গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

এক জীবনে : হাফিজ রহমান > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অবসরের পর মাত্র পাঁচটা বছর, এরই মাঝে অধ্যাপক আশরাফ সাহেবের জীবন একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে উঠবে এটা তিনি ভাবতে পারেননি। মনে হয় আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীটা ক্রমশ যেন অসীম নীরবতায় বদলে গেছে। একটা অতীব মূল্যবান জীবন বহু ব্যবহারে ক্রমে ক্রমে মূল্যহীন হয়ে উঠেছে। মনে হয় একটা ভারী পাথর তার মনটাকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে।
বয়স তাকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। দিয়েছে সতর্কবাণী। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে একটা অদৃশ্য সুতো, তার মনে হয় তিনি সুতোটা ছুঁয়ে ফেলেছেন। কর্মজীবন যেমন তাকে অবসর দিয়েছে, মহাজগতও তেমনি শুনিয়েছে অবসরের বাণী। যতই বার্ধক্য আসে, ততই একটা অজানা ভয় ভর করে। সারাজীবনের সযতœ ভালোবাসায় গড়া একটা সংসারের সর্ব্বোচ্চ সুখের মাঝেও যেন বিষাদের কালোছায়া মনের ওপর উড়ে যায়। মনে হয় এই জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই পালিয়ে যাই। সুখের কি নির্দিষ্ট কোনো সীমা আছে? নেই বরং সুখের পরে দুঃখ থাকাটাই স্বাভাবিক। সুস্থ-সুন্দর জীবনের শেষে রোগ-শোক জ¦রা আসাটাই স্বাভাবিক। তাই অনেক কষ্ট সয়ে গড়ে তোলা সুখের এই সংসার থাকতেই এই জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা তাগিদ সবসময় অনুভব করেন। সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে থাকতে চলে গেলেই ভালো। আশরাফ ভাবেন, সামনে তেমন একটা সময় আসছে তার। তাছাড়া মনে হয় পৃথিবীর সব কাজ শেষ করে বসে আছেন। যেন অতিথির বাড়ি থেকে ফিরে যাবেন আপন আলয়ে! অপেক্ষা ছাড়া তার এখন কোনো কাজ নেই। নিজেকে মনে হয় অপাঙ্ক্তেয়। মনে হয় কবি জীবনানন্দের কবিতার কথা-
কখন জন্মেছি, কখন শেষ হয়ে গেলাম,
কেউ খবর রাখে না
পৃথিবীর একগুচ্ছ মৃত ঘাসের মতো ;
একদিন সবুজ ছিলাম,
এই আনন্দ নিয়ে হারিয়ে যেতে হবে
আশরাফ সাহেব ভাবেন, তারও সেই সময় এসে গেছে। অযথা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে বেঁচে থাকা খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার। তিনি উপলব্ধি করেন, পালাতে হবে, যেমন করেই হোক, এই মায়ার ভুবন ছেড়ে পালাতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে যে পলায়নপর মনটা পথ খুঁজে পায়নি, আজ চরম একাকিত্বের মাঝে মন বিদ্রোহ করে ওঠে, বারবার বলতে থাকে- পালাও, পালাও, এই মায়ার ভুবন ছেড়ে পালিয়ে যাও।

জীবনের সবগুলো ধাপ সাফল্যের সাথে শেষ করেছেন অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ। তিনি জানেন, নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই। তার ভাবনায় জীবন হলো একটা অচেনা পথের ভ্রমণ, আগে থাকতে তার কিছুই জানা যাবে না। সে ভ্রমণে কেউ শুরুতেই আবার কেউ মাঝপথেই থেমে যায়। সেই ভ্রমণের মাঝেই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশে থাকে। সেই সাথে তার আশপাশে ভ্রমণরত আরও অসংখ্য জীবনের সংশ্রব। তার মাঝেই কাছের কিছু সম্পর্ক, তাদের সুখ-দুঃখও স্পর্শ করে। সম্পর্কগুলোর নামও থাকে- পিতামাতা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি, বন্ধু-বান্ধব আরও অনেক সম্পর্কের মায়াজালে বাঁধা থাকে প্রতিটি একক জীবনের ভ্রমণ। এসব সম্পর্কের সাথে জড়িয়েই বয়ে যায় একটা জীবনপ্রবাহ। সেই সাথে থাকে অবশ্যপালনীয় কিছু কাজ। কাজ ছাড়া একটি জীবন যেন মরা নদীর মতো, একদিন স্থবিরতায় থেমে যায়।
