গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা : অর্থ আত্মসাৎ

আগের সংবাদ

মন্ত্রী-এমপির হস্তক্ষেপে লাগাম

পরের সংবাদ

বাঙালি সংস্কৃতির বহুমাত্রিক উৎসব

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লোকায়ত বাংলার চিরায়ত রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একেক সময় একেক বিদেশি শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করেছে বঙ্গ নামে দেশটি। এদের মধ্যে আর্য-অনার্য পাল মোগল পাঠান ও ইংরেজ বেনিয়ারা অন্যতম। তাদের শিল্প সংস্কৃতির মিশ্রণে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির রূপ। হাজার নদীবিধৌত ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঐতিহাসিকদের মতে এই জনপদে নানা শ্রেণি-পেশা ও ধর্মের মানুষের সহাবস্থান দীর্ঘদিনের। এদের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। আবার প্রতিটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতি থাকলেও সর্বোপরি বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এই বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের এই স্বাধীন ভূখণ্ডে গ্রামীণ জীবনে রয়েছে নানা ধরনের লোকজ উৎসব ও পার্বণ। এই লোকজ অনুষ্ঠানগুলো বাঙালির প্রাণের উৎসব। যা হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবগুলো মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ। নববর্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা কবে তা নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। তবে ইতিহাস যতটুকু সাক্ষ্য দেয় তা থেকে জানা যায় মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে আকবরের সময় হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীরা বছরান্তে পুরনো বছরের দেনা-পাওনা ও লেনদেনের হিসাব-নিকাশ শেষ করে একটি নতুন বছরের হালনাগাদ খাতার মাধ্যমে হিসাব শুরু করত বলে একে পহেলা বৈশাখের হালখাতাও বলা হয়। হালখাতার দিনে চিড়া, মুড়ি, দই, মিষ্টি, দুধ, কলা ইত্যাদির মাধ্যমে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো। হিন্দু মহাজনদের হাত ধরে হালখাতার প্রচলন শুরু হলেও পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজেও এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। আগেকার দিনে ব্যবসায়ী মহল ছাড়াও প্রতি বাড়িতে পহেলা বৈশাখে আনন্দ উৎসব করে খাওয়া-দাওয়া হতো। তখনকার দিনে আজকের মতো একক পরিবার ছিল না, ছিল যৌথ পরিবার। প্রতিটি পরিবারে ছিল গোলা ভরা ধান, বট ভরা পান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। বৈশাখ এলেই বটতলা ও শিমুল তলায় বসত বৈশাখী মেলা। মেলা থেকে তালপাতার বাঁশি আর হাতপাখা এনে রাতের গরম নিবারণ করা হতো। বলতে গেলে আজকাল গ্রামীণ জীবনেও বৈশাখী উৎসব ও হালখাতার সেই রকম ধুমধাম আর নেই।
অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে নানা কারণে। এখন বৈশাখী উৎসব স্থান করে নিয়েছে শহরে। প্রায় তিন যুগ ধরে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রী ও পহেলা বৈশাখ উদযাপন কমিটির যৌথ আয়োজনে প্রতি বছর উদযাপন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। প্রতীকী পশুপাখি ও নানা ধনের মুখোশ পরিধান করে ভোরবেলায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। দিন দিন এর পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ইদানীংকালে রাজনীতির নানা মেরুকরণের হিসাব-নিকাশের বেড়াজালে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে অনুষ্ঠানমালা অনেকটা সীমিত করতে হয়। যা একসময় রাত প্রায় ১২টা অবধি চলত। সেই সুসময় আর ফিরে আসবে কিনা জানি না। পহেলা বৈশাখের পর রয়েছে পৌষ সংক্রান্তির মেলা। এই পৌষ মেলা সাধারণত পৌষের শীতেই শুরু হয়ে থাকে। মাসব্যাপী চলে নতুন জামাই ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পিঠাপুলি খাওয়ার আয়োজন। পৌষমেলায় প্রাধান্য পায় লোক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ ঢাকঢোল মাটির হাতি ঘোড়া পুতুল ইত্যাদি। পুতুল নাচের মন মাতানো দৃশ্য আজো আমাদের মনে দাগ কেটে রেখেছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ এখানে বারো মাসের তেরো পার্বণ লেগে থাকে। এই ঋতু বৈচিত্র্যের খেলা আমাদের মনের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন মানুষের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটে তেমনি উৎসবমালার। কার্তিক, অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্ত কাল। অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে নতুন ধান ওঠে। ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কিষান কিষানির বুক আনন্দে ভরে ওঠে। শুরু হয় নবান্নের উৎসব। শুধু গ্রামেই নয়, এই পিঠাপুলির উৎসব এখন শহরে বেশ জমজমাট। বাঙালির এই মুখরোচক খাবার পিঠা উৎসব নগর জীবনে প্রায় বারো মাসই দেখা যায়। আমাদের দেশে আরেক দাপুটে ঋতু বসন্ত। শুরু হয় চৈত্রের দাবদাহ আর ঝড়ো হাওয়া। রুক্ষ উদাস মনকে রাঙিয়ে তোলে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব। সংক্রান্তির দিনে গ্রামে গ্রামে বসে চরক মেলা, গাজীর গান, টপ্পা, গম্ভীরা, লাঠি খেলা। এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির লৌকিক অনুষ্ঠানগুলো বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। সামাজিক বা লোকজ উৎসবগুলোর পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রাধান্য। যেমন মুসলিমদের, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেকদর, শবেবরাত, হিন্দুদের দুর্গাপূজা শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা, খ্রিস্টানদের বড়দিন, ইস্টার সানডে, গুড ফ্রাইডে, বৌদ্ধদের, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ি পূর্ণিমা, কঠিনচিবর দান। এছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের রয়েছে নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি। তাদের মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে এদেশের পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মানুষদের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘সেøাগান’ কাউকে পেছনে রেখে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সে লক্ষ্যে সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর শিল্প সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা প্রয়োজন। যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। যে দেশে আমাদের সবার পরিচয় হবে একটাই- আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের প্রিয় স্বদেশ। এই স্বাধীন স্বদেশের ভূমিতে কোনোভাবেই যেন উগ্রধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ও বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেটাই হোক পহেলা বৈশাখের দীপ্ত অঙ্গীকার।

গোরা বিশ্বাস : লেখক ও পরিবেশকর্মী, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়