গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

হঠাৎ দুপুরে নচিকেতা : আমিরুল মোমেনীন মানিক > সংগীত

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

টিএনএজে আমার উপর পুরোমাত্রায় ভর করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ সংকল্প কবিতার এই লাইনটা তখন মাথার ভেতর মাছির মতো কেবলই ভনভন করতো। দুর্বার-দুরন্ত-দুর্বিনীত সেই সময়কাল। কবিতা-গান-লেখালেখির জন্য উড়াল পাখির মতো মফস্বলের এদিক ওদিক ছুটোছুটি করা। কত মেঠোপথ যে পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েছে, তার হিসেব পরিসংখ্যানের ছাত্রের পক্ষেও রাখা সম্ভব না। থানা সদরে সাংস্কৃতিক আসর মানেই আমিরুল মোমেনীন মানিকের উপস্থিতি। একবার আমাকে নিয়ে বাড়িতে বেশ হৈ-হুল্লোড় কাণ্ড ঘটে যায়। স্কুলে আসার পর বিকেলে বিজয় দিবসের কালচারাল অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফার্স্ট হলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় পুরস্কার দেয়া হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। পুরস্কারের জন্য আমি নিশ্চিন্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত বাড়িতে না ফেরায় উদ্বেগের ব্যারোমিটার বাড়তে লাগলো বাবা-মা’র। তারা সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করলেন। এরপর বাবা-মা ভেবে নিলেন, মানিক নিখোঁজ হয়েছেন। আমাকে খোঁজাখুঁজির জন্য পুরো থানা সদরে শুরু করলেন মাইকিং। ‘একটি নিখোঁজ সংবাদ। গোবিন্দপুর নাংলা কাঠপাড়া গ্রামের জামালউদ্দিন বিএবিএডের ছোট ছেলে আমিরুল মোমেনীন মানিক নিখোঁজ হয়েছেন। সে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তার গায়ে সাদা হাফ শার্ট…’ মাইকিংয়ে এ খবর থানা সদরেও পৌঁছাল। এরপর আমার হুঁশ হলো। গভীর রাতে পুরস্কার নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন দেখি শোকের বন্যা বইছে…।
সেই থেকেই শুরু। গান, কবিতার নেশা ভূতের মতো চেপে বসে আমার উপর। ছোট্ট রেডিওতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুষ্ঠান মধুর চেয়ে ভালো লাগার খাবার ছিল তখন। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির উঠোনে রেডিওতে বন্দি থাকতো পড়ন্তবিকেল। তার সাক্ষ্য এখনো দিতে পারবে সরু হয়ে যাওয়া গ্রামের মেঠোপথ।
স্কুলের সিঁড়িতেই তখন গড়াগড়ি। হঠাৎ একজন এলেন ভীষণ তেজদীপ্ততা নিয়ে। তার কণ্ঠ শুনে শরীরে কাটা দিলো। শিং মাছের মতো নড়েচড়ে বসলাম। বুকের মধ্যে বসে নজরুলটা আরো বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। কার কাছে যেনো শুনলাম, তাঁর নাম আগুনপাখি। ‘দু চোখে আকাশ, বুকে আগুন, আরো আরো কত উড়া বাকি’- ফিনিক্স এর মতো উড়ার সাধ স্পর্শ করলো চিবুক, কপোল, অলিন্দ। অন্যরকম ভাষায় নতুন স্বপ্ন দেখালো তার গান, হতাশা থেকে উঠে দাঁড়াবার সাহস পেলাম, মধ্যবিত্তের ছাদ ভেদ করে আকাশ ধরার হাত তৈরি হলো, কি এক অদ্ভুত নীল রক্ত হিম হিম ঠান্ডা হয়ে বয়ে গেলো বুকের ভেতর। প্রেরণার ছিটকে পড়া দ্যুতি যেনো।
ডিফোকাসড স্বপ্নগুলো চকচকে হয়ে উঠলো চোখের সামনে। বুকপকেটে রেখে দিলাম গানের কথাগুলো। যখনই ব্যর্থ হই, বুকপকেটে বন্দি চিরকুট খুলে সাহসের শব্দমালা দেখে নেই। আরে তাইতো, এতো আমারই কথা, আমরা রক্তক্ষরণ।
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়/নিরাশারা পাখি দু হাত বাড়ায়/খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন/কি আর করে তখন/স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন দেখে মন/যখন আমার গানে পাখি/শুধু আমাকেই দিয়ে ফাঁকি/সোনার শিকল ধরা দেয় গিয়ে আমি শূন্যতা ঢাকি/যখন এ ঘরে ফেরে না সে পাখি/নিস্ফল হয় শত ডাকাডাকি/খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন/কি আর করে তখন/স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন/স্বপ্ন দেখে মন /যখন এ মনে প্রশ্নের ঝড়/ভেঙে দেয় যুক্তির খেলাঘর/তখন বাতাস অন্য কোথাও শোনায় তার উত্তর/যখন আমার ক্লান্ত চরণ/অবিরত বুকে রক্তক্ষরণ/খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন/কি আর করে তখন/ স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন/স্বপ্ন দেখে মন…
