গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা : অর্থ আত্মসাৎ

আগের সংবাদ

মন্ত্রী-এমপির হস্তক্ষেপে লাগাম

পরের সংবাদ

চট্টগ্রামের মেলা মেলার চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে বারো মাসে তেরো পার্বণ নামে একটি প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। এই প্রবাদটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এ দেশের বিভিন্ন জনপদে বছরের বিভিন্ন দিনে বিশেষ বিশেষ পালা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মূলত এসব পালা-পার্বণকে ঘিরে মেলা ও উৎসবের উৎপত্তি। আকৃতি, প্রকৃতি ও অঞ্চলভেদে এসব উৎসব একদিন থেকে দীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আর এসব মেলা ও উৎসবকে উপলক্ষ করে আবহমান কাল থেকে আবর্তিত হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির লোকায়ত জীবনবৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ধারা।
প্রত্যেক মেলা সূচনার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সেটি হয়তো ধর্মীয়, নয়তো ব্রত-পালা-পার্বণ অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয়কে কেন্দ্র করে, নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সমাগম ও সমাবেশ। আর এই সমাবেশ এবং সমাগম মানেই মেলা। আর এই মেলাকে যদি বছরের প্রথম মাস বৈশাখ থেকে গণনা শুরু করি, তাহলে দেখা যাবে বৈশাখে শুরু চৈত্রে শেষ অর্থাৎ সারা বছর ধরেই গ্রামগঞ্জ কি শহর সবখানেই মেলা আর মেলা। হিসাব করলে তাই দেখা যাবে মেলাময় বাংলাদেশে কম করে হলেও পাঁচ হাজার মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের এই চট্টগ্রামে তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় যে মেলাটি বসে তার নাম লালদীঘির মেলা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক, বকশিরহাটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক আবদুল জব্বার সেই ১৯০৯ সালে যে বলীখেলার সূচনা করেছিলেন, তাকে ঘিরেই প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখে এ মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু ঐতিহাসিক এই বলীখেলা ও মেলা সম্পর্কে চট্টগ্রামের মানুষ মাত্রই অবগত। তাই এ নিবন্ধে বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্যান্য মেলা সম্পর্কে আলোকপাতের চেষ্টা করেছি।
ডিসি হিলের বৈশাখীমেলা
চট্টগ্রামের মেলা বলতে লালদীঘির পরেই আসে ডিসি হিলের বৈশাখীমেলার কথা। বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এর বর্ণাঢ্য আয়োজন। ডিসি হিলের পাদদেশে- আশপাশের বিশাল এলাকাকে গলাগলি করে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসব। সত্যিকার অর্থেও তাই। বৈশাখীমেলায় ফুটে ওঠে আবহমান বাঙালির ঐতিহ্য। কুটির শিল্পসামগ্রী, মাটির পুতুল, বাঁশির মন ভোলানো সুদৃশ্য, সুতার টানা গাড়ি, মোয়া, খই, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, বিবিধ মিষ্টান্ন প্রচুর পরিমাণে এ মেলায় থাকে। কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর প্রতি থাকে মানুষের বাড়তি আকর্ষণ। ফলে ভোর হতে মাঝরাত অবধি বাহারি কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিকিকিনি চলে।
বিজুমেলা
বৃহত্তর চট্টগ্রামের আর একটি বড় মেলার নাম বিজুমেলা বা বিজু উৎসব। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে জমজমাট উৎসব। এই মেলা প্রতি বছর শেষ চৈত্র ও পহেলা বৈশাখ বর্ষ বিদায় ও বরণের মাধ্যমে শুরু হয় এবং চলে পাঁচ দিন। পাহাড়ের পাদদেশে, নদীর পাড়ে, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়ে এক ধরনের সাদা রঙ্গন ফুটে থাকে। চাকমারা এই রঙ্গনকে বিজু বলে। এই বিজু ফুল পাহাড়ি শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী সবার প্রিয়। এই ফুল নিয়ে খেলা করে শিশুরা। কলাপাতায় বিজু ফুল ভাসিয়ে নদীর পাড়ে উৎসবে মাতে তারা। আর তরুণীরা এই ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজায়।
