গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

সাবেক স্ত্রীর স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক : আন্দালিব রাশদী > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ক্যামিলা বলবে ডায়ানা আমার স্বামীর সাবেক স্ত্রী লাগে। রিচার্ড বার্টন দু’দফায় এলিজাবেথ টেলরের স্বামী হলেও প্রথম স্বামী নন। দরকার হলে রিচার্ড বার্টনকে নিশ্চয়ই বলতে হতো নিকি হিলটন আমার স্ত্রী লিজের স্বামী লাগে।
সম্পর্কের বিলেতি অভিধান এ সম্পর্কে কি বলে দেখি।
ডযধঃ ফড় ও পধষষ সু বী যঁংনধহফ’ং রিভব?
ণড়ঁৎ বী-যঁংনধহফ’ং রিভব রং ুড়ঁৎ বী-যঁংনধহফ’ং রিভব,

ডযধঃ ফড় ও পধষষ সু বী রিভব’ং যঁংনধহফ?
ণড়ঁৎ বী রিভব’ং যঁংনধহফ রং ুড়ঁৎ বী রিভব’ং যঁংনধহফ,

হঠাৎ এই সম্পর্কের ব্যাপারটা এমন জরুরি হয়ে পড়ল কেনো?
জরুরি হয়ে পড়ল সঙ্গত কারণেই, তার সাথে কিছু কথা বলা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর সাবেক স্বামীর সাথে আপনার পরিচয় আছে তো? থাকাটা বরং ভালো। যখন তার সাথে ফোনে কথা বলতে হবে পরিচয় দেবার সময় আপনিও বিব্রত হবেন, তিনিও বিব্রত হবেন। স্ত্রীর বর্তমান ও সাবেক স্বামীর মধ্যে ‘কমন স্ত্রী’র কারণে এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্ক তো হতেই পারে। সম্পর্কটা অনেকটা ভায়রার মতো, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণে ভায়রার চেয়েও ঘনিষ্ট। দুই ভায়রার মধ্যে একমাত্র কমন নারী হচ্ছে তাদের শাশুড়ি, এক প্রজন্ম পেছনের নারী। তার গর্ভজাত দুই কন্যাকে আপনারা দু’জন বিয়ে করেছেন, ঘুমিয়েছেন, সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালিয়েছেন, কিন্তু সবই পৃথকভাবে। কিন্তু এখানে তো আপনাদের দুজনের সাথেই ঘনিষ্ট তাদের একই প্রজন্মের একজন নারী। দু’জনই তার সাথে একই ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন।
একই সময়ে একই স্বামীর একাধিক স্ত্রী পরস্পরের সতীন। শর্ত একটাই-একই সঙ্গে বর্তমান থাকতে হবে। এটাই সতীন সম্পর্ক। স্বামীর আগের স্ত্রীকে আত্মীয়তার সূত্রে কাউকে সাবেক সতীন বলতে শুনিনি। বলেছে, আমার হাজব্যান্ডের আগের ওয়াইফ। সতীন সদা বর্তমান। সতীনকে নিত্যস্ত্রীসূচক শব্দ করে রাখা হয়েছে, এর লিঙ্গান্তরের সুযোগ রাখা হয়নি। এটা পলিঅ্যান্ড্রিক সোসাইটির ধারনাকে অস্বীকার করে অথচ দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। নকুল, সহদেব, ভীম, যুধিষ্ঠির ও অর্জুন, হোক তারা ভাই তবুও স্ত্রীকে ঘিরে তাদের নতুন সম্পর্কটি কি? একজন অন্যজনের কি হন?
ডক্টর ইকবাল ভাবলেন যেহেতু এখনো তিব্বতে এক স্ত্রীর একাধিক স্বামী প্রথা চালু আছে তাদের অভিধানে হয়ত কোনো শব্দও থাকতে পারে। তবে তার চাওয়াটা ভিন্ন ধরনের।
ক’বছর আগে যে স্ত্রী আপনাকে তালাক দিয়েছেন তার নতুন স্বামীর যদি কোনো অনিবার্য কারণে আপনাকে ফোন করতেই হয় তাহলে তিনি কীভাবে নিজের পরিচয় দেবেন?
হ্যালো, আমি ডক্টর ইকবাল আহমেদ।
কি বললেন? আমার কোনো মাল ডেলিভারি বাকি আছে নাকি?
বলেছি, না না তা নয়। আমি ডক্টর ইকবাল আহমেদ।
জি ডাক্তার সাহেব বলুন।
আমি ডাক্তার নই। ডক্টর। ডক্টর ইকবাল আহমেদ। আমি বুয়েটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।
প্রফেসর শোনার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মুখে স্যার চলে আসে। যদিও সুযোগ পেলে স্যারদের কেউ কেউ ছাত্রীদেরও রেহাই দেন না। তবু তাদেরও স্যার বলা চালিয়ে যেতে হয়।
ঢোক গেলা উত্তর এলো, জি স্যার, বলুন। কিসের প্রফেসর বললেন?