তার কর্মজীবন শেষ হওয়ার আগে আগেই অবশ্য তার দুই সন্তানই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ছেলে বায়েজিদ এখন আমেরিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিসিএস দিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল বিসিএস করে সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু তা হয়নি। মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু ওর চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্র ছিল তাদের দুজনের হয়েছে। বায়েজিদের কষ্টটা এখানেই। কী আর্তনাদ তার! বারবার বলে মুহিবের হয়েছে, আমার হলো না! অথচ বরাবরই মুহিবের চেয়ে ভালো রেজাল্ট তার। পিতা হয়ে সন্তানের স্বপ্নভঙ্গ দেখা যায় না। কতগুলো দিন নিদ্রাহীন অনাহারে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল সে। সন্তানের অমঙ্গল চিন্তায় তারা দুজনও সবসময় ভয়ে-ভয়ে থাকতেন। এ যুগের ছেলে, যদি রাগের বশে আত্মহত্যা করে বসে! অনেক বুঝিয়ে কোনোক্রমে একটু সুস্থ হতেই সে ঘোষণা দেয়, আমি আমেরিকা যাবো। নিজের চেষ্টায় সে নিউইয়র্কের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। সেখানে এক বাঙালি মেয়ে লুবনার সাথে পরিচয় হয়। ওদের পরিবার আমেরিকার বাসিন্দা। পরিচয় থেকে ভালো লাগা, তারপর ছয় মাসের মাথায় লুবনার পরিবার থেকে প্রস্তাব আসে, দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়। বিয়ের পর নিয়মমতো আবেদন করলে কোর্স শেষ করার আগেই গ্রিন কার্ড পেয়ে যায়। দুজনেই চাকরি করে। তাদের একটা সন্তানও হয়েছে। বলতে গেলে আগের সেই কষ্টবোধ নেই। বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। কষ্ট শুধু একটাই, বাবা মাকে ছেড়ে, দেশ ছেড়ে বিদেশে পরে থাকা। সেই কষ্ট আশরাফকেও কাঁদায়। তার ভেতরটা বিরান মরুভূমি হয়ে যায়। তারপর একদিন শৈলীও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতেই একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, পরিবারে শুধু মা, তাকে নিয়েই মেলবোর্ন থাকে। অত্যন্ত ভালো ছেলে, অতএব দ্রুতই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। একমাত্র বোনের বিয়ে, তাই বায়েজিদও বিয়ের আগে আসে।
তিল তিল ¯েœহ দিয়ে সন্তানকে গড়ে তোলে বাবা মা। কিন্তু সেই সন্তান যখন পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে, তখন বজ্রাদীর্ণ বৃক্ষের মতো মন ভেঙে যায়। আশরাফ দম্পতিরও গেল। শৈলীর বিয়ে, তাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত। সৌম্য এসেছে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। দাদুভাই ফারাবীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা দুজনই, বিয়ের সকল যোগাড়-যন্তের মাঝেও তাকে নিয়ে প্রতিযোগিতা দুজনেরই। দুজনেই মনে আশঙ্কা, ফারাবীকে আর কোনোদিনও হয়তো কাছে পাবেন না। বিয়ে উপলক্ষে মাত্র দশ দিনের জন্য এসেছে। আবার কবে আসবে, ঠিক নেই। মনে যত কষ্টবোধই থাক, সকলের মাঝে প্রকাশ করা যায় না। সারাক্ষণ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও মুখের ওপর হাসি চাপিয়ে রাখতে হয়। এমন আনন্দের মাঝেও একটা বিষাদ, সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে দুই ভাইবোনের কথা কাটাকাটি থেকে মনোমালিন্যে জড়িয় পড়ে। শৈলির সাথে লুবনার একটু কথা কাটাকাটি হয়। এই ঘটনার জের ধরে সৌম্যের অভিযোগ, বাবা-মা শৈলীকে বেশি গুরুত্ব দেয়, বেশি ভালোবাসে। তার অভিযোগ শুনে পাথর হয়ে যান তারা দুজনেই। এদিকে বিয়ের মাত্র দুদিন, চার দিন পরে বায়েজিদও চলে যাবে। তিনি কী করবেন, বুঝতে পারেন না। বায়েজিদকে শুধু বলেন, তুমিও বাবা হয়েছ, আরেকটা সন্তান হলে বুঝবে, বাবা-মায়ের কাছে সব সন্তানই একই গুরুত্বের। স্থানকালপাত্র ভেদে গুরুত্বের কম-বেশি হতে পারে, কিন্তু অন্তরে সবারই সমান অবস্থান। খুব ছোট থাকতে তোমাকে বলেছিলাম, সংসারের বড় সন্তানকে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। তবে ছোট-ছোট রাগ, অভিমান জমিয়ে রেখো না। ছোট-বড় ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নাও, জীবন তো একটাই, সেই জীবনও খুব বড় নয়! জমে থাকা এই রাগ, এই অভিমান একদিন বিস্ফোরিত হয়ে সংসারে ফাটল সৃষ্টি হয়, তার থেকে আসে অপ্রত্যাশিত ভাঙন। মনে যাই থাক, বায়েজিদ আর কিছু বলে না, বরং বাবার পাশাপাশি সকল কাজ সে তদারক করে আর ভালোভাবেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এত কিছুর মাঝেও কিন্তু আরেকটি বেদনার উপাখ্যান তৈরি হয়। ফারাবী রাতে দাদা-দাদির মাঝখানে ঘুমায়। চলে যাওয়ার আগের রাতে যখন রজনী বলে- আমার দাদুকে আবার কবে যে দেখতে পাবো! ফারাবী বলে, তোমরা আমাকে রেখে দাও, আমি তোমাদের কাছে থাকবো। শিশুর সেই সরল স্বীকারোক্তি তাদের কান্নায় প্লাবিত করে, দুজনেই নীরবে কাঁদেন। নির্ধারিত দিনে বায়েজিদ চলে যায়, আর একমাসের মধ্যে শৈলীও চলে যায়। তারা তারা দুজন শুধু, মনে হয় চারিদিকে এক অসীম শূন্যতা।

দুই.
আশরাফ আহমেদের জীবনের লম্বা ভ্রমণ যেন ক্রমে-ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। অবসর প্রস্তুতি ছুটির সময়টা বেশ কেটে যায়। ভেবেছিলেন পেনশনের টাকা পেয়ে ব্যাংকে সঞ্চিত রেখে স্বামী-স্ত্রী ইচ্ছামতো খরচ করবেন, কোনো পিছুটান তো নেই। ষাট পেরিয়ে গেলে জীবনের আর থাকে কী? তাই বাকি সময়টুকু দুজনে একান্তে ব্যয় করবেন। কিন্তু রজনী একদম রাজি হয় না। তার বক্তব্য হলো, নগদ টাকা থাকলে খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র কিনে রাখো। ওর মুনাফা আর মাসিক পেনশনের টাকায় বেশ চলে যাবে। সন্তানেরাও তাদের মায়ের পক্ষে মত দেয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেইমতো ব্যবস্থা নিতে হয়। সারাদিন নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। প্রতিদিনের পত্রিকা আর বই পড়ে সময় কাটে। তিন বেলা খাওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ব্যস নিত্যদিনের রুটিন। সংসারের কোনো কাজে হাত দিলে কাজের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই সবকিছু থেকে তাকে দূরে রাখে রজনী। অনেকদিন হলো রজনী বদলাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে শৈলী অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর থেকেই। কত সখ ছিল তার, শেষ বয়সে নাতি-নাতনি নিয়ে দিন কাটাবে। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, নাতি-নাতনি হওয়ার আগেই ছেলেমেয়ে বিদেশে। ফারাবী যখন ভিডিও কলে দাদি বলে ডাকে, ফোনের স্ক্রিনের ওপর দিয়েই রজনীর আঙুল যেন তাকে ছুঁতে চায়, বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে চায়। বাবার ব্যস্ততার কারণে বেশিক্ষণ কথাও বলতে পারে না। সংক্ষিপ্ত সময়ে কথা শেষ হলে রজনী আরও গম্ভীর হয়ে যায়, অগোচরে চোখের জল মোছে। বুঝতে পারি, জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনুভবগুলো বদলাতে থাকে। একান্ত আপনজনকে সর্বক্ষণ কাছে চায়। কিন্তু বাস্তবতা তাকে শূন্যতার হাহাকার দেয়। এ সময় রজনীকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য কোনো কথা বলতে গেলেও সে সহ্য করতে পারে না। প্রথমদিকে তিনি গ্রাহ্য করেননি, কিন্তু দিন-দিন যেন সে আরও খিটখিটে হয়ে ওঠে, যা-তা কথা বলে দেয়। বিশেষ করে মোনোপজ শুরু হওয়ার পর থেকেই। একই বিছানায় শুয়ে থাকলেও যেন দুজনের মাঝে বিশাল দূরত্ব। শারীরিক চাহিদা তারও আগের মতো প্রবল নেই, তবুও মাঝেমাঝে রজনীর শরীরটা চায়। কিন্তু তার একান্ত অনাগ্রহ তাকে ব্যথিত করলেও কিছু বলেন না। কিন্তু তখন আশরাফেরও রাগ হয়। মনে হয় ঘর থেকে অন্যত্র চলে যান। শারীরিক দূরত্ব দিন দিন মনের দূরত্বও বাড়িয়ে দেয় যেন! কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সংসারের প্রয়োজনেই আবার কাছাকাছি হন, ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রজনীকে সঙ্গ দেন, আর একাকী পড়ার ঘরে সবকিছু ভুলতে বইয়ের মাঝে ডুবে যান।

তিন.
দীর্ঘদিন এভাবে থেকে হাঁপিয়ে ওঠে মন। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দুটো দিন কাটিয়ে এলে মন ভালো হবে, তাই তারা গ্রামে আসেন। কয়েকটা দিন বেশ কাটে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে সামান্য পরিবর্তনও মনে প্রশান্তি আনে। কিন্তু একদিনের একটা ঘটনা রজনীর মনে সন্দেহের জন্ম দেয়। দুজন একদিন হাঁটতে-হাঁটতে গ্রামের উত্তর পাড়া চলে গিয়েছিল। ফেরা পথে এক মহিলার সাথে দেখা হয়। তাদের মধ্যে কিছু কথা হয়।
– আশরাফ, ভালো আছ?
– হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কে? আশরাফ হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকান। একটা খুব চেনা মুখের আদল যেন, যৌবনের প্রারম্ভে যে মুখ মনে দাগ কেটেছিল।
আমি নাবিলা, একেবারেই ভুলে গেছো? ঈষৎ শ্লেষ যেন তার কণ্ঠে।
– না, মানে কিন্তু তুমি এইখানে?
– ওইযে আমার বাড়ি। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকি। সময় হলে এসো। রজনীর সামনে যেন দুজনই সংকোচবোধ করে।

ফিরে আসতে আসতে রজনীর মনে কৌতূহল, তিনি আশরাফকে জিজ্ঞেস করেন, মহিলা কে?
– ওর নাম নাবিলা।
– ওর সাথে তোমার কীসের সম্পর্ক?
– তেমন কিছু না, একই গ্রামে বাড়ি, এক স্কুলে পড়তাম, এইতো! একটা জানাশোনা তো থাকেই!
– শুধু জানাশোনা?
