গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ফুটফুটি : মানজুর মুহাম্মদ > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমঝুপি গ্রামটি শহর থেকে অনেক দূরে। এখানে এখনো গরুর গাড়ি চলে। নদী পারাপারে নৌকাই একমাত্র ভরসা। গ্রামের উত্তরে কালা পাহাড়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে এক ঘন সবুজ বন। কী নেই এই বনে! হরেক রকম ফল-ফুলের গাছে বন ভর্তি। আছে শাল, সেগুন, গর্জন, মেহগনি, আম, আতা, জাম, জারুল, জামরুল, গাব, তাল, আকাশমনি, কদম, কৃষ্ণচূড়া, চাপা, বকুল, মেঘ, শিরিষ আরো কত গাছ! বনে অনেক পাখিরও বসবাস। ফিঙে, টুনটুনি, চড়–ই, বুলবুলি, সুইচোরা, কাঠ ময়ূর, শালিক, টিয়া, ছাতারে, নীলকণ্ঠ, ঈগল, মধুবাজ, শাহবাজ, ধনেশ, কাঠঠোকরা, সাপপাখি, কোয়েল, ময়না, দোয়েল আরো কত পাখি! এই বনের রাজা হলো ফটিক। ফটিক দরিদ্র মনু মাঝির দশ বছরের ছেলে। ফটিকের একটি বন্ধু দল আছে। যাদেরকে গ্রামের মানুষ ‘খুদে বিচ্ছুর দল’ বলে ডাকে। মায়া, নিশি, শরিফ, কানু, রাজন, সুজন, ভেদা, হারু ও পল্টু এই দলের সদস্য। সবার বয়স দশ থেকে চৌদ্দ বছরের মধ্যে। বনের সব পাখি ফটিকের বন্ধু। ফটিক পাখিদের ভাষা বুঝে। সে পাখিদের সাথে পাখির ভাষায় কথা বলে।
হেমন্তের মায়াবী সকাল। আমঝুপি গ্রামের দক্ষিণে রয়েছে নয়ন জুড়ানো বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ। রোদের সোনালি আলো মেখে ধানের মাঠটি আরো রূপবতী হয়ে উঠেছে হেমন্তের এই সকালে। কালো-পাহাড়ের দিক হতে উত্তরের হাওয়া বইছে। উত্তরের দুষ্টু হাওয়া সোনালি ধানের চূড়োকে কাতুকুতু দিয়ে যেন দূরে পালিয়ে যাচ্ছে। ওই কাতুকুতুয় ধানের গাছগুলো যেন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সেই হাসিতে ধানের মাঠে ওঠছে সোনালি ঢেউ। একঝাঁক ছোট্ট হলুদ পাখি গায়ে নরোম রোদ মেখে সোনালি ঢেউ খেলানো মাঠে মনের আনন্দে ওড়াউড়ি করছে। ওই ছোট্ট পাখিগুলো হলো আমঝুপি বনের অনন্য সুন্দর পাখি। তারা হলো- ফুটফুটি। ফুটফুটিরা ফটিকের সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ফটিককেও তারা অনেক বেশি ভালোবাসে। ফটিক গত শীতের শুরুতে একঝাঁক ফুটফুটির প্রাণ বাঁচিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল আমঝুপি গ্রামের ধানের মাঠে। তখন কৃষকরা মাঠের সব পাকা ধান কেটে নিয়ে গেছে। ফুটফুটিরা খালি মাঠে নাড়ার গোড়ায় পড়ে থাকা ঝরে পড়া ধান খেতে নেমেছিল মাঠে। তারা যেই মাঠে পা রাখল, অমনি তাদের পা মাঠে পেতে রাখা সূ²সুতোর জালে আটকে গেল। কেউ কেউ পা ছাড়িয়ে পালালো। অন্যরা পা ছাড়াতে যখন মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে, ঠিক তখনি শিকারি বালক মাছ ধরার ঝাঁকি জাল ফেলল তাদের উপর। উপর থেকে ঝাঁকি জালে সবাই আটকা পড়ল। ফটিক দূর থেকে এই দৃশ্য সেখানে দৌড়ে এলো। শিকারি বালককে ধমক দিয়ে সব ফুটফুটিকে জাল থেকে উদ্ধার করে আকাশে ছেড়ে দিল। সেই থেকে ফটফুটিরা ফটিকের অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়ল।
