দেয়াল চাপায় শিশুর মৃত্যু : কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিস

আগের সংবাদ

বিজয়ী বিদ্রোহীদের ভাগ্যে কী আছে : সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা সাময়িক বহিষ্কার > ১৯ নভেম্বর আ.লীগের সভায় আসতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত

পরের সংবাদ

তৃণমূলের রাজনীতি : বিএনপি (সিলেট বিভাগ) > নেতার চেয়ে গ্রুপ বেশি কমিটি দিয়েও স্বস্তি নেই

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : বিগত দিনে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে নতুন করে ঘর গোছাতে চায় বিএনপি। আগামী দিনে দলকে সু-সংগঠিত রাখার পাশাপাশি আন্দোলন ও নির্বাচন পরিচালনায় যোগ্য নেতাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চায় দলের নীতিনির্ধারকরা। সেই মোতাবেক বিভেদ-কোন্দলে ধুঁকতে থাকা সিলেট বিএনপির নেতারাও তৃণমূলে নতুন যোগ্য নেতৃত্বের খোঁজে এখন পুরোদমে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
সিলেট বিভাগের বিএনপির একটি মহানগর এবং ৪টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। তিন বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ওই দিন বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি আবদুল কাইয়ূম জালালী পংকীকে আহ্বায়ক ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি অনুমোদন দেন দলের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়াও সিলেট জেলা সদরে রয়েছে আহ্বায়ক কমিটি। সুনামগঞ্জে পূর্ণাঙ্গ

