ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ : বাংলাদেশিসহ ৪৩ অভিবাসীর সলিল সমাধির আশঙ্কা

আগের সংবাদ

অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ ‘আশ্রয়ণ’ > দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : পাঁচ কর্মকর্তা ওএসডি, দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত

পরের সংবাদ

গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে শনাক্ত-মৃত্যু

প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** হাসপাতালে আসা অর্ধেক রোগীই গ্রামের ** অক্সিজেন-শয্যা সংকটে চিকিৎসা ব্যাহত **
কাগজ প্রতিবেদক : দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি থামানোই যাচ্ছে না। এপ্রিল মাসে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করার পর সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। তবে জুনের শেষের দিকে সেই সংক্রমণ রীতিমতো রুদ্র রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখন রোগী শনাক্ত হচ্ছে বেশি। জেলা পর্যায়ে করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এখনো নিশ্চিত না হওয়ায় সেখানে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে বেডসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল জানিয়েছেন, হাসপাতালে এখন যে রোগীরা আসছেন, তাদের অর্ধেকই গ্রামের। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এখন যে সংক্রমণ হচ্ছে তা কমিউনিটিতে ছড়িয়ে গেছে। সংক্রমণ গ্রামের লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫০ শতাংশের বেশি রোগী গ্রাম থেকে আসছে। আমরা সব উপজেলায় কথা বলেছি। সবার পর্যবেক্ষণ একটাই, রোগীদের অনেকেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে ৪০-৫০ এ নেমে গেলে হাসপাতালে আসছেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে ব্রেইন ড্যামেজ আগেই হয়ে যায়। এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো খুব কঠিন হয়। গ্রামের রোগীরা অসতর্ক, গ্রামের বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে আসেন অনেক পরে, এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে।
গ্রামে কেন সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি? এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসে রোজার ঈদে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে গেছেন। গ্রামে কিন্তু পরিস্থিতি আগে খারাপ ছিল না। শহর থেকে মানুষ গ্রামে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। আবার ওই লোকগুলো শহরে ফেরত এসেছেন। এর ফলে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে। এছাড়া গ্রামের মানুষ এখনো অসচেতন। কুরবানির পশুর হাটে মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে না পারলে করোনা সংক্রমণের হার আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নেয়ারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতোমধ্যে সিনোফার্মের টিকা দিয়ে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে গণটিকা কার্যক্রম। টিকার জন্য নিবন্ধনের অ্যাপটিও সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে অচিরেই। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনার টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (এমএনসি এন্ড এএইচ) ডা. মো. শামসুল হক গতকাল বলেন, দেশে টিকার মজুদ বেড়েছে। সিনোফার্মের টিকা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও দেয়া শুরু হবে। রবিবার এক সভায়