ফুটফুটিরা রোজ সকালে নিজেদের আড়ালে রেখে মোলায়েম সুরে গান করে। ফটিক সেই গান খুব পছন্দ করে। তাই ফটিক সবসময় ফুটফুটিদের মোলায়েম সুরে গান শুনতে কাক ডাকা ভোরে বনে আসে। চিকিক কিক্ চিক্কি… চিকিক কিক্ চিক্কি স্বরে মিষ্টি সুরের গান ফটিকের মন প্রাণ আকুল করে। কখনো সে হুইছো.. ছিক..ছিক..ছিক স্বরেও ডাকে। ফুটফুটিদের গায়ের রংও অনেক সুন্দর। তাদের মাথা গাঢ় ধূসর। মাথা থেকে ধূসর রং ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নেমেছে। পিঠ সোনালি। সোনালি পিঠেও ধূসর রঙের আবছা ভাব আছে। গলা ও বুকের অর্ধেকটা হালকা ধূসর, তারপরে আবছা সোনালি টান আছে বুকের মাঝ বরাবর পর্যন্ত। পেটের রং কী সুন্দর উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁটের রং ধূসর। ঠোঁট তীক্ষè ও শক্ত। লেজ যেখানে শুরু তার উপরের কিছুটা অংশ গাঢ় হলুদ। লেজের উপরিভাগের পালক সুরমা রঙের। ডানার পালকের রং কালো। ডানার কিছু পালকের কিনারায় হলুদ রঙের দারুণ কারুকাজ আছে।
ফটিক ফুটফুটিদের সৌন্দর্যের কারণে তাদের দিকে মুগ্ধ চোকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ফুটফুটিরা যখন উড়ন্ত পোকার পেছনে ছুটে, নিচ থেকে তা দেখতে ফটিক পাগলপারা হয়। ফুটফুটিদের উপর চোখ রেখে তাদের পেছনে দৌড়াতে থাকে। ফুটফুটিরা উড়ন্ত পোকার পেছনে বিদ্যুৎ বেগে উড়ে যায়। পোকা যত বড়ই চালাক হোক না কেন, পোকাটিকে ঠোঁটে চেপে ধরে গাছে নেমে আসবেই। কখনো যদি পোকা ধরতে না পারে, তখন তারা নিজের উপর ক্ষেপে গিয়ে নিজেকেই ‘জি..ট..ট..টট .. চায়র..রট..চিট..চিট..জিটট’ স্বরে গাল মন্দ করতে থাকে। মেজাজ বিগড়ালে ও শত্রæ দেখলে তারা এমন করেই আওয়াজ করে। গাছে বসে ছুটন্ত সাপ দেখলে তারা চাপাস্বরে শিস বাজায়। সাপটি যতক্ষণ চোখে দেখা যাবে ততক্ষণ তারা ওই চাপাস্বরে শিস বাজাতে থাকবে।
ফুটফুটিদের বাসা চায়ের ছোট কাপের মতো। লতাপাতা, মিহি ঘাস তাদের বাসার প্রধান উপকরণ। চিকন দুই বা তিনটি ডালের ভেতর তারা বাসা বানায়। বাসা বানানোর জন্য তারা পছন্দ করে অন্ধকার ছায়া ছায়া জায়গা। ফটিক ফুটফুটিদের বাসাগুলো দেখে দেখে রাখে। ফটিক জানে বনের কোথায় কোথায় তাদের বাসা আছে। ফুটফুটিদের বাচ্চারা খুব দুষ্টু হয়। বাসায় বসে সারাক্ষণই দুষ্টুমি করে। ফটিক ফুটফুটিদের বাচ্চাদের দুষ্টুমি দেখতে ভীষণ পছন্দ করে। সে গোপনে বাসার কাছে গিয়ে মন ভরে তাদের দুষ্টুমি দেখে। ফুটফুটিরা খুব সাহসী, বুদ্ধিমান ও চতুর পাখি। ওদের বাসার কাছে কোনো বন্যপ্রাণী বা মানুষ গেলে ওরা খুব রেগে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে। তখন ওরা ডাইভ মেরে শত্রæর মাথায় তীক্ষè ও শক্ত ঠোঁটের ঠোকর বসায়। নখ চালায়। শুধু ফটিককে ওরা ভালোবাসে বলে কিছু করে না। বরং ফটিক তাদের বাসার কাছে গেলে ওরা খুশি হয়ে উড়ে এসে তার মাথায় কাঁধে হাতে বসে খেলায় মাতে। ফুটফুটিদের একজন সর্দার আছে। সর্দারের দেহ সবার চেয়ে ছোট। কিন্তু সবার চেয়ে ওর বুদ্ধি বেশি বলে ফুটফুটিরা ওকে সর্দার বানিয়েছে। ফুটফুটিদের বিশ্বাস হলো, সর্দারের শক্তির চেয়েও বুদ্ধি বেশি জরুরি। সর্দারকে ফটিক ফুটুস বলে ডাকে। ফটিকের দেয়া এই নামটি সর্দারের খুব পছন্দ। সর্দার ফটিকের জন্য পাগল। ফটিক বনে ঢুকে ফুটুস বলে ডাক দিলেই সর্দার মুহূর্তে তার কাছে উড়ে আসে। ফুটফুটিদের আর একটি নাম আছে, তা হলো- হলুদ চটক। ফুটফুটিরা আমঝুপি বনের ফুল, ফল ও গাছের পরম বন্ধু। তারা ফুল, ফল, গাছকে ছন্দে ছন্দে গান শোনায়। হলুদ আবির ছড়িয়ে উড়ে উড়ে নেচে-গেয়ে বন মাতিয়ে রাখে।
বনের সব গাছও ফটিকের বন্ধু। ফটিক গাছেদের সাথেও কথা বলে। গাছের গায়ে কান পেতে নীরবে শুনে গাছ কী বলছে তা। ফটিকের বন্ধুরাও বনের সব গাছ ও পাখির বন্ধু। ফটিক বনের নাম দিয়েছে গল্প-পাখির বন। গল্প-পাখি বনের গাছেরা যেমন এই ছোট ছোট শিশুদের ভালোবাসে, তেমনি পাখিরাও ভালোবাসে। গাছেরা কথা বলতে পারে না। কিন্তু শিশুরা যখন বনে এসে তাদের জড়িয়ে ধরে, তখন গাছেরা তাদের পাতা দিয়ে এই শিশুগুলোর মুখে আদর দেয়। ডাল দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাদের। শিশুদের আদর দেয়ার সময় গাছেদের প্রাণ হেসে ওঠে। গাছেরা ফল-ফুল-পাতা-বাকলের গন্ধ ছড়িয়ে তাদের কাছে ডেকে নেয়। গাছেদের সন্তান, নাতিপুতি ছোট ছোট চারা গাছরাও এসব শিশুর সাথে খেলে। শিশুরা বনে এলে পাখিরাও গান শুরু করে সুরেলা কণ্ঠে। খুদে বিচ্ছুর দল যখনি বনে ঢুকে তখনি সেকি হৈ চৈ! আনন্দ উচ্ছ¡াস! সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে মনের খুশিতে। পাখিরা ছোট ছোট সোনামনিদের আশপাশে ঘুরে ঘুরে গান গায়। কখনো তাদের কাঁধে মাথায় চড়ে বসে। শিশু ও পাখিরা মিলে বনের গহিনে গিয়ে লুকোচুরি খেলে। শিশুদের ক্ষিদে পেলে পাখিরা গাছ থেকে মিষ্টি পাকা ফল পেড়ে দেয়। শিশুরা প্রজাপতি ফড়িংয়েরও বন্ধু। শিশুদের আওয়াজ শুনলে বনের আশপাশের মাঠ থেকে শত শত ফড়িং বনের দিকে উড়ে আসে। শিশুরা ফড়িংদের নিয়ে শক্তি পরীক্ষা খেলা খেলে। তারা সুতোর একপ্রান্ত