কবি হেলাল হাফিজ আমাদেরকে কষ্ট কিনতে বলেছিলেন। নানা রঙের কষ্টের বর্ণনাও জেনেছিলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখালেন আগুন পাখি। বললেন, আমি এক ফেরিওয়ালা ভাই/স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই/হরেক রকম স্বপ্ন পাবে/আশা কিংবা নিরাশার/জন্মভূমি মুক্ত করার/কিংবা প্রিয় প্রেমিকার/আমার স্বপ্ন কিনতে হলে/আস্ত পাগল হওয়া চাই/তোমরা শুধু দেখতে যে চাও/স্বপ্নজুড়ে আশা/ স্বপ্নজুড়ে শান্তি থাকুক/কিংবা ভালোবাসা/ভালোটুকু নিতে যে চাও অমৃতেরই মতো/আরে কেউ না নিলে/যাবে কোথায় বিষ আছে যতো/স্বপ্ন দেখতে হলে দুঃস্বপ্ন দেখার সাহস চাই…
স্বপ্নের রঙে ভাসতে ভাসতে পেরিয়ে গেলো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্দ্রাময় দিনগুলো। স্বার্থান্ধ রাজধানীতে পা। নাগরিক ব্যস্ততা তখন ঘিরে ধরেছে আমার চারপাশ। আমি এক অনুজ নগরশ্রমিক। দিনমান মাইক্রোফোন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। তবু আস্তিনে ঝুলে থাকে গান। নিজের গানে নিজেই আলো জ¦ালাই। আবার সেই প্রতারক স্বপ্নে বুঁদ হই। মাঝে মাঝে আগুন পাখিকে গালি দেই, ‘শালা বাটপার, তোকে আর ছাড়তে পারলাম, তোর দেখানো স্বপ্ন তো দেখি সর্বস্বান্ত করে দেবে…’
এইভাবে পেরিয়ে যেতে থাকে দিন। অভিজ্ঞতার ডালপালা গজাতে থাকে বসন্তের মগজে।
একদিন খবর পেলাম আগুন পাখি এসেছে। শহুরে বোহেমিয়ানদের গান শুনাতে। বোকা বাকশের মাইক্রোফোন হাতে ছুটে গেলাম। উটকো বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম তার কাছে।
মনে হলো একদলা স্বপ্নের ঝিঁঝিঁ পোকা। আমার প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করালাম তাকে। মুখোমুখি আমি আর আগুন পাখি। আমার প্রশ্নের তার প্রশ্নের তীর।
: কে তুই?
: তোমার স্বপ্নে আমার শৈশব নিহত হয়েছে। তোমার সুরের ঘোরে প্রতারিত এক বালক।
: গান করিস?
: না, নিজের চোখে দেখা ঘাত-প্রতিঘাত রক্ত হয়ে বের হয় আসে বুকের ভেতর থেকে, ওগুলো গান না রক্তাম্বরী সুর। (অকপটে বলতে থাকি নিজের কথা) এই প্রেমকাতুরে রাজধানীতে গাইছি আমি মানুষমুখী গান/রক্তকণাতে জ¦লছে আগুন আমার কলম এখন মেশিনগান/আছে আমার গানে মূল্যবোধের ঘ্রাণ/আছে আমার গানে ঘৃণা-অভিমান/আমার গান শুনে তাই বোধে লাগে টান/আমার গানগুলোকে তাই তো বলি মানুষমুখী গান/দ্রোহের পথে জীবন পথে করি আহ্বান/আমার গানগুলোতে লুকিয়ে থাকুক সবুজ সবুজ বন/আমার গানশুনে হোক সবার হৃদয় স্নিগ্ধ উঁচাটন/আমার গানগুলোকে তাই তো বলি মানুষমুখী গান/আমার গানে নেই তো কোনো অভিনয়ের ভান।
(এতক্ষণে আগুন পাখির চোখ বড় হয়ে গেছে)
: কি রে দারুণ তো…
: আগুন পাখি, আজ তোমার কথা শুনতে এসেছি, তোমার বৃত্তান্ত।
: তাহলে বলছি, শোন। বাবার মুত্যুর পর সংসারের হাল ধরার তাগিদে আমার গানের সমুদ্রে আসা। নিতান্তই জীবিকার তাড়নায়। অন্য কিছু করার ছিল না। সামান্য বিএ পাস ছেলে আমি। এমএ পড়তে পারিনি। হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন। সংসারের হাল ধরতে হবে। ঘরে খাবার নেই। মা অসুস্থ। জীবিকার প্রয়োজনে একজন শ্রমিক হাতুড়ি কিনে, একজন রাজনীতিবিদ মিথ্যে কিনে। আমার কাছে গান ছাড়া আর কিছু নেই। আমার জীবনের একটা বড় সময় স্ট্রাগল করে কেটেছে। সব মধ্যবিত্ত পরিবারেই একটা নিয়ম প্রচলিত ছিল, চাকরি করো, গানটান হবে না। তো ওই সময়টাই গানের পোকাটা আমার মাথায় ঢুকেছিল। আত্মীয়স্বজন কী কাজে লাগে, এটা বুঝিস তো? ঘরের বেকার ছেলের জ¦ালা আরও হাজার গুণ বাড়াতে চাইলে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ডেকে আনবেন। তারা ছেলে কী করে, গান করে, পাগল হয়ে গেল বলে জ¦ালা আরও বাড়িয়ে দেবে। এক সময় এমন দশা কেটেছে আমার। গান করি বলে সবাই করুণার চোখে তাকাত। ভাবখানা রবিঠাকুরের গানের মতো, ‘অন্ধকানাই পথের ধারে/গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে।’ রেডিওর কাছে সবচেয়ে বেশি শিখেছি। মায়ের কাছেও শিখেছি ২। জীবনমুখী গানের অনুপ্রেরণা আসলে এই সিস্টেমের কাছে পেয়েছি। যেখানে আমি বড় হয়েছি, বুড়ো হচ্ছি। আমার কাছে এক সময় মনে হয়েছিল, প্রেমট্রেম নিয়ে অনেক গান হলো। এবার যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেই সময়ের মাটির জন্য গান করতে হবে। সময়ই আমাকে এ ধরনের গান শিখিয়েছে। আমি নিজেই নিজের গানকে এমন বলেছি। অবশ্য আমার চেয়ে বেশি বলেছে, আমার শ্রোতারা। আচ্ছা ভাই, আমার গান আমার সন্তান। আমি আমার সন্তান নাম যা ইচ্ছা রাখব। এতে কার বাপের কী? এখন যদি আমার ছেলের নাম সুমন রাখি, তাহলে কি আরেকজন বলবে, ‘বাহ্,আমার ছেলের নাম তাহলে দুশমন! বলবে?’ গান গাইতে গাইতে আমি জয় করেছি নিজের সীমাবদ্ধতা, হতাশা আর বেকারত্ব। আমার তো কিছুই ছিলো না। ঘর, অর্থ, সম্মান, কিচ্ছু না। গানই আমাকে সব দিয়েছে। আমার একটা বউ, একটাই সন্তান। ওর নাম ধানসিঁড়ি। সব নিয়ে ভালোই আছি। আমার সন্তান যা ইচ্ছে তা-ই হবে, এ নিয়ে আমার কোনো ধরাবাধা নেই। আজকের যে মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান, তাঁরা কি ডাক্তার হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের কখনো বলবেন, চট্টগ্রামের ওই গাঁয়ে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দাও। তাঁরা ছেলেমেয়েদের নার্সিংহোমে মোটা অঙ্কের টাকা কামানোর জন্যই ডাক্তার বানাতে চান। সত্যিকার মানুষের যে বড়ই অভাব রয়ে গেছে। আমি প্রেম করেই বিয়ে করেছি। তবে ছিচকাদুনে প্রেম আমার কখনোই ভালো লাগে না। প্রোপোজ করো, ট্রিট দাও হরবোলা পাখির মতো রূপের প্রশংসা, আমার এসব ভালো লাগে না। অবশ্য আমার চেহারা-শরীরের যে আকৃতি, তাতে কোনো মেয়ে আমার দিকে ফিরে তাকাত না। পাত্তা পেতাম না। তখন গাইলাম, ‘যদি না ভালোবাসো তবে পরোয়া করি না…।’ ব্যস, আমার মতো খারাপ চেহারার ছেলেদের কাছে আমি আইকন হয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার হলো, মেয়েদের কাছেও প্রিয় হলাম। আসলে মেয়েরাও ওইসব ছেলেকে পছন্দ করে, যারা পাত্তা কম দেয়। আমার ওই গান ছিল একটা কৌশল। কেননা, আমিও এই জাতির ওপর দুর্বল! ছোটবেলায় প্রেম করেছি। দুজনেই স্কুলে পড়ি। সেই প্রেমেই ঝুলে গেলাম। আসলে প্রেম একটা সময়ের হাওয়া। একসময় হাওয়া ফুরিয়ে গেলে পড়ে থাকে শুধু দায়িত্ব ও দায়বোধ। বিরহই শ্রেষ্ঠ প্রেম। বিরহী প্রেমের কথা জীবনের শেষ দিনও মনে থাকে।
(কথাগুলো বলতে বলতে আগুন পাখি কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চেনা দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অন্য অচেনা অন্ধকারে।)
: বাংলাদেশেই আমার নাড়িপোঁতা। আমার পিতৃ ও মাতৃভূমি। বরিশালের ভান্ডারিয়ায়। আমার দাদু ভান্ডারিয়ার একটা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ভান্ডারিয়া থেকে মাটি এনে আমি আমার ড্রইংরুমে তুলে রেখেছি।
শোন, এই সীমান্ত, এই কাঁটাতার ভালো লাগে না। বাংলাদেশে এসে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গান করেছি। যেদিন ফিরে যাব, তার আগের রাতে ছিলাম সোনারগাঁও হোটেলে। সকালে ফ্লাইট। আগের রাতে অন্তত হাজারখানেক তরুণ-তরুণী হোটেলের বারান্দায় ভিড় করেছিল। সারারাত ওরা ছিল। আমি মাঝে মধ্যে নেমে ওদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছি। বিড়ি ফুকেছি। গালগপ্পে অন্যরকম সেই রাতটা কেটেছে। সবই স্বপ্নের মতো।
: তুমি যে আদর্শের কথা বলো, তা কি তোমার ভেতরের ব্যক্তিকেও ছুঁয়ে যায়?