কমিটি রয়েছে। এই জেলার উপজেলা, থানা ও পৌর ইউনিটগুলোর পুনর্গঠন শুরু হয়েছে। মৌলভীবাজারে পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং ইউনিট কমিটিগুলো গোছানো প্রায় শেষ। হবিগঞ্জে আহ্বায়ক কমিটি এবং ইউনিট কমিটিগুলোর কাজ চলছে। মহানগরের আওতাধীন ২৭টি ওয়ার্ড কমিটির সবগুলোই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন ভোরের কাগজকে বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশ মতো গুরুত্ব দিয়ে দল গোছানোর চেষ্টা করছি। আমার বিভাগের দুটি জেলায় আহ্বায়ক এবং দুটি জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। বেশির ভাগ উপজেলার ওয়ার্ড কমিটিগুলোও গোছানো শেষ। এখন সম্মেলনের অপেক্ষা। উপজেলা কমিটিগুলো শেষ হলেই ধারাবাহিকভাবে জেলা কমিটি নিয়ে কাজ করব।
সিলেট বিভাগে তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন্দল সব রাজনৈতিক দলেই থাকে। বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখানে পদ-পদবির প্রতিযোগিতা থাকবে- এটা স্বাভাবিক। তবে কোথাও দ্ব›দ্ব প্রকট হয়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নিয়ে বসি। আলোচনা করি। সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি। তবে কোনো গ্রুপিং বা কোন্দলকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না।
বিভাগের বিএনপির সাংগঠনিক টিমের নেতারা জানান, নতুন করে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মিসভা করছে মহানগর বিএনপি। এরপর গঠন করে দেয়া হবে আহ্বায়ক কমিটি। আহ্বায়ক কমিটিকে সম্মেলনের জন্য বেঁধে দেয়া হবে সময়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্মেলনের মাধ্যমে আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কর্মিসভা করে সেখান থেকে নেতাকর্মীদের আন্দোলন কর্মসূচির দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকী জানান, কেন্দ্র থেকে এটা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এই সরকারের অধীনে দল নির্বাচনে যাবে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে রাজপথে শক্ত আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। এজন্য রাজপথে শক্তি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য ওয়ার্ড কমিটিগুলোতে ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। নানা কারণে প্ল্যাটফর্ম না পেয়ে যারা এখন ঘরবন্দি, তাদের কমিটিতে এনে সক্রিয় করা হবে। এতে দল ও নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবে।
নেতার চেয়ে গ্রুপিং বেশি : একটা সময় এম সাইফুর রহমান ছিলেন সিলেট বিএনপির একক নেতা। এরপর ইলিয়াস আলীর উত্থান হলে দুই ধারায় সক্রিয় ছিল সিলেট বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। সাইফুর রহমানের মৃত্যু ও ইলিয়াস আলী ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর দল আর ঐক্যবদ্ধ হয়নি। উল্টো বলয় বেড়েছে, বলয়ের ভেতরে তৈরি হয়েছে উপবলয়ে অন্তঃ¯্রােত। ফলে দ্ব›দ্ব ও রেষারেষি বেড়েছে।
স্থানীয় নেতারা জানান, এখন দলের বড় একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কমিটির বেশির ভাগ নেতা তার বলয়ের। সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর বলয়ে থাকা বেশ কয়েকজন নেতা মুক্তাদিরের পেছনে আছেন। এর বাইরে প্রয়াত সাইফুর রহমানের অনুসারীদের নেতৃত্বে আছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলীর অনুসারীরা মূলত সদ্য পদত্যাগকারী কেন্দ্রীয় বিএনপির সহস্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামানের নেতৃত্বে সংগঠিত আছেন।
এ তিন বলয়ের বাইরে কয়েকটি উপবলয় দলের ভেতরে নানাভাবে সক্রিয় আছে বলে জানান বিএনপির নেতারা। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম, মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহরিয়ার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুজ্জামান সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী ও সহসভাপতি ফরহাদ চৌধুরী শামীম- এসব উপবলয়ের নেতৃত্বে আছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয়ভাবে দলে চলমান অসন্তোষের একটা বড় কারণ, বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটিতে মুক্তাদিরের অনুসারীদের বেশি ঠাঁই পাওয়া। গত কয়েক বছরে এই মেরুকরণ স্পষ্ট হয়েছে। তাতে অন্য গ্রুপগুলোর নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
জেলা কমিটি নিয়ে অসন্তুষ্টি : মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি কামরুল হুদা জায়গীরদারকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন মাসের মধ্যে তাদের সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তারা তা করেননি। গত বছরের ৩ মার্চ জেলার আহ্বায়ক কমিটির নয়জন সদস্য সংবাদ সম্মেলন করে আহ্বায়কের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনেন। একইভাবে বিভিন্ন শাখা কমিটির নেতৃত্বে থাকা ও বাদ পড়া নেতাদের একটি অংশও আহ্বায়কের বিরুদ্ধে সরব হন। কামরুল হুদা জায়গীরদার বলেন, কমিটি গঠনে কোনো স্বেচ্ছাচারিতা ছিল না। কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। তবে দলকে এগিয়ে নিতে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন।
নতুন কমিটি অনুমোদনে ‘সতর্কবার্তা’! : গত বছরের শেষের দিকে সিলেট জেলা বিএনপির আওতাধীন ১৩ উপজেলা ও ৫ পৌরসভার সাংগঠনিক কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেন জেলার আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার। এরপর ঘোষিত কমিটিগুলো প্রত্যাখ্যান করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নয়জন সদস্য। কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা আহ্বায়কের অপসারণও দাবি করেন।
নেতাদের অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে জেলা কমিটির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার আপন খেয়াল খুশিমতো কমিটি করায় তৃণমূল নেতাদের তোপের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি নিরাপত্তাহীনবোধ করে নিজের পদ থেকে অব্যাহতি চান। পরে কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা কমিটিকে ও উপজেলা কমিটিকে আর কোনো কমিটি করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। পরে বিএনপির সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন দফায় দফায় বৈঠক করেন দলের কেন্দ্রীয় সিলেটি নেতা ও জেলার আহ্বায়ক কমিটির সঙ্গে। পরে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাখাওয়াত হাসান জীবনসহ সব বিষয়ে নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারসম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা ছাড়া নতুন কোনো কমিটি অনুমোদন করতে পারবে না সিলেট জেলা, উপজেলা ও পৌর বিএনপি।
পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ডেকে শাখাওয়াত হাসান জীবন জানিয়ে দেন জেলার আওতাধীন কমিটি দেয়ার এখতিয়ার সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়কের। তবে তৃণমূল্যের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামত নিয়ে কমিটি অনুমোদন দিলে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক আসত না। ইউনিট কমিটি দেয়ার এখতিয়ার জেলা আহ্বায়কের রয়েছে। তবে কমিটিগুলোতে বাদ পড়াদের নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যে কারণে ইউনিট কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়তে কমতে পারে। তবে আপাতত ইউনিট কমিটিগুলোর নেতারা কর্মসূচিতে নিজের পদবি ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু কোনো ধরনের কমিটি দেয়ার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
পদত্যাগের হিড়িক : কমিটি গঠন নিয়ে অসন্তোষ থেকে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রায় ৩০০ নেতা পদত্যাগ করেছেন। ছাত্রদল, যুবদলের কমিটি নিয়েও চলছে অসন্তোষ। আছে তিন বছর ধরে বিএনপির জেলা ও মহানগর কমিটি না হওয়ার ক্ষোভ। এই অবস্থায় স্থানীয় বিএনপিতে গ্রহণযোগ্য একক নেতৃত্বের অনুপস্থিতির বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। সেখান থেকে মুখরোচক আলোচনা সিলেট বিএনপিতে এখন ‘যত নেতা তত গ্রুপ’। স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন জেলা ও মহানগর কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে বিএনপির সহস্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামান গত ১৮ আগস্ট দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। সামসুজ্জামানের ঘোষণার পর তার অনুসারী বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের প্রায় ৩০০ পদধারী নেতা কয়েক দিনের ব্যবধানে পদত্যাগ করেন।
জানতে চাইলে সামসুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন দলের আদর্শিক কর্মীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ছাত্রদল ও যুবদলের যোগ্য নেতাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। তিনি বলেন, দলের স্বার্থে আমরা যেসব কথা বলছি, তা শোনা হচ্ছে না। এই দলের পেছনে আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। অথচ আমিই অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়