ফড়িংয়ের লেজে বাঁধে আর অন্যপ্রান্তে ছোট বড় ফুল বেঁধে দেয়। যেই ফড়িং সবচেয়ে বড় ফুল নিয়ে উড়তে পারে, ওই ফড়িংকে শিশুরা পাহলোয়ান ঘোষণা দেয়। শিশুদের হতে ‘পাহলোয়ান’ উপাধি পেতে ফড়িংরা মরিয়া হয়ে ফুলসহ উড়তে চেষ্টা করে। ফুল নিয়ে ফড়িংদের ওড়ার প্রতিযোগিতা দেখে পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং ও শিশুরা হেসে লুটোপুটি খায়। সব খেলার শেষে বসে গল্পের আসর। এক একদিন এক এক পাখি গল্প বলে। শিশুদের সাথে প্রজাপতি ফড়িংরাও পাখির গল্প শুনে। দুঃখের গল্পে সবার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। সুখের গল্পে সবাই হেসে গড়া গড়ি দেয়।
বনের মালিক বাবুল শেঠ একদিন বনের সবগুলো গাছ একজনের কাছে বিক্রি করে দিল। তাই গল্প-পাখির বনে মহাবিপদ নেমে এলো। বনের গাছ বিক্রির বিষয়ে খুদে বিচ্ছুর দল কিছুই জানে না। তারা শুধু ধনেশ পাখির কাছে শুনেছে যে, সামনের শুক্রবার বনের মালিক সব গাছ কেটে নিয়ে যাবে। এই কথা শোনার পর শিশুদের মন ভেঙে গেল। তারা খুব দুঃখ পেল। প্রাণপ্রিয় বন্ধু-বনের গাছ বাঁচানোর জন্য শিশুরা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। খুদে বিচ্ছুর দলের অন্যতম সদস্য পল্টু অনেক ধরনের প্রাণী ও পাখির ডাক জানে। সে বাঘের ডাক যেমন জানে তেমনি জানে হাতি, সিংহ, বানর এবং ভালুকের ডাক। পল্টু ময়না, কোয়েল, ঘুঘু, টিয়ে ও সারসের ডাকও দিতে পারে। ফটিক বনের বন্ধু-গাছগুলেকে বাঁচাতে পল্টু ও অন্যদের নিয়ে ফন্দি করে। ফটিকরা ঠিক করল- আগামী শুক্রবার যখন বনের গাছ কাটতে কাঠুরিয়ারা আসবে, তখন তাদের কঠিন ভয় দেখাবে তারা। পল্টু নানান ভয়ংকর প্রাণীর ডাক নকল করে বনের ভেতর থেকে ডাকতে থাকবে। ফটিক বলল- আমরা শুক্রবারে খুব সকালে এসে বনে অবস্থান নেব। কাঠুরিয়ারা যখন বনের কাছাকাছি আসবে তখন আমরা সবাই বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করতে করতে পালাতে থাকবো। আমরা যখন পালাতে থাকবো তখন পল্টু বাঘের মতো গর্জন করতে থাকবে। পল্টু একটি কাগজের চুঙ্গা বানিয়ে নেবে, যাতে আওয়াজ বড় হয়। কাঠুরিয়ারা আমাদের পালানো দেখে এবং পল্টুর কণ্ঠে বাঘের গর্জন শুনে ভয় পেয়ে নিশ্চিত পালিয়ে যাবে। ফটিকরা যখন বন বাঁচাতে এই সব ফন্দি করছে তখন ফটিকের প্রিয় ফুটফুটিরা দল বেঁধে ফটিকের কাছে এলো। সর্দার ফুটুস ফটিককে বলল, ফটিক চিন্তা করো না, আমরা সবাই তোমার দলের সাথে আছি। বাবুল শেঠ ও তার মানুষদের বনে ঢোকার সময় আমরাও সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেব। ফটিক ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, বাহ্-রে পাহলোয়ান আমার। খুব খুশি হলাম ফুটুস। তুমি সত্যি অনেক সাহসী। ফুটুস তার ছোট্ট বুক ফুলিয়ে বলল, ফুটফুটিরা সবসময় সাহসী পাখি। তার কথা শুনে সবাই হেসে দিল।