: হ্যাঁ। এবার গাইলাম তারকা হোটেলে। দেখলাম আমার গান শুনে ওরা খুব মজা করছে। মনে হলো, অনেক কিছু নিচ্ছে গান থেকে, শিক্ষা-দীক্ষা…। আমি গান শেষ করলাম। শুরু হলো ডি জে। ওমা, যারা আমার গান শুনেছে, তারাই দেখি ওই উন্মাদনায় হাফপ্যান্ট পরে নাচা শুরু করল! এটা খুবই হুমকির কথা। আমি মানতে রাজি নই।
: তোমার নীলাঞ্জনা আমাদের কিশোর বুকেও সিম্ফনি তুলেছে। কিন্তু নীলাঞ্জনার আদ্যোপান্ত তুমি আজো বলনি। এইসব বিষয়ে তুমি এতো উদাসীন কেন?
: আপনার প্রথম প্রেম নীলাঞ্জনা। না, নীলাঞ্জনা নিয়ে আমি কখনো কোনো কথা বলিনি। আজও বলব না। রহস্যটা আমি কখনোই প্রকাশ করব না।
: গানেও তুমি নানা চরিত্রের ফাঁদ পেতেছো?
: ফাঁদ ! কি বলিস !
: হ্যাঁ, ফাঁদ তো বটেই। কোনো কিছুই তো পরিষ্কার করোনি। শুধু ধোঁয়াশা।
: হ্যাঁ, পৌলমিতে একটা ভাঙা সংসারের কথা বলেছি। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য যে একটি সম্পর্কের জন্য ভীষণ রকম দরকার, একটা সময়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। অনির্বাণ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। এটা একটা পলিটিক্যাল ক্যারেক্টার। নির্দিষ্ট কেউ না। আমি একটা সময় তুখোড় বাম রাজনীতি করতাম। অন্য রকম সময়। এখন পুরোটা বলতে পারব না। ওই সময়ে আমি আমার যেসব বন্ধুকে ছেড়ে এসেছি, আগুনপাখি হওয়ার অন্তরালে তারা আমার প্রেরণা। বলতে পারিস, এটা একটা আক্ষেপের গল্প। হারানো দিনের আক্ষেপ। নষ্টালজিয়া। আদিত্য সেন, আমার স্বপ্ন পুরুষ।
: তুমি পরিবতর্নের কথা বলো। পরিবর্তন কি আসবে?
: আসবেই। আমার দর্শন সংসদীয় গণতন্ত্রের রাস্তা নয়। আমি বিশ্বাস করি না যে এভাবে আমাদের মুক্তি আসবে। তুই বল, একটা পার্টি চলে কীভাবে? শিল্পপতির টাকায়। তাহলে তো ভোটে জিতে তাঁদের জন্যই কাজ করতে হবে। আর একটি কথা, পৃথিবীতে যদি এই মুহূর্তে শান্তি আনতে চাস, তাহলে সব রাজনীতিবিদকে মেরে ফেলতে হবে।
(আমি খানিকটা উত্তেজিত।)
: আগুনপাখি তোমার কি মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে?
: না। আমি যা বলছি, সত্যি বলছি। বলছি আমার বিশ্বাস থেকে।
: কিন্তু আগুনপাখি তুমি তো সেই চারু মজুমদারের নকশালবাড়ী আন্দোলনের পুরনো সুরই নতুন করে উচ্চারণ করছো। যে আন্দোলন সত্তরের দশকে হাজার হাজার তরুণকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলো। কিন্তু কি হয়েছে? পরিবর্তন তো হয়নি, উল্টো অসংখ্য প্রাণহানি আর আতœঘাত।
: শোন, পরিবর্তনের স্বপ্ন কখনো পুরনো হয় না। তা বারবার ফিরে আসে নতুন রূপে।
: তুমি রবীন্দ্রনাথকে উল্টে দিয়েছো… তার সুরকে তুমি ভিন্ন মেজাজে নিয়ে গিয়ে বিকৃতির পথে পা বাড়িয়েছো-এ অভিযোগ অস্বীকার করবে কিভাবে?

: আধুনিক যন্ত্র সহযোগে রবীন্দ্রসংগীত মানুষ তো গ্রহণ করেছে। আর বিতর্ক তো হবেই। এসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। যখন মানুষ সময় থেকে এগিয়ে কথা বলে, তখন বিতর্ক হয়। আমি অত কিছু চিন্তা করি না। আমার কাছে আপাত সত্য যেটা মনে হয়, আমি সেটা করি। আজকে রবি বেঁচে থাকলে তিনিও গিটার, ড্রাম সহযোগেই গাইতেন। ধ্রæব বলে কিছু নেই। সময়কে সাথে নিয়ে বদলাতে হবেই। সেটা কোন পথে, এটাই আসল কথা।
: ভারতের সব মানুষের হাততালি কি চাও তুমি? শাহরুখ খানের মতো?
