শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি : চলতি সপ্তাহেই শতভাগ শিক্ষক টিকার আওতায়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

সাক্ষাৎকার : কাজী ফিরোজ রশীদ > বঙ্গবন্ধু বললেন, ষড়যন্ত্র হচ্ছে তোরা সাবধানে থাকিস

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : তুখোড় রাজনীতিবিদ কাজী ফিরোজ রশীদ। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা। ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ¯েœহভাজন। ছাত্রলীগের হয়ে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজ ছাত্রসংসদের তিনবার নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। ছিলেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। পরে জাতীয় পার্টির হয়ে এইচ এম এরশাদের পার্লামেন্টে দুবার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। এখন তিনি জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান। দলটির হয়েই দশম ও বর্তমানে একাদশ জাতীয় সংসদে ঢাকা-৬ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি-ওয়ারী ও গেণ্ডারিয়া) আসনের সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফিরোজ রশীদের শেষ সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে। ওইদিন শেখ মনির সঙ্গে রাত সোয়া ১১টায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় প্রবেশ করেন। সাক্ষাৎ করেন। বের হয়ে আসেন সোয়া ১২টায়। ওই সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন, এখন তোরা যা, কাল দেখা হবে। ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তোরা সাবধানে থাকিস। কিন্তু সেই কাল আর এলো না। পরদিন ঘটল ইতিহাসের নির্মমতম ট্র্যাজেডি। শোকের মাস আগস্ট নিয়ে ভোরের কাগজের কাছে বিশেষ সাক্ষাৎকারে সে সময়ের নানা বিষয় নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ফিরোজ রশীদ।
কোন প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী ফিরোজ