বুয়েট-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলোজি। আমি জানি না আপনি আমার নাম শুনেছেন কিনা। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাকাডেমিক সার্কেলে বলতে পারেন প্রায় সকলেই আমাকে চেনেন।
স্যার আমি দুঃখিত। এ দেশের শিক্ষিত লোকদের তেমন কাউকেই চিনি না। আমার সাথে যাদের ওঠাবসা কিংবা আমি যে পরিবার থেকে উঠে এসেছি, আমরা টেনেটুনে মেট্রিক পাস কাউকে পেলে তাকেই উচ্চশিক্ষিত মনে করে থাকি। আর কলেজ পর্যন্ত গেলে তো কোনো কথাই নেই।
ডক্টর ইকবালের মনে হলো, অপাত্রে ঘি ঢালা ঠিক হয়নি, যার কাছে মেট্রিক আর পিএইচডি একই মানের তার সাথে দেখা না করলেই ভালো। পরক্ষণেই মনে হলো, তা হয় না, দেখা করতেই হবে। প্রয়োজনটা তার।
আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। পরিচয়ের সময় পুরো পরিচয়টা দিতে পারলে কমিউনিকেশনে সুবিধা হয়।
স্যার, আপনি যদি পুরো পরিচয়টা এর মধ্যে দিয়েও থাকেন, আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনাকে চিনতে পারিনি। আমরা চিনি কাস্টমার। কে কতো বড় কাস্টমার আর কার কাছে কতো টাকা পাওনা, এ সবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
না না তা ঠিক আছে, প্রফেশনাল পয়েন্ট অব ভিউতে এমনই হবার কথা। তবু আমরা একটা সমাজে তো বাস করি, কিছু বাড়তি মানুষকে চিনতেই হয়। আমিই বা ক’জনকে নাম শুনে চিনতে পারব। আমি আপনার, মানে আপনার বলছিলাম কি, আমি ডালিয়ার হাজব্যান্ড।
আলী মুর্তজা ডালিয়া নামের দু’জনকে চেনেন। একজন ভাওয়াইয়া শিল্পী ডালিয়া আহমেদ। আরো একজন আছেন, কিন্তু তিনি তো এ নামে পরিচিত নন।
আলী মুর্তজা চুপ থাকায় ইকবাল আহমেদ ভাবলেন, ব্যাটা সম্ভবত বিব্রত।
কোন ডালিয়া?
জবাবে আপনার আর আমার কমন ডালিয়া বলতে পারলেই ভালো ছিল, তবু এ লাইনে না গিয়ে বলবেন, আমার স্ত্রী ডালিয়ার সাথে আপনি কিছুদিন ঘর-সংসার করেছেন।
বিব্রত অবস্থা আরো বেড়ে গেলে, তিনি তোতলাতে শুরু করলেন, তবুও এটুকু বলতে পারলেন যে তার পরিবারে ডাক নাম ধরে কাউকে ডাকার রেওয়াজ না থাকাতে তিনি জহরত আরা নামেই পরিচিত ছিলেন। আমি ভেবেছিলাম আপনি ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী ডালিয়া আহমেদের…।
তিনি কথা শেষ করার আগেই ডক্টর ইকবাল আহমেদ বললেন, আমি তাকেও চিনি। তার হাজব্যান্ডের নাম কাজী জুলফিকার আহমেদ, সিস্পল বিএ, আর্টস গ্র্যাজুয়েট। যাকগে সে কথা থাক। আমি যে জন্য ফোন করেছি সেটা বলি-আপনার সাথে আমার দেখা করা দরকার।
আমার সাথে! আলী মর্তুজার কথায় অবিশ্বাসের সুর।
জি, আপনার সাথে। আলী মর্তুজা মুহূর্তেই বিপাকে পড়ে গেলেন। তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। দেখা সাক্ষাতের কী আছে। তিনি তো আর তাদের বিয়েতে বাধা দেননি, কারো সম্পর্কে এতটুকু কটু কথাও বলেননি। কটু কথা এমনিতেও তিনি বলেন না।
জহরত আরার সাথে তালাক একুশ মাস আগের ঘটনা। তারপর তিনি তার সাবেক স্ত্রীর খোঁজ রাখেননি। রাখাটা ধর্মমতে না-জায়েজ হতো। জহরত আরা শিক্ষিত মানুষ, অসন্তুষ্ট হতে পারেন এই ভেবে দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে থেকেও অনেক কথা জিজ্ঞেস করেননি, তালাকের পর তার কী হলো সে গবেষণায় তিনি সময় দেননি, সুযোগ ছিল না। তালাক সম্পন্ন হবার চতুর্থ মাসে তিনি বিয়ে করেন, পরের দিনই করতে পারতেন, কিন্তু হুট করেই তো আর প্রস্তাব আসে না। তাছাড়া জহরত আরার সাথে সংসার টিকবে না, এটাও তো জানা ছিল না।