– জানাশোনাই তো, আরকি! কিন্তু সত্তর দশকের গ্রাম তো। ছোট বিষয়টিকে জোরেশোরে প্রচার করে। কোনো পরিবারই বিষয়টা এগুতে দেয়নি। ওকে তখনই বিয়ে দিয়ে দেয়, আমি চলে যাই শহরে। তারপর আর দেখা নেই। আজই জানতে পারেন, সেই অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে এখানে চলে এসেছে।
রজনীর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, যখন জানতে পারে, গোপনে ওই বাড়িতে আশরাফ গিয়ে দেখা করেছে। সে আরও গম্ভীর হয়ে যায়, আর পরদিনই শহরের বাড়িতে ফিরে যায়। আর গিয়ে তার সাথে এমন আচরণ করেন, যাতে একেবারে অতীষ্ঠ হয়ে যান আশরাফ। দুজনের দূরত্ব বাড়তেই থাকে। দিনান্তে এক বিছানায় ঘুমালেও যেন দুজন দুপ্রান্তের মানুষ। আগে থেকেই দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছিল। সেটা এখন একেবারেই শূন্যের ঘরে নেমে আসে। সন্তানদের সাথে কথা বলার সময়ই শুধু আন্তরিকতার কথা বলা হয়, অন্যথায় দুজনের মাঝে মৃতের দূরত্ব। অথচ জীবনের এই পর্যায়ে এমন কিছু কথা, কিছু অনুভূতি, কিছু হতাশা থাকে, যা শুধু একান্ত আপনজনকেই বলা যায়। সংসারের প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া রজনী আর কিছুই শুনতে চায় না। ফলে দিন-দিন আশরাফ আরও হতাশ হয়ে পড়েন। এই একাকী জীবনে নাতির সাথে ক্ষণিক কথার অনুরণন ছাড়া তার চারপাশের সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু এ কথা কাউকে বলাও যায় না, সকলের সামনে তা প্রকাশও করা যায় না
আশরাফ তো জানে, নাবিলার সাথে শুধু জানাশোনা নয়, গভীর প্রণয় ছিল তার। মনে হতো দুজন এক অন্যকে ছাড়া বাঁচবে না। অনেকেই বলেন, তুমি আমার জীবনসঙ্গী না হলে আমার জীবন হয়তো মাঝপথেই থেমে যেতো। আশরাফ তা মনে করেন না। নাবিলাকে ভালোবেসেছিলেন, তার সাথে সংসার হয়নি। রজনীকে দেখে ভালো লেগেছিল, দুই পরিবারের সম্মতিইে তাদের বিয়ে হয়েছে। সংসার হয়েছে। এই সংসারে কখনো নাবিলার অভাব অনুভূত হয় নাই। সুখেই কেটে যাচ্ছে রজনীর সাথে তার সংসার। আসলে সংসার আর ভালোবাসা দুটো আলাদা জিনিস। রজনীকে এই কথাটা বোঝাতেই পারেন না আশরাফ।
শৈলীর বাচ্চা হবে। ওর শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, আকিব একা পারছে না। সে কারণে রজনীকে যেতে হবে। আশরাফকে রেখে রজনী যাবে না। আশরাফের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। নবায়ন করতে সময় লাগবে। নতুন যে আসছে পৃথিবীতে, তার গুরুত্বই বেশি। আশরাফ বলে, আমি পাসপোর্ট নবায়ন করেই যত দ্রুত সম্ভব চলে আসবো। তুমি একাই যাও। আমি আমার খেয়াল রাখবো। অগত্যা রজনীকে যেতেই হয়।
দুই সপ্তাহ হলো রজনী চলে গেছে। শৈলীর একটা সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। ভিডিও কলে তার সাথে কথা হয়। কেমন চোখ পিটপিট করে তাকায়। আশরাফ ভাবে, নবীন কিশলয় জন্মে, প্রবীণ বৃক্ষকে সরে যেতে হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আশরাফের সাথে প্রতিদিনই ছেলেমেয়ের আর রজনীর কথা হয়। ঠিকমতো খোঁজ নেয়। সারাদিনের পরে রাত্রের নির্জনতায় নিজেকে কেমন একা আর অসহায় মনে হয়। প্রায় প্রতিদিনই এমন অনেক খবর দেখেন যে যা দেখে নিজেকে আরো অসহায় মনে হয়। তার মতনই এক অধ্যাপক ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। এখন অসহায় অবস্থায় একটা বৃদ্ধাশ্রমে কী নিদারুণ কষ্টে প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মরে গেলেন। আবার কয়েকদিন পরে দেখলেন, এক ভদ্রলোক অঢেল সম্পদ রেখে মারা গেলেন, লাশ দাফনের আগেই তার ছেলেরা সম্পত্তি নিয়ে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়লে সে বিবাদ আদালতে গড়ায়, হতভাগ্য মানুষটার লাশ পড়ে থাকে হিমঘরে। এসব খবর দেখে আশরাফ নিজেই কেমন হিম হয়ে যান।