রশীদ বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র, এটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। এটি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি, জাতির পিতা, আমাদের চেতনা-প্রেরণা, গর্ব-অহঙ্কার, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তার গোটা পরিবার শহীদ হয়ে গেল। শিশু রাসেলও রক্ষা পেল না। এটাতো দুঃস্বপ্নেরও বহির্ভূত ঘটনা। যিনি সারাজীবন স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, বাঙালির স্বার্থে কোনো দিন আপস করেননি, এদেশের স্বাধীনতা এনেছেন- যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে সাজিয়ে গুছিয়ে সোনার বাংলায় রূপান্তরের আরেকটি সংগ্রাম করছিলেন। সেই দেশে তার মতো মানুষকে সপরিবারে হত্যা করার কোনো প্রেক্ষাপট হতে পারে না। প্রশ্ন আসে তাহলে কেনো এই ন্যক্কারজনক ঘটনা? আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বঙ্গবন্ধু এভাবে হারিয়ে যাবেন। মনে হয়েছিল মধ্য গগণ থেকে উজ্জ্বল সূর্যটা হঠাৎ হারিয়ে গেল, আমরা নিকশ কালো অন্ধকারে ডুবে গেলাম।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ঘাতক চক্র কী অর্জন করতে চেয়েছিল- উত্তরে এক সময়ের তুখোড় এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো অর্থেই ‘অর্জন’ শব্দটাকে মেলাতে চাই না। ‘অর্জন’ একটি ইতিবাচক শব্দ। বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল? প্রথমত তারা একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। দ্বিতীয়ত তারা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে মারতে পারলেই বুঝি দেশ তাদের করায়ত্ব হবে। আর আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য সফল হবে অর্থাৎ বাংলাদেশ তাদের করতলগত হবে। কিছু সময়ের জন্য হলেও সেখানে ঘাতকরা সফল হয়েছে। যদিও ইতিহাস তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করেছে।
এই হত্যার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের স্বরূপ, নেপথ্যের খলনায়কদের বিচারের মুখোমুখি না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল। তা না হলে দেশের অভ্যন্তরের গুটিকয়েকট বিপথগামী সৈনিকের পক্ষে এহেন নিকৃষ্ট দুঃসাহস দেখানোর কথা ভাবাই যেত না। তারা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ষড়যন্ত্রের ধাপগুলো সাজাতে পেরেছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর বিশাল বুকজুড়ে ছিল মানুষের প্রতি অফুরন্ত বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকেই ষড়যন্ত্রকারীরা বড় পুঁজি করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বের দুটি বৃহৎ শক্তি বিরোধিতা করেছিল। তারাও তো পরাজিত হয়েছিল। সেই পরাজয়ের গøানি নিয়ে তারা চুপ করে বসে থাকবে- এমনটি ভেবে রাখা সঠিক ছিল না। সেইসঙ্গে দেশীয় পরাজিত শক্তি, তার সঙ্গে আবার বিশ্বাসঘাতকদের দল মিলেমিশে একটা নিখুঁত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে পেরেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের খলনায়কদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। বিচারের আওতায় সবসময় নেপথ্যের নায়কদের আনাও সম্ভব হয় না। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের কীভাবে বিচার করা হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা হয়েছে বিচারের পথে বলবৎ থাকা সাংবিধানিক বাধা সাংবিধানিকভাবে অপসারণের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বিচার বহির্ভূতভাবেও- যেমন ‘ক্রসফায়ার’, ‘হার্ট অ্যাটাক’ ইত্যাদি উদ্ভাবিত দুষ্টের দমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে বিচারব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল- তার সর্বোচ্চ উদাহারণ সৃষ্টি করে আদালতের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করিয়েছেন। শাস্তি কার্যকর দেখেছেন। আমি মনে করি, এটা শেখ হাসিনার জীবনের একটি বড় অর্জন। কোনো বিচার যখন আদালতে গড়ায় তখন আইনের চলার গতিতে মান্য করতে হয়। প্রমাণ উপস্থাপনের ব্যর্থতায় হয়ত বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। তবে এই হত্যার বিচার হয়েছে এটাই খুনিদের চূড়ান্ত পরাজয়। আর যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল- তা চিরতরে নস্যাৎ হয়ে গেছে- এটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের চিরকালের শাস্তি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শোনার পর নিজের প্রতিক্রিয়া স্মরণ করে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল আমার আত্মার সম্পর্ক। আমার রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ-দর্শন গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধুকে যখন হারালাম তখন আমার অবস্থা হয়েছিল মণিহারা ফণির মতো দিশাহারা পরিস্থিতি। তার একান্ত সান্নিধ্যে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তার নির্দেশে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। জীবন তখন তুচ্ছ- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করায়ই তখন শ্রেষ্ঠতম তপস্যা। প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর মুখদর্শন চাই-ই চাই। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে যখন পাক হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, ওই দিন রাতেও আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ৩২ নং ধানমন্ডির বাসাতে গিয়েছিলাম। ওই সময়েও তিনি চূড়ান্ত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে আবার বঙ্গবন্ধুর কোলেই ফিরে গিয়েছিলাম। জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য- সেই কোলে আর বেশি দিন থাকতে পারলাম না। গোটা দেশকেই মনে হতো বঙ্গবন্ধুর বুক আর এদেশের মাটি তার কোল। জীবনের ব্রত ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশকে সাজাতে তার নির্দেশ পালন করে যাব। তিনি আরো বলেন, ১৫ আগস্ট ঢাকা ভার্সিটিতে বঙ্গবন্ধুর যাবার কথা ছিল। আমরা তার আগমণের সব প্রস্তুতি সেড়ে ১৪ আগস্ট রাত সোয়া ১১টায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। ওই রাতেই আমার সঙ্গে তার শেষ কথা ছিল- এখন তোরা যা, কাল দেখা হবে। সেই কাল আর এলো না। নেমে এলো এক ভয়াল কাল রাত্রি। চিরতরে হারিয়ে গেল আমার চেতনার প্রাণ-প্রদীপ, প্রাণের প্রেরণার সব উৎস। তাকে হারানোর সংবাদ শোনার পর মনে হয়েছে হঠাৎ উজ্জ্বল আকাশ থেকে জ্বলন্ত সূর্যটা উধাও হয়ে গেছে। গোটা দুনিয়ায় নেমে এসেছে অন্ধকার। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। সব উত্তাপ নিঃশ্বেষ পানির জগৎ কঠিন বরফে পরিণত হয়ে গেছে। হিম শিতলে আমিও পাথর হয়ে গেছি।
ওইদিন নিজের ভূমিকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ফিরোজ বলেন, কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতি, সমাজ, সংসার সবকিছু অসাড় মনে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশকে ভাবতেই পারছিলাম না। বলতে গেলে সবকিছুতে একেবারে খামোশ হয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে এভাবে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোক কখনই ভোলার নয়। তারপর আবার ভেবেছি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণের। সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছেগুলো পূরণে যদি একটু অবদান রাখতে পারি তাহলে হয়ত তার আত্মাকে কিছু শান্তি দিতে পারব। তাই দীর্ঘদিন রাজনীতিতে বিরতি দেবার পর আরেকজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক পল্লিবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দেখতে পেয়েছিলাম। তার হাতে হাত মিলিয়ে ব্রতি হয়েছিলাম নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে। সেখানে সফল হয়েছি। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া দেশ আজ শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে অভূতপূর্ব সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে- এটাকেই বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকে সান্ত¡না হিসেবে নিয়ে আগামীতে আরো সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দিন গুনছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়