‘শুক্রবার খুব সকাল সকাল খুদে বিচ্ছুর দল বনে এল। তারা বনের ভেতর লুকিয়ে রইল। পুবাকাশের সূর্য যখন পরিপূর্ণভাবে আলো ছড়াতে শুরু করল, তখন কাঠুরিয়ার দলকে বনের অদূরে দেখা গেল। তারা কাঁধে করাত কুড়াল নিয়ে বনের দিকে আসছে। কাঠুরিয়ার দল কাছাকাছি এলে পরিকল্পনা মতো পল্টু বনের ভেতর থেকে কাগজের চুঙ্গায় বাঘের মতো গর্জন করতে লাগল। শিশুরা এক সাথে বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করতে করতে বন থেকে বেরিয়ে এসে ঊর্ধ্ব শ্বাসে দৌড়াতে লাগল। কাঠুরিয়ারা এই দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গেল। তারা শিশুদের জিজ্ঞেস করলো, কোথায় বাঘ? শিশুরা দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগল, বাঘ বনে, বাঘ বনে। কাঠুরিয়ারা পড়িমড়ি করে শিশুদের সাথে পালাতে লাগল।
বনের মালিক বাবুল শেঠ এই কথা শুনে খুব অবাক হলেন। তার জানা মতে পলাশ বনে বাঘ নেই। পরবর্তী শুক্রবার বনের গাছ কাটার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আরেক দল কাঠুরিয়া ঠিক করলেন। পরবর্তী শুক্রবারও খুদে বিচ্ছুর দল একই কাজ করবে বলে ঠিক করল। তবে এবার তারা বাঘের পরিবর্তে পাগলা হাতি বলবে। কাঠুরিয়ারা যখন বনের কাছাকাছি এলো, তখন খুদে বিচ্ছুর দল পাগলা হাতি, পাগলা হাতি বলে দিদ্বিদিক পালাতে লাগলো। শিশুরা ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, পালাও পালাও, ওই যে পাগলা হাতি আসছে, তোমাদের পায়ে পিষে মারবে। কাঠুরিয়ারা ছুটন্ত শিশুদের উদ্দেশে বলল, বনে বাঘ আছে শুনেছি, হাতি কোত্থেকে এলো! হাতি হাতি বলে আমাদের ভয় লাগাচ্ছো! তোমরা কি আমাদের পাগল পেয়ছ! এই বলে শিশুদের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বনের দিকে তারা এগোতে লাগল। শিশুরা কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল। কাঠুরিয়ারা ভয় না পাওয়াতে তারা ভীষণ হতাশ হলো। তারা ভাবল, আজ বনের রক্ষা নেই। বনের সব গাছ আজ কেটে নিয়ে যাবে এই কাঠুরিয়ারা। কাঠুরিয়ারা যখন বনের ভেতর পা রাখল বনের ভেতর পল্টু কাগজের চুঙ্গায় একের পর এক হাতির আওয়াজ তুলল। পল্টু যখন হাতির আওয়াজ দিতে লাগলো, তখন গাছগুলো নড়ে চড়ে উঠতে লাগলো। এতে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, মনে হচ্ছে বনের ভেতর থেকে গাছ-বন কাঁপিয়ে পাগলা হাতি আসছে। হাতির আওয়াজ শুনে এবং বনের গাছগুলোর অসম্ভব কম্পন দেখে কাঠুরিয়ারা ভাবল, সত্যি সত্যি বনে পাগলা হাতি আছে। পাগলা হাতি ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। এক্ষুনি হাতি তার ইয়া বড় পা দিয়ে পিষে মারবে। কাঠুরিয়ারা প্রচণ্ড ভয় পেল। তারা পড়ি মরি করে পালাতে লাগল।
