আশুলিয়ায় ফার্নিচার গুদামে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৩

আগের সংবাদ

বাতাসে আগুনের হলকা!

পরের সংবাদ

শিশু হাসপাতাল : ছিল না পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে’ কার্ডিয়াক বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর ৫টি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কার্ডিয়াক বিভাগের এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও শিশু হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমনকি যেখানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সেই আইসিইউতেও ছিল না পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা।
হাসপাতালটি আগে থেকে অগ্নিঝুঁকিতে ছিল কিনা- সেটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে, ঝুঁকি নির্ণয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন একটি টিম আজ (শনিবার) হাসপাতালটি পরিদর্শন করবে জানা গেছে। ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগুন লাগার খবরে পুরো হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অসুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে ভবন ছেড়ে নিচে নেমে আসেন সবাই। অসুস্থ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবা-মাদের হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গরমের মধ্যে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। আইসিইউতে থাকা শিশুদের অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। তবে, আতঙ্ক কাটেনি রোগীর স্বজনদের। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কম থাকায় আবারো এ ধরনের ঘটলে বড় বিপদ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের আইসিইউ ইউনিটের বাইরে বসে ছিলেন পোশাকশ্রমিক রিনা আক্তার। রিনার নাতনির চিকিৎসা চলছিল আইসিইউতে। হঠাৎ আগুন লাগলে দৌড়ে আইসিইউতে ঢোকেন রিনা। এরপর নাতনিকে নিয়ে বের হয়ে আসেন। রিনা আক্তার বলেন, আইসিইউতে গিয়ে দেখি লাইট বন্ধ। অন্ধকারে আমার নাতনি রিপামনিকে খুঁজছিলাম। ওর হাতে ক্যানুলা লাগানো ছিল। আমি জোরে টান দিয়ে ক্যানুলা খুলে ওকে নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসি। পরে চিৎকার দিয়ে আগুনের খবর জানালে সবাই গিয়ে তাদের বাচ্চাদের উদ্ধার করে আনে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, আমার নাতনি তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। এর আগেও এ হাসপাতালে আগুন লাগে। আজ (গতকাল) আগুন লাগার পরও কোনো বাঁশি বা হুইসেল দেয়নি কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকরা নিজেরা রোগীদের উদ্ধার না করলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। অগ্নিকাণ্ডের পর শিশুদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান রিনা আক্তার।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দুই বছর বয়সি সন্তানকে নিয়ে স্ত্রীসহ শিশু হাসপাতালে এসেছেন শফিউল্লাহ। আগুনের খবর শুনেই দ্রুত স্ত্রী-সন্তানকে বাইরে চলে আসেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর শুনে অন্য কিছু চিন্তা করিনি। দ্রুত ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে ভবন থেকে বের হয়ে পড়ি। এখন খোলা জায়গায় আছি। সবকিছু ঠিকঠাক হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন বলবে তখন ওয়ার্ডে চলে যাব। অসুস্থ কন্যাসন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুলবুল বলেন, নিচতলায় আগুন ছড়ায়নি। ধোঁয়া দেখতে পেয়ে আমরা বের হয়ে আসি। আমাদের ওয়ার্ডে যারা ছিল সবাই বের হয়ে আসে। অন্যদের তেমন একটা সমস্যা হয়নি।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরপর যখন জানতে পারেন আগুন লেগেছে, তখন সবাই তাড়াহুড়ো করে নিচে নামতে শুরু করেন। এক রোগীর স্বজন রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে যদি হুটহাট এভাবে আগুন লেগে যায়, তাহলে তো রোগীদের জন্য ভয়ের বিষয়। এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো অবশ্যই সবসময় নিরাপদ রাখা উচিত। হাসপাতালের নিচে নেমে আসা হামিদুর রহমান জানান, কার্ডিয়াক বিভাগে তার বাচ্চা ভর্তি ছিল। জুমার নামাজ পড়ে এসে দেখেন ভবনটিতে আগুন। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন তার বাচ্চাসহ ভর্তি থাকা সব বাচ্চাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এদিকে কার্ডিয়াক বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউর চিকিৎসক রুমে থাকা কম্পিউটার, প্রিন্টার, চেয়ার-টেবিলসহ সবকিছুই প্রায় আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে। রুমের দেয়ালসহ সবকিছুতেই কালো ধোঁয়ার আস্তর পড়ে আছে। কার্ডিয়াক বিভাগে কর্তব্যরত এক নার্স বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রত্যেক বেডেই রোগী ছিল। যখন দুর্ঘটনা ঘটে আইসিইউতে মোট ১৭ জন রোগী ছিল। আগুন লাগার পর তাদের প্রত্যেককেই বিভিন্ন ওয়ার্ড ও অন্য আইসিইউগুলোতে স্থানান্তর করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, আগুনে পুরো বেড, দেয়াল, এসি, ফ্রিজসহ রোগীদের অক্সিজেনসামগ্রী পুড়ে গেছে। যেগুলোর কোনোটাই আর ব্যবহার উপযোগী নেই। যেগুলো ছিল, প্রায় সবগুলোই অতন্ত দাহ্য পদার্থ। আগুন যদি ছড়িয়ে পড়ত, তাহলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি ছিল। কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধোঁয়া। এখান থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো পথ ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে কয়েকটি জানালার কাঁচ ভেঙে ধোঁয়া বের হওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর মোটামুটি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
আগুন নিয়ন্ত্রণ শেষে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন বলেন, দেশের এত বড় একটি শিশু হাসপাতাল; অথচ এখানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া আর কিছুই নেই। যার ফলে কার্ডিয়াক আইসিইউতে লাগা আগুন নির্বাপণ করতে কিছুটা সময় লেগেছে। কার্ডিয়াক আইসিইউতে থাকা এসি বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে। তবে তদন্তে পর ঘটনার সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যাবে। তিনি বলেন, এখানে পানির ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় পাশের মানসিক হাসপাতালের পানির রিজার্ভ থেকে পানি আনা হয়। ছিল না পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট। তবে আগুন লাগার পরপরই আইসিইউতে থাকা সবাইকে সরিয়ে নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বজনরা। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা ধারণা করছি আইসিইউর ভেতরে এসি ছিল, সেটা থেকে হয়তো আগুন লেগেছে। তবে তদন্তের পর সঠিক কারণ জানা যাবে। তিনি আরো বলেন, আগুনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিছু ভালো আছে। পাশাপাশি আইসিইউ রুমে যে অক্সিজেন সংযোগ ছিল সেটি আগুনের কারণে পুড়ে যায়। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা সময় লেগেছে। পরবর্তী সময়ে ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় অক্সিজেন লাইনটি বন্ধ করা হয়েছে।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : আইসিইউতে লাগা আগুনের ঘটনায় ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তদন্ত কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে কার্ডিয়াক আইসিইউ বিভাগের প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। এছাড়া কমিটিতে আছেন একজন মেনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ওয়ার্ড মাস্টার ও একজন নার্স। তারা তিন দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবেন। তিনি আরো বলেন, এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সেবা চালু করা। আমাদের নিজস্ব টেকনিক্যাল টিম, ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার, ডিপিডিসি ও ফায়ার সার্ভিস চেক করে যদি সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে আমরা নিচতলার সেবা থেকেই চালু করতে চাই। এভাবে ধীরে ধীরে আমরা সব ফ্লোরের সেবা চালু করতে চাই। সেবা শুরু করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। তবে তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু এখন বলতে পারছি না।
গত মঙ্গলবারও শিশু হাসপাতালে আগুন লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আগুনের বিষয়টি বড় কিছু না। খাবার গরম করার চুলায় রোগীর স্বজনের কাপড়ে আগুন লেগেছিল, যা নার্সসহ স্টাফদের চেষ্টায় সঙ্গে সঙ্গে নেভানো হয়। আজকের যে আগুন সেটির বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়