এদিকে রজনীর সেই সন্দেহবাতিকতা বিদেশে গিয়ে আরও প্রবল হয়, সে কথা প্রকাশ পায় তার বাক্যবাণে। রজনীকে তিনি অনেক বুঝিয়েছেন। পুরাতন প্রেমের সাথে আবেগ থাকতে পারে, কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তার জন্য একটু সহানুভূতি, একটু ভালোবাসা দিলে সব ফুরিয়ে যায় না। কিন্তু রজনী এ কথা শুনে আরও রেগে যায়। মনে হয় দুজনের মাঝে অসীম কোনো নদী, তাদের ভাগ করে রেখেছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আমেরিকা, আমেরিকা উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র শান্তনুর বাবার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য কাহিনি বলা হয়েছে। তিনিও বিয়ের আগে আভা নামের একজনকে ভালোবেসেছিলেন। মৃত্যুর আগে আভা তার সান্নিধ্য চেয়েছিল। তাতে তার স্ত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া আচরণগুলোও এমনই ছিল। শান্তনু লিখেছে-

“সেই রাত্রেই নিমগাছের ডালে বাবা ঝুলে পড়ে বেরিয়ে পড়েন তার সেই কোথাও না কোথাও থাকা অদ্ভুত সুন্দর শান্ত জায়গাটার খোঁজে। আসলে আভার জন্য বাবার কিনে আনা শাড়ি গলায় বেঁধে ঝুলে পড়তে চেয়েছিলেন মা-ই। বাবাকে তার মতো করে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। বাবা কোনোরকমে বুঝিয়ে, মায়ের দাবি অনুযায়ী না করা অন্যায়ের জন্য ক্ষমা স্বীকার করে তাকে নিরস্ত করেন। তারপর মা ঘুমিয়ে পড়লে নিচে নিজের চেম্বারে গিয়ে ডায়রির পাতায় মাকে চিঠি লেখেন। অদ্ভুত সেই চিঠির ভাষা। “তোমাকে শুধু মুখে নয়, তোমার দাবি অনুযায়ী চিঠি লিখিয়াও ক্ষমা চাহিব কথা দিয়াছিলাম। সেই চিঠি লিখিতেছি। আমি বেড়াইতে বাহির হইলাম। ইহাকে আমার শেষ ভ্রমণও বলিতে পারো, যেখানে একা যাইতে হয়। নিমগাছ সাক্ষী রহিল, আমি কোনো অন্যায় করি নাই। শুধু একটি কথা মনে রাখিও, কোনো মানুষকেই কেহ সম্পূর্ণরূপে পাইতে পারে না, তাহা চাহিতে নাই, চাহিয়া লাভও নাই আর চাহিবার নিয়মও নাই। তাহা হইলে জীবন আরো জটিল হইয়া পড়ে, যেখান হইতে জীবনকে টানিয়া না বাহির করা আর যায় না। চলিলাম।”
না, আশরাফ তার মতো আত্মহননের পথে যাবেন না। কিন্তু জীবন থেকে মুক্তি চাইছেন কায়মনোবাক্যে, যে মুক্তি তার সন্তানেরা নিজেদের মতো গুছিয়ে নিয়ে তাকে একা ছেড়ে দিয়ে গেছে, কিন্তু তিনি নিজের অন্তর থেকে সন্তানের স্নেহ ভুলে স্বাধীন হতে পারেননি, এখনও তাদের চিন্তায় ছটফট করেন, একমাত্র অনন্ত জীবনই তাকে সেই মুক্তি দিয়ে যাবে। প্রবল একাকিত্বেরে জ¦ালা সইতে না পেরে তিনি ছটফট করেন। বাড়িময় নীরবে ঘুরে বেড়ান। একটা ঘরে পুরাতন জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো পড়ে আছে। একটা ছোট্ট সাইকেল, যেটা দেখে মনে পড়ে সৌম্যের ছোট্ট মুখটা! যেন ডেকে ওঠে, আব্বু! আরেক প্রান্তে একটা বড় পুতুল। যেন শৈলীর কোলে বসে আছে। হঠাৎ দেখতে পান অনেক দূরে গাছের ছায়ায় বাবার কবরটা নিঃসঙ্গ পরে আছে। মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই-ই সুযোগ! একাকী জীবনের সব বাঁধন কেটে গেছে। এবার ফিরতে হবে।

চার.