আবারো তার মনে হলো দেখা-সাক্ষাতের কী আছে, যা হবার তা তো হয়েছেই। এখন আপনারা সুখে শান্তিতে থাকুন। আমার কোনো আফসোস নেই, অভিযোগও নেই। কথাগুলো শুধু ভেবেছেন, বলেননি, এর মধ্যেই লাইনটা কেটে যায়। আলী মর্তুজা স্বস্তি বোধ করেন।
একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে জহরত আরার বিয়ে হয়েছে তিনি শুনেছেন। কিন্তু কবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কেমন বয়সী এর কিছুই তার জানা হয়নি। ক্ষীণ আগ্রহ না থাকার কারণ নেই। ভেবেছেন বেঁচে থাকলে একদিন নিশ্চয়ই জানা হবে।
তবে ইকবাল আহমেদ জানতেও পারেন নাও জানতে পারেন, তার স্ত্রী-ডালিয়া ভালো করেই জানেন তার সাবেক স্বামী স্বল্পশিক্ষিত একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। তিনি আলী মর্তুজার নতুন ঢাকাবাসী বোনের মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন, শম্পা, তোমার নতুন মামী খুব সুন্দর, তাই না। শম্পা বলেছে, মামার বউভাগ্য খুবই ভালো। নতুন মামী দেখতে ইন্ডিয়ান হিন্দি সিনেমার নায়িকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো। প্রিয়াঙ্কা কিন্তু দেখতে হেব্বি! বাঙালি মনেই হয় না। অবশ্য আপনার কথা আলাদা, আপনি কত উচ্চশিক্ষিত।
মানে আপনি তেমন সুন্দর নন। উচ্চশিক্ষা আপনার সৌন্দর্যের ঘাটতিটা পূরণ করে দিয়েছে।
আলী মর্তুজা ভাবলেন আবার তার ফোন এলে বলবেন, কংগ্রাচুলেশনস। কিন্তু তিনি এটাও বোঝেন কংগ্রাচুলেশনস কথাটা, তার মুখে মানায় না।
আবার ভাবলেন-এভাবে বলবেন, মন কষাকষি চলছে নাকি? দুটো অপশন : যদি হানিমুন সফর না হয়ে থাকে টাকা পয়সার টানাটানি না থাকলে নেপাল কী ভুটান থেকে ঘুরে আসুন কিংবা স্ত্রীর পছন্দমতো একসেট গয়না কিনে দিন। তবে দু’ক্ষেত্রেই পাশাপাশি শোবার সময় হাতের কাছে কোনো কন্ট্রাসেপটিভ রাখবেন না। দ্রুত একটা বাচ্চা নেবার প্রক্রিয়া শুরু করে দিন। বমিটমি শুরু হয়ে গেলে অভিমানের ধারা বদলে যাবে। তারপর দেখবেন তরতর করে সময় কেটে যাবে। ছেলেমেয়ে বড় হবে, তাদেরও ছেলেমেয়ে হবে, তাদেরও হবে, এই ধারার মধ্যেই আপনি একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। আপনি হয়ে উঠবেন জাস্ট নোবডি। তারপর দার্শনিকী চাল মেরে বলবেন, আরে ধ্যাৎ আমার কথা বাদ দিন জহরত আরার মতো এমন স্ত্রী কি আর আমার কপালে বেশিদিন সয়? সয় না। এর মধ্যেই ফোন আসে চট্টগ্রাম স্টিল মিল থেকে। রড়ের দাম টনপ্রতি আটশ’ পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বললেন, তাহলে তো আমার দেড় হাজার বাড়ানো দরকার। ফোন রেখে তিনি কর্মচারীদের আদেশ দিলেন। রড বিক্রি দু’দিন বন্ধ রাখো। কাস্টমার চাইলে বলবে পুরো স্টক বিক্রি হয়ে গেছে, কাস্টমারের ট্রাক এলে তুলে দেরো। গোডাউন থেকে আনার দরকার নেই। শিপ ব্রেকিং-এ খারাপ অবস্থা যাচ্ছে, রডের দাম টনে দেড়-দু হাজার বাড়বে।
এরপরের ফোনটিতে ডক্টর ইকবাল আহমেদ বললেন, সরি লাইনটা কেটে গিয়েছিল। যা বলছিলাম, আপনার সাথে আমার দেখা করা দরকার।
তিনি বললেন, আমার রড-সিমেন্টের দোকান। একটু পর পর কাস্টমার ঢোকে। ভালো-মন্দ দুটো কথা বলবেন সে সুযোগটা কোথায়? তারচেয়ে ফোনেই বলুন, শুনি।
ইকবাল আহমেদ বললেন, তাহলে আপনাকে অনুরোধ করি, আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে আসুন না। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই। আমাদেরও তো আপনার মতোই সিমেন্ট আর রডের কারবার। তবে আমাদের পরিবেশটা ভালো। অ্যাকাডেমিক এনভারোনমেন্ট কিনা।
