কবিতাসমগ্র

আগের সংবাদ

অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠেকাতে কঠোর বার্তা

পরের সংবাদ

দেশে দেশে রোজার ঈদ বিভ্রান্তির অবসান চাই

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলায় আমরা যাকে রোজার ঈদ বলতাম, তাকে এখন ঈদুল ফিতর হিসেবে অনেকে চেনে। আর তখন আমরা যাকে রমজান মাস বলতাম, এখন তাকে রামাদান বলার জন্য উৎসাহী লোকের অভাব নেই কিংবা এই দুটো পরিবর্তিত নাম গ্রহণ করার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রচারণাও চলমান রয়েছে। তবুও এই নিবন্ধে আমি রোজার ঈদ ও রমজান শব্দদ্বয়ই ব্যবহার করছি।
রোজার মাসের ব্যাপ্তি কখনো ২৯ দিন আবার কখনো ৩০ দিন হতে পারে। আমাদের দেশের মানুষ ৩০ রোজার কথাই বলে। এমনকি সত্য-মিথ্যার ঝগড়ায় অনেককে বলতে শুনেছি- ‘দেখ, আমি তিরিশ রোজা মুখে নিয়ে বলছি।’ অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রচলিত বিশ্বাস- রমজান মাস ৩০ দিনের হতে হবে। তাতে একটু বেশি সওয়াব মিলবে। কিন্তু ৩০ দিন চালাতে গিয়ে যদি আমরা ঈদের দিন রোজা রাখি তাহলে কিন্তু আমরা একটা পাপ কাজ করে ফেললাম বলে জেনেছি। কারণ চন্দ্র মাস ২৯ দিন ৪ ঘণ্টার। সে কারণে ৪-৫ বা ৬ বছর রোজার মাস ৩০ দিনের হওয়া বিজ্ঞানসম্মত। আমি প্রায় ৬ বছর নাইজেরিয়ায় ছিলাম। তাই ৬ বছরে কোনো দিনও ৬ রোজা আমি চোখে দেখিনি বা কানে শুনিনি। নাইজেরিয়ায় সুলতান অব সকেটো এর নির্দেশ মোতাবেক ঈদের দিনটি ধার্য হয় এবং সেখানে হাউসা-ফুলানি ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ও তা মেনে চলত। এখনো চলে কিনা নিশ্চিত জানি না। এমনকি নাইজেরিয়ায় আহম্মদিয়া সম্প্রদায়ের লোকদের ওই একই দিনই মেনে চলতে দেখেছি। নাইজেরিয়ায় আরো দেখেছি, আহম্মদিয়াদেরও হজ করতে ভিসা সেকালে দেয়া হতো।
নাইজেরিয়ায় ক্রমাগত ২৯ দিনের রোজা পালন করে ঈদ করাটাতে ধর্মীয় কোনো ব্যত্যয় কিনা, তা বলার মতো যোগ্য ব্যক্তি আমি নই। তবে তাতে যে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা হয়তো হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশে কি অনুরূপ কিছু ঘটেছে? আমাদের দেশে ১০ এপ্রিল কেউ কেউ ঈদ পালন করছেন। তারা কি ২৯ দিন রোজা রেখে একদিন কম রোজা রাখলেন কিনা, তা জিজ্ঞাসা আর যারা ৩০ দিন রোজা পালন করে ঈদ করলেন তারাও কি কোনো ধর্মীয় অনুশাসন ভঙ্গ করলেন কিনা মিডিয়ার বদৌলতে জানতে পারলাম বিশ্বের একমাত্র মুসলমান অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য জায়গায় ঈদ পালিত হয়েছে। এই তালিকায় আছে সৌদি আরব থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, আরো আছে পাকিস্তান। জানা গেছে, ভারতের কেরালায় গত রাতে চাঁদ দেখা গেছে। একজন তো জিজ্ঞেস করেই বসলেন ভারত-পাকিস্তানে ঈদ হলে বাংলাদেশের সর্বত্র ১০ এপ্রিল ঈদ হবে না কেন? তবে পরে জানা গেল, পাকিস্তানের সর্বত্র একদিনে ঈদ হলেও ভারতের শুধু কেরালা, কাশ্মির ও লাদাখে ১০ এপ্রিল ঈদ হয়েছে। তার প্রশ্নের জবাবে বলা যেতে পারে যে আপনি নিজেকে এখনো পাকিস্তানি মনে করলে ঈদটা পাকিস্তানের তরিকামতো করতে পারেন। কিন্তু কেরালা, কাশ্মির ও লাদাখের জায়গায় সারা ভারতকে মিশিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার তীরটি না ছোড়াই কি সঙ্গত নয়? সৌর বছর মোতাবেক আমাদের আর পাকিস্তানের সময় ব্যবধান ১ ঘণ্টা আর ভারতের সঙ্গে তা আধঘণ্টা। চন্দ্র মাস হিসেবে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতের ব্যবধান প্রায় ২৩ ও সাড়ে ২৩ ঘণ্টা। তাই পাকিস্তান বা ভারতে চাঁদ দেখা গেলে ইন্দোনেশিয়ায় সেটা দেখা যাওয়াটা হয়তো অসম্ভব। কারণ যতই পূর্ব দিকে যাব, ততই ঈদের দিনক্ষণ চন্দ্র মাসের কারণে ভিন্ন হতে পারে। এটা আমার কথা না, ফেসবুকে এ তথ্য একজন দিয়েছেন।