এই ঘটনার পর বনের মালিক বাবুল শেঠ ক্ষেপে গেলেন। তিনি আবারো কাঠুরিয়ার আরেকটি নতুন দল ঠিক করলেন। তারা পরবর্তী শুক্রবারে বনের গাছ কাটতে যাবে। এবারো খুদে বিচ্ছুর দল ঠিক করল শুক্রবার সবাই খুব সকালে বনে আসবে। ঠিক হলো কাঠুরিয়ারা বনের কাছাকছি এলে আগের মতোই শিশুরা বন থেকে পালাবে। তবে বন থেকে পালানোর সময় তারা সিংহ সিংহ বলে চিৎকার করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবারে সবাই খুব ভোরে বনে চলে এলো। তারা বনের ভেতর ওঁৎ পেতে রইল। যখন কাঠুরিয়ারা বনের কাছাকাছি এলো, শিশুরা সিংহ সিংহ বলে পালাতে লাগল। এবারের কাঠুরিয়ারা অনেক বেশি সাহসী। তারা শিশুদের পালানোকে আমল দিল না। শিশুদের কথা তারা হেসে উড়িয়ে দিল। তারা বলল, একবার বাঘে দৌড়াইছে, আর একবার হাতি দৌড়াইছে এবার সিংহ দৌড়াচ্ছে। দেখি বনের ভেতর কী আছে। তারা খুব সাহস নিয়ে বনে ঢুকলো। ওইদিকে পল্টু যথারীতি কাগজের চুঙ্গায় সিংহের আওয়াজ তুলতে লাগল। এবার বনের পাখিরা পল্টুর সিংহের আওয়াজের সাথে সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিল। পাখিরা দিগি¦দিক ছুটোছুটি করতে লাগল এবং গাছগুলো প্রচণ্ড রকম দুলতে লাগল। গাছগুলোর ভীষণ দোলা এবং পাখিদের অসম্ভব রকম চেঁচামেচিতে কাঠুরিয়া খুব ভয় পেল। তারা দিশাহারা হয়ে ভয়ে পালাতে লাগল। এভাবে কাঠুরিয়াদের তৃতীয় দলও পালিয়ে গেল।
বনের মালিক বাবুল শেঠ খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। রেগে-মেগে নিজেই একদিন বনে গেলেন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে। বন্ধুদের হাতে বাঘ মারার বন্দুক। শিশুরা তখন সেখানে ছিল না। পলাশ বন ছিল একদম শান্ত। বনে কেউ নেই। পাখিরাও যে যার মতো করে আহার সংগ্রহ করতে বাইরে গেছে। মালিক ও তার বন্ধুদের শুধু গাছেরা দেখলো আর পাখির ছানারা দেখলো। পাখির ছানারা চিন্তায় পড়ে গেল। ঘরে মা বাবা নেই। লোকগুলো যদি তাদের ধরে নিয়ে যায়! যদি তারা গুলি করে দেয়! মালিকের বন্ধু দুইজন আনন্দ চিৎকার দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ল আকাশের দিকে। গুলিতে বনের নীরবতা ভেঙে খান খান হল। গুলিতে গাছের কিছু পাতা ঝরে পড়ল শুধু। কোনো বন্য প্রাণীর আওয়াজ শোনা গেল না। পুরো বনের এমন নীরবতা দেখে মালিকের বন্ধুরা হো হো করে হাসতে লাগল। তারা মালিককে বলল- বন্ধু এখানে বাঘ, হাতি, সিংহ দূরে থাক ওদের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সর্দার ফুটুস ফটফুটিদের দল