: মুম্বাই নিয়ে আমার মোটেও আগ্রহ নেই। একদম না। মাঝেমাঝে অবশ্য খারাপ লাগে। মনের অন্ধকার জিজ্ঞেস করে-তুই বাংলা নিয়েই পড়ে রইলি, হিন্দীতে গেলে তো মহাভারতে তুলকালাম হতো। পরক্ষণে মন ভালো হয়ে যায়। আমি তো এখানেই ভালো আছি। হাততালির আওয়াজ তো সবখানে একই। বাংলায় আমি সবার বন্ধু। বিশ্বাস কর, আমি কোনো তারকা নই। এই যে এভাবে সেন্ডেল পরে, বিড়ি ফুকতে ফুকতে হেঁটে বেড়াই, আড্ডা মারি। ভালোই তো আছি। তা ছাড়া আমি খুব মুডি মানুষ। যখন ভালো লাগে কাজ করি, যখন লাগে না তখন করি না। অত নিয়ম করেও চলি না। একবার এআর রহমানের কল এসছিলো আমার ফোনে। মিসডকল হয়েছিলো। কিন্তু আমি আমার নতিজার কারণেই কলব্যাক করিনি। আমি অনির্বাণের বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। আমি শুধু বাংলার হয়েই থাকতে চাই। ধুলোমাখা মেঠোপথই আমার শেষ শয্যা হোক, এই সাধনাই তো করছি।
: তোমার বৃদ্ধাশ্রম গান তৈরির পর, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরির প্রবণতা বেড়ে গেছে। মানে, সহানুভূতি বেড়েছে, মূল্যবোধ বাড়েনি।
: ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি নিয়ে আমার নিজের প্রতিক্রিয়া বাজে। আমি যে অর্থে গেয়েছি, বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটি। মনে হলো করেছি আমি। বৃদ্ধাশ্রমে আসুন সবাই-এ টাইপের কিছু! একটা মজার কথা শুনুন। গানটি গাইবার কয়েক দিন পরে আমার এলাকার এক নেতা আমাকে নিয়ে গেলেন এক অনুষ্ঠানে। গিয়ে দেখি বৃদ্ধাশ্রমের উদ্বোধন। আমি তো রেগে অস্থির। ভেতরে ঢুকিনি। ওরা বলে, দাদা, আসবেন না? আমি বলি, আসব। যেদিন এই আশ্রম বন্ধ হবে, সেদিন আমি তালা মারতে আসবো।
: তুমি কি তোমার গানের মতো শতভাগ সৎ?
: না আমি সৎ নই। লোভী মানুষ। ষড়ঋপুর সব আমার মধ্যে আছে। নিজেকে চরিত্রবান দাবি করে ভণ্ড হতে চাই না।
(এরপর আগুনপাখির দীর্ঘ হাসি। গোঁফের ফাঁক দিয়ে হাসির রশ্মি ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। )
মঞ্চে তখন কেউ একজন গাইছে- যদি ভালোবাসো

এক.
ঢাকা ক্লাব। তাঁর অপেক্ষায়। আমি আর ভিডিও নির্মাতা সৈয়দ আলী আহসান লিটন। হিরক দা জানালেন, গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত জেগেছেন তিনি। তাই ঘুম থেকে উঠতে দেরি। ফ্রেশ হচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে নামবেন।
ঠিক তিরিশ মিনিট পরে এলেন।
আমার উচ্ছ¡াসভরা প্রশ্ন, দাদা কেমন আছো? দাদা বললেন, ‘এই বেশ ভালো আছি, তোদের চলছে কেমন?’
: হ্যাঁ, ভালোই চলছে দাদা।
এর মধ্যে কয়েকজন ফটোসাংবাদিক ঘিরে ধরেছেন তাকে। একের পর এক সেলুলয়েড ফিতায় বন্দি হচ্ছেন। অনেকে তার সঙ্গে গ্রুপ ছবিও তুলছেন।
: চলুন, দাদা। খানিকটা দেরিই হয়ে গেল। স্টুডিও’র শিফট অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।
: চল্ চল্।
কথা হচ্ছে নচিকেতা চক্রবর্তীকে নিয়ে। জীবনমুখী বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী। গাড়ি ড্রাইভ করছেন সৈয়দ আলী আহসান লিটন। নচি দা সামনের সিটে বসা। হিরক দা ও আমি পেছনে। নীরবতা ভাঙলেন নচিকেতা। বললেন, ‘এখন এখানে বাংলা গান কেমন হচ্ছে?’ গাড়ির সিডি প্লেয়ার অন করেন লিটন ভাই। ফুল ভলিউমে বাজতে লাগল, তোমার ছায়া পড়ে থাকে/আমার চোখের পথ ধরে/যখনই যাই ছুঁতে আমি/অচেনা দূরত্বে যায় সরে/ ছায়ার মাঝে বসত তোমার/তুমি ছায়ামানবী/তোমার জন্য উজাড় আমার রোদেলা পৃথিবী।
নচি দা বললেন, ‘বাহ্। অসাধারণ গান। কলকাতা ফেল।’

দুই.
কথার তুবড়ি উড়াতে উড়াতে আমরা পৌঁছলাম মগবাজারের অন্তরা স্টুডিওতে। স্টুডিও’র ফটো বোর্ডে বেশ কজন প্রয়াত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পীর ফটোগ্রাফ। রবীন্দ্র, নজরুল, ডিএল রায়, এসডি বর্মন, আরডি বর্মন থেকে শুরু করে মান্না দে। ছবিগুলো দেখে দাদা বললেন, কিরে আমার ছবি কই?
