সম্প্রীতির জমিনে শকুনের চোখ

আগের সংবাদ

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান এখন ‘মেটা’

পরের সংবাদ

বাস্তুচ্যুতদের ৮০ শতাংশই নারী : জলবায়ু পরিবর্তন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** ছয় বছরে বাস্তুহারা ৫৭ লাখ ** উপকূলীয় নারীদের গর্ভপাতের ঝুঁকি ১ দশমিক ৩ গুণ **
ঝর্ণা মনি : জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে রয়েছে প্রথম স্থানে। ভূ-গর্ভস্তর থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বাপার (বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন) গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ ফুটেরও বেশি নিচে নেমে গেছে। গত ৫০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে ৫২০টি নদী। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের সম্মুখীন হন নারীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই নারী। জলবায়ু, খাদ্য উৎপাদন এবং নারী তিনটিই একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ছয় বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। ঢাকার বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্থানান্তরিত বলে জানিয়েছে অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিপর্যয়ের ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা প্রভৃতি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। খরা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরা। তাদের ঘরে-বাইরে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।
বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে জেলা ১৯টি, উপজেলা রয়েছে উপজেলা ১৪৭টি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ। এর মধ্যে ৪৯ শতাংশ নারী। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জীবন-জীবিকা, কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ¡াসের আঘাত নিয়মিত ঘটনা। গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে

নি¤œাঞ্চল নিমজ্জ্বিত ও লবণাক্ত পানি বাড়ছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগতসহ জীবন-জীবিকাজনিত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, বিশেষ করে নারীরা এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বেশি। বাধ্য হয়ে এ জনপদের মানুষ তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পেশার পরিবর্তন করছে, কর্মসংস্থানের খোঁজে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে। ফলে নারীদের কর্মসংস্থানহীনতা বেড়েছে, পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা ও পেশার ধরন।
জার্মান ওয়াচ গেøাবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২১) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি। ঝুঁকি ও ক্ষতিগ্রস্তের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তথ্যমতে, উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা জীবন-জীবিকা, পরিবার, সন্তান, গবাদিপশু, দৈনন্দিন খাদ্য, পানি, জ¦ালানি ও পশুখাদ্য সংগ্রহ, বৃক্ষরোপণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেন। এছাড়া তারা কৃষি কাজ, চিংড়ি মাছের পোনা ধরা ও মাছের ঘেরে কাজ, বনায়নের মতো অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারের শিশু, গবাদিপশু, গৃহস্থালি বিষয়াদির দেখাশোনার কারণে পুরুষরা বিকল্প পেশায় নিয়োজিত হলেও নারীরা অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হতে পারেন না। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয় বেশি। পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি, জ¦ালানির সংকটে পড়ে নারী। এসব সংগ্রহে তাকে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হয়। অন্যদিকে জীবিকার তাগিদে অনেক নারীই চিংড়ি পোনা ধরে বিক্রি করেন। দিনে ৮-১০ ঘণ্টা নদীতে ঠাণ্ডা লোনা পানিতে দাঁড়িয়ে পোনা ধরার ফলে হৃদরোগসহ অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন। আবার অনেকেই নিম্ন মজুরির বিনিময়ে চিংড়ি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের উপযুক্ত পোশাকের অভাবে কেমিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব যেমন- মাথাঘোরা, চর্মরোগ, হাত ও পায়ের নখ ভাঙা, হৃদপিণ্ডের অসুখসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় পড়তে হয়। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। গবেষণা বলছে, উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যান্য নারীদের তুলনায় ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি থাকে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, এ নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। শরীরের জন্য প্রয়োজন মিঠা পানি। লবণাক্ত পানি সোডিয়াম বাড়ায়। উচ্চরক্তচাপ বাড়ায়। বিপাকক্রিয়া ব্যাহত করে। কিডনি-লিভারের ওপর প্রভাব ফেলে। চর্মরোগ বাড়ে।
এদিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতি এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালে ন্যাপ (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা) রোড ম্যাপ চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নারী ও শিশুর সামাজিক সুরক্ষাকরণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ২০০৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। যা ২০০৯ সালে হালনাগাদ করা হয় এবং তার পাশাপাশি ন্যাপ নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দেশের চাহিদাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এবং ন্যাপ জাতীয় দলিল তৈরির পথে ক্রম অগ্রসরমান। যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ ২০২২ সালের আগেই ন্যাপ জাতীয় দলিল সম্পূর্ণ করতে আশাবাদী। এছাড়া ইউএনডিপির সহায়তায় বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ‘জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা’ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে। দেশটি ‘রেডিনেস এন্ড প্রিপারেটরি প্রোগ্রাম’ কর্মসূচিতে সহায়তার জন্য ২ দশমিক ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিলের অনুমোদন পেয়েছে। যেখানে অভিযোজনকে সুসংহত করার জন্য সহ-সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
নারী ও শিশুবান্ধব জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন মন্তব্য করে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশের (এনসিসিবি) রিসার্স এন্ড এডভোকেসি এসোসিয়েট প্রতীতি কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নারী-শিশুরা বেশি অবহেলিত। এক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমাদের একটি টেকসই অভিযোজন পরিকল্পনা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক গবেষণারও কোনো বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়