ডিএনসিসি মেয়র আতিক : ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন করতে পারছি না

আগের সংবাদ

বেহাল রেলের মেগা প্রকল্প : খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না

পরের সংবাদ

মুজিব টেকস ওভার

প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরাধীন ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তানের কালো অধ্যায় পেরিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই মহান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো নানা ঘটনা, যার কারিগর হিসেবে কেউ আখ্যায়িত হয়েছেন নায়কের অভিধায়; কেউবা আবির্ভূত হয়েছেন খলনায়কের চরিত্রে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সেসব ঘটনা ও তার নায়ক-খলনায়কদের কার কি ভূমিকা, তাই নিয়েই অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গ্রন্থ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’। সম্প্রতি ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বইটি। এ বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন কিছু অংশ তুলে ধরা হচ্ছে ভোরের কাগজের পাঠকদের জন্য।
১৫ মার্চ শিরোনামটি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপনীয় নথি (২০৫২০) থেকে নেয়া। বলা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেছেন। প্রাদেশিক পরিষদে তার দলের সদস্য সংখ্যা ৩০০ জনের ভেতরে ২৮৮ এবং জাতীয় পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। শেখ মুজিব ও তার দল ক্রমাগতভাবে সামরিক ফরমান অগ্রাহ্য করে চলেছেন। কিন্তু সামরিক জান্তা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
এক্ষেত্রে দুটি মূল সমস্যা ছিল।
ক. বঙ্গবন্ধু কৌশলে অসহযোগ ও অহিংস কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রচলিত রীতি।
খ. পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে যে বিদ্রোহ দেখা দেবে তা দীর্ঘকাল দখল রাখার সক্ষমতা তাদের ছিল না।
এই সময়ের মধ্যেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল অঙ্গ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং সংসদ তিনটিই তার করায়ত্ব। বিচার বিভাগ অচল হয়ে পড়েছিল। কোর্ট-কাচারি বন্ধ। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত জেনারেল টিক্কা খান ৭ই মার্চ এসে তাকে শপথ দেয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি এ বি সিদ্দিকিকে অনুরোধ জানালে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ প্রত্যহ ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে প্রদত্ত নির্দেশ পালন করতেন। সংসদ সদস্যগণ অধিকাংশই স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে ৭ই মার্চে প্রদত্ত নির্দেশ বাস্তবায়নে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। অস্ত্রের দোকান ও বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি ও থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।
এই অবস্থায় ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে ঢাকার

