কবিতাসমগ্র

আগের সংবাদ

অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠেকাতে কঠোর বার্তা

পরের সংবাদ

ভারতের লোকসভা নির্বাচন এবং গণতন্ত্র

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চলতি মাসেই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপরই নির্ভর করছে কোন দল দিল্লির মসনদে বসবে, সেটাই চূড়ান্ত হবে এই নির্বাচনে। তাই লোকসভা নির্বাচন এককেন্দ্রিক শাসনাধীন ভারত রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্ববহ নির্বাচন। সারাদেশে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচন হবে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মরিয়া শাসক দল বিজেপি। ছলে, বলে, কৌশলে এবং অঢেল অর্থের বিনিয়োগে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক ছক কষে চলেছে। দিল্লির আসন নিশ্চিত নয়, তাই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালসহ তার কর্মী-সমর্থকদের ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইডি, সিবিএ-কে ঢালাও ব্যবহার করে জেলে ঢুকিয়েছে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন ও তার কর্মী-সমর্থকদেরও আটক করেছে। বিরোধী পক্ষকে জেলে আটক করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাঁয়তারা শুরু করেছে শাসক দল বিজেপি।
পশ্চিম বাংলার তৃণমূল দলের নেতা-মন্ত্রীদের সীমাহীন দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সেটা জনগণের কাছে যেমন উন্মোচিত, তেমনি রাষ্ট্র ও সরকারের কাছেও দুর্নীতির প্রমাণাদিসহ রয়েছে। বিজেপিবিরোধী জোট ইন্ডিয়াতে তৃণমূল প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত হলেও অনিয়ম-দুর্নীতির ট্রাম্প কার্ড দেখিয়ে বিজেপি তাকে ইন্ডিয়া জোট ত্যাগে বাধ্য করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরেই বিজেপি পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে। তাই বিজেপি ও তৃণমূলকে ‘বিজেমূল’ আখ্যা দিয়েছে বিরোধীরা। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচন কমিশনে তালিকাভুক্তিতে সুপারিশ করেছিলেন বিজেপির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল কে আদভানি। সঙ্গত কারণেই তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি বাইরে কেবল কালো আর ধলো, ভেতরে দুই দলই সমান রাঙা। তৃণমূল কংগ্রেসকে ইন্ডিয়া জোট থেকে বের করে আনার ফলে পশ্চিম বাংলায় বিজেপির ব্যাপক উত্থান ঘটবে বলেই বিজেপি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। কেননা তৃণমূল কংগ্রেস অনিয়ম-দুর্নীতিতে চরমভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তাই তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটির টান পড়েছে। আর এই সুযোগ বিজেপি পকেটস্থ করে পশ্চিম বাংলায় সর্বাধিক আসন লাভ করবে বলেই প্রত্যাশা করছে।
ইন্ডিয়া জোটের অপর নেতা বিহারের নীতিশ কুমারও ইন্ডিয়া জোট ত্যাগ করে বিজেপি জোটে শামিল হয়েছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের ‘ত্রিপুরা মথা’ গত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট বিভক্তকরণে বিজেপিকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। ‘ত্রিপুরা মথা’ প্রধান ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যুৎ দেববর্মা বিজেপির ছক অনুযায়ী অঢেল অর্থের বিনিময়ে উপজাতিদের ভোটে ভাগ বসিয়ে বিজেপির বিজয় নিশ্চিত করেছিল। এবারের লোকসভা নির্বাচনে ‘ত্রিপুরা মথা’ বিজেপি জোটে ও রাজ্য সরকারে যোগ দিয়ে বিজেপির বিজয়াভিযানে শামিল হয়েছে।
পশ্চিম বাংলায় লোকসভা আসন ৪২টি। বিজেপি, তৃণমূল এবং ইন্ডিয়া জোটবদ্ধ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের জোটমিত্র আইএসএফ লোকসভা নির্বাচনে ৮টি আসন দাবি করে না পেয়ে পৃথকভাবে নির্বাচন করছে। বিধানসভার একমাত্র সদস্য নওশাদ সিদ্দিকী কোনো সমঝোতার তোয়াক্কা না করে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। নওশাদ সিদ্দিকীর আইএসএফ দল বিজেপির ফাঁদে পড়ে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট জোট ত্যাগ করে বিজেপির বিজয়ে একপ্রকার ভূমিকা পালন করছে বলেই মনে হচ্ছে। পেছনে বিজেপির প্রলোভন রয়েছে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। সাচ্চা বিপ্লবী দাবিদার এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলটি আগাগোড়া সিপিএম বিদ্বেষী। তারাও পৃথকভাবে ৪২টি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে বামপন্থি ভোট বিভক্তিতে নেমেছে। তৃণমূলের জনপ্রিয়তা আগের অবস্থানে নেই। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস মিলে এতগুলো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কতটুকু সফল্য লাভ করতে পারবে, সেটা নিকট ভবিষ্যৎই বলে দেবে। মুসলিম বিদ্বেষী বিজেপি সারা ভারতে মুসলিম দলগুলোকে বিভক্তিকরণে এবং নতুন নতুন দল সৃষ্টিতে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। কেননা বিজেপি জানে তারা মুসলিম ভোট পাবে না। তাই মুসলিমদের ভোট বিভক্তির কৌশল গ্রহণ করে ফায়দা হাতাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিজেপি এই নির্বাচনে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে। তাদের অর্থের উৎস ভারতীয় পুঁজিপতিরা। বিশেষ করে আদানি, আম্বানি, বিড়লা প্রমুখ পুঁজিপতি। বিজেপি ক্ষমতায় থাকায় অজস্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তর করাসহ তাদের মুনাফা বাণিজ্যে পূর্ণ সহযোগিতা করে এসেছে। প্রতিদানে স্বীয় স্বার্থে পুঁজিপতিরা অগণিত অর্থ বিজেপির পেছনে ঢালছে। ভারতের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও এসব পুঁজিপতির মালিকানাধীন। টিভি চ্যানেলগুলো অবিরাম বিজেপির প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি করার আইনি ক্ষমতাও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বদৌলতে বিজেপি পেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে ব্যবহার করে রায় পক্ষে নিয়েছিল। বাবরি মসজিদ মামলার রায় প্রদানের পর অবসর গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বিজেপির বিধানসভার সদস্য হয়েছেন। ইলেকট্রোরাল ফান্ডের মাধ্যমে বিজেপি হাজার হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছে, ইডি ও সিবিআইকে ব্যবহার করে, সাংবিধানিক আইন-কানুন উপেক্ষা করে।
নির্বাচনী বন্ডের মামলা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সাংবিধানিক বেঞ্চে প্রেরণ করেছে। অথচ আদালতে মামলা চললেও বন্ডের টাকা সংগ্রহ বন্ধ করেনি বিজেপি। বন্ডে করপোরেট থেকে বিজেপি হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছে কোনোরূপ আইনি তোয়াক্কা না করেই। আগে করপোরেটরা মুনাফার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ রাজনৈতিক দলকে চাঁদা হিসেবে প্রদান করতে পারত। মোদি সরকার নির্বাচনী বন্ড চালু করার ফলে করপোরেটদের থেকে দেদার অর্থ তুলতে পারছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালে এই বন্ডকে অসাংবিধানিক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পাশাপাশি তথ্যের অধিকার আইন (আরটিআই) এবং ১৯(১)(এ) আইন ভঙ্গ হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছেন। অপরদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ব্যয় ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে নির্বাচনী ব্যয়ের ৯৮ শতাংশ অর্থ আদায় তারা করেছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। নির্বাচনী বন্ড নিয়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হিসাব দাখিল করেনি। ভারতের পুঁজিপতি গোষ্ঠীর এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা এতে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সরকার কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে ভারত গণতান্ত্রিক নয়, রাজতান্ত্রিক শাসনাধীনে এখন। কোনো প্রকার জবাবদিহিতা নেই।
নির্বাচনকে উপলক্ষ করে তড়িঘড়ি রামমন্দির নির্মাণ ও উদ্বোধন করে বিজেপি বাজিমাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু রামমন্দির নির্বাচনী বৈতরণীতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই শঠতার নানা পন্থায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি।
আমাদের অতি নিকটবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে লোকসভা আসন মাত্র ২টি। গত বিধানসভা নির্বাচনে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোটে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বিজেপি। বিরোধীদের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ পর্যন্ত নিতে দেয়নি বিজেপির সন্ত্রাসী বাহিনী। এবারের লোকসভা নির্বাচনও ভয়াবহ অবস্থা। গত বিধানসভা নির্বাচনের অনুকরণে বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদান, কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে মারধর, ভয়-ভীতি, দমন-পীড়ন করে যাচ্ছে। দুটি লোকসভা আসনে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থীদের একজন বামফ্রন্টের এবং অপরজন কংগ্রেস দলের। আগরতলার দৈনিক দেশের কথার সাংবাদিক জানিয়েছেন, ‘বিজেপি ভোটের অধিকার হরণ করে ভোট হতে দেবে না।’ গত বিধানসভার ধারাবাহিকতায় বিজেপি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার তালে আছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপির, রাজ্য সরকারেও বিজেপি; তাই প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তারপরও রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সব অঙ্গ বিজেপি সরকারের কথায় ওঠ-বস করছে। ভারতের নির্বাচন ক্রমাগত লোক দেখানোর তামাশায় পরিণত হয়ে পড়েছে। অতীতের সব সুখ্যাতি ধূলায় মিশে গেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের অতীতের সব সুনাম-অর্জন বিজেপির শাসনামলে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। উপমহাদেশে সামরিক শাসনের কবলে পতিত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভাগ্যবরণ ভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি সত্য। তবে জনগণের রায়ে সরকার বদলের পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভারতীয় নির্বাচন এবং দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এর থেকে কবে তাদের মুক্তি ঘটবে কিংবা আদৌ ঘটবে কিনা সেটা আগত ভবিষ্যৎই বলে দেবে। চূড়ান্তভাবে বিজেপি বিজয়ী হবে তেমনটা মনে করলেও, জনগণ শেষ পর্যন্ত কোন অবস্থান গ্রহণ করে তার ওপরই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়