সম্প্রীতির জমিনে শকুনের চোখ

আগের সংবাদ

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান এখন ‘মেটা’

পরের সংবাদ

বোরহানউদ্দিনে হামলাকারীদের চেনে না কেউ, গা-ছাড়া প্রশাসন : সাম্প্রদায়িক হামলা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ধর্মীয় অবমাননার গুজব রটিয়ে বারবারই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। বাংলাদেশে গত এক যুগে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই-এক বছর পরপরই এমন গুজব রটিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। এ রকম জঘন্য ঘটনা শুরু হয় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের রামুতে। এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া, ২০১৬ সালে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৯ সালে ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ব্যাপক আকারে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুর্গোৎসবের সময়ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইনে ধর্মীয় অবমাননার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধানের উল্লেখ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
সেবিকা দেবনাথ (ঢাকা) ও এইচ এম নাহিদ (বোরহানউদ্দিন, ভোলা) : রংপুরের গঙ্গাচড়া ঠাকুরপাড়ায় হামলার দুই বছরের মাথায় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায় ভোলায়। জেলার বোরহানউদ্দিনে ২০১৯ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনায় প্রাণ দিতে হয় চারজনকে। আহতদের তালিকাও ছিল দীর্ঘ। সেই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও ভোলায় ঘটে যায় তেমনি আরেকটি ঘটনা। এবার ইসলাম অবমাননার অভিযোগ ওঠে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক ও জেলার পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি গৌরাঙ্গ চন্দ্র দের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার ব্যাপকতা তেমন না হলেও গৌরাঙ্গ চন্দ্র দের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালীন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার আঁচ সেখানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ছিলেন স্থানীয়রা। তবে এলাকার সংসদ সদস্যর তৎপরতায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা থেকে রেহাই মিললেও যে কোনো সময় হামলে পড়তে পারে সাম্প্রদায়িকতার দানব- সেই শঙ্কায় আছেন স্থানীয় সংখ্যালঘুরা।
যা ঘটেছিল : ঘটনার সূত্রপাত ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর। ভোলার বোরহানউদ্দিনের বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভ নামের এক তরুণ

ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে আল্লাহ ও মহানবীকে (সা.) নিয়ে কু-রুচিপূর্ণ কথোপকথনের বক্তব্য স্ক্রিনসর্টের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপরই ১৯ অক্টোবর বোরহানউদ্দিন উপজেলায় দফায় দফায় স্থানীয় উত্তেজিত জনতা বিপ্লব চন্দ্রের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করে। যদিও এই ঘটনায় বিপ্লব চন্দ্রসহ আরো দুজনকে পুলিশ আটক করে। উত্তেজিত জনতা ২০ অক্টোবর পুলিশ অনুমতি দেয়ার আগেই মাইকিং করে স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে লোকজন জড়ো করে। পরিস্থিতি খারাপ ভেবে পুলিশ বাটামারা পীর সাহেব মাওলানা ম. মহিবুল্লাহকে অনুরোধ করেন সমাবেশ না করার জন্য। একপর্যায়ে পুলিশ মাওলানা মহিবুল্লাহকে তুলে নিয়ে গেলেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সংবদ্ধ একটি চক্র তৌহিদি জনতার ব্যানারে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা করে। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে। এতে বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ (৪৫), বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর ছেলে মাহবুব পাটওয়ারী (১৪), মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪০) ও বোরহানউদ্দিনের মো. শাহিন নামের চারজন নিহত ও ১০ পুলিশ সদস্যসহ ৫ থেকে ৬০০ জন আহত হন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সংঘবদ্ধ দুস্কৃতকারী একটি দল ভাওয়াল বাড়ির ৮টি বাড়িতে ভাঙচুর ও ২টি বাড়িতে আগুন দেয়। শ্রী শ্রী গৌর নিতাই মন্দিরে হামলা চালায় ও প্রতীমা ভাঙচুর করে।
এই ঘটনার পর, শুভর ফেইসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের সত্যতা মেলে। এই ঘটনার মূল আসামি কিশোরগঞ্জের বাপন দাস নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। বাপন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত তার ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।
মামলা ও আসামির সংখ্যা : শ্রী শ্রী গৌর নিতাই মন্দিরের সভাপতি সত্য প্রসাদ দাস ২২ অক্টোবর মঙ্গলবার বোরহানউদ্দিন থানায় অজ্ঞাত ৪ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মোট ৩টি মামলা হয়েছে।
হামলার নেতৃত্বে যাদের নাম : এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় সব আসামিই অজ্ঞাত। আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলছেন হামলা চালাতে দেখলেও হামলাকারীদের তারা কেউ চেনেন না। তাছাড়া সিসি ক্যামেরার সুবিধা না থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এদিকে এলাকাবাসীর কেউ কেউ বলছেন, যারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাদের অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চান না। তবে সরকার চাইলে দোষীদের শনাক্ত করা সম্ভব।
রবীন্দ্রপল্লীর ভাওয়াল বাড়ির মন্দিরের সভাপতি এবং সহিংস ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার ২য় বাদী রাজিব চন্দ্র দে ভোরের কাগজকে বলেন, ঘটনার দিন আমি ছিলাম রাজশাহী। যারা ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন তারা কাউকে চিনতে পারেননি। তবে সরকার চাইলে সবই সম্ভব। বর্তমানে গ্রামের পরিবেশ ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আমরা ভালোই আছি। তবে যে কোনো সময় আবারো যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে এ আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করছি।
মামলার বর্তমান অবস্থা : ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বোরহানউদ্দিন সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ম. রাশেদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, তখনকার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি ও মন্দির কমিটির সভাপতি ১টি মোটসহ ৩টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো এখনো তদন্তনাধীন আছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য : সেদিনের ঘটনায় সংঘবদ্ধ চক্রটি তুলসী গাছ আর দেব-দেবতার ছবি দেখে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করেছে বলে জানান ভুক্তভোগী পরিবারের সদ্য প্রভা রানী দাস (৬২)। তিনি বলেন, ’৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার পর বোরহানউদ্দিনে আর কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়নি। ২০১৯ সালে আবার হলো। দুই বছর পরও সেদিনের নাশকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে যান আভা রাণী। তিনি বলেন, কী হয়ে গেল তা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ কয়েকশ লোক ভরদুপুরে মহল্লায় আসে। মন্দির ভাঙচুর করে। ঠাকুরের প্রতিমাসহ সব জিনিস ভাঙতে থাকে।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গৌরাঙ্গ জেলে : চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেও ভোলায় ফেইসবুকে ইসলাম অবমানা করে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে সহিংস ঘটনা ঘটে। ভোলা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি গৌরাঙ্গ চন্দ্র দের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠে। গৌরাঙ্গ দের ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে এবং ‘জয়রাম’ নামে আরেকটি ভুয়া আইডি খুলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন পোস্ট দেয়া হয়। এই ঘটনায় ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে গৌরাঙ্গ দের বাড়িতে হামলা, ককটেল ফাটানো, গাড়ি ভাঙচুর করে কিছু দুষ্কৃতকারী। এ প্রসঙ্গে ভোলা সদর থানার ওসি এনায়েত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, গৌরাঙ্গ দে-কে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তরা করা হয়েছে। তার মামলাটি এখন সাইবার ক্রাইম বিভাগে তদন্তাধীন আছে।
এলাকাবাসীরা বলছেন, স্থানীয় রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক গৌরাঙ্গ দে। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। তবে তারা কেউই ভয়ে মুখ খুলতে চান না।
বিশিষ্ট্য ব্যক্তিদের বক্তব্য : জেলা পূজা উৎযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসীম চন্দ্র সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভোলায় তথাকথিত ধর্মঅবমাননার দোহাই দিয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার একটির জন্যও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দায়ী নয়। অথচ এই অজুহাতে বারবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। তার কোনো বিচার আমরা পাইনি, শুধু তথাকথিত তদন্তের বেড়াজালে মৌলবাদী অপরাধীরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। আইনের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। দেশে আইন আছে। শুধু আমাদের জন্য আইনের প্রয়োগ হয় না।
জেলা মুসলিম ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোবাশ্বের উল হক নাঈম বলেন, ইসলাম কখনোই প্রতিহিংসায় বিশ্বাসী নয়, ইসলাম শান্তি ও গোটা মানবজাতির মুক্তির কথা বলে, যদি কখনো সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা হয়ে থাকে তার দায় কোনো মুসলমান নেবে না। কারণ মুসলমানরা এই কাজ করতে পারে না। যদি কোনো দুষ্কৃতকারী গোষ্ঠী মুসলমান সেজে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তা প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে। যদি একটি ঘটনার বিচার হতো তাহলে কেউ ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করার সাহস দেখাতে পারত না।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার সার্বজনীন পূজা উৎযাপন কমিটির সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ চন্দ্র দে ভোরের কাগজকে বলেন, এখন পরিবেশ শান্ত। সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে এলাকায় থমথমে অবস্থা ছিল। এলাকাবাসী আতঙ্কিত ছিল। পরিস্থিতি যাতে খারাপ না হয় সে জন্য সংসদ সদস্য আলি আজম মুকুল ত্বরিত উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নির্বাহী কর্মকর্তার সভাকক্ষে আলেম-ওলামা এবং আমাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। ফলে এলাকার পরিবেশ শান্ত। গৌরাঙ্গ দের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বলেন, ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়