নিয়ে একটু দূরে গাছের ডাল পাতার আড়াল থেকে সব দেখছিল। বনের মালিক বাবুল শেঠের বন্ধুদের শূন্যে গুলি ছোড়ায় তার খুব রাগ হলো। সে তখনি সিদ্ধান্ত নিল, তাদের বনে ঢোকার মজা দেখাবে। মালিকের বন্ধুরা যখন হো হো করে হাসছে, ঠিক তখনি ফুটুসের নির্দেশে সদলবলে ফুটফুটিরা ডাইভ মেরে বাবুল শেঠ ও তার বন্ধুদের মাথার উপর ঠোকর মারতে লাগল। কেউ কেউ ছোট্ট নখর দিয়ে তাদের নাখ-মুখ খামছে দিল। বাবুল শেঠ ও তার বন্ধুরা মাথার উপর হাত নেড়ে ফুটফুটিদের আক্রমণ ঠেকাতে ঠেকাতে দৌড়ে বনের বাইরে চলে এলো। বনের মালিকের এমন পলায়ন দেখে সবাই হেসে একজন অন্য জনের গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল।
বনের মালিক ঠিক করলেন, পরের শুক্রবার কাঠুরিয়াদের নিয়ে তিনি নিজেই বাগানে গাছ কাটতে যাবেন। এই কথা যখন খুদে বিচ্ছুর দল জানল, তখন পল্টু ঠিক করল বনের মালিককে এবার ভয় লাগাতে হবে। বনের মালিক ভয় পেলে আর কখনো বন মুখো হবেন না। পল্টু খোঁজ নিয়ে জনল, বনের মালিক ভূতকে প্রচণ্ড ভয় পায়। পল্টু সবাইকে বলে দিল- তোমরা সবাই খুব ভোরে বনে চলে আসবে। এবার কানু, রাজন, সুজন আর আমি গাছের পাতা পুরো শরীরে জড়িয়ে গাছ ভূত সাজবো। বনের কাছাকাছি মালিক ও কাঠুরিয়ারা আসলে মায়া, নিশি, শরিফ, ভেদা আগের মতো বন থেকে পালাবে। এবার পালানোর সময় ভূত গাছ ভূত গাছ বলবে সবাই।
আজ শুক্রবার। খুদে বিচ্ছুর দল খুব সকালে বনে চলে এসেছে। বনের মালিককে ভয় লাগাতে পল্টুর পরিকল্পনা মতো সবাই প্রস্তুত। কানু, রাজন, সুজন আর পল্টু পুরো শরীরে গাছের পাতা জড়িয়ে নিয়ে বনের ভেতর অবস্থান নিয়েছে। মায়া, নিশি, শরিফ, ভেদা বনের কাছে মালিক বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়াদের জন্য অপেক্ষা করছে। সূর্যের আলোয় চারদিক পুরোপুরি ফর্সা হয়ে উঠেছে। মায়া বলল- ওই দেখ দেখ, মালিক ও কাঠুরিয়ারা আসছে। মায়ার কথায় নিশি, শরিফ, ভেদাও তাকাল। অনেক দূরে কিছু লোককে বনের দিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। লোকগুলো আরো কাছে আসলে বুঝা গেল, মালিক বাবুল শেঠ সাদা ধুতি পরে আগে আগে আসছে। আর তার পেছনে করাত কুড়াল কাঁধে একদল কাঠুরিয়ারা আসছে। সবার মাথায় হেলমেট পরা আছে। মালিক ও কাঠুরিয়ারা যখন বনের কাছাকাছি এলো তখন মায়া, নিশি, শরিফ, ভেদা গাছ ভূত, গাছ ভূত, পালাও পালাও, গাছ ভূত, গাছ ভূত বলে ঊর্ধ্ব শ্বাসে পালাতে লাগল। ছুটন্ত শিশুদের দেখে বনের মালিক বাবুল শেঠ তাদের দিকে তেড়ে এলেন। শিশুরা যে যেদিকে পারল পালাল। শিশুদের ধরতে না পেরে বাবুল শেঠ রাগে গর গর করতে করতে বনের দিকে এগুতে লাগলেন। বাবুল শেঠ রেগে মেগে বলতে লাগলেন- হতচ্ছাড়ার দল, ধরতে পারলে পিঠের চামড়া তুলে নেব তোদের।
