আশুলিয়ায় ফার্নিচার গুদামে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৩

আগের সংবাদ

বাতাসে আগুনের হলকা!

পরের সংবাদ

গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন

প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হরলাল রায় সাগর : তাপপ্রবাহের তীব্রতায় পুড়ছে দেশ। জনজীবন হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত। অসহনীয় গরমে ত্রাহি অবস্থা জনসাধারণের। পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এ বছর চৈত্র মাসের শুরু থেকেই তীব্র গরম পড়েছে। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে তাপপ্রবাহ। এ আবহাওয়া পরিস্থিতিকে মরুভূমির আবহাওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন অনেকে। তবে চলমান তাপপ্রবাহ নিয়ে সহসা কোনো সুখবর দিতে পারছে না আবহাওয়া অধিদপ্তর বরং তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহ আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। চলতি মাস তো বটেই, মে মাসে নতুন করে তাপমাত্রা আরো বেড়ে যাবে। এ যাবৎকালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। গতকাল শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়- ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহী, পাবনা, টাঙ্গাইল ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর প্রায় সারাদেশের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। এ পরিস্থিতিতে সারাদেশে জারি করা হয়েছে তাপপ্রবাহের তিন দিনের সতর্কবার্তা। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়তে পারে। পাশাপাশি জনসাধারণকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ক্রমশ জলীয়বাষ্পসমৃদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় গোটা বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা। এছাড়া তারা উষ্ণতা ও তাপপ্রবাহ বাড়ার আরো তিন কারণ হিসেবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, হিমালয়ের বরফ গলে কঠিন শিলা বের হওয়া এবং দেশে মানবসৃষ্ট- সবুজায়ন ধ্বংস করা, দখল-দূষণ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।
আবহাওয়ার ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহী, পাবনা ও টাঙ্গাইল জেলাসহ খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। চাঁদপুর, মৌলভীবাজার জেলাসহ ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ, বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
পূর্বাভাসে আরো বলা হয়, চুয়াডাঙ্গায় গতকাল শুক্রবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুলনায় তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সাতক্ষীরায় ৪১ ও যশোরে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিভাগীয় শহর ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৪, রাজশাহীতে ৪১, চট্টগ্রামে ৩৪ দশমিক ২, বরিশালে ৩৮ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ৩৪ ও রংপুরে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে কম তাপামাত্রা ছিল সিলেটে ৩০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নিকলীতে ২১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ো অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, প্রায় সব জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে- ৩৫ ডিগ্রি

সেলসিয়াসের উপরে। গতকাল সিলেট ও কুমিল্লায় কিছু বৃষ্টিপাতও হয়েছে বলে জানানো হয় পূর্বাভাসে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আজ শনিবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে। এজন্য সতর্কবর্তা জারি করা হয়েছে। এ সময় সারাদেশ উত্তপ্ত, উষ্ণ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সূর্যের প্রখরতা ও তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময় ছায়ায় থাকা, নিতান্ত না হলে বাইরে বের না হওয়া, সুতি পোশাক পরা, বেশি পানি পান করা এবং কোমলমতি শিশুদের বাইরে খেলাধুলা না করার পরামর্শ দেন তিনি।
চলমান তাপপ্রবাহ এপ্রিলজুড়েই থাকবে, হয়তো তাপমাত্রা বাড়বে-কমবে জানিয়ে এ আবহাওয়াবিদ বলেন, এপ্রিল-মে হলো উষ্ণতম মাস। তাই মে মাসেও নতুন করে তাপমাত্রা বাড়বে বলে ধারণা করছি। গত বছর বাংলাদেশ ৪৭ বছরের মধ্যে উষ্ণতম ছিল; কিন্তু এ বছর সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে- অর্থাৎ উষ্ণতম বছর হবে বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে জলীয়বাষ্পসমৃদ্ধ বাতাস অনবরত প্রবাহিত হয়। এতে গরমের তীব্রতা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে মৃদু, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর ৪২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়।
তাপপ্রবাহ বাড়ার বেশ কিছু কারণের মধ্যে তিনটির সম্ভাব্য ব্যাখা করেছেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, তাপমাত্রার তীব্রতার প্রথম কারণ হলো বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। এর কারণে বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবও আছে বাংলাদেশের ওপর। দ্বিতীয়ত আঞ্চলিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে তাপমাত্রাটা বাড়ছে। হিমালয়ের বরফ গলে কঠিন শিলা বের হয়ে আসছে। এ অঞ্চলে নদনদীর ও বনভূমির সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে। এর একটা উদাহরণ হলো- সমুদ্রপৃষ্টে তাপমাত্রা বেড়েছে এলনিনোর প্রভাবে। এতে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে উষ্ণ ও শুষ্ক বাতাস বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। সে কারণেও বাংলাদেশের আবহাওয়া উত্তপ্ত, লু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
আর তৃতীয়ত স্থানীয় কারণের মধ্যে বহু ফ্যাক্টর রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের এখানে যে পরিমাণ গাছপালা ও জলাধার থাকা দরকার, তা নেই। অর্থাৎ সবুজায়ন ও জলাধার কমে যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণেও পৃষ্ঠ উত্তপ্ত থাকছে। তিনি বলেন, লক্ষ্য করেছি- ঢাকা নগরীতে প্রায় ১৬ লাখ যানবাহন চলাচল করছে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ লাখ গ্যাসের চুলা জ্বলছে আর ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইউনিট এসি চলছে। এগুলো প্রতিনিয়িত এ শহরকে উত্তপ্ত করছে। তাছাড়া যেখানে-সেখানে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। বায়ুদূষণ বাড়ছে। এখানে বিল্ডআপ স্পেস ৯৫ শতাংশ। কোনো খালি জায়গা নেই। ভবনসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। মাত্র পাঁচ থেকে ১০ ভাগ আছে- মাটি দেখা যায়। কাচের ভবন করা হচ্ছে। এতে উত্তাপ ধারণ করে রাখা হচ্ছে। এ কারণে তাপমাত্রাটা বাড়ছে।
স্বল্পমেয়াদি এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের তেমন কোনো উপায় নেই জানিয়ে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এক দিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। তাপমাত্রা থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। দেশের কোথাও কোনো খালি জায়গা রাখা যাবে না, নতুন গাছ লাগাতে হবে। গাছ কাটায় জিরো টলারেন্সে যেতে হবে। সবুজায়ন করার কমিটমেন্ট থাকতে হবে। জলাধার সংরক্ষণ ও দখল-দূষণ থেকে উদ্ধার করা এবং নতুন জলাধার তৈরি করতে হবে। কাঁচের ভবনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহারের মাধ্যমে উষ্ণতা সহনশীল রাখতে পারি। আর জীবাষ্ম জ্বালানি বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
তীব্র তাপপ্রবাহ সুরক্ষার বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ডা. লেনিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, অতি গরমে শরীর থেকে ঘামের সঙ্গে লবণ ও পটাসিয়াম বের হয়ে যায়। এতে পানি ও লবণশূন্যতা দেখা দেয়। তাই অতি প্রয়োজন না হলে বাইরে বের না হওয়াই ভালো। একান্ত বের হলে সুতির জামা-কাপড় পরে ও রোদ এড়িয়ে বারবার গাছ কিংবা কোনো ছায়ায় আশ্রয় নিতে হবে। পানি খেতে হবে। তিনি বলেন, রাস্তার পাশের শরবত ও পানি কোনোক্রমেই খাওয়া যাবে না। তীব্র গরমে ভাইরাসের চরিত্রও বদলে যায়। এতে ভাইরাসজনিত জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে। তাই সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়