তা আজ বিলুপ্ত প্রায়। তারা কবি গান শুনেন আর দুজনে সুর বাঁধেন। রমেশ শীল তো মশগুল হয়ে পড়লেন, তার ধ্যান-জ্ঞানে কবি গান ছাড়া কিছুই নেই, এভাবে বেশকিছু সঙ্গীও জুটে গেলো।

একবার বন্ধুদের সাথে সদরঘাটের জগদ্ধাত্রী পূজায় এলেন শ্রোতা হয়ে, সে বারই তার জীবনে বাক পরিবর্তনের সুযোগ এলো অযাচিতভাবে। কবি গান শুরু হলো, মুখোমুখি দুকবিয়াল, মোহনবাঁশী ও চিন্তাহরণ। কিন্তু চিন্তাহরণ বেশিদূর এগুতে পারলেন না, তার কণ্ঠ বসে যাওয়ায় পড়লেন বিপাকে। শ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে উদ্যোক্তারা শ্রোতাদের মধ্য থেকে কবিয়াল সন্ধান করতে থাকেন। ঘোষণা করেন কেউ যদি কবি গান জানেন, যেনো মঞ্চে উঠে আসেন। বন্ধুদের উৎসাহ ও সাহস যুবক রমেশকে মঞ্চে নিয়ে যায়। তিনি ভয়ে আড়ষ্ট, কিন্তু দমার পাত্র নন। সেদিন রামায়ণ আশ্রিত গল্প, রাবণের বোন রাক্ষস কন্যা সূর্র্পনখার প্রেম নিবেদনের কাহিনীই ছিলো কবি গানের বিষয়। প্রেম নিবেদন করছে মধুকে, যে কিনা তারই ভগ্নিপতি। মোহনবাঁশী ছিলেন মধুদৈত্যের ভূমিকায়, তরুণ কবিয়াল রমেশ শীল সঙ্গত কারণেই সূর্পনখা।

অভিজ্ঞ মোহনবাঁশী ও আনকোড়া তরুণ রমেশের মধ্যে শুরু হলো যুক্তি, পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন ও খণ্ডন। ক্রমশ এগিয়ে চললো ছন্দে ছন্দে, আনন্দ কলরবে কবি গানের আসর। তীক্ষè যুক্তি-তর্কে মোহনবাঁশী অসহায় বোধ করলেন, চোখে-মুখে হতাশার ছাপ, কিছুতেই হার মানাতে পারছেন না এ তরুণকে। রাত গড়িয়ে সকাল, সকাল গিয়ে বিকাল কিন্তু দুজনই তর্কে অনড়। অবশেষে উদ্যোক্তারা আপসরফা করলেন, রমেশ শীলকে পুরস্কৃত করা হলো। পুরস্কারের অর্থ পেয়ে তার উৎসাহ আকাশ স্পর্শ করে। তরুণ কবিয়ালের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে দিনের অনুপ্রেরণা তাকে চালিত করে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের পথে। সময় কাটান রামায়ণ, মহাভারত, বাংলা কোরান শরিফ, গীতা ইত্যাদি অনুশীলনে। খুব স্বল্প সময়ে লাভ করেন শাস্ত্রজ্ঞান। এভাবে তিনি ক্রমশ কবি গানে জড়িয়ে পড়েন। তার পেশা ও নেশা হয়ে ওঠে কবি গান।
তার গানের বিষয় হয়ে ওঠে প্রথম মহাসমর, দ্বিতীয় মহাসমর, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, দুর্ভিক্ষ, মানুষে মানুষে মহামিলনের বাণী, দেশের গান ইত্যাদি। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগের সূত্রে তার গানে যুক্ত হয় মানুষের শোষণ-বঞ্চনার কাহিনী। ধীরে ধীরে এ বাংলা ছাড়িয়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। চট্টগ্রামের বাইরে তিনি প্রথম কবি গান পরিবেশন করেন বর্ধমান জেলার হাটগোবিন্দপুরে। পরবর্তীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের আয়োজনে কলকাতায় তিনি আরো বৃহত্তর পরিসরে গান পরিবেশনের সুযোগ পান। এটি ছিলো তাদের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন। মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত এ কবি গানে তিনি কলকাতার মানুষের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হন এবং তার প্রশংসায় ভরে ওঠে সংবাদপত্রের পাতা। কবি গানে তার এ সুখ্যাতি তাকে অপ্রতিদ্ব›িদ্বতার আসনে বসায়। এভাবে তিনি অসংখ্য আসরে কবি গান পরিবেশন করেন এবং নায়ক হয়ে ওঠেন।