একাকিত্ব আশরাফকে কুরে কুরে খায়। কোনকিছু ভালো লাগে না। কোনো কোনো দিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ছুটে যান পরিচিত সেই চায়ের দোকানে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন, অবশেষে মারুফ বেলাল আর সৌমেন আসেন। তারা সকলেই অবসরে গিয়েছেন। তারা আলোচনায় মেতে ওঠেন। কিন্তু তারাও যেন একই রোগের রোগী। তাদের মধ্যেও একই কষ্টবোধ, কিন্তু কী সুন্দর হাসির আড়ালে সব ঢেকে রেখেছে। তাদের জীবনও যেন একই ছাচে গড়া। কোনো আনন্দ নেই, যান্ত্রিক চাকার মতো একই পথে ঘুরছে আর অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। যেন প্রত্যেকেই এক একটা জীবন্ত শব। যেন কবরে যাওয়ার আগেই সবাই কবরে শুয়ে আছে। পার্থক্য শুধু এই কবরে খাওয়া চলে, শ্বাস চলে, পৃথিবীর আলো দেখা যায়। তবুও যেন আসল কবরের মতো অন্ধকারে সবাই। তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তখনই মনে গ্রামে ফিরে যাবেন।
তিন দিন গ্রামে এসেছেন। পরিচিত গ্রামও বদলে গেছে অনেক। দুয়েকজন বন্ধুর সাথে কথা বলে ভালো লাগে। বেশ কেটে যাচ্ছে। গ্রামে গিয়েও ছেলেমেয়ের সাথে কথা হয়। কথার মাঝে একটু হাঁচি, কাশি হলেও সন্তানেরা ডরায়। উদ্বিগ্ন সন্তানেরা তাকে দ্রুত শহরের বাড়িতে ফিরতে বলে। এখানে অসুখ হলে কে দেখবে? ওষুধ পাবে কোথায়? তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। তিনি হেসে বলেন, ফিরব, অতিশীঘ্রই বাড়ি ফিরে যাবো। কিন্তু শহরে ফিরতে তার কোনো তাড়া থাকে না। দিব্বি সুন্দর কেটে যাচ্ছে নিরুদ্বিগ্ন জীবন। কিছুদিন আগে পরীক্ষা করিয়েছেন। ডায়াবেটিস ১০ এর উপরে। রক্তচাপও ১৫০/১০০, তুলনামূলক বেশিই। ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে ডাক্তার। এই বয়সে ওষুধ ছাড়া চলে না। সমস্যা হলো, গ্রামে ওষুধ সময়মতো পাওয়া যায় না। ফার্মেসিতে বললে এনে দেয়। কিন্তু দু-একদিন পরে। আজ দুদিন ওষুধ নেই, ছেলেটাকে বলেও ওষুধ আনতে পারেননি। আজ যেন একটু কেমন কেমন লাগছে। কিন্তু কোনো উপায়ও তো নেই!
শুক্লা দ্বাদশীর তরল জোছনায় ছেয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতিময় মাঠ তার ঘরের সাথেই। কাল কখন যে কিসের টানে তিনি গভীর রাতে ছুটে যান সেখানে। সেই শৈশবের মতোন দাদা, বাবা, চাচারা যেন সমবেত বৈঠকে তাকে ডেকেছেন। তিনি বিমূর্ত সেই ক্ষণে বিহ্বল হয়ে ছুটে যান। ধবল জোছনা যেন উষর মাটির বুকে ছড়িয়ে আছে। যতদূর দৃষ্টি যায়, কুয়াশার চাদরের গায়ে সেই দুগ্ধ ফেননিভ জোছনা! বাবা একা বসে আছে উদাসী হয়ে। তাকে দেখে কাছে টেনে নেয়। মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা। বাড়ির পালানের ছোট্ট ডোবায় ডুবে জল খেয়ে যখন পেট ফুলে হাঁসফাঁস করছিল সে, একপর্যায়ে বাঁচার আশা ত্যাগ করে ডুবে যাচ্ছিল, তখন কোথা থেকে দৌড়ে এসে বাবা বুকে তুলে নিয়ে পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করে বাঁচিয়ে তুলেছিল, আজও তেমনি বুকের ভেতর টেনে নিতেই সে ক্রমাগত ভুলতে থাকে তার সব কষ্ট। বাবার সেই প্রশান্তিময় বুকের মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়ে শিশুর মতো আদুরে কণ্ঠে বলে ওঠে, বাবা!
– হুম
– আমার অনেক কষ্ট!
– জানি বাবা….
– তোমার কষ্ট আমি নিয়েছি।
– জানি…
– মায়ের কষ্ট আমি নিয়েছি…
– সন্তানদের কষ্ট….
– জানি তো বাবা..
– হৃদয়ের গভীরে যত স্নেহ মমতা প্রেম ভালোবাসা লুকিয়ে রাখি, অবহেলা আর অমনোযোগে একদিন পুড়ে বিষবাষ্প হয়ে আমাকেই গিলে খায়! বড় অভিমানে বলে আশরাফ। আমি আর পারছিনে বাবা… বড্ড হতাশ শোনায় তার কণ্ঠ।
– আজ থেকে তোর সব কষ্ট শেষ! তুই আমার সাথে থাকবি, আমার বুকে।
– তোমার সাথে সারাক্ষণ থাকবো!

বাবার বুকের মাঝে আবিষ্ট হয়ে মিশে যায় আশরাফ- কতক্ষণ.. কতটা সময়…
একসময় বাবা ডাকে, আশরাফ –
– হ্যাঁ বাবা..
– জোছনা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যেতে হবে অনেকটা পথ… কেমন গম্ভীর শোনায় বাবার কণ্ঠ।
– আচ্ছা বাবা, আমি তৈরি হয়ে আসি।
সেই জোছনার প্লাবনভরা মাঠে আশরাফ দেখে তার জন্য তৈরি সাদা ধবধবে একটা অদ্ভুত পোশাক। সে সেটা পড়ে নেয়। একটা আলোকজ্জ্বল পথ, বাবা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। আশরাফও এগিয়ে যায় একটা ফুরফুরে ঝর্ণার মতো দুপায়ে ছন্দিত শব্দ তুলে।
দিনের সূর্য তার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে প্রথম উঁকি দেয়। তার বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে আলো। কেউ একজন জানালা দিয়ে তার মৃতদেহটা প্রথম দেখে। একে একে প্রতিবেশী সবাই আসে। দেখে তার নিষ্প্রাণ দেহটা বিছানায় পরে আছে। চোখ দুটো চেয়ে আছে অসীম অলক্ষ্যে। সেই চোখে এক প্রশান্তির হাসি। মুখটাও ঈষৎ খোলা। মনে হয় শেষ শব্দটা বড় তৃপ্তিতে উচচ্চারণ করেছিলেন- আহ্…
যেন একটি শব্দেই তার বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা কষ্টকে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন…

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়