আলী মর্তুজা বিনীতভাবে বললেন, স্যার আপনাকে তো আগেই বলেছি, মেট্রিক পাস করতে পারলেই, আমরা ক্ষ্যান্ত দিই। স্বাধীনতার পরের বছরের পাস-পাতা কেটে পরীক্ষা দিয়েছি। নতুবা এসএসসিটাও হতো না। তারপরও কলেজে নাম লেখাতে চেয়েছিলাম। বাবা বললেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর সময় নষ্ট করে কি হবে? খুব প্র্যাকটিক্যাল কথা। বসে গেলাম বাবার রড-সিমেন্টের দোকানে। ইউনিভার্সিটির মতো বড় জায়গায় যাবার সাহস আমার নেই, জহরত আরার ছিল, তিনি সেসব জায়গায় পড়াশোনা করেছেন, সেখানকার মানুষের সাথে তার উঠাবসা ছিল। সেখানে আমি বেমানান।
ইকবাল আহমেদ বললেন, তাহলে আপনার বাসায় আসি?
স্যার, আমাদের ওল্ড টাউনের কালচার ভিন্ন। নেহায়েৎ আপনজন না হলে আমাদের মধ্যে বাড়িতে আসা-যাওয়ার রেওয়াজ নেই। আমার দাদা আর বাবার আমলে দেখাসাক্ষাৎ হতো গদিতে।
তাহলে আপনিই বলুন কোথায় বসব?
আমি স্যার এমনিতেই ব্যস্ত মানুষ, আপনার সাথে বসতে চাই না। মানে আমি কথা বলার উপযুক্ত নই। তাছাড়া আপনি যদি জহরত আরা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেন, আমার বলার এখতিয়ারও নেই। তিনি অন্য একজনের স্ত্রী। আর আপনি যে মাপের উচ্চশিক্ষিত মানুষ আমি হয়ত আপনার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারব না।

আলী মর্তুজা প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীকে বাসায় আনতে চান না। কারণ তিনি তার বাসায় আসা লুঙ্গিপরা বন্ধুদের মতো নন। তিনি আসলে কে কোনোভাবে জানাজানি হলে আলী মর্তুজার বর্তমান স্ত্রীও কৌতূহলী হয়ে পাঁচটা প্রশ্ন করবেন। তিনি এসব প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহী নন। একটি প্রশ্ন সবার জন্য কমন : ছাড়াছাড়িটা হলো কেনো?
ইকবাল আহমেদ বুঝলেন, মানুষটা মনে হচ্ছে পিছলে টাইপের।
তা হলে চলুন ধানমন্ডির দিকে কোনো রেস্তোরঁাঁয় বসি।
সর্বনাশ, যে সময় যাবে তাতে আমার রড-সিমেন্টের ব্যবসা লাটে উঠবে।
ইকবাল আহমেদের পীড়াপীড়িতে আলী মর্তুজা বললেন, তা হলে দোকানে আসুন। নয়াবাজারে একেবারে রাস্তার উপর। হাতের ডানে মডার্ন বিল্ডার্স। সাইনবোর্ড আছে। ঠিক তার পাশের দোকানটিই। নয়াবাজারের সবাই চেনে সিমেন্ট মর্তুজা বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। দুজন মর্তুজা আছে এখানে, আর একজন রড মর্তুজা। এখন অবশ্য আমার রড়ের ব্যবসাই আসল, সিমেন্টের চেয়ে লাভ বেশি। কিন্তু পুরনো নামটাই রয়ে গেছে।
আলী মর্তুজা এই ফাঁকে ক্যাসিও ক্যালকুলেটারে দ্রুত আঙুল চালিয়ে হিসাবটা করে নিলেন। দোকানেও গুদামে মজুদ দেড় হাজার মেট্রিক টন রড। হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ায় তার বাড়তি পাওনা দেড় হাজার টাকা ইন্টু দেড় হাজার টন, মোট টাকা দাঁড়াচ্ছে বাইশ লাখ পঞ্চাশ হাজার। খরচ-টরচ বাদ দিয়ে পনেরো লক্ষ তো টিকবেই। ভাগ্যিস স্টক প্রায় পুরোটাই অবিক্রীত ছিল। এই বাড়তি টাকাটা সরিয়ে নেবেন। নতুন শহরে বাড়ি নিতে হবে। রড-সিমেন্টের পুঁজিতে তো হাত পড়েনি।
বাড়তি লাভের আনন্দটুকু তার প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীর কারণে নিরঙ্কুশ হতে পারছে না। প্রফেসর সাহেব কেনো তার সাথে কথা বলতে চান? কী কথা তার সাথে? জহরত তারা কি তাকে আলী মর্তুজার কাছে পাঠাচ্ছেন? কোন দেনা পাওনা?