রমেশ শীল মরমি গানের ধারায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন প্রায় ৪৬ বছর বয়সে। সে সময় এ অঞ্চলের খ্যাতিমান পীর ছিলেন মাইজভাণ্ডারের সাধক গোলাম রহমান। সেখানে প্রতি বছর মাঘ মাসে উরস অনুষ্ঠিত হয়। মেলা বসে, মানুষের মেলা। প্রতিবেশী সারদাচরণ দে তাকে সে উরসে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে পীরের সাক্ষাৎ লাভে তিনি আবেগ-দগ্ধ হন ও তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। হৃদয়ের গভীরে আনন্দঅশ্রæ বয়ে গেলো, ভক্তবৃন্দকে গান শুনানোর তাগিদ অনুভব করলেন। সেই থেকে তার গানের সুরে নতুন নাচন লাগলো; মরমি গানের স্রোতে নিজেকে অবগাহনে সিক্ত করেন। হয়ে ওঠেন মাইজভাণ্ডারী ধারার গানের প্রাণভোমরা। তিনি প্রতি বছর উরসে ভক্তদের গান শুনান। নিজে পরিণত হন এ উরসের অবিচ্ছেদ্য রূপে।
রমেশ শীল লিখেন-

‘(ভাণ্ডারী)- রসিক, রতন, আড় নয়নে দৃষ্টি করে হরিয়া নিল মন।
যারে চায় নয়ন কোণে তার মনে কি মানা মানে,
চুম্বকে যেন লোহা টানে, তার প্রেমের আকর্ষণ\
যারে চায় এক নজরে, অম্নি ঘরের বাহির করে,
এক পলকে দেখায় তারে বেহেশ্তের রোশন\
যারে চায় দয়া করি তার কি আর দুনিয়াদারী,
চায়না ফিরি নারী বাড়ী রাজ্য সিংহাসন\
দীনহীন রমেশ বলে, মাইজভাণ্ডারীর চরণ তলে,
ইহকালে পরকালে ভরসা দুই চরণ\’

কবি রমেশ শীল এ গানের মাধ্যমে যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন তাকে সুফি তত্ত্বে ফানাফিল্লাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আমিত্ব বিসর্জনের মাধ্যমে স্রষ্টা, সৃষ্টি ও পীর-ফকিরের সাথে একীভূত হয়ে যাওয়া। তখন মানুষের মধ্যে লোভ, কাম, ক্রোধ, মোহ, মাৎসন্যায় এসব লোপ পায়। যারা তা পারেন তারাই মুক্তির স্বাদ পায়। বুদ্ধ দর্শনে যেমন বির্বাণ বা মুক্তি লাভের কথা বলা হয়েছে। এ পযায়ে পৌঁছুতে পারলে মানুষের মধ্যে রাজ সিংহাসনের প্রতি আসক্তিও লোপ পায়।

এভাবে রমেশ শীল অসংখ্য মাইজভাণ্ডারী ও মরমি গান রচনা করেছেন। তার আর কয়েকটি গান যদি উদ্ধৃত করি তাহলে সে বিষয়ে আমরা আরো স্পষ্ট ধারণা পাবো।