এবার অবাধ মিডিয়ায় প্রাপ্ত খবরগুলো একটু বিশ্লেষণ করার দুঃসাহস দেখছি। যুগান্তর পত্রিকার ভাষ্যমতে বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার ঈদ। তারা লিখেছেন মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ, পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান ও ভারতে পালিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জর্ডান, মরক্কো, ইরান ও ফিলিস্তিনে ২৯ রোজার পর বুধবার ১০ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হয়েছে। আর ৩০ রোজার পর যেসব দেশ ঈদ করছে সেগুলো হলো আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, ইয়েমেন, মিসর, তিউনিশিয়া। অর্থাৎ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশ বুধবারে ঈদ করছে না, কথাটা প্রশ্নবোধক। ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে জানলাম বাংলাদেশে অনেক উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে ২৯ রোজার পর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদের নামাজ আদায় করছে। এই গ্রামগুলো হলো ঝিনাইদহে, চাঁদপুর, নোয়াখালীর কয়েকটি গ্রাম, সর্বোচ্চ হবে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ৪০টি গ্রাম।
জানা গেছে, ১৯২৮ সাল থেকে হাজীগঞ্জের রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ মাওলানা মোহম্মদ ইসহাক সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে, রোজা, পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন উদযাপন শুরু করেন। ফেসবুক থেকে আরো জানলাম, মাওলানা শব্দের অর্থ আমার প্রভু। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রিধারীদের এই টাইটেল দেয়া হতো এবং এটুকু জেনে বিস্মিত হলাম যে, প্রায় ১০০ বছর ধরে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ২৬ জন অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন ২৬ জন খ্রিস্টান। তাদের গ্রাজুয়েট দিয়ে নাকি দেওবন্ধ ধারার উদ্ভব ও বিস্তার ঘটেছে। ঘাবড়ে যাচ্ছি আরো বিভ্রান্ত হচ্ছি। কেউ কি উদ্ধারে আসবেন?
ইত্তেফাকের শিরোনাম ‘সৌদির সঙ্গে মিল রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঈদ হচ্ছে।’ এই ঈদ উদযাপনে শরিক হয়েছেন ইসলাম ধর্মের হানাফি মাজহাবের অনুসারীরা। তারা বলছেন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাঁদের অবস্থান জেনে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে চাঁদ দেখার খবর পেয়ে ১০ এপ্রিল তারা ঈদ উদযাপন করছেন। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, শেরপুর, বরিশাল, মৌলভীবাজার, পিরোজপুর, জামালপুর, বরগুনাসহ অনেক জেলার প্রায় কয়েক ডজন গ্রামের নামোল্লেখ করে। তবে এসব পালনকারীদের কতভাগ হানাফি মাজহাবের আর কত শতাংশ পীরের অনুসারী এবং কতজন সাধারণ মানুষ, তা জানা যায়নি।
এসব গ্রামের লোকেরা নাকি বলছে সৌদি আরব নয়, তারা চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করেই রোজা ও ঈদ পালন করে থাকে। কালের কণ্ঠ প্রায় অনুরূপ রিপোর্ট করেছে। তবে তারা অতিরিক্ত জানালে, ‘এক দুনিয়া এক চাঁদ’ নিয়ম অনুসারে বিশ্বের যে কোনো দেশে চাঁদ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত হলে কোন কোন পীরের অনুসারীরা ঈদ পালন করেন। নিকটতম প্রতিবেশী যার সময়ে আমাদের চেয়ে আধঘণ্টা এগিয়ে সেখানে অধিকাংশ স্থানে মুসলমানরা ঈদ করলেন কাল অর্থাৎ ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার।
১০ এপ্রিলের রাতে বাংলাদেশের কেউ কোথাও চাঁদ দেখেনি। সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ পালন করলে নামাজও তদ্রুপভাবে পালন করতে হবে। তাই আমাদের জোহরের নামাজ সৌদির সঙ্গে মিল রেখে পড়তে গেলে জোহরের নামাজের সময় শেষ হয়ে আসরের নামাজের সময় এসে যাবে। এসব নিয়ে আমরা বড্ড বিভ্রান্তিতে আছি। আমরা মানে সাধারণ সোজাসাপটা মানুষ। এসব বিভ্রান্তি থেকে বাগবিতণ্ডা গড়িয়ে লাঠালাঠির পর্যায়ে গড়ানো অসম্ভব নয়। ছোটবেলায় দেখেছি আমার নানা ও তার শ্বশুর নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী পোষণ করত এবং তা প্রায় সুন্নি ও ওয়াহাবি বিতর্কের অন্তে ব্যবহৃত হতো। সৌদি অনুসারীদের কেউ কেউ যদি ওয়াহাবি বা সালাফি ঠাহর করে দু’পন্থিদের সংঘাত বাধিয়ে দেয়, তাহলে ইসলামের মাহাত্ম্য ও মহিমাই ক্ষুণ্ন হবে। আর এসব দিনক্ষণের ভিন্নতার কারণে রোজা শেষ না করে ঈদ হয়ে গেল বা ঈদের দিন রোজা রাখা হলো, তাহলে বিষয়টি সরকার ও ইসলামি ফাউন্ডেশনের হস্তক্ষেপ করা উচিত।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়