শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি : চলতি সপ্তাহেই শতভাগ শিক্ষক টিকার আওতায়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

শিক্ষকদের প্রণোদনার টাকা কেউ পেলেন, কেউ পাননি : জটিলতা নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ মাউশি সচিবের

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া টাকা ঈদুল ফিতরের আগে গত মে মাসে ছাড় করা হলেও এখন পর্যন্ত নন এমপিও দেড় লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর সবাই তা পাননি। তবে কোনো কোনো শিক্ষক টাকা পেয়েছেন। টাকা ছাড়ের চার মাস পেরিয়ে গেলেও না পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনুদান না পাওয়া শিক্ষকরা। তারা দ্রুত অনুদানের টাকা শিক্ষকদের মাঝে বিতরণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের তালিকাভুক্ত ইআইএনধারী (শিক্ষা বোর্ডের বৈধ প্রতিষ্ঠান শনাক্তকরণ নম্বর) নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশাল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে ডাটাবেজ তৈরি করে ব্যানবেইস। এরপর তা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। তারপরও কেন শিক্ষকদের তথ্যে অসঙ্গতির প্রশ্ন উঠবে? এই অসঙ্গতির কারণে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন পেলে আরেকজন প্রণোদনার টাকা এখনো পাননি। এতে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, সব শিক্ষকের তথ্য ঠিক না থাকায় টাকা পাঠানো যাচ্ছে না। যাদের তথ্য ঠিক আছে তাদের টাকা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ টাকা পাঠানো হচ্ছে। তথ্য সংশোধনের পর দ্রুত এ টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও কিছুদিন আগে সংসদে একই কথা জানিয়েছিলেন। শিক্ষকরা বলেছেন, ২০২০ সালেও প্রধানমন্ত্রী নন এমপিও শিক্ষকদের জন্য অনুদান দিয়েছিলেন এবং শিক্ষকরা তা পেয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছর এসে পুরো বিষয়টিতে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
জানতে চাইলে নন এমিপও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার ভোরের কাগজকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া টাকা ছাড় হলেও দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ নন এমপিও শিক্ষকও সেই প্রণোদনা পাননি। কেন পাননি-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে

গিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট শাখায় পুরো বিষয়টি জানতে চাইলে ওই শাখায় কর্মরত উপসচিব জানান, শিক্ষকদের মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র এক না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা পাঠাতে পারছে না। গত বছর যেভাবে পাঠিয়েছিলেন সেইভাবে পাঠানো যায় কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই উপসচিব এই শিক্ষক নেতাকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই ঠিকঠাকমতো কাজ না করায় শিক্ষকদের ভোগান্তি বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (মাউশি) সচিব মাহবুব হোসেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, জটিলতা নিরসন করে শিক্ষকদের কাছে টাকা পাঠাতে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি। আসলে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়েরও দোষ নয়। মাঠপর্যায় থেকে নন এমপিও শিক্ষকদের যে তালিকা এসেছে তাতে মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরে মিল নেই। অর্থাৎ শিক্ষকরা যে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন তাতে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাচ্ছে অন্যজনের। আর এ কারণে বহু শিক্ষককে টাকা পাঠাতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। তবু আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করছি শিগগিরই জটিলতার নিরসন হবে।
নন এমপিও শিক্ষকদের মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, বহু শিক্ষকের মোবাইল ফোন নম্বর নেই, ব্যাংক হিসাব নম্বর নেই। প্রণোদনার টাকা আসবে শুনে কোনো কোনো শিক্ষক তার আত্মীয়ের নামে থাকা মোবাইল নম্বর দিয়েছেন সঙ্গে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছেন। এতেই হয়তো মিলছে না। শিক্ষকদের জন্য বিষয়টি শিথিল করে দেখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন এই শিক্ষক নেতা।
ঢাকার কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্ বলেছেন, ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের দ্বিতীয় দফার প্রণোদনার টাকা অনেকেই পাননি। তাদের এই প্রাপ্য না পাওয়ার কারণ সম্পর্কেও তারা তেমন কিছুই জানেন না। কোনো যুক্তিযুক্ত কারণে যদি তাদের টাকা দেয়া না হয়ে থাকে বা দেয়া সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে সেটির ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। টাকা পাওয়ার জন্য তাদের কোনো কিছু করণীয় আছে কিনা তাও পরিষ্কার বলে দেয়া উচিত। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এই অনুদানের টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের বিলম্বে পৌঁছে দেয়া হলে কেউ লাভবান হচ্ছে কিনা তাও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। সরকার টাকা দেয়ার পরেও সেই টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের হাতে না যাওয়ায় সমালোচিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা দেয়া হয়েছিল। তখন টাকা না পাওয়ার এত অভিযোগ ছিল না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা দিতে গিয়ে যদি সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে আবারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর মোবাইল সিমের নাম, আইডি কার্ডের নাম ও প্রতিষ্ঠানের/ সনদের নাম গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। জন্মনিবন্ধন অফিস ও নির্বাচন কমিশন অফিস বন্ধ থাকায় বা নিয়মিত খোলা না থাকায় এই গরমিল সারানো এখন অসম্ভব হচ্ছে বা বিলম্ব হচ্ছে। তাই প্রথম দফার মতো এবারও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা দেয়াই উত্তম সমাধান হবে বলে আমি মনে করি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সংকটের কথা চিন্তা করে কারিগরি, মাদ্রাসা ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোর ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের এককালীন আর্থিক সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগের বছরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ হাজার ৯২৯টি কওমি মাদ্রাসার এতিম ও দুস্থদের জন্য ১৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন ননএমপিও ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষক ও ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারীকে ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় করোনাকালে বিপর্যস্ত ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের আগে প্রণোদনার টাকা বরাদ্দ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষকদের ৫ হাজার টাকা ও কর্মচারীদের ২ হাজার ৫০০ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। নানান জটিলতা কাটিয়ে প্রণোদনার সেই টাকা গত জুলাই মাসে সে টাকা বিতরণ শুরু হয়। শিক্ষক কর্মচারীদের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে সে টাকা পাঠানো হচ্ছে। তবে, ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ অনুদানের টাকা পেয়েছেন আবার কেউ পাননি। একই প্রতিষ্ঠানের একই স্তরের একইসঙ্গে কর্মরতদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।
শিক্ষকরা বলেছেন, গত বছর প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেকের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিতরণ করা হয়েছিল। সেসময় তালিকাভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সহজেই টাকা পেয়েছিলেন। তবে এবার কোনো শিক্ষক টাকা পাচ্ছেন আবারা অনেকে পাচ্ছেন না। একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছয় জন ননএমপিও শিক্ষকের মধ্যে চার জন টাকা পেয়েছেন, দুজন পাননি। কর্মচারী চার জনের মধ্যে দুজন পেয়েছেন, দুজন পাননি।
খুলনার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মোড়ল বলেন, ঈদুল ফিতরের আগে কিছুসংখ্যক শিক্ষক অনুদানের টাকা পেয়েছেন। আমাদের কলেজে ননএমপিও শিক্ষক ২৫ জন। সেখানে ৬ থেকে ৭ জন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা পেয়েছেন। বাকি কেউ আজ পর্যন্ত টাকা পাননি। শুধু আমার কলেজে নয়, সারাদেশে অনেক কলেজ আছে যেখানে একজন শিক্ষক কর্মচারীও টাকা পাননি। গত বছর আমাদের অনুদানের টাকা চেকের মাধ্যমে দিয়েছিল, তখন সবাই পেয়েছিল। এবার দিচ্ছেন না। শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলছেন বিষয়টি দেখছি, দেখব। তিনি আরো বলেন, করোনা মহামারিতে বেশির ভাগ কলেজ বেতন বন্ধ রেখেছে। এ অনুদানের টাকা পেলে শিক্ষকরা কিছুটা স্বস্তি পেতেন।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বোয়ালিয়া মুক্তিযোদ্ধা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের ননএমপিও শিক্ষক মুরাদ হোসেন বলেন, তার কলেজের ডিগ্রি স্তরের শিক্ষকদের ছয় জনের মধ্যে চার জন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা পেয়েছেন অথচ দুইজন এখনো পাননি। প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের তথ্য সঠিক আছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। একই উপজেলার ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান কলেজের অফিস সহকারী বিলকিস রুখসানা বলেন, এখনো পর্যন্ত তার কলেজের কোনো শিক্ষক কর্মচারী প্রণোদনার টাকা পাননি।
শিক্ষকরা বলেছেন, ব্যানবেইস মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের তালিকাভুক্ত ইআইএনধারী (শিক্ষা বোর্ডের বৈধ প্রতিষ্ঠান শনাক্তকরণ নম্বর) ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশালসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে ডাটাবেজ তৈরি করে। এরপর তা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। সেই তালিকার ভিত্তিতে গত বছরও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ননএমপিও শিক্ষক কর্মচারীদের বিশেষ অনুদানের টাকা ডিসি ও ইউএনওদের তত্ত্বাবধানে চেকের মাধ্যমে শিক্ষক কর্মচারীদের টাকা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার মোবাইল ব্যাংকিং হওয়ায় অনেকেই তা পাননি এখনো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়