শিগগিরই প্রয়োগ শুরু : আরো ৭ লাখ ৮১ হাজার টিকা এলো জাপান থেকে

আগের সংবাদ

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ ২ : সশস্ত্র আরসা ও আরএসও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। লিফশুলজ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র বিষয়ে তার ‘এন আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে বহু দলিলপত্রভিত্তিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন, লেডিস ক্লাবের তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবে শেখ মুজিব খুন হননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, লেডিস ক্লাবের ঘটনার বহু আগেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুজিব হত্যাকারীরা যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টেফার হিছেন তার গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সম্মতি ছিল। কিন্তু পৈশাচিক ওই হত্যাকাণ্ডের ৩৫ বছর পর হত্যার বিচার হলেও জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দিক উন্মোচিত হয়নি। ফলে বিশ্বের নির্মম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের চিত্রনাট্য কারা লিখেছেন, কারা পট সাজিয়েছেন সেসব জানা সম্ভব হয়নি।
গত ৪৬ বছরে মুজিব হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করেছেন অনেকেই। এসব গবেষণায় দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের দিক উঠে এসেছে। স্ট্যানলি উলপার্ট তার গ্রন্থে মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জড়িত থাকার দলিলপত্রও হাজির করেছেন। ভুট্টো বাংলাদেশের কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তার গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থ

সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং আগস্ট মাস (১৯৭৫) শেষ হওয়ার আগেই তিনি তার বিনিয়োগের ফল লাভ করেন। এ হত্যাকাণ্ডটি মূলত ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি ধারাবাহিকতার সাফল্য। গবেষকদের মতে, মুজিব হত্যাকারী চক্র ১৯৭৪ সালের শরতের মৌসুমে মার্কিন দূতাবাসে এ ব্যাপারে সাহায্য চায় এবং ঘটনার চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে আমেরিকার মনোভাব কি, তা জানতে চায়। মাহবুব আলম চাষী, এ বি এম সফদার ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) গোপন প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সফদার সিআইএর অধীনে বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তিনি সিআইএকে মুজিব হত্যার পরিকল্পনা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।
মোশতাক-জিয়া পরিকল্পনাকারী : অশোক রায়নার ‘ইনসাইড র দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে খালেদা জিয়ার বাড়ির ট্রেস থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্যুয়ের একটি স্ক্রাপ পেপার উদ্ধার করা হয়েছিল। কাগজটি গার্বেজ করা হলেও একজন গুপ্তচর গৃহভৃত্যের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই চিরকুটে জিয়াউর রহমান, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর শাহরিয়ারের নাম ছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ‘র’ এর পরিচালক রামনাথ কাউ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেও বঙ্গবন্ধু সেটাকে যথারীতি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ওরা আমার সন্তানের মতো। কাউ হতাশ হয়ে দিল্লি ফিরে যান। এদিকে ১৯৭৭ সালে ইউরোপের একটি শহরে খুনি লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগ সম্পর্কে লিফশুলজকে বলেন, জিয়াই আমাদের আশ্বস্ত করেছে, আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে এবং অন্য কোনো তরফ থেকেও কোনো বাধা আসবে না। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে লিফশুলজ বলেন, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেন জিয়া। জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া ওই হত্যাকাণ্ড ঘটতই না। জিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কর্নেল রশীদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন এবং রশীদকে সব সময় আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন।
দলের ভেতরেই মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল মন্তব্য করে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, চক্রান্ত করে তাজউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর ডান হাত ভেঙে দিয়েছিল। ফলে আঘাত হানা সহজ হয়। ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল খোন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, মাহবুবুল আলম চাষী। জাসদের বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকে পুঁজি করেছে খুনিরা। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই ষড়যন্ত্রে ছিল।
জল্লাদের ভূমিকায় ফারুক-রশীদ-ডালিম-নূর : যুক্তরাজ্যে গঠিত কমিশনের ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি’ প্রতিবেদনে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়। প্রতিবেদনে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত আরো অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারা হলেন- লে. কর্নেল আজিজ পাশা, মেজর মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মেজর শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিশমত হোসেন, লেফটেন্যান্ট এম খায়রুজ্জামান এবং লেফটেন্যান্ট আবদুল মাজেদ। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক ও রশিদ পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ব্যাংকক চলে যান। ব্যাংককে এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পরিবার এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন কর্নেল ফারুক। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমসে এবং ওই বছরের ২ আগস্ট লন্ডনে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন ফারুক।
হত্যাকাণ্ডের কথা জানত মার্কিন, সৌদি, পাকিস্তান, চীন! : গবেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল। চুয়াত্তরের নভেম্বরে হেনরি কিসিঞ্জার ৮ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিসিঞ্জারের এই সফরের পর থেকে ঢাকার সিআইএ কর্মকর্তা ফিলিপ চেরি বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করত। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ডিসেম্বরে ও পঁচাত্তরের মার্চে জানানো হয়, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ক্যাভালরি ইউনিটের বেশ কিছু অফিসার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু বাঙালির প্রতি ভালোবাসা-আস্থা ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সরবরাহে দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা ও আরেক অংশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা। বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সতর্ক করতে ১২ জুলাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন পংকজ ভট্টাচার্য। সব শুনে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার বুকে অস্ত্র তাক করতে ওদের কি একটুও হাত কাঁপবে না? পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, ষড়যন্ত্র ছিল ঘরে-বাইরে। পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরব এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ যে জড়িত ছিল; বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের আশ্রয় এবং তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণই দিয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের নয়া সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি ইসলামি ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেও অনুরূপ স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানায় এবং মোশতাক সরকারের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ ৫০ হাজার টন চাল এবং দেড় কোটি গজ কাপড় উপহার দিয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের খবর সর্বপ্রথম আমেরিকাই পেয়েছিল। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু চেয়ার, ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মহান একাত্তরে পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসর, আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ জড়িত। দেশি-বিদেশি পরাজিত এই চক্রের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, খন্দকার মোশতাক, আমলা মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কর্নেল ফারুক-রশিদ গংরা যুক্ত হয়ে কিলিং মিশনে অংশ নেয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের এই পরিকল্পনার কথা জানতেন। তিনি খুনিদের মিশনে কোনো বাধা দেননি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়