আমি বললাম, দাদা, উনারা সবাই প্রয়াত…শুনে হাসলেন নচিকেতা। বললেন, ও তাহলে আমাকেও মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
স্টুডিও প্রস্তুত। নচি দা গান গাইবেন আয় ভোর… শিরোনামের গান। কথা ও সুর আমারই । আর তানভীর তারেক ভাই করেছেন সংগীত পরিচালনা। কথাগুলো এরকম : আয় ভোর আয় ভোর/তোর জন্য এই স্বপ্ন দেখা/ তোকে পেলেই পাবো মুক্তির রেখা/তুই তো বলেছিলি অন্তরে অন্তরে/আসবে সোনালী সকাল/তোর জন্য হেঁটেছি কতদূর/তবে কেন এই বেড়াজাল/তোর জন্য কত আর/ কষ্টের হাহাকার/ভাঙিয়ে দে এই ঘুমঘোর/তোর ছোঁয়া পেয়ে উঠবে জেগে অগণিত সুপ্ত প্রাণ/তুই তো আছিস হয়ে বুকের ভেতর/স্বপ্নের নতুন নিশান/ তোর জন্য হৈচৈ/ আছিস বল কই/ভাঙিয়ে দে এই ঘুমঘোর।
গানটা শুনে নচিদা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
এরপর মুখ খুললেন। বললেন, অনেকদিন এই ধরনের গান শুনি না। অসাধারণ! দাদা, স্টুডিওতে ভয়েস দিলেন। তার কণ্ঠ বেয়ে বেরিয়ে এলো সুরের আগুন। আমরা ক’জন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাক্ষী হলাম ইতিহাসের।
হাতের কর গুণে ঠিক ৯০ দিন পর। নচিকেতা আবার এলেন ঢাকায়। সাভারের গল্ফক্লাবে আয়োজন করা হলো আয় ভোর গানের শুটিংয়ের। দৃষ্টিনন্দন লোকেশনে জিমিজিমির কারিশমায় সম্পন্ন গানগল্পের চলমান ছবি। এরপর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন জীবনমুখী গানের যুবরাজ। হরবোলা পাখির মতো তিনিই বলতে লাগলেন।
‘আমি সাধারণত নিজের গান নিজেই লিখি ও সুর করি। তরুণ কণ্ঠশিল্পী মানিক আমাকে দীর্ঘদিন থেকেই অনুরোধ করছিল তাঁঁর নতুন একটি গানে কণ্ঠ দেবার জন্য। ওকে বলেছিলাম, গানের কথা ও সুর মানসম্মত হলে অবশ্যই গাইব। কিন্তু সময়-সুযোগ হয়ে উঠছিল না। বাংলাদেশ সফরে এলে একদিন মানিক আমাকে ‘আয় ভোর’ গানটা শুনাল। দারুণ কথা ও অদ্ভুত সুন্দর সুরে আমি আবিষ্ট হয়ে যাই। এক বাক্যে বলে দিলাম, গানটি আমি করব। মানিক নিঃসন্দেহে ভালো গেয়েছে। ওর মধ্যে একটা আগুন আছে। ওই আগুনটা যখন প্রজ¦লিত হবে, তখন পুরো বাংলাদেশ ওর গানে মুগ্ধ হবে; এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমি বরাবরই তরুণদের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। যখন আমি সংগ্রাম করেছি, তখন অনেকেই আমাকে কোন সহযোগিতা করেনি। সেই যন্ত্রণা আমি বুঝি বলেই গান নিয়ে যারা সংগ্রাম ও সাধনা করে, সেইসব শিল্পীদের আমি স্যালুট করি। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো জীবনমুখী দ্বৈত গান গাইলাম। আউটডোরে গিয়ে ভিডিওতে অংশ নেয়াও এটি আমার জন্য প্রথম। হ্যাঁ.. দ্বৈত গান সাধারণত পুরুষ এবং নারী কণ্ঠশিল্পীর মধ্যে হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে আমি কবির সুমনসহ অনেকের সঙ্গে এ রকম গান করেছি। বাংলাদেশে এই প্রথম গাইলাম মানিকের সঙ্গে। ‘আয় ভোর’ এর মধ্য দিয়ে বাংলা গানে পুরুষে-পুরুষে দ্বৈত গান গাওয়ার একটা ট্রেন্ড চালু হোক, এটা আমি প্রত্যাশা করি। এ রকম গান হলে গানের বিষয়বস্তুর ভিন্নতা আসবে। ‘আয় ভোর’ গানে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করা। এটা প্রতীকী গান, প্রত্যাশার গান, আশাবাদী হওয়ার গান। প্রত্যেক মানুষই চায়, তার সকালটা, তার আগামী দিনগুলো যেন সুন্দর হয়। এই গানে সেই চাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। গানটিকে একেকজন একেক রকমভাবে নিতে পারে। অনেকটা আমার ঢংয়ের গান। বাংলাদেশে এমন গান খুব একটা হতে দেখি না। ‘আয় ভোর’য়ে যে ভোরকে আহ্বান করা হয়েছে, এটাকে কেউ প্রেমিকা হিসেবেও কল্পনা করতে পারে। গানটির কথা- সুর সাহিত্য ও শিল্পমান সমৃদ্ধ। মানিক যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। তানভীর তারেকের কম্পোজিশনও দারুণ হয়েছে। মোট কথা, এ রকম ভালো গান বারবার হয় না, হঠাৎ হঠাৎ হয়। ভিডিও’র কাজটি করেছে ইমন নামের একটা ছেলে। সব মিলিয়ে পুরো টিম ছিল পজেটিভ। ফলে একটা ভালো কাজ করতে পেরেছি। বাংলাদেশ হলো বাংলা গানের আঁতুড়ঘর। রুনা লায়লা জি’কে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। তিনি বাংলা গানকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আলাউদ্দিন আলীও আমার প্রিয়। তরুণদের মধ্যেও অনেকেই ভালো কাজ করছে। ভালো কাজগুলোর প্রচার এখানে কম হয় বলে আমার ধারণা। তবে এখানকার বাজার চলতি গানগুলো আমার ভালো লাগে না। সেগুলোতে তুমি-আমি ছাড়া আর কোন কিছুই পাওয়া যায় না। তবে, যাই বলি না কেন, বাংলা গানের ভবিষ্যত কিন্তু এখন বাংলাদেশের সংগীতজ্ঞদের উপরই নির্ভর করছে।’

তিন.