পথে রওনা দেন। তার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ও তার নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনি ৩৫টি নির্দেশনা জারি করেন। অফিস, আদালত, কোট-কাচারি কীভাবে চলবে, প্রশাসন যন্ত্র কীভাবে চলবে? তারও দিকনির্দেশনা দেন। সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি ব্যাংক-বিমা, শ্রমিক-সংস্থা, আইনজীবী, বেতার-টিভি সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর আদেশে-নির্দেশে চলতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাপর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু যে ৩৫টি নির্দেশ দিয়েছিলেন তার সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে।
পাশাপাশি সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫ নম্বর সামরিক আইন জারি করেন। তাজউদ্দীন আহমদ এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এইসব সামরিক ফরমান মানি না। আমরা আমাদের মতো চলবো।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার হুকুম মত দেশ চলবে।’
১৫ই মার্চ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টকে ‘অতিথি’ হিসাবে উল্লেখ করে তার কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তার যেন কোন অপমান না হয়।’
প্রেসিডেন্ট ভবন রক্ষা থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত রাজপথে দেয়া ব্যারিকেটগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে ‘অতিথি’ বলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করলেন তিনি একটি নতুন রাষ্ট্রে পদার্পণ করেছেন। যে নবরাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। যার ‘পতাকা’ নির্ধারিত এবং দেশটির জাতীয় সঙ্গীতও বিদ্যমান। সর্বোপরি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগণ এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বাধিনায়ক ও রাষ্ট্রপতি পদে ৩রা মার্চ বরণ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে আরো আলাপ-আলোচনার জন্যে ঢাকা এলেন। সেদিন ‘টাইম’ সাময়িকী নিউইয়র্ক থেকে লেখে, ‘আসন্ন বিভক্তির (পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণতকরণ) পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। গত সপ্তাহে ঢাকায় শেখ মুজিব ‘টাইম’ এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে বলেন, বর্তমান পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনো আশা নেই। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা বলেন এবং জানান যে, তার অনুগামীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর দিতে অস্বীকার করেছে, যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। মনে হচ্ছে, তিনি তাঁর ভাষায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের এই নেতা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তাদেরকে পঙ্গু করে দেব এবং তাদেরকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করব। এ ধরনের একটি বিবৃতির পর সোজাসুজি স্বাধীনতা ঘোষণা আর অতি নাটকীয় কিছু নয়।’
১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ পতাকাবাহী গাড়িতে করে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন। প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মুহম্মদ ইসহাক খান তাকে রিসিভ করেন এবং তাকে পেছনের বারান্দায় নিয়ে যান, যেখানে ইয়াহিয়া বেতের সোফাতে বসে ছিলেন। তাদের সাথে বসার জন্য জেনারেল পীরজাদাকে ডাকা হয়। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্য শুরু করলেন, ‘আমি আপনার সাথে কাজ করতে বসেছি। এ প্রদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। আমি আপনার সহযোগিতা চাই। আমি চাই, আপনি যেন জাতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন।’ মুজিব সন্তোষজনকভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন, ‘অন্যখানে কথা বলা উচিত হবে।’ তিনি সন্দেহ করেন তার কথাগুলো রেকর্ড হচ্ছিল।
প্রেসিডেন্ট পীরজাদার দিকে তাকালেন এবং পীরজাদা মুজিবকে ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কি হলো?’ মুজিব ইঙ্গিত করে বললেন, উনি অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলতে চান। তারা উপরে ইয়াহিয়ার বেডরুমে কথা বলেন। মুজিব ৭ মার্চের উল্লেখিত ৪ দফা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে যোগ দেয়ার আগে এ শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট তাকে জানালেন যে, চার দফার মধ্যে ইতোমধ্যে দুটি পূরণ করা হয়েছে। সেনা সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১ এবং ২ মার্চে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্দোষ নাগরিকদের হত্যার অভিযোগ তদন্তের জন্য আদেশ দেয়া হয়েছিল। অন্য দুটি শর্ত সম্পর্কে জেনারেল ইয়াহিয়া বুঝালেন যে, ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির মাধ্যমে সামরিক আইন তুলে ফেলা এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।
তদন্ত কমিটির গঠন নিয়ে মুজিবের আপত্তি ছিল। কারণ তার মতে, এ কমিটিতে আওয়ামী লীগের একজন সদস্য রাখা উচিত ছিল। তিনি তদন্ত কমিটির বিবরণ প্রত্যাখ্যান করেন। আর তিনি বাকি দুই দফার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। তিনি বলেন যে, ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি শুরুর আগে এ দুই দফাও বাস্তবায়ন করতে হবে। ইয়াহিয়া জবাব দিলেন, ‘নীতিগতভাবে সামরিক আইন তুলে ফেলা আমার কাজ নয়। বা ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্বও আমার না। তবে শান্তি ফিরিয়ে আনার স্বার্থ আমি এ দুই দফাও বিবেচনা করব অ্যাসেমব্লির আগে। তবে এ নিয়ে কিছু কাজ করতে হবে।’ মুজিব এতে রাজি হলেন।
প্রেসিডেন্ট তারপর বলেন, ‘আমরা একসাথে এ নিয়ে কাজ করব। আমাদের টিম আছে। ওরা এক সাথে বসে বিষয়গুলো ঠিক করুক। আমরা তদারকি করব।’ মুজিব তার টিম পাঠাতে রাজি হলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমরা কনফেডারেশন করি না কেন? তারপরও আমাদের প্রেসিডেন্ট এক, এক পতাকা থাকবে।’
ইয়াহিয়া অবাক হলেন। নিশ্চুপ ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপরও তিনি মেজাজ ঠাণ্ডা রাখলেন। তিনি বলেন, ‘শেখ সাহেব, আমি পাকিস্তান ফেডারেশন সম্বন্ধে কথা বলতে এসেছি। কনফেডারেশন নয়। কোন কোন প্রদেশকে (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান) বেশি স্বাতন্ত্র দেয়ার ব্যাপারে আমরা তো প্রস্তুত আছি।’
বৈঠকটি একঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে চলে এবং বৈঠক শেষে স্থির করা হয় যে, তাদের দুই মধ্যস্থতাকারী দল আলোচনায় বসবে।
প্রেসিডেন্ট পীরজাদাকে নির্দেশ দিলেন যেন ‘কনফেডারেশন’ শব্দটি কোথাও উচ্চারিত না হয়। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে বলল যে, এ আলোচনা ত্রিপাক্ষিক হবে না। এখানে ভুট্টোকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ড. কামাল হোসেন পীরজাদাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, তাদের সব খসড়া শুধুমাত্র তারা ইয়াহিয়ার কাছে পেশ করবেন।
মুজিব চলে যাওয়ার পর ইয়াহিয়া তার সব সহায়তাকারীকে ডাকলেন। বিচারপতি কর্নেলিয়াস ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সামরিক শাসন তুলে ফেলার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। কারণ, সামরিক আইন তুলে ফেলা হলে, একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। কেননা, তখন প্রেসিডেন্টের কোন আইনগত কর্তৃত্ব থাকবে না। তার মতে, প্রক্রিয়াটি এভাবে চালানো উচিত হবে: ১. ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশন ডাকা; ২. অ্যাসেমব্লি সিএমএলএকে সামরিক আইন তুলে ফেলার অনুরোধ জানাবে; ৩. নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।
প্রেসিডেন্ট চেয়েছেন যে কর্নেলিয়াস বাস্তবের মুখোমুখি হন। তিনি তাকে মনে করিয়ে দেন যে, ওই দুই দফা নিয়ে কোন সন্তোষজনক ব্যবস্থা না হলে, আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যাবে না। কর্নেলিয়াস জবাব দিলেন, ‘দেখি কি করা যায়।’

আগামীকাল প্রকাশিত হবে
‘দি বাস্টার্ড ইজ নট বিহেভিং’
‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এ ছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও। 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়