গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

আলেয়ার প্রতিশ্রæতি : শেলী সেনগুপ্তা > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রিকশা করে চিনিকলের সামনে দিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ওদের চোখ জলে ভরে ওঠে। তখন ওরা কেউ কারো দিকে তাকায় না, ওরা কেউ কাউকে চোখের জল দেখাতে চায় না। এটা ওদের প্রতিদিনের লুকোচুরি খেলা। ওরা মনিরুল ও আলেয়া। ওরা স্বামী-স্ত্রী। বারো বছর আগে বিয়ে হয়েছে ওদের। ঘরে কোনো সন্তান আসেনি। ওরা শুধু অপেক্ষা করেছে। কখনো চিকিৎসার কথা মনে আসেনি। সন্তান নেই এটা ওদের কাছে কোনো সমস্যায় না। ওদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলে একটু আদেখলাপনা রকমের বাড়তি ভালোবাসা। সারাক্ষণ ওরা সুখের বন্যায় ভাসছে। হয়ত বিধাতা অন্তরালে হাসলেন। ওদের সুখের সংসারে ঝড় এলো। রাত পোহানোর আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেল।
মনিরুল নাটোরের চিনি কলে কাজ করে, ওরা থাকে নাটোরের ছোবান বস্তিতে। এক রুমের বাসাতে ওদের সুখের সংসার। সে কাজে গেলে আলেয়া ওদের ছিমছাম সংসারের কাজ শেষ করে কাঁথা পেতে বসে। খুব সুন্দর সেলাই করে সে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁথার ওপরে বরবউ, নদী, নৌকা, পাখি, গাছপালা সেলাই করে। কখনো কখনো বালিশের কভারে লিখে রাখে ‘ল²ীটি ঘুমাও’, কাঁচের ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয় ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’। সারাদিন শেষ অপেক্ষা করে কখন মনিরুল ফিরে আসবে।
সেদিনও মনিরুল কাজে যাচ্ছিল, যাওয়ার সময় প্রতিদিনের নিজস্ব স্টাইলে আলেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। এমন সময় ওদের বস্তির খেন্তি বুড়ি দরজার সামনে চলে এলো, হয়ত কিছু চাইতে এসেছিল। ওদের এ অবস্থায় দেখে ছ্যা ছ্যা করতে করতে চলে গেল। যাওয়ার সময় চিল চিৎকারে পাড়া মাথায় তুলল। খেন্তি বুড়িকে দেখে আলেয়া লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে গেল। আর মনিরুলের কপাল দরজার চৌকাঠে ঠুকে গেল। তখনই চিনি কলের ভেঁপু বেজে উঠল। মনিরুল পড়িমরি করে বের হয়ে গেল। আলেয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বাসার বাইরে আসতে ইচ্ছে করছে না। চাপকলের পাড়ে বসে বস্তির মহিলারা মুখরোচক আলোচনায় ব্যস্ত। খেন্তি বুড়ি ওদের কাছে আলোচনার রসদ দিয়ে গেছে।
তখনই টিনের চালে কয়েকটা কাক তারস্বরে ডেকে উঠল। আলেয়ার মনটা খুব অস্থির, না জানি কোথায় কী হলো। কলপাড় থেকে পানি আনতে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। কাকগুলো ডেকেই যাচ্ছে। খেন্তি বুড়ির ওপর খুব রাগ হচ্ছে। মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে দিল।
নানা কাজের মাঝে বার বার ঘরবাহির করছে, কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না। এমন সময় মনিরুলের বন্ধু রমজান ছুটতে ছুটতে এলো। আলেয়াকে এক্ষুণি হাসপাতালে যেতে হবে। মনিরুল এক্সিডেন্ট করেছে। আলেয়া পাগলের মতো ছুটে গেল। মনিরুল তখন অপারেশন থিয়েটারে। ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন বের করে আনা হলো তখন সে অর্ধেক মানুষ। হাঁটু থেকে পা দুটো কেটে ফেলতে হয়েছে। ডাক্তার এবং চিনি কলের ম্যানেজার খুব দুঃখ প্রকাশ করল। পা কেটে ফেলা ছাড়া মনিরুলকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় ছিল না। আলেয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। হাসপাতালের মেঝেতে বসে পড়ল। রমজান ওকে তুলে ধরল। হাসপাতালের বাইরে একটা খুপরি চায়ের দোকানে এনে বসাল। আলেয়া অকাতরে কেঁদেই যাচ্ছে।

এক মাস পরে মনিরুল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। রমজান ওকে বাসায় পৌঁছে দিল। এখন শুধু শুয়ে থাকা জীবন। খাওয়া-দাওয়া আর পায়খানা-প্রশ্রাব বিছানায়। আলেয়া এখন পূর্ণ উদ্যমে সেবা করতে শুরু করল।
তবে শুধু সেবাতে তো পেট ভরে না। খাবার দরকার। আয় নেই, কষ্টের দিন শুরু হলো ওদের। এতদিন যারা সহানুভূতি দেখিয়েছিল তারা আর আসে না। বস্তির মালিক বাসা ছেড়ে দেয়ার তাগাদা দিচ্ছে। মনিরুল পঙ্গু তাই দয়া করে এক মাসের সময় দিয়েছে।
