রাজধানীতে ছাদ থেকে নিচে পড়ে নারীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন

পরের সংবাদ

ছলাৎ ছল, ইছামতীর স্তব্ধ জল

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মানবসভ্যতার সবচেয়ে স্বীকৃত প্রধান একটি উপকরণের নাম নদী। সেই মিসর সভ্যতার নীল নদ থেকে তা শুরু হয়েছে এবং আজো নদীর অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আসেনি। তবু মানুষেরই অবহেলায় নদী ক্রমেই হারায় তার গতিপথ; অবরুদ্ধ হয় সভ্যতার বেড়াজালে। এমন এক নদীর গল্প শুনাব আজ। ইছামতি প্রবাহিনী প্রাচীন জনপদ নবাবগঞ্জ-দোহার-কেরানীগঞ্জ-ঢাকা। এ নদীতে যেখানে পদ্মা নদী মিশেছে, সেই বেড়িবাঁধের প্রান্ত থেকে ইছামতী নদী নবাবগঞ্জ-দোহার-কেরানীগঞ্জ ছুঁয়ে মিশেছে বুড়িগঙ্গায়। কোনো এক সময় এ ইছামতী-বুড়িগঙ্গা ছিল ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। সংস্কারের অভাবে ইছামতী ভরাট হয়েছে, দখল হয়েছে, দুই পাশে বর্জ্য-আবর্জনা-জঞ্জাল-প্লাস্টিকে ভরপুর হয়েছে। গজিয়ে উঠেছে কচুরিপানা, জঞ্জাল, লোভী মানুষের অট্টালিকা। ফলশ্রæতিতে ইছামতী মলমূত্র, মৃত পচা প্রাণী আর আবর্জনার স্তূপে ভরা বদ্ধ নালাতে পরিণত হয়েছে। অথচ এ নদীই একদিন দু’হাত ভরে ফসল দিয়েছে চাষিকে, মৎস্যজীবীদের নৌকা ভরিয়ে দিয়েছে মাছ দিয়ে। জলজ প্রাণীরা খেলা করে বেড়িয়েছে স্বচ্ছ বহমান জলধারায়। কিন্তু এখন নৌ-বাণিজ্য আর নেই, নৌ-শিল্পাঞ্চল আর নেই; নেই নদীর পাড়ের মেলা। যার জীবনের ওপর এত মানুষের ভার ছিল, তার নিয়মিত সংস্কারের অভাবে অগভীর খাতে চর জেগে উঠেছে, চর বিক্রি হচ্ছে, পাকা দালান উঠছে। ইছামতী আর নেই এখন। আজই বলার সময় হয়ে গিয়েছে- ‘ইছামতী বলে একটি নদী ছিল’।
ফাল্গুনের ঝকঝকে রৌদ্রময় দিন। পথের ধারে পলাশের গুচ্ছে বসন্ত এসেছে। ঢাকা শহর থেকে পথ গেছে জাতীয় সড়কের আড়াআড়ি চিরে নবাবগঞ্জ-দোহারের দিকে, শিকারিপাড়া বেড়িবাঁধের দিকে। পথে পড়বে জিঞ্জিরার মোড়। তারপরই দুই পাশে শুধু ধান এবং শাকসবজির সবুজ রঙের খেলা। বাতাসে কচি পাতার হিল্লোল। কিছুটা গেলেই পরপর দুটি ব্রিজ। এ পথেরই পাশ দিয়ে একসময় কলকল করে বয়ে চলত ইছামতী নদী। আজ সেই ছলাৎ ছলে শুধুই স্তব্ধতা। চোখে পড়ে মলিন নদীখাত এবং তার শুষ্কতা। জলহীন নদীর মরমরে শব্দের হাহাকার। কথিত আছে, ইছামতী নদীর পথে কলকাতা থেকে ব্যবসা শেষে ফিরে আসতেন কলাকোপার নামি-দামি ব্যবসায়ীরা। নৌকাবাইচে মাইকের গানে দুই পাশের নর-নারী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত সেই নৌকাবাইচ উপভোগ করতে। মরিচা ঘাটের কাছে চায়ের দোকানে দুধ দেয়া ঘন চা আর বিস্কুট খেতে খেতে নদীর কথা বলতে পারেন স্থানীয়দের সঙ্গে। ওরা এখনো বুক চেতিয়ে বলবে- ‘আমার ইছামতী নদী।’ এখনো ওদের নদীর প্রতি এত টান, এত মায়া। এ নদীর ওপর এখনো ‘ইছামতী নদী বাঁচাও আন্দোলন’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন কাজ করছে। কখনো কখনো মুদ্রিত হচ্ছে নদীকে নিয়ে গল্প, হাহাকারের শব্দ। ধ্বনিত হয় মৎস্যজীবীদের জীবিকা নষ্ট হওয়ার গল্প, বর্ষাকালে মাছ না পাওয়ার বেদনা। এটা শুধু ইছামতী পারে থাকা হাজার হাজার জেলের সংকট নয়, গরিবের আহারে পুষ্টির সংকটও বটে। সহজলভ্য মাছগুলো হারিয়ে গেছে নদী অববাহিকা থেকে। বিপন্ন ইছামতীর জীববৈচিত্র্য ফেরাতে ক’জন তরুণের কণ্ঠ সরকার পর্যন্ত পৌঁছায় না। পৌঁছেছিল একসময়, প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সøুইস গেট নির্মাণের সরকারি পরিকল্পনা। কিন্তু তা তো হয়েছিল বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে। জনপ্রতিনিধিরা, জনপ্রতিনিধিদের তল্পিবাহকরা বেঁকে বসলেন- আপনারা কারা? কে অথরিটি দিয়েছে আপনাদের এতসব ভালো করার? যা করার জনপ্রতিনিধিরাই করবেন। তারপর লম্বা লম্বা হিসাব- এই করেঙ্গা, সেই করেঙ্গা; কত শত হিসাব। কিন্তু আজো সেই অন্ধকারেই আছে ইছামতী। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার লোকের অভাব নেই। কিন্তু ইছামতী নিয়ে ভাববার সময় নেই তাদের। না-কি, এই প্রজেক্টে লাভের অঙ্ক শূন্য- এটা তারা বুঝে গিয়েছেন?
