জাসদের পাল্টা প্রশ্ন : ১৫ আগস্ট সেলিম মার্কিন দূতাবাসে কী করছিলেন

আগের সংবাদ

কারা এই আইএস-কে? আফগানিস্তানে সক্রিয় নৃশংসতম জঙ্গিগোষ্ঠীর কাবুলে হামলার দায় স্বীকার

পরের সংবাদ

চার কারণে বাড়ছে বজ্রপাত ১০ জেলা ঝুঁকিতে : হাওর অঞ্চলে মৃত্যু বেশি; ৭৪ শতাংশই কৃষক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : ২৩ আগস্ট দিনাজপুর সদর উপজেলার ৮ নম্বর উপশহরে এক সঙ্গে চার কিশোর এবং চিরিরবন্দর উপজেলায় একসঙ্গে তিন যুবক বজ্রপাতে মারা গেছে। ৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের পদ্মা নদীতে বরযাত্রীবাহী নৌকায় বজ্রপাতে মারা যান ১৭ জন। গত কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা প্রায়ই উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে দুই দিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছরই বর্তমান সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু বজ্রপাতে প্রতি বছর কত মানুষের মৃত্যু হয় তার সঠিক তথ্য নেই কোথাও।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সীমিত গবেষণার আলোকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বজ্রপাত প্রবণ যে কয়েকটি দেশ আছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বজ্রপাত বাড়ার পেছনে চারটি কারণ এবং বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে ১০টি এলাকাকে চিহ্নিত করেছেন তারা। তথ্য বলছে, বজ্রপাতে মৃতদের ৭৪ শতাংশই কৃষক।
চার কারণ : প্রথমত; মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের আদ্রতা বেড়ে যাওয়া, দ্বিতীয়ত; হিমালয়ের পাদদেশে হাওর অঞ্চলগুলোতে উষ্ণতা ও পুঞ্জীভূত মেঘের আধিক্য, তৃতীয়ত; কিউমুলোনিম্বাস মেঘ বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ এবং চতুর্থত; পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়লে বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে যায় ১০ থেকে ১২ বর্গকিলোমিটার।
ঝুঁকিপূর্ণ ১০ জেলা : ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইয়ারলি এভারেজ লাইটেনিং ডেনসিটি ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাৎসরিক প্রতি বর্গকিলোমিটারে বজ্রপাতের প্রবণতার হার ১৫ দশমিক ৪৫। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি জেলায় কম-বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। তবে শহরের তুলানায় গ্রামাঞ্চলে এবং হাওর এলাকায় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ১০ জেলায় বজ্রপাতের ঘটনা এবং মৃত্যু বেশি হয়। জেলাগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট,

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রাম।
পরিসংখ্যান কী বলছে : দুর্যোগব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং কৃষি তথ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৬ হাজার ৭৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে গত ৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৭৮ জন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ২৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে।
হাওর অঞ্চলে কেন বেশি হয় : তথ্য বলছে, বজ্রপাত হওয়ার ডেনসিটি গ্রামাঞ্চলেই বেশি। কারণ শহর এলাকায় উঁচু বিল্ডিং, টাওয়ারে বজ্র নিরোধ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়- যার কারণে মৃত্যুহার শহরে প্রায় শূন্য। আর ২০১৫ থেকে ২০২০ এই ৫ বছরে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্চ থেকে বজ্রপাত শুরু হয়। অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। তবে মে, জুন, জুলাই এই তিন মাসে বেশি বজ্রপাত ও এতে মৃত্যু হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর মে মাস।
এ প্রসঙ্গে সামাজিক সংগঠন ‘সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের কাগজকে বলেন, একটা সময় দেশে প্রচুর সংখ্যক বড় বড় গাছ ছিল। যেমন তাল, সুপারি, নারকেল। আর এখন মাঠের পর মাঠ কোনো বড় গাছ দেখা যায় না। আমরা গাছ কেটে ফেলেছি। হাওর অঞ্চলের বিশাল ভূমিতে বজ্রপাতের সময় কৃষকরা আশ্রয় নেয়ার কোনো জায়গা পায় না।
বজ্রপাত রোধে তালগাছ কতটা কার্যকর : চলতি বছরের ১৪ জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটির উদ্যোগে ‘বজ্রপাত ও করণীয়’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে জানানো হয়, থাইল্যান্ডে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। সেখানকার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভিয়েতনামে মোবাইল টাওয়ারের আর্থিং সিস্টেমের মাধ্যমে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইডিইবি রিসার্চ ও টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো মো. মনির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু তালগাছ না দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগাতে হবে। তাহলেই সেটা বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারবে।
বজ্রপাতের উপকারিতাও আছে : ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বজ্রপাত নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করছেন মুনির আহমেদ। মুনির আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, সব বজ্রপাতে মানুষ মারা যায় না। আর সার্বিক পরিবেশের জন্য বজ্রপাত উপকারী। বজ্রপাত হলে মাটিতে নাইট্রোজেনের সংযুক্তি হয়। যা ভূমির উর্বরতা বাড়ায়। এছাড়া বজ্রপাত হলে মাছ ডিম পাড়ে।
উপকারে আসছে না পূর্বাভাস : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত হওয়ার কমপক্ষে ২০ মিনিট আগে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। আবহাওয়া অধিদপ্তর এই কাজটি করে থাকে। তবে অধিদপ্তর বর্তমানে যেভাবে পূর্বাভাস দেয় তা খুব একটা কার্যকর নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পেতে হলে রাডারের সঙ্গে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির উন্নয়ন করা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে মুনির আহমেদ বলেন, মেঘের অবস্থান ও ধরন দেখে আগে থেকেই বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। তবে যখন এই পূর্বাভাস দেয়া হয় তখন হয়তো কৃষকরা মাঠে ও জেলেরা নদীতে থাকে। ফলে আগাম পূর্বাভাস কাজে আসে না।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাওসার পারভিন ভোরের কাগজকে বলেন, অধিদপ্তর থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কোন কোন এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে তা জানানো হয়।
করণীয় কী :
দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বজ্রপাত সেলকে আরো আধুনিকায়ন করায় বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও নিহত ব্যক্তিদের তালিকা নির্ভুল প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে কাওসার পারভিন জানান, বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ২০০৭ সাল থেকে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এ প্রসঙ্গে মো. মনির হোসেন বলেন, বজ্রপাতের সময় মাঠে কর্মরত কৃষকদের সুরক্ষার জন্য দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে খুব কম খরচে ‘লাইটনিং প্রটেকশন জোন’ তৈরি করেও অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।
বজ্রপাতে আহতরা চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হন বলে উল্লেখ করেন মুনির আহমেদ। বজ্রপাতে আহতদের বাঁচাতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা দেয়ার পাশাপাশি সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়