শুভ জন্মদিন > বিমল গুহ : ভালোবাসার কাব্যবীক্ষণ

আগের সংবাদ

বাস্তুচ্যুতদের ৮০ শতাংশই নারী : জলবায়ু পরিবর্তন

পরের সংবাদ

সম্প্রীতির জমিনে শকুনের চোখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ৬:৩১ অপরাহ্ণ

আমি ধর্মকে ব্যক্তির পবিত্র সম্পদ বিবেচনা করি, কিন্তু এই সম্পদকে ব্যক্তি ও সমাজের দুষ্ট উপাদান করা হলে ধর্মভ্রষ্টতার অভিযোগ যেমন বর্তায়, তেমনি মনুষ্যত্বহীনতারও কারণ ঘটে। অতএব কে মসজিদে যায়, কে মন্দিরে যায়, কে প্যাগাডা বা চার্চে যায়- তা না দেখে আমরা যেন মানুষ হই, আমরা যেন সভ্য হই, আমরা যেন বাঙালি হই। আমরা যেন আত্মঘাতী না হই।
এই বাংলায় সব ধর্ম, সব বর্ণ ও গোত্রের মানুষের বন্ধন কয়েক শতাব্দীর। বাঙালির যা কিছু মহৎ, যা কিছু বৃহৎ, তার সবটাই এই সম্প্রীতির অর্জন। তবে লজ্জার কিছু দৃষ্টান্তও যে নেই- বলা যাবে না। অতি সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা ঘিরে একশ্রেণির ধর্মান্ধ যে কলংক স্থাপন করেছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় ধর্মীয় উন্মাদনা মানুষকে কতটা যুক্তিশূন্য, বিবেকশূন্য করতে পারে। বলা বাহুল্য, এই উন্মাদনা বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি ও জাতীয় অহংকারের বহুবিধ অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আঘাত করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক এই আগ্রাসনটি নিশ্চিতভাবেই ছিল সুপরিকল্পিত, যা ঘটানো হয়েছে আফগানিস্তানের সাম্প্রদায়িক তালেবানি পুনরুত্থানের পর।
এই জনপদে হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান একত্রে বসবাস করেছে। এই বঙ্গের সৌহার্দ্যরে শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত। এশিয়ার আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম বাঙালি জাতি। প্রতিটি ধর্মের মানুষ এই অঞ্চলে চিরকাল সম্প্রীতিতে বসবাস করেছে, গড়ে তুলেছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সভ্যতা। পার হয়েছে শশাঙ্ক, পাল, সেন, সুলতান, মোগল, বারো ভূইয়া, নবাবের আমল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমলে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাচার করেছে স্বাধীনভাবে। মুসলমান সুফী সাধকদের আধ্যাত্মিকতা গণমানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মসজিদের আযান, মন্দিরের কীর্তন, গির্জার ঘণ্টা ও প্যাগোডার প্রার্থনা চলেছে নির্বিবাদে। মানব প্রেমের বার্তা বয়েছে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেসিক শাসক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদরা রোপণ করেছে বিভক্তির বিষ। ফলে মানুষ বিভাজিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে বাঙালি জনগোষ্ঠী নিপীড়িত হতে থাকে। ক্রমে গড়ে ওঠে জনবিদ্রোহ, সামনে এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘটে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। লাখো শহীদের রক্তে পূর্ব পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়।
সাধারণ মানুষ কখনোই ধর্ম সংঘাত তৈরি করেনি, করেছে স্বার্থান্বেষীরা- এদের কেউ ধর্ম ব্যবসা করে, কেউ আবার অন্যের হয়ে ভাড়া খাটে কিংবা কেউ নিছক ধর্মান্ধতায় ভোগে। পাকিস্তানি শাসকরা ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির পরীক্ষিত শত্রæ। কিন্তু এরপরও আমাদের ভাষা আন্দোলন হয়েছে, বাঙালির সম্মিলিত শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেনা ও ধর্ম শাসিত পাকিস্তান ভেঙেছে। কিন্তু সে অর্জন স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। দুটি সামরিক শাসন, সংবিধানে পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী, ইত্যাদি সংখ্যালঘুকে নতুন করে আতঙ্কে নিপতিত করেছে। একাত্তর পাল্টে সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক চেতনা সমাজকে গ্রাস করেছে। অতএব সংকটের স্বরূপ অনুধাবন করতে হবে, আমাদের আত্মানুসন্ধান করতে হবে। কারণ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তির টানা ১৩ বছর রাষ্ট্র শাসনের পরও সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি আবারো আঘাত হেনেছে।
সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মগজে দুষ্ট ক্ষত যা ব্যক্তিকে অসুস্থ করে, কলংকিত করে। এই ব্যাধি একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত করে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় পবিত্রতা। অতএব একে প্রতিহত করতে হবে সর্বশক্তিতে। এই মুক্তি কেবল সরকার একা দিতে পারে না, এর দায় সকলের; তাই এগিয়ে আসতে হবে সকল সচেতন মানুষকে। এ করতে ব্যর্থ হলে লুটেরা, লুম্ফেন সত্য ও সুন্দরকে গ্রাস করবে, বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত্তিকে যারা দুর্বল করতে চায় তারা কেবল রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়, তারা সভ্যতা ও মনুষত্বের প্রতিপক্ষ।
রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটলে সমাজ বিপন্ন হয়, ধর্মচর্চাও কলুষিত হয়। এ প্রবণতা সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা বিঘিœত করে, মানুষের সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিপন্ন করে। কাজেই এর থেকে নিস্তার পাওয়া জরুরি। কিন্তু এতসব উদ্বেগের পরও ধর্মীয় রাজনীতির কালো থাবা থেকে ভারত উপমহাদেশ মুক্ত হতে পারেনি! বরং ক্রমান্বয়ে এর ব্যাপকতা বেড়ে চলেছে। সে কারণে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করা একটি অপরিহার্য মানবিক দায়িত্ব।
মানুষের ও ধর্মের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই যে কোনো রাষ্ট্রকে পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে, তা না হলে নাগরিক অধিকারের তারতম্য ঘটবে। এতে কেবল গণতন্ত্র বা বহুত্ববাদ বিপন্ন হয় না, বিপন্ন হয় মনুষত্বও। অতএব রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ রুখতে হবে। অতএব প্রগতিশীল মানুষদের সাহসী ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমেছে। ১৯৪১ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল ২৮.০ শতাংশ। ১৯৪৭ এর দেশভাগ এবং ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাদের জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেছে। ফলে তাদের হার ২৮ থেকে ২২ শতাংশে নেমে আসে। অন্যদিকে হাজার হাজার মুসলমান আসে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে। সেদিনকার মুসলিম লীগের চরম হিন্দু বিদ্বেষ এবং একই সাথে ভারত বিদ্বেষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করেছে। ফলে চলেছে সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ। এমন পরিস্থিতি কোনো সুস্থ, বিবেচক মানুষের কাম্য হতে পারে না। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীর সম্পত্তি ‘শত্রæ সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানি এই কালাকানুন চিরকালের জন্য এদেশের হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষকে নির্যাতনের শিকার করে রেখেছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আজ নতুন করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আক্রান্ত হচ্ছে, দেখতে হচ্ছে তাদের নীরব দেশত্যাগ! এ আমাদের সভ্যতার লজ্জা। এ প্রলয়কে রুখতে হবে। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র হোক যেখানে সব ধর্মবর্ণের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করবে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ পূর্ণ মর্যাদা ও নিরাপত্তায় তাদের ধর্ম পালন করার অধিকার রাখবে। অন্যথায় সব অর্জন ব্যর্থ হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়