বাবুল শেঠের সাথে কাঠুরিয়ারা বুক চিতিয়ে বনে ঢুকে পড়ল। বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়াদের মাথায় হেলমেট দেখে ফুটফুটিরা বুঝল, তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তারা হেলমেট পরেছে আজ। তারা এতে খুব মজা পেল। ফুটুস সবাইকে নির্দেশ দিল, আজ হেলমেটওয়ালাদের নাক-মুখ আর চোখ টার্গেট করতে হবে। ফুটফুটিরা সবাই হেসে দিয়ে সমস্বরে বলল, জি সর্দার, আমরা তাই করবো। বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়ারা বনে ঢুকার সাথে সাথে গাছগুলো ভীষণ দুলতে লাগল। সারা শরীরে গাছের পাতা জড়ানো কানু, রাজন, সুজন আর পল্টু খাঁও.. মাঁও.. খাঁও.. বনের শত্রæদের খাঁও.. বলতে বলতে বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়াদের দিকে দৌড়ে আসতে লাগল। ঠিক তখন ফুটফুটিরা ফুটুসের নেতৃত্বে সদল বলে ডাইভ মেরে বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়াদের নাক-মুখ-চোখে খামছি ও ঠোকর দিতে লাগল। ভূতের আওয়াজ তুলে তুলে জীবন্ত গাছের এমন দৌড়ে গায়ের দিকে আসতে দেখে এবং ছোট্ট হলুদ পাখির এমন ঠোকর ও খামছিতে বনের মালিক বাবুল শেঠ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বাবা গো.. মা গো.. গাছ ভূত.. গাছ ভূত বলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে দৌড়াতে বন থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাঠুরিয়ারাও গাছ ভূতের ভয়ে যে যেদিকে পারল বন থেকে পালিয়ে গেল। মায়া, নিশি, শরিফ, ভেদা বাবুল শেঠ থেকে পালিয়ে বেঁচে বনের অদূরে লেবু ঝোপের ভেতর লুকিয়েছিল। সেখান থেকে তারা বনের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবুল শেঠ ও কাঠুরিয়ারা প্রাণ বাঁচাতে পড়ি মরি করে বন থেকে পালাতে দেখে তারা নেবু বনে হেসে লুটোপুটি খেল। বনের মালিক ও কাঠুরিয়ারা পালিয়ে যাওয়ার পর সবাই বনের ভেতর একত্রিত হলো। ফটিক ফুটুসকে হাতের তালুতে নিয়ে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, সত্যি তুই গল্প-পাখি বনের পাহলোয়ান। আজ থেকে তোর নাম ফুটুস-পাহলোয়ান। সবাই চিৎকার করে বলে উঠল, ফুটুস-পাহলোয়ান… ফুটুস-পাহলোয়ান। ফুটফুটিরা এতে খুব আনন্দ ও গর্ববোধ করল। তারা ছোট্ট বুকটি ফুলিয়ে বীর দর্পে উড়ে উড়ে বলতে লাগল, আমরা গল্প-পাখি বন রক্ষায় সবসময় নিজেদের প্রস্তুত রাখব। আনন্দে প্রজাপতি ফড়িং পাখিরা হাত তালি দিল। গাছেরা পাতায় পাতায় খুশিতে শিস তুলল। তারপর বন বাঁচানোর সুখে সবাই প্রাণ খুলে হাসতে লাগল, নাচতে লাগল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়