শিগগিরই প্রয়োগ শুরু : আরো ৭ লাখ ৮১ হাজার টিকা এলো জাপান থেকে

আগের সংবাদ

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ ২ : সশস্ত্র আরসা ও আরএসও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

পরের সংবাদ

চাকরি ও বেতন বাঁচাতে জীবনবাজি রেখে কাজে! পোশাক শিল্পের ৯০ শতাংশ কর্মী হাজির

প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রাজধানীর মালিবাগ নিউ ফয়সাল অ্যাপারেলস নামের একটি কারখানায় তাড়াহুড়ো করে এসেছেন আম্বিয়া (ছদ্মনাম)। বললেন, কাকডাকা ভোরে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন তিনি। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, নাটোর থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ করে গাবতলী এসেছি। সেখান থেকে ৫০০ টাকায় একটি রিকশা ভাড়া করে মালিবাগ এসেছি। ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, রবিবার থেকে কারখানা খোলা, আপনারা চলে আসেন। ভেবেছিলাম ৫ আগস্টের আগে কারখানা খুলবে না। কিন্তু হঠাৎ করে খুলে দিল, আবার গাড়িও ছাড়ল না। এজন্য পথে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। গাড়ির মধ্যে গাদাগাদি করে আসতে গিয়ে মনে হয়েছিল দমটা বের হয়ে যাবে। আর মনে হয় বাঁচব না। তবুও এসেছি, আমি না থাকলে আমার জায়গা আরেকজন দখল নেবে। তখন চাকরিটা থাকবে কী করে?
আম্বিয়ার মতো হাজার হাজার কর্মী ও শ্রমিক কাজে যোগ দিতে বাড়তি ভাড়া, পথে পথে দুর্ভোগ আর ভোগান্তি পেরিয়ে শিল্পকারখানায় উপস্থিত হয়েছেন। গতকাল রবিবার রাজধানী ও রাজধানীর আশপাশে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও

আশুলিয়াসহ শিল্প এলাকার রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো চালু হয়েছে। একদিনের নোটিসে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়ায় শনিবার সকাল থেকেই দীর্ঘ অনিশ্চিত যাত্রা জেনেও কর্মস্থলে ফিরেছেন শ্রমিকরা। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকির চেয়েও চাকরি এবং বেতন ঠিক রাখাই তাদের কাছে বড় বিষয় বলে জানান তারা। কারখানা খুললেও লকডাউন শেষ হওয়ার আগে না এলেও কারো চাকরি যাবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তবে আম্বিয়া বলেন, অনেক ঘোষণাই দেয়া হয়। কিন্তু গার্মেন্টসের ভেতরে যে কী হয়, সেটা শুধু আমরাই জানি।
আরেকটু গোছানোভাবে উদ্যোগগুলো নিলে এমন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না, শ্রমিকদেরও এত ভোগান্তিতে পড়তে হতো না বলে জানালেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে যদি নির্দেশনা দেয়া থাকত, কারখানাগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি শ্রমিক ঢুকতে পারবে না, সেটা মালিকদের শ্রমিক আনতে নিরুৎসাহিত করত। শ্রমিকরাও তখন বাড়িতে থাকতে পারত। তিনি বলেন, একদিকে সরকার নির্দেশনা দিয়েছেন, আবার মালিকরাও সেই নিয়ম ভঙ্গ করে শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে আসতে বাধ্য করেছেন। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, প্রক্রিয়াটা আরেকটু গুছিয়ে করলে চ্যালেঞ্জগুলো কম হতো। শ্রমিকদের অযাচিত কষ্ট এড়ানো যেত। তিনি বলেন, বিজিএমইএর পক্ষ থেকেও যে মেসেজ দেয়া হয়েছে সেটাও শ্রমিকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। আবার মালিকরাও যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি। প্রথমত, এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আরো শক্ত ভূমিকা নেয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে পরিদর্শন করা জরুরি। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি শ্রমিক নিয়ে কারখানাগুলো যেন পরিচালিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্তত পাঁচ তারিখ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, শ্রমিকদের অবশ্যই টিকার আওতায় আনতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সংগঠনের দায়িত্ব হবে শ্রমিকদের যেন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়।
সরজমিন দেখা গেছে, কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের প্রবেশ করানো হচ্ছে। তবে কিছু কিছু কারখানায় ঢিলেঢালাভাব দেখা গেছে। এছাড়া মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলেও অধিকাংশ কারখানায় তাপমাত্রা মাপা ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কারখানা চালু করার পাশাপাশি সংক্রমণ প্রতিরোধে শনিবার রাতেই ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত বছর মার্চে মহামারি প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর এ ধরনের হেলথ প্রটোকল বা নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়েছিল। সকালে রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট, রামপুরা, বাড্ডা, কমলাপুর এলাকায় মারিয়া ফ্যাশন, আরিফ ডিজাইন, নিউ ফয়সাল, রাবেয়া ফ্যাশন, আল মুসলিম গ্রুপ, ড্রেস এন্ড ডিসমেটিক প্রাইভেট লিমিটেড, হার্টি অ্যাপারেলস, এ কে এম রহমতুল্লাহ গার্মেন্টস, আর টেক্স ফ্যাশন, জান কম্পোজিট ইউনিট লিমিটেড (ইউনিট-২), ড্রেস ফাই নেটওয়ার্ক, ইনজেক্ট ফ্যাশন, ওল্যিও ফ্যাশন, সরদার গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ৮টার আগেই দলে দলে কাজে যোগ দিচ্ছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। অনেকে আবার নতুন কাজের জন্য ভিড় করেছেন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হঠাৎ গার্মেন্টস খোলার ঘোষণায় অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে অনেক কষ্ট করে এসেছেন। অনেকে আবার ঢাকাতেই ছিলেন বলে জানান।
মালিবাগে আল মুসলিম কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকদের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা আছে। প্রত্যেক শ্রমিক সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, তাপমাত্রা মেপে, স্যাভলনযুক্ত পানিতে পা ভিজিয়ে কারখানায় ঢুকছেন। সেখানের গেটে থাকা নিরাপত্তাকর্মী জানান, কিছুক্ষণ পরপরই তারা জীবাণুনাশক পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কারখানার আশপাশে এবং প্রত্যেক শ্রমিক যেন নিয়ম মেনে কারখানায় ঢুকে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। এ সময় কারখানায় ঢুকতে যাওয়া একজন নারী শ্রমিক সকিনা বলেন, আমি গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র এসেছি। প্রথম দিনের হাজিরা নিশ্চিত করতে কারখানায় চলে আসলাম। কমলাপুরের সরদার গার্মেন্টসে দেখা যায়, প্রবেশ পথে পানির নল বসিয়ে ডিটারজেন্টের মিশ্রণ দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারখানায় প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে তাপমাত্রা মাপার মেশিন। এখানে নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, প্রথমদিনে কারখানার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কর্মী চলে এসেছেন। প্রথম দিনে উৎপাদন শুরু না করে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সারবেন তারা। বিকাল ৩টার মধ্যেই কারখানা ছুটি হয়ে যাবে। সাধারণত ওভার টাইমসহ সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারখানা চলে।