হলিউডের এক আপাদমস্তক বাণিজ্যিক, অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ছবিতে বিশেষ এক সংলাপ শুনেছিলাম, ‘হোয়েন হিস্টিরিয়া রিচেস একাডেমিয়া- আই গেস ইটস টাইম টু কল ইট অ্যা কেরিয়ার’। এ সংলাপটি সেই সময়কে চিহ্নিত করে, যে সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক এলবার্ট আইনস্টাইনের ওপর পর্যন্ত এফবিআই গোয়েন্দারা কমিউনিস্ট যোগসাজশের সন্দেহে নজরদারি চালাত। প্রোপাগান্ডা অথবা বিকৃত প্রচারের উদ্দেশ্যই হলো- জনসাধারণের চিন্তা-যুক্তি অথবা ভাবনার সব বৈশিষ্ট্যকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে একসুরে একদিকে কারো কোনো বিকৃত মতাদর্শের দিকে তাদের চালনা করা। এই বিকৃত মতাদর্শের অনুসারীদের দৃষ্টি তখন অন্ধের মতো থাকে। শুধু ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ ছাড়া তাদের কাছ থেকে আর কিছুই আশা করা যায় না। একটি প্রাসঙ্গিক কথা এখানে না বললেই নয়- যে মুহূর্ত থেকে কোনো মেধাকে সার্বিকভাবে অসম্মান করা শুরু হয় এবং বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে মেধার বিপরীতে জনতার মেন্টালিটিকে যুক্তির অতীত বলে মনে করা হতে থাকে, সেই মুহূর্ত থেকে বুঝতে হবে- ভবিষ্যৎ এক গাঢ়তর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ইছামতীর সংস্কার হলে কী কী লাভ হবে কিংবা ইছামতীতে সøুইস গেট হলে পদ্মার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় কী কী উপকার হবে- তা এলাকার মানুষ বুঝলে তো হচ্ছে না; বুঝতে হবে জনপ্রতিনিধিদের। উন্নয়নের শব্দ শুধু বাতাসে ছড়িয়ে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের মুখ মানুষ দেখতে পায় না। প্রকৃত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু কিংবা উষ্ণায়নের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নও অতি প্রয়োজন- তা বুঝতে হবে জনপ্রতিনিধিদেরও। আর শুধু মুখে তা বোঝার কথা বলেই শেষ করা যাবে না, কাজেও প্রমাণ করতে হবে। বহুদিন ধরেই গবেষণায় প্রমাণিত যে, জলবায়ু রক্ষায় পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করা প্রয়োজন। কার্বন অপসারণের অন্যতম উপায় হলো কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন বা কার্বনকে স্থিতিশীল যৌগে রূপান্তরিত করা। কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশনের একটি পদ্ধতি হলো- জৈব উপায়ে কার্বন অপসারণ করে সেগুলোকে জলাভূমিতে আটকে রাখা। আমাদের আশপাশের বিভিন্ন বনভূমি, নদী, জলাভূমি ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদগুলো বহুকাল ধরে বিনা খরচে জৈব পদ্ধতিতে কার্বন পুনর্বাসন করে চলেছে। তাই ইছামতী নদীকে রক্ষা করা শুধু স্থানীয় বিষয় নয়, বরং জলবায়ুর উন্নয়নেও ইছামতি নদী কাজ করতে পারে ব্যাপকভাবে।
ইছামতীর সংস্কার হলে, ইছামতীর বেড়িবাঁধ এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় সøুইস গেট স্থাপিত হলে, নিশ্চিত করে বলা যায়- পুরো এলাকার ছবিটাই বদলে যাবে। স্তব্ধ স্রোত সচল হলে ইছামতীতে আবর্জনার স্তূপ বন্ধ হবে। মৎস্যজীবী ও হারিয়ে যাওয়া পাট চাষিরা তাদের জীবিকা ফিরে পাবে। দুই তীরে ব্যবস্থা হতে পারে পার্ক ও মেরিন ওয়াকিংয়ের। ইছামতীর জীববৈচিত্র্য উন্নত হলে সন্নিহিত এলাকাগুলোর জীবŸৈচিত্র্যও উন্নত হবে। সব মিলিয়ে ইছামতীর উন্নয়নে নবাবগঞ্জ-দোহার-কেরানীগঞ্জের মানুষের জীবনে আবারো রং ছড়াবে। এটাই বুঝতে পেরে নীরবে কাজ করা নদীপ্রেমিক ‘ইছামতী নদী বাঁচাও আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক মোতাহারুল ইসলাম খান যখন আমার কাছে এলেন, তাকে হতাশার বাণী শোনানো ছাড়া আমার কাছে আর কোনো সান্ত¡নার বাণী ছিল না। তবে তার আগমনটি নতুন করে এ নিয়ে লেখার শক্তি জোগাল আমার।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়