ফুল থেকে এই উৎসবের নামকরণ করা হলেও এটা কিন্তু ফুলের মেলা নয়। ফুল এখানে আনন্দের একটি উপাদান মাত্র। মূলত বিজু উৎসব পাহাড়ি মানুষের একটি পবিত্র অনুষ্ঠান। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি। চাকমাদের ধারণা, ভালো খাবার খেয়ে এবং অন্যকে খাইয়ে বর্ষ বিদায় করা পুণ্যের কাজ। আরো নানা রেওয়াজ দেখা যায় সেদিন। তরুণ-তরুণীরা নদী থেকে জল এনে মুরব্বিদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। মন্দিরে মন্দিরে ফুল দিয়ে, প্রদীপ জ¦ালিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।
শুধু চাকমারা নয়- এ উৎসব পালন করে প্রায় প্রতিটি উপজাতি। মারমা ও রাখাইনরা কোনো কোনো এলাকায় এ উৎসব যৌথভাবে পালন করে। এই যৌথ উৎসবকে বলা হয় পানি উৎসব। উৎসবকে ঘিরে মেলা। বিজু উৎসবও তাই কখনো বিজুমেলা, কখনো বিজু উৎসব নামে পরিচিত। বিজু উৎসবকে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে বসে অনেক মেলা। উপজাতিরা এই মেলাকে বৈসাবি মেলাও বলে। এ ধরনের মেলার বিখ্যাত কয়েকটি হলো- মহামুনির মেলা, চিৎমরম মেলা, রাজানগর মেলা ইত্যাদি।
মাইজভাণ্ডারী মেলা
মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের উরসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় মাইজভাণ্ডারী মেলা। বছরের বেশ কয়েকটি দিনেই মাইজভাণ্ডারের উরস উপলক্ষে সমাবেশ ঘটে লাখ লাখ লোকের। আর তাতেই মাইজভাণ্ডার গ্রামজুড়ে বসে যায় মেলা। এ মেলায় ভক্ত ও আউল-বাউলসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে উত্তর চট্টগ্রামের বিশাল জনপদ হাটহাজারী-ফটিকছড়ি। মেলায় নানা রকমের গৃহসামগ্রী, বাঁশ, বেত, কাঠের আসবাবপত্র, লৌহজাত বিভিন্ন দ্রব্য, শিশু-কিশোরদের খেলনা এবং বাহারি খাদ্যসামগ্রী বিকিকিনি হয়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক শাহ আহমদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর ১০ মাঘের ওফাত দিবসে অনুষ্ঠেয় বার্ষিক উরস উপলক্ষে প্রধান মেলাটি বসলেও ওই দরবার শরিফকে কেন্দ্র করে আরো দুটি উরস ও মেলা হয়। তার একটি ১৪ বৈশাখ, অন্যটি বসে ২৪ বৈশাখ।
চট্টগ্রামের মেলা- মেলার চট্টগ্রাম। সারা বছর ধরে একের পর এক মেলা অনুষ্ঠিত হয়, বিভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে। তাই চট্টগ্রামের বারো মাসের মেলার কথা বলে শেষ করা যাবে না। ১ বৈশাখের মেলার কথা বলেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। বৈশাখের ৩১ দিনের প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো জায়গায় মেলা বসে। খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে আজ এখানে মেলাতো কাল ওখানে মেলা। নিচে এ রকম কয়েকটি মেলার দিনক্ষণ তুলে ধরছি। সঙ্গে স্থায়ী কালটিও।
চিগমাইমেলা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ১ বৈশাখ, ৩০ দিন।
বৈশাখীমেলা, সীতাকুণ্ড। ১ বৈশাখ, ৩ দিন। বৈশাখীমেলা, রাউজান। ১ বৈশাখ, ৩ দিন।
বদর আউলিয়ার উরস ও মেলা। ১ বৈশাখ, ৩ দিন।
গাছবাড়িয়া মেলা, চন্দনাইশ। ২২ বৈশাখ, ২ দিন।
আর বৈশাখের প্রথম দিনতো যেন মেলারই দিন। চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ভেঁপু বাজে না। নাগরদোলা দোলে না। মুড়কি-মুড়ির গন্ধে আশপাশের বাতাস আমোদিত হয় না। কারণ মেলা মানে তো আনন্দ-উৎসব-ফূর্তি।

এমরান চৌধুরী : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়