‘চলরে মন মাইজভাণ্ডার খেলতে প্রেমের খেলা।
মাইজভাণ্ডারী বাবা আমার নূরের পোতুলা\’ …
বা
‘ওরে পরাণের বন্ধুরে নিশি যোগে আমার বাড়ী যাইও।
(বন্ধুরে) জ্বালাইয়া মোমের বাতি,
জেগে থাকবো সারা রাত্রি,
আশা দিয়া জলে না ভাসাইও।’
বা
‘ফরাজী মাইজভাণ্ডার চল একবার, প্রেম দরবার।
তোমার হিংসা নিন্দা ছুটে যাবে ঘুচে যাবে অন্ধকার।’

তিনি তার মাইজভাণ্ডারী গানে যে বাণী প্রচার করেছেন তা মানবতার, সমন্ব^য়বাদের, মানুষে মানুষে মহামিলনের এবং প্রেমের। প্রেমধর্মই হচ্ছে মুক্তির প্রকৃত সাকিন, যথার্থ ঠিকানা। মানুষকে মানুষ হিসেবেই গড়ে ওঠতে হবে, আর এর মধ্যেই রয়েছে সকল আনন্দ ভৈরবী। তিনি বলেন :

‘মুখে কি হয় মানুষ পরিচয়। দয়া শূন্য যে হৃদয়।
রুহু ইন্ছান হলে মানুষ কয়,
রুহু হাইওয়ানী মানুষ রূপে সেত পশু হয়,
রুহু রহমানি দুর্লভ জানি আসল মানুষ তারে কয়’…

কিংবা
যখন বলেন,
‘ধর্ম কিসের বাড়াবাড়ি (মোর ভাইকে কইও)
এই ধর্ম সেই ধর্ম বড়, বৃথা কেন দ্ব›দ্ব কর,
এক ধর্ম রয়েছে জগৎ ধরি,
রাজা প্রজা সবের ভিতরে, একভাবে নড়ে চড়ে
তারে চিনতে সাধুতা ফকিরী\’

কিংবা

‘মিমের পর্দা উঠাইলে দেখবি ওরে মন।
রাম রহিম কৃষ্ণ করিম মূলেতে একজন\
আহাম্মদে আহাদ পাওয়া আহম্মদে আহাদ হওয়া,
মনসুরে আনল হক কওয়া সেই কথার কারণ\’

এভাবে ভাণ্ডারী গানকে তিনি পৌঁছে দেন মানুষের হৃদয় কন্দরে। এখানেই শেষ নয়। তার দর্শন ও চিন্তার ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত ও গভীর ছিলো তা অসংখ্য জনপ্রিয় গান থেকে একটির উদাহরণ টানলেই বুঝা যাবে।

‘ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা ইস্কুল খুইলাছে’,

এই গানটির অন্তর্গত ভাব বিশ্লেষণ করলে আমার ক্ষুদ্র চিন্তায় যা ধরা দেয় তা হচ্ছে, মাইজভাণ্ডারী তরিকার যে দর্শন তা তিনি এভাবে প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে গানে রূপায়িত করেছেন। তার এ স্কুল হচ্ছে, উছুলে ছাবয়া, আত্মশুদ্ধি ও সপ্তকর্ম পদ্ধতির। এ স্কুলের সবক নেয়ার জন্য, নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য মানুষকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।

রমেশ শীলের ভাণ্ডারী গান রচনা ও গাওয়ার আগে থেকেই সেখানে তালযন্ত্রের ব্যবহার ছিলো। ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো উরসের সময় ও সেমা মাহফিলে। সে বাদ্যের সুরে প্রাণ সঞ্চার করেন, মানুষকে সুন্দরের পথে আহ্বানের ভাষা শৈলী তৈরি করেন কবিয়াল রমেশ শীল। মাইজভাণ্ডারী বাজনা ও গানের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রচার প্রসারে তার ভূমিকা ধ্রæব তারার মতো সত্য ও উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার শিল্পবোধ, শব্দের ব্যবহার ও ঔজ্বল্য দীপ শিখার মতো উদ্ভাসিত। তার এ গান ও দর্শন আরো গবেষণার দাবি রাখে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়