আরটিভির বেঙ্গল স্টুডিও। অনুষ্ঠানের নাম ‘বেস্ট অব নচিকেতা’। ১৩টা গান নিয়ে অনুষ্ঠান ।
দাদা বললেন, ‘দেখ বারবার জনপ্রিয় গানগুলোই আমি গাই। তবুও মনে রাখতে পারি না, ভুলে যাই। এটা একটা দুর্বলতা। আর আমি কিন্তু নিজে আমার গানগুলোর নাম ‘জীবনমুখী’ দিইনি। শ্রোতারাই নাম দিয়েছে ‘জীবনমুখী গান’। শুনতে ভালোই লাগে।
-দাদা, আপনি তো জীবনমুখী ধারার। কিন্তু বাংলাদেশে ‘মানুষমুখী’ নামের আরেকটা ধারা সচেতনভাবে তরুণরা শুরু করেছি- কথার মাহফিলে যোগ করলাম আমি।
নচিদা একটু ভিমরি খেলেন। এটা আবার কেমন?
আমি তখন খুলে দিলাম গানের নতুন ট্রেন্ড নিয়ে স্বপ্নের ঝাঁপি। দাদাকে জানাতে লাগলাম, মানুষমুখী গানের কনসেপ্ট।
‘মানুষের জন্যই তো সব। নীলচে আকাশ, অতলান্তিক সাগর, ঘন সবুজের নিবিড় বনভূমি, জলের কুমির, ডাঙ্গার ডোরাকাটা বাঘ অথবা রঙিন প্রজাপতি, ঘাস ফড়িং- সবকিছুই কেবল মানুষ ও মানবতার প্রয়োজনেই। সংস্কৃতির সবচেয়ে গতিময় মাধ্যম গান। তাহলে কেন সুরের সিম্ফনিতে থাকবে না মানষের যাপিত জীবনের এপিঠ-ওপিঠ? তার মানে কি! এখন যে গান হচ্ছে তাতে কি মানুষের প্রসঙ্গ নেই? উত্তরে বলবো, অবশ্যই আছে; কিন্তু অধিকাংশ গানে যে নেই, এটা তো রূপবতী নারীর মতো সত্য ।
মানুষমুখী গান হলো সেই ধরনের গান, যে গানে মানুষের উপলব্ধি, অনুভূতি, বিবেক ও বোধগুলো নিপুণ সুতীব্র সুষ্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলায় লিখেছেন, মরণরে তুহ মম শ্যাম সম। আবার পরিণত বয়সে তিনি বললেন, মরিতে চাহিনা এ সুন্দর ভুবনে। এটা তো জীবনবোধের উপলব্ধির পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান। মানুষের পক্ষে বাংলা সাহিত্যে এর চেয়ে স্মার্ট কথা আর কেউ বলতে পারেন নি।
গীতিকবিতার ধারায় নজরুল নিঃসন্দেহে প্রথম মানুষমুখী গানের সূচনা করেন। তিনি এত সহজ করে বললেন যে, চল চল চল ঊর্ধ গগণে বাজে মাদল নি¤েœ উতলা ধরণী তল… এখানে মূলত মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন। যদিও নজরুল কখনোই কোথাও মানুষমুখী গানের কথা উল্লেখ করেননি।
তারাশঙ্কর বললেন, কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে?
সুকান্তের ভাষায়, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ফররুখের এক গানে আছে, শুনি মৃত্যুর তুর্য নিনাদ ফারাক্কা বাঁধ। বাজনা ছাড়া খালি গলায় গান গেয়ে বিখ্যাত হওয়া প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গান এমন :
ঝিঙে ব্যাচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা/বন্ধু তোমার লাল টুকটুক স্বপ্ন ব্যাচোনা। জীবনবোধের কঠিন উপলব্ধি থেকেই বেরয়ে এসেছে এ কথাগুলো। এগুলোই মানুষমুখী বাণী। মানুষমুখী গানে মানুষের সব অনুসঙ্গই থাকবে; থাকবে প্রেম থাকবে প্রতিবাদ থাকবে দ্রোহ থাকবে স্রষ্টা প্রীতি কিন্তু তার উপস্থাপনা ভঙ্গি হবে আলাদা। এসব গানের বাণী তীব্রভাবে নাড়িয়ে দেবে মননকে।’
কথা শেষ না হতেই দাদা, চিৎকার করে উঠলেন-ওয়াও, ফাটিয়ে দিয়েছিস রে…

চার.
