ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ

আগের সংবাদ

পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অযাচিত হস্তক্ষেপে

পরের সংবাদ

প্রতিকারহীন মৃত্যুর মিছিল!

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** সড়কে ১১ মাসে মৃত্যু ৫ হাজার ** আর্থিক ক্ষতি জিডিপির ২ শতাংশ ** ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই **

দেব দুলাল মিত্র : সড়ক মানেই মৃত্যুর হাতছানি, ওত পেতে থাকা যমদূত। পথচারী থেকে যানবাহনের আরোহী- সড়কের পাশে নিজ ঘরে বা দোকানেও রেহাই নেই। যে কোনো মুহূর্তে হানা দিতে পারে যন্ত্রদানব। তারপরই সব শেষ। সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল। শতচেষ্টা করেও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন একটি দিনও নেই যেদিন দেশের কোথাও না কোথাও একাধিক সড়ক দুর্ঘটনা বা প্রাণহানি হচ্ছে না। মৃত্যুর পাশাপাশি হাজারো মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। অনেক পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন, মহাসড়ক উন্নয়ন, সড়কে লেনের সংখ্যা বাড়ানো, সাধারণ মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়েতে পরিণত করার পরও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর চেয়েও বড় কথা সড়ক দুর্ঘটনায় এত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও এসবের কোনো প্রতিকার মিলছে না। না ভুক্তভোগী পাচ্ছেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ; না দায়ী ব্যক্তি পাচ্ছে শাস্তি। এ কারণেই সড়কে প্রতিকারহীন মৃত্যুর মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। গত নভেম্বরে সারাদেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪১৩ জনের।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশের সড়ক যোগাযোগ খাতের উন্নতি করা হয়েছে। কিন্তু এখনো এর সুফল মিলছে না। মূলত সড়ক পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে দেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত ও ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হন। এর আগে ২০১৭ সালে ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত হয়েছেন। চলতি বছরের গত ১১ মাসে নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন নানা বয়সী মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। হতাহতের এই মিছিল কোনোভাবেই থামছে না। এক সময় সড়কে বাস ও ট্রাকের কারণে

দুর্ঘটনা বেশি ঘটত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সব সড়কেই মোটরসাইকেল নতুন দানবে পরিণত হয়েছে। গত নভেম্বরে সারাদেশে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন- যা এই মাসের মোট নিহতের ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এছাড়া প্রাইভেট কার দুর্ঘটনাও আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সড়কে দুর্ঘটনার প্রায় ৯০ শতাংশই চালকদের বেপরোয়া গতি এবং ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটে থাকে। প্রায়ই দেখা যায় লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও হেলপাররা গাড়ি চালাচ্ছেন। এতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ঘটনার সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ওই ট্রাকের হেলপার। বর্তমান আইনে দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ডের কোনো তোয়াক্কা চালকরা করছেন না। যদিও এই আইনে এরই মধ্যে কয়েকজনের শাস্তি হয়েছে।
কীভাবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব, এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, সড়ক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন একত্রে বসেছে, আলোচনা হয়েছে। তারা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে যানবাহন চালকরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
নিরাপদ সড়কের জন্য জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সরকারের কাছে ১১১টি সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশে সড়কের সব সমস্যা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে এবং সমাধানের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলেই সড়ক দুর্ঘটনা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু বিগত কয়েক বছরেও এই ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন করা হয়নি। এভাবে সুপারিশ জমা হয়, কিন্তু এগুলো আমলে নিয়ে বাস্তবায়ন না করার কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, মহাসড়কে রোড ডিভাইডার ও সার্ভিস রোড নির্মাণে সরকার ব্যবস্থা নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। ১১১টি সুপারিশ তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এই সুপারিশগুলো সড়কে বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর কার্যকরী উপায়। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তা আমাদের জিডিপির ২ শতাংশের কাছাকাছি।
সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অনেক সুপারিশ করা হয়েছে। দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানো, সবার জন্য ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ ও সার্ভিস লেন তৈরি করা, সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা এবং সর্বোপরি ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগ সুপারিশই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এছাড়া ত্রæটিপূর্ণ যানবাহন চালানো, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও উদাসীনতার কারণেই বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক পরিবহন নতুন আইন ও পুরনো আইন বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করছি না। আইন বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলেও মনে হয় না। এ কারণেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না, দুর্ঘটনাও কমছে না। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকার পরও চালকরা সতর্ক হচ্ছেন না। শুনেছি এখন এই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আইন শিথিল করা হলে চালকদের বেপরোয়া আচরণ এখন যেমন আছে, তেমনই থাকবে। জাতি আইনের সুফল পাবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়