এ গার্মেন্টসে কর্মরত কয়েকজন জানালেন, গার্মেন্টস খোলার নোটিস মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে সব শ্রমিকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রায় অধিকাংশ শ্রমিকই কাজে যোগদান করেছে। এ কারখানার মানবসম্পদ ও কমপ্লায়েন্স বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দিনে কতজন শ্রমিক অনুপস্থিত, তা এখনো বলতে পারছি না। তবে আনুমানিক প্রায় ৮০% চলে এসেছে। এটিই চূড়ান্ত হিসাব নয়; কম-বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের অধিকাংশ শ্রমিকই কারখানার আশপাশে থাকেন। ফলে লকডাউনের কারণে অনুপস্থিতির হার খুব একটা বেশি নয়। স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে যতটা সম্ভব আমরা ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি। কারখানায় প্রচুর কাজের অর্ডার পড়ে আছে। তাই মালিক-শ্রমিক কেউই কাজ বন্ধ রাখার পক্ষে নন।
হাজীপাড়ায় অবস্থিত নিউ ফয়সাল নামের এক পোশাক কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সামনে অনেক নারী-পুরুষের ভিড়। তবে তাদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সেখানকার একজন পাপিয়া বেগম বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। হঠাৎ করে কারখানা খোলার ঘোষণায় অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হয়েছে। গতকাল রাতে রওনা দিয়ে আসার সময় কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে বসে দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে শ্রমিকদের আসতে নিষেধ করেছে, এরপরও কেন আসলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আজকে কাজে জয়েন না করলে বেতন কাটা যেতে পারে। একই কথা জানালেন সরদার গার্মেন্টসের কর্মী হাজেরা। তিনি বলেন, বরিশালের মুলাদি থেকে ভেঙে ভেঙে কয়েকভাবে রিকশা-ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, মিনি ট্রাকের মধ্যে গাদাগাদি করে আসতে হয়েছে। ফেরি পারাপারের সময় মনে হয়েছিল দমটা বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে আরিফ, সালেহা, রুবি, ইয়াসমিন বলেন, ১ আগস্ট কারখানা খুলতে পারে ভেবে আমরা ঈদের পরেই ঢাকাতেই চলে এসেছিলাম।
এদিকে গাজীপুরে ওয়ানগ্রুপের কারখানা শ্রমিক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, সকালে কুষ্টিয়া থেকে ১০০ টাকার ভাড়া ১১০০ টাকা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় হেমায়েতপুরে, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গাবতলীতে এসেছি। এখান থেকে যাব গাজীপুরে। বিজিএমইএ থেকে নিষেধ করার পরেও ঝুঁকি নিয়ে আসার কারণ হিসেবে রিয়াজুল বলেন, অফিস থেকে তেমন কিছু বলেনি। তবে আমি না আসলে এ জায়গা তো খালি থাকবে না। নারায়ণগঞ্জের আদমজিতে ইউনিভার্সেল ফ্যাশনসে জামাল উদ্দিন জানান, দুজনে ২ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে পাবনা থেকে অটোরিকশা করে গাবতলীতে এসেছেন।
এদিকে লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ায় শ্রমিকদের ‘দ্বিমুখী সংকটে’ ঠেলে দেয়া হয়েছে মন্তব্য করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদ এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার বারবার বলছিল লকডাউনে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে। এখন শিল্প মালিকদের চাপে তা খুলে দিল। ফলে চাকরি হারানোর ভয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যেয়ে আটকে থাকা লাখ-লাখ শ্রমিককে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় দুর্ভোগ আর ঝুঁকিকে সঙ্গী করে একদিনের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরতে হবে। পরিবহন ও আনুষঙ্গিক আয়োজন ছাড়া সরকারের এই ঘোষণা একদিকে শ্রমিকদের যাত্রাপথের ঝুঁকি এবং অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয়ের ক্ষতি, অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ আর চাকরি হারানোর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চলমান বিধিনিষেধে গ্রামে থাকা শ্রমিকদের কাজে না ফিরতে অনুরোধ জানিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)।
শ্রমিকদের অভয় দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, বিধিনিষেধ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ না দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি, তাদের ফোন করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। এমনকি তাদের বেতন কাটা যাবে। এজন্য শনিবার বিধিনিষেধের মধ্যে রাজধানীতে ফিরেছে তারা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়ায় তাদের ফিরতে হয়েছে। সাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, হিউম্যান হলার, ট্রাক ও মোটরসাইকেলে করে তারা বাড়ি থেকে আসেন। কিন্তু ঢাকার প্রবেশমুখে পুলিশের বাধায় অনেকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় ঢোকেন। ফেরিগুলোতেও ছিল জনস্রোত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়