নচিকেতা অসম্ভব গজল অন্তঃপ্রাণ মানুষ। কৈশরে গানের হাতেখড়িটা তার গজল দিয়ে হয়েছিলো বলেই হয়ত!
‘গজল নিয়ে কিছু এক্সক্লুসিভ পরিকল্পনা আছে। আর যেভাবে চলছে চলুক না, ভালোই তো। এই বেশ ভালো আছি। ক’দিনই বা আর বাঁচব।’ দাদার খোলামেলা উইশ।
জানিয়ে রাখা ভালো যে, কিছুদিন আগে নচিকেতার ক্যানসার ধরা পড়ে। তবে আনন্দের কথা, ইতোমধ্যে সেই ক্যানসারের সাকসেসফুল অপারেশন হয়েছে।

পাঁচ.
সন্ধ্যায় আমরা ক’জন হাজির হলাম গুলশানের এক বাসায়। ঢাকা ক্লাব ছেড়ে নচি দা উঠেছেন ওই বাড়িতে।
দরজা খুলতেই তার দেখা।
: আরে, অবশেষে তোরা এলি!
: হ্যাঁ, দাদা।
ঘরভর্তি মানুষ। সাংবাদিক, শিল্পী, বহুজাতিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরাও আছেন।
: দাদা, আপনার দেশ তো আমাদের টিভি চ্যানেল দেখায় না!
: এটা খুব দুঃখজনক। আর আমি তো নিজেকে বাংলাদেশের মানুষ মনে করি। তোরা আমাকে রেখে দে, আমি থেকে যাই। আমার দাদার বাড়ি তো বরিশাল। ধানসিঁড়ি নদীর নামে আমি আমার একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছি। আমি এ টু জেড হুমায়ুন আহমেদ পড়েছি। আমি জানি বাংলাদেশটা কেমন। রুনা লায়লার গানের আমি অন্ধ ভক্ত। ইতোমধ্যে ঢাকা শহরকে নিয়ে আমি একটা গানও লিখে ফেলেছি। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সাথে আমার নাড়ীর যোগাযোগ। রাত বাড়ছে কথা চলছেই। একপর্যায়ে নচি দা বললেন, এবার তোরা যা। সমৃদ্ধ স্মৃতি নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়ালাম।

ছয়.
নচিকেতার ফিরতি ফ্লাইট ফাইনাল হয়ে গেছে। ফোন করলাম মুঠোফোনে।
: হ্যাঁ, আজ রাতে চলে যাচ্ছি।
: আসব? একটা নতুন গান করে দিতে হবে।
: আয় আয়…
দেরি না করে রওনা হলাম গুলশানে। নচিদা খানিকটা ক্লান্ত।
: তোরা বোস।
কাগজ-কলম নিয়ে চলে গেলেন। দশ মিনিট পর এলেন নতুন গান নিয়ে। গানটির নাম, ‘কলেজ লাইফ’। দাদা হারমোনিয়ম বাজিয়ে তাৎক্ষণিক সুর করলেন। তৈরি হলো চমৎকার একটি গান। স্থায়ী এবং প্রথম অন্তরাটা দিলেন তিনি। দাদা না লিখে দেয়ায় পরবর্তিতে দ্বিতীয় অন্তরা আমাকেই লিখতে হয়। একজন কিংবদন্তির একটি সৃজনশীল কাজের আঁতুড়ঘরের সাক্ষী হলাম আমরা। প্রথমবারের মতো গানটিতে তিনি বললেন, তাঁর কলেজ লাইফের বান্ধবী মোনাইয়ের কথা।
পুরো গানটা হলো :
আবার ইচ্ছে করে কলেজে যাই
সোনালী দিনগুলোকে কাছে পাই
ভুলবোনা ক্লাসেতে ঢুকতে
পরীক্ষাতে বসে টুকতে
ভুলবোনা গ্যাজাতে মিলে সবাই
ভুলবোনা কমন রুমে বসে
বেহিসেবি অঙ্ক কষে
স্বপ্ন বিলাসে গা ভাসাতে
পুঁজিবাদী রাজনীতি থেকে
সাম্যবাদী স্বপ্ন এঁকে
অবশেষে ফেরা সেই বাসাতে
ভুলবোনা এবার বলতে
একসাথে চলতে চলতে
আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ মোনাই
ভুলবোনা স্লোগান প্রতিবাদে
নতুনের স্বপ্ন সাধে
জেগে উঠতে ভীষণ সাহসে
চেনা অন্ধকার গলি থেকে
অচেনা মহাসমুদ্রে
একলা একা হেঁটে হেঁটে যেতে
ভুলবোনা এবার বলতে
একসাথে চলতে
আই হেইট ইউ আই হেইট ইউ মোনাই
: দাদা যাই তাহলে?
: যাই কেন? বারবার ফিরে আয়। ভালো থাকিস। মনে রাখিস, ভালো থাকতে পারাটাই বড় কথা। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। প্রবল প্রতিকূলেও হাল ছাড়বি না। দেখা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়