সিদ্ধান্ত হয়েছে, মডার্নার টিকা দেয়া হবে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায় আর সিনোফার্মের টিকা দেয়া হবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে বেড সংখ্যা ৪০৫। সেখানে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৪৯৫। এদের মধ্যে ২১০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম ইয়াজদানী জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আবারো করোনা ইউনিট বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া রাজশাহী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হলে অবস্থা স্বাভাবিকে আনা যাবে। সিভিল সার্জন ডা. মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, প্রথম দিকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের মাঝে অনীহা দেখা গেলেও বর্তমানে আগের চেয়ে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কঠোর লকডাউনের প্রভাবে আক্রান্তের হার কমলেও সামনে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনার মধ্যেও সীমান্তবর্তী জেলা কুষ্টিয়ার করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। জেলা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে জায়গা নেই। কুষ্টিয়া ২৫০ বেডের হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, হাসপাতালে এখন বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। বেড না থাকায় এখন রোগীদের মেঝেতে ও করিডরে রাখতে হচ্ছে। হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছে ২৮৭ জন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই ১৯৩ জন। আর উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রয়েছেন ৯৪ জন।
নাটোর সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. পরিতোষ কুমার রায় জানান, সংক্রমণের হার বেশি হওয়ায় এবং রোগীর চাপ থাকায় করোনা ইউনিটে বেড সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টির স্থলে ৭০টি করা হয়েছে। তবু সামাল দেয়া যাচ্ছে না। গতকাল ৭০ বেডের করোনা ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ৮২ জন রোগী।
কিশোরগঞ্জের একমাত্র কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক ডা. অনুপম ভট্টাচার্য জানান, রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে করোনায় আক্রান্ত রোগীরা এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন। গত ১০ দিন ধরে জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কোভিড রোগীদের জন্যে বরাদ্দ করা সিট ১২০টি থেকে বাড়িয়ে ১৫০টি করা হয়েছে। বর্তমানে ১২৫ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন। ১০টি আইসিইউ বেড থাকলেও সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক ডা. সালেহ মোহাম্মদ আলী জানান, রোগীদের অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন শেষ সময়ে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকছে না। যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই করোনা আক্রান্ত হয়ে শেষ সময়ে হাসপাতালে এসেছিলেন। তিনি জানান, এই হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালু না থাকায় অক্সিজেনের ব্যাপক সংকট দেখা দিচ্ছে। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মেডিফোল্ড সিস্টেমে বড় বোতলে অক্সিজেন সরবরাহ শুরু হলেও রোগীর চাপের সঙ্গে পাল্লা দিতে আরো অক্সিজেন প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯৬৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৬৪ জনের। বিভাগ ও জেলাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ৪ হাজার ২৫০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই (মহানগরসহ) শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ১৯৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। এরপরই বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে টাঙ্গাইলে। সেখানে ২২৭ জন রোগী শনাক্ত ও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদপুরে ১৭৬ জন রোগী শনাক্ত ও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে ১১২ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, কিশোরগঞ্জে ১০৭ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গাজীপুরে ৯০ জন রোগী শনাক্ত ও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজবাড়ীতেও শনাক্ত রোগী কম হলেও মৃত্যু বেশি। সেখানে ৫৮ জন শনাক্ত ও ৪ জনের মৃত্যু হয়।
ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৮৯ জন রোগী শনাক্ত ও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ময়মনসিংহে ২১০ জন রোগী শনাক্ত এবং ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নেত্রকোনায় ৭০ জন এবং জামালপুরে ৬০ জন রোগী শনাক্ত হলেও কেউ মারা যাননি। শেরপুরে ৪৯ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ৩৬৭ জন রোগী শনাক্ত এবং ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। সেখানে ৫৫৯ জন রোগী শনাক্ত ও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লায় ১৭৪ জন রোগী শনাক্ত ও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, নোয়াখালীতে ১৫৮ জন রোগী শনাক্ত ও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, কক্সবাজারে ১৪০ জন শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে, ফেনীতে ৯৮ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ১২৩ জন রোগী শনাক্ত ও ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় ৩১৪ জন রোগী শনাক্ত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, রাজশাহীতে ২৮০ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে, নাটোরে ১৮৩ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, পাবনায় ১৩৯ জন রোগী শনাক্ত ও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে, সিরাজগঞ্জে ১১৮ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। জয়পুরহাট ও নওগাঁয় ৩১ জন করে রোগী শনাক্ত ও ১ জন করে মোট ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে ৬৭৬ জন রোগী শনাক্ত ও ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরে ২৬৭ জন রোগী শনাক্ত ও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৩০ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুরে ৮৫ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে পঞ্চাশের কম রোগী শনাক্ত হলেও ওই দুই জেলা ২ জন করে মোট ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়, নীলফামারীতে ১ জন করে মোট ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৪৭০ জন রোগী শনাক্ত ও ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়াতে ২৯২ জন রোগী শনাক্ত ও ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, খুলনায় ২৩৯ জন রোগী শনাক্ত ও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, ঝিনাইদহে ৮৬ জন রোগী শনাক্ত ও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যশোরে ২৮৬ জন রোগী শনাক্ত ও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, বাগেরহাটে ১২১ জন রোগী শনাক্ত ও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, মেহেরপুরে ৮৮ জন রোগী শনাক্ত ও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, চুয়াডাঙ্গায় ১৫২ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাতক্ষীরাতে ১০২ জন রোগী শনাক্ত হলেও সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় কারো মৃত্যু হয়নি। নড়াইল ও মাগুড়ায় ১ জন করে মোট ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বরিশাল বিভাগে ৪৩৬ জন রোগী শনাক্ত ও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ১৫৭ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, ঝালকাঠিতে ১০০ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পিরোজপুরে ৮৩ জন রোগী শনাক্ত ও ২ জনের মৃত্যু, ভোলায় ১৬ জন রোগী শনাক্ত ও ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সিলেট বিভাগে রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৫৩ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ১১৭ জন রোগী শনাক্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, সুনামগঞ্জে ২১ জন রোগী শনাক্ত ও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে, হবিগঞ্জে ৫৪ জন রোগী ও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মৌলভীবাজারে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে, শনাক্ত হয়েছেন ৬১ জন রোগী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়