হোক, ধরেই নিতে হবে, মানুষটা তার জন্য গুড লাক। পনের লক্ষ তো বছরের ইনকাম।
জহরত আরার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের দিন আলী মর্তুজা একটি ছোট ট্রাক আনিয়েছেন। যখন নিজ হাতে স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে খাটের বল্টু খুলতে শুরু করেন, জহরত আরা জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার খাট খুলছেন কেন?
ট্রাক এসেছে। খাট, স্টিলের আলমারি, ডাইনিং টেবিল, সোফাসেট তুলে দিই?
কেন?
এগুলো আপনার।
আমার মানে? এগুলো সবই তো আপনার টাকায় কিনেছেন!
টাকা কার এটা বড় কথা নয়। এগুলো আপনার জন্য কেনা। খাট আর আলমারি আমি যেমন মনে করেছি কিনেছি। কিন্তু সোফা আর ডাইনিং সেট তো আপনি পছন্দ করে কিনেছেন।
হ্যাঁ পছন্দ করেছি তো হয়েছে কি? বাথরুমের ইংলিশ কমোডও তো আমি পছন্দ করে লাগিয়েছি। তাই বলে কমোড খুলে গাড়িতে তুলে দেবেন না কি? কী আশ্চর্য! আপনি এমন কেনো?
আলী মর্তুজা রেঞ্জ হাতে বল্টু খোলার বদলে বিদায়ী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। জহরত আরাকে, হয়ত চলে যাবেন বলেই আগের চেয়েও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। শাড়িটা হালকা গোলাপি, ব্লাউজও তা-ই শরীরের সাথে মিশে আছে।
আপনাকে ট্রাক আনতে কে বলেছে? যান, ট্রাক ছেড়ে দিয়ে আসুন।
যন্ত্রচালিতের মতো আলী মর্তুজা বলেন, আচ্ছা।
শুধু দু’টো স্যুটকেস। গাড়িতে একটা লিফটা দিলেই হবে।
গাড়িটাও আপনার জন্য কেনা হয়েছিল। আমরা ওল্ড টাউনের মানুষ বলে রিকশায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। গাড়িটা আপনি নিয়ে যায়। ড্রাইভারের বেতন, তেলের দাম-এসব বাড়তি খরচ আমার আর লাগবে না। আমিও বেঁচে যাই।
বারবার এত ওল্ড টাউনের মানুষ বলতে হবে না। যাক আমার লিফটও লাগবে না। বেবিট্যাক্সি কি রিকশায় কেউ একজন পৌঁছে দিয়ে এলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকব। না দিলেও সমস্যা নেই। ঠিকানা যখন আছে পৌঁছাতে পারব। আর আমার জন্য গাড়ি পুষতে গিয়ে আপনার যে বাড়তি খরচ হয়েছে, আমি সে জন্য দুঃখিত।
মহাখালী খুব দূরের পথ নয়। আপাতত সেখানে বাবার বাড়িতেই উঠবেন।
জহরত আবার সাথে সম্পর্কটা যে শেষ হতে যাচ্ছে, বাড়ির কনিষ্ঠজনেরা আঁচ করতে পারেনি। জহরত আরার জন্য কেনা টেবিল ফ্যান, টেবিল ল্যাম্প, ঝাড়বাতি, ইরানী কার্পেট কোনটাই নিতে চাননি। নিয়েছেন নিজের কাপড়-চোপড়, গয়না, এক স্যুটকেস ভর্তি বইপত্র।
বেরোবার সময় মাথা নুইয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আলী মর্তুজাকে কদমবুসি করলেন। আলী মর্তুজা কী করছেন কী করছেন বলে তাকে টেনে তুলতে চাইলেন, কিন্তু তালাক মেনে নেওয়া স্ত্রী গা ছোঁয়া বেশরিয়তি হতে পারে ভেবে হাত গুটিয়ে নিলেন। তালাক কার্যকর হযে গেছে মানে আর ছোঁয়া যাবে না।
গাড়ি যখন স্টার্ট দিচ্ছে, আলী মর্তুজা পরি কি মরি দৌড়ে জহরত আবার পছন্দের একটি বড় ক্রিস্টাল ফুলদানি গাড়িতে তুলে দিতে এলেন। বললেন, এটা আপনি অনেক ঘুরে পছন্দ করেছিলেন। এটা নিয়ে যান। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে ফুলের কোনো ব্যবহার নেই।