মাঝে মাঝে রমজান ওদের দেখতে আসে। শুধু আসা, কোনো সহায়তা করতে পারে না। সে নিজেও গরিব। ওর আসা-যাওয়া নিয়ে বস্তির মানুষ নানা মুখরোচক আলোচনা করছে। কথাগুলো লতাপাতার মতো ছড়িয়ে রমজানের স্ত্রী খাদিজার কানে গেলে সেখানেও নানা অশান্তি। তারপরও রমজান ওদের দেখতে আসে। কখনো কাজ থেকে ফেরার সময় আবার কখনো ছুটির দিনে। দীর্ঘক্ষণ মনিরুলের সঙ্গে গল্প করে। সান্ত¡না দেয়, নানা পরামর্শ দেয়।
এর মধ্যে আলেয়া একটা বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ খুঁজে নিয়েছে। সারাদিন কাজ করে বিকেলে ফিরে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে ভাত আর বাসি তরকারি। তাতে দুজনের খাওয়া চলে কিন্তু ঘরভাড়া আর হয় না। একসময় মনিরুল নিজেই প্রস্তাব দিল প্রতিদিন সে নাটোর বাজারে গিয়ে বসবে। যদি দয়া পরবশ হয়ে কেউ কিছু দেয় তাহলে ঘরভাড়াটা হয়ে যাবে। আলেয়া তীব্র আপত্তি মনিরুলকে সে ভিক্ষুক হিসেবে দেখতে পারবে না। সে আরো একটা বাসায় কাজ নিতে চাইল। মনিরুল ওকে বুঝিয়ে বললো যে ঘরে বসে থাকার চেয়ে বাইরে গেলে ভালোভাবে সময় কেটে যাবে, মন ভালো থাকবে সঙ্গে কিছু টাকাও আসবে। রমজান ওকে সমর্থন করল। আলেয়া নিমরাজী।
কিছুই করার নেই। প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় আলেয়া ওকে নিয়ে বের হয়। রিকশা করে বাজারে নিয়ে যায়। বাজারের একপাশে চট পেতে বসিয়ে দেয়। আবার কাজ থেকে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসে। মনিরুল রিকশার সিটে বসতে পারে না। রিকশাওয়ালার সঙ্গে ধরাধরি করে ওকে পাদানীতে বসিয়ে দেয়। আলেয়া মাথায় কাপড় দিয়ে সসংকোচে সিটের ওপর বসে থাকে। মনটা খুব খারাপ থাকে। বুক চিরে বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
মনিরুল সব বোঝে। একদিন রাতে আলেয়াকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে,
-বউ, ওইখানেই আমার শান্তি, আমি হগল সুময় তর পাও এর কাছেই থাইকতে চাই।
-ধুর, তুমি যে কি কওনা, তুমি থাকবা আমার কান্ধে।
-পাগলি, কান্ধে থাহে ফেরেস্তা, জানস না?
-তুমি আমার জীবনে ফেরেস্তার থন কম অইলা কেমনে?
-কি যে কস তুই, কিছুই ঠিক থাহে না।
-হাঁচাই কইলাম, তোমার জায়গা কিন্তুক আমার কান্ধে গো।
আবারো বিধাতা অলক্ষ্যে হেসেছেন। পরদিন সকালে ওরা যখন চিনি কলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল সেদিন আর পরস্পরের কাছ থেকে কান্না লুকানোর সুযোগ হলো না। একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিল ওদের রিকশায়। আলেয়া দূরে ছিটকে পড়ল। মনিরুল চলে গেল চাকার নিচে। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এলো। সবাই দেখল চিনি কলের আধখানা দেহের সাবেক শ্রমিক, নাটোর বাজারের প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকটি আর বেঁচে নেই।
বিকেল হয়ে এসেছে। ছোবান বস্তির সামনের রাস্তায় স্বল্পসংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে মনিরুলের জানাজা হয়ে গেল। সবাই খুব আফসোস করল, ‘খুব ভালো ছিল লোকটা।’ চোখের জলে ভাসতে ভাসতে রমজান সবকিছুর তদারক করছে।
বস্তির লোকেরা খাটিয়া কাঁধে নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওনা হল। তখন সবাই দেখল, এক বিপর্যস্ত নারী একগলা ঘোমটা দিয়ে খাটিয়ার সামনে দাঁড়াল। একজনকে সরিয়ে দিয়ে খাটিয়া কাঁধে নিতে গেল। মসজিদের ইমাম সাহেব ফুঁসে উঠলেন,
-এইডা কি অইল, খাটিয়াত কান্ধা লাগায় বেডিছওল! কলিকাল আইয়া গেল নাহি?
কোন কথায় ওর কানে গেল না। কঠিন হাতে খাটিয়ার ডাট ধরে আছে, কেউ কেউ ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করছে, আবার কেউ কেউ বিদ্রুপ করছে। বস্তির মহিলা যারপর নাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চারপাশের কড়া কথা জবাবে আলেয়া মাথার ঘোমটা ফেলে দিলো, বললো,
-আমি কিতাব জানি না, কানুন জানি না, আমি হ্যারেই জানি। হারা জীবন হ্যারেই জানছি। হ্যারে আমি কথা দিছিলাম, হারাজীবন কান্ধেই রাখমু। আইজ যাওনের কালে তারে আমি কান্ধা দিমু না এইডা কেমনে অয়? আপনেরা যে যেইডাই কন, আমি আমার সোয়ামীকে কান্ধে নিমুই।’
সবার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে তিনজন পুরুষের সঙ্গে খাটিয়া কাঁধে কবরস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়