জহরত আরা হাত বাড়ালেন। তিনি ধরেছেন ভেবে আলী মর্তুজা হাত ছেড়ে দিলেন। গাড়ির গা ঘেঁষে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে ক্রিস্টাল ফুলদানিটা ভেঙে চৌচির। ক্রিস্টাল কাঁচের কাঠামো থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে টুকরোগুলো সূর্যালোকের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করেছে।
জহরত আরা কাঁচ নামিয়ে এক নজর ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে একবার চোখ তুললেন আলী মর্তুজার দিকে। বললেন, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।
আলী মর্তুজা হটাৎ তোতলাতে শুরু করলেন। জি দো-দো-দোয়া অবশ্যই করব।
ততক্ষণে গাড়ি অনেকটা পথ চলে গেছে। আর একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই জহরত আরা চলে যাবেন আলী মর্তুজার দৃষ্টিসীমার বাইরে।

আলী মর্তুজা বাড়ি থেকে আসা দুপুরে খাবারটা সেরে যথারীতি পিতলের চিলুমচিতে কুলি করলেন অথচ তার দোকানের একপ্রান্তে রানিং ওয়াটার ও ওয়াশ বেসিন আছে, সেটা ব্যবহার করলেই চলতো। কার বাসায়ও খাবার সময় চিলুমচি ব্যবহার করাটা জহরত আরা পছন্দ করতেন না। আলী মর্তুজা তাকে মান্য করে বেসিনে যেতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তার বিদায়ের পর চিলুমচি ফিরিয়ে আনেন।
দুপুরের কুলিটা সারতে না সারতেই বেশ কটা লাগাতার গুলির শব্দ শুনলেন। একবার মনে হলো শব্দটা তার দোকানের ঠিক পিছনে, একবার মনে হলো ডানে। কিন্তু একজন মানুষের চিৎকার শোনা গেল ঠিক দোকানের সামনেই। রক্ত ঝরছে আর মানুষটি চিৎকার করেছে, আমার ব্যাগ, আমার ব্যাগ। ব্যাগে জনতা ব্যাংক থেকে তোলা সাড়ে তিন লাখ টাকা। মানুষটা অজ্ঞান হয়ে গেলো, পুলিশ এসে পথচারীদের মতোই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আলী মর্তুজা বললেন, যাই হোক, আগে মানুষটাকে হাসপাতালে পাঠান। তার কথা শুনে পুলিশ দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
কেউ একজন বলল, দুই হোন্ডায় চারজন ছিল, একজন এমপি সাহেবের পোলা।
দোকান মালিকদের অনুরোধে কমিশনারের একজন সহযোগী অজ্ঞান মানুষটিকে রিকশায় তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির দিকে রওনা হলো। কেউই সম্পৃক্ত হতে চায় না। পরে তারা আবার না এমপিপুত্রের ক্রোধের শিকার হয়।
আলী মর্তুজা চেয়ারে ঝিমুচ্ছিলেন। আবারো একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ। এবার গোলাগুলি নয়, গুলিস্তান- সদরঘাট রুটের বাসের চাকা বাস্ট হয়েছে।
সন্ধ্যার দিকে প্রফেসর ইকবাল আহমেদ নয়াবাজার রোডের একপ্রান্তে তার রিকন্ডিশন টয়োটা করোলা থেকে নামলেন। সন্ধ্যার দিকে ট্রাফিক জ্যাম একটু বেশিই থাকে। বেপরোয়া কোনো রিকশাচালক গাড়ির শরীর একটা দীর্ঘ দাগ বসিয়ে দিক এটা তিনি কখনো চাইবেন না। দরকার হয় এক মাইল হেঁটে এসে গাড়িতে উঠবেন।
সুদর্শন যুবক, ফর্সা গায়ের রং, চিকন ফ্রেমের চশমা, ঘিয়ে রঙের শার্ট, নেভি ব্লু কিংবা কালো প্যান্ট। রাতের বেলা আলোর খুব কাছাকাছি না এলে নেভি ব্লুু আর কালোর ফারাকটা ধরা যায় না। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচিয়ে মাথা পেছনে হেলিয়ে সাইনবোর্ড পড়ছেন : মর্ডান বিল্ডার্স। তার মানে পেয়ে গেছেন। দোকানের নামের নিচে লেখা : এখানে এক নম্বর সিমেন্ট ও রড পাওয়া যায়। প্রোপাইটার : নুরু সরদার। নয়া বাজার রোড, ঢাকা। এটা অবশ্যই নয়। ফোনে বলেছেন পাশেরটা। ডান পাশেরটারা ঢাকা রেফ্রিজারেশন ওয়ার্কশপ, দোকানের ভেতরে বাইরে অনেক পুরনো রেফ্রিজারেটর। এটাও নয়। বাম পাশেরটাতে রড সিমেন্ট দেখা যাচ্ছে। ঘাড় উঁচিয়ে সাইন বোর্ডটা পড়লেন, বেশ বড় অক্ষরে লেখা : জহরত আরা ট্রেডার্স। সিমেন্ট ও রডের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা। প্রোপাইটার : আলী মর্তুজা ওরফে ময়না মিয়া। নয়া বাজার রোড, ঢাকা।
জহরত আরা ট্রেডার্স কেনো? ফাজলেমি নাকি? শুরুতেই ডক্টর ইববাল আহমেদের খটকা লাগল।
একজন মানুষ আসবেন এ প্রস্তুতি তার ছিলই। সাবেক স্ত্রীর বর্তমান স্বামী এক অর্থে আত্মীয়ই তো। মানুষটি আলী মর্তুজার চেয়ে ছয় ইঞ্চি না হলেও চার ইঞ্চি যে খাটো এটা নিশ্চিত। একটুখানি মোটার ধাঁচ আছে। মাথার সামনের দিকে চুলের ঘাটতি। টেলিফোনে তিনি যে স্বরে কথা বলেছেন চেহারা দেখে তার সাথে বেশ কিছুটা মিলিয়ে নেওয়া যায়। অধ্যাপকরা এমনই হন। এমন মানুষকে তো আর বলা যায় না, আসুন ভাই সাহেব, ভেতরে আসুন। তাকে স্যারই বলতে হয়। স্যার, অনুগ্রহ করে ভেতরে এসে বসুন। কিংবা স্যার, তশরিফ আনুন।
বিয়ের পরপরই নয়াবাজারে রাস্তার উপর ভালো লোকেশনে দোকানটা স্ত্রীর নামেই সাইনবোর্ডটা লিখিয়ে নেন, ট্রেড লাইসেন্স তার নামেই রয়ে যায়। আলী মর্তুজা সাধারণত ইস্ত্রি ভাঙা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরে দোকানে আসেন। বাইরে কোথাও যেতে হলে সেদিন পাজামা পরেন, পাঞ্জাবিতে একটুখানি পারফিউম স্প্রে করেন। আতরই মাখতেন, জহরত আরা পারফিউমটা ধরিয়েছেন। কখনো কখনো র‌্যায়বন সানগøাস সাথে নিয়ে আসেন, তবে চোখে কমই লাগান। টাকাটা তার হলেও জহরত আরাই এটা পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন।
সেদিন দোকানে এসেছেন লুঙ্গি আর হাফহাতা পাঞ্জাবি টাইপের একটি শার্ট পরে। এসব শার্টের তেমন প্রচলন তখনও ছিল না, পুরনো ফ্যাশানের, জহরত আরার অপছন্দের। শেভও করেননি। সাবেক স্ত্রীর বর্তমান স্বামীর কাছে নিজেকে যতটা অপাঙ্ক্তেয় করে উপস্থাপন করা যায়, চেষ্টাটা এই আর কি। আলী মর্তুজার এই কর্মকৌশল মূলত অধ্যাপক সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এই লোকটি অবশ্যই ডালিয়ার অযোগ্য এমন একটা ধারণা নিয়ে স্ত্রীর কাছে ফিরতে পারলে নিজেকে তিনি বিজয়ী ভাববেন। স্ত্রীকে বলতেও পারেন, তুমি এই গাড়লটাকে বিয়ে করলে কেমন করে? কাস্টমারকে সবসময়ই জেতার একটা অনুভূতি দেবার প্রচেষ্টা থাকে তার। এতে কাস্টমারের আনুগত্য বাড়ে, স্থায়ী কাস্টমার সৃষ্টি হয়। আলী মর্তুজা এটাই কেনো স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীর উপর প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন তিনিই ভালো জানেন।
সাইনবোর্ড পাঠরত মানুষটিকে দেখে আলী মর্তুজা তার স্টিলের চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, স্যার কি কাউবে খুঁজছেন? স্যার কি বুয়েট থেকে এসেছেন?
জি¦ বুয়েট থেকে। আমার সাথে আলী মর্তুজা সাহেবের কথা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় তার সাখে আমার দেখা করার কথা।
স্যার ভেতরে আসুন। আমিই মর্তুজা।
মানে আপনি আলী মর্তুজা? আমি ফোনে আপনার সাথে কথা বলেছিলাম?
জি¦ স্যার আমার আলী মর্তুজা ময়না মিয়া, ডাক নাম ময়না, ময়না মিয়া। তিনি অবশ্য ময়না মিয়া অংশটা পছন্দ করতেন না। স্যার আপনার অনুগ্রহ! আপনি আমার সাথেই কথা বলেছিলেন। ভেতরে একটু বসুন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দোকানের আর সব লোক বিদায় করে দেব। তখন কথা বরতে অসুবিধা হবে না।
নিজের চেয়ার থেকে সাদা তোয়ালে তুলে তা ছোট টেবিলের বিপরীত একই ধরনের একটি চেয়ারে বিছিয়ে বললেন, স্যার বসুন।
অধ্যাপক বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনি হাতের কাজ শেষ করুন। তারপর বসা যাবে।
স্যার, আশপাশের কোনো একটা রেস্তোরাঁয় বসা যেত। কিন্তু ভেতরে পরিবেশ আপনার পছন্দ হবে না। আফটার অল আপনি একজন অধ্যাপক। সাধারণত ফাতরা লোকজন রেস্তোরাঁয় আড্ডা মারে।
এবার অধ্যাপক বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে, এখানেই ঠিক আছে। আমি বসছি।
স্যার, হাজির বিরিয়ানি খাবেন? কাছেই কাজী আলাউদ্দিন রোডে। গরুর বিরিয়ানি। খুব টেস্টফুল-আমরা মাঝে মাঝে খাই।
অধ্যাপক ইকবাল আহমেদ খুব মেপে মেপে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মর্তুজা সাহেব। যদি সুযোগ হয় অন্য কোনোদিন খাবো। রাত সাড়ে আটটায় আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ডিনার অ্যাটেন্ড করতে হবে। দু’জন ইন্ডিয়ান গেস্টও থাকবেন। রিনাউন্ড প্রফেসর্স।
সব মানুষ বিদায় করতে দশ মিনিট লেগে গেল। দোকানের ছয় সারি শাটারের পাঁটি নামিয়ে দেয়া হলো। খোলা দরজা বরাবর মাথার উপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ‘দোকান বন্ধ’ সাইনবোর্ড। নিচে ছোট হরফে ‘আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’।
একজন কর্মচারী রেখে অন্যদের ছুটি দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, সাহেবের সাথে একটা বড় ডিল হতে পারে। আগে আলাপটা সেরে নিই।
মূল আলোচনায় পৌঁছার আগেই ইকবাল আহমেদ দেখলেন নয়াবাজারের লুঙ্গিপরা বড় সিমেন্ট ব্যাপারির টেবিল খাবারে ভরে গেছে। মোগলাই পরোটা, তন্দুরি রুটি, শিক কাবাব, এক হালি কমলা, কয়েকটা আতা ও সবেদা ফল, দু’কাপ চা এবং তস্তরিতে সাজানো পান।
তিনি বললেন, বলেছি তো আমাকে একটা ডিনার অ্যাটেন্ড করতে হবে।
সেজন্যই তো স্যার বিরিয়ানি আনতে নিষেধ করেছি। বিরিয়ানির পর চাইলেও আর তেমন কিছু খাওয়া যায় না।
থ্যাঙ্ক ইউ মর্তুজা সাহেব, আমি শুধু চা নেব।
তাহলে আগে সেভেন আপটা নিন।
তিনি বললেন, আমার সুগার প্রবলেম আছে। অবশ্য মার্জিনাল লেভেলে। তবুও চায়ে চিনি দিয়ে আনলে ফিরিয়ে নিতে বলুন। আমি ব্ল্যাক টি খাই।
মোগলাই পরোটায় কামড় বসিয়ে আলী মর্তুজা কর্মচারীটিকে বললেন, স্যারের জন্য ব্ল্যাক টি-নো সুগার নো মিল্ক। চা দিয়ে শাটার অর্ধেক লাগিয়ে বাইরে দাঁড়াও। দরকার হলে ডাকব।
ইকবাল আহমেদ সৌজন্যবশত জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির সবাই ভালো তো? আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?
জি বেঁচে আছেন। আমাদের আর একটা দোকান আছে নয়াবাজারের শেষ মাথায়। সিমেন্ট আর চুনা পাইকারি বিক্রি হয়। আমার আব্বাই সেই দোকানে বসেন। ওটার হিসাব-নিকাশ তিনিই করেন।
তিনি বললেন, আপনি ভাগ্যবান। আমার বয়স যখন এগারো বছর, আমার বাবা সরকারি দলের গুন্ডাদের হাতে নিহত হন। আমার মা একাই আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। তিনিও মারা গেছেন এগারো বছর আগে। আমি তখন শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির থিসিস ডিফেল্ড করছি। শেষ দেখার জন্য আসতে পারিনি।
আলী মর্তুজা আরও একটা ব্যাপার এড়িয়ে গেলেন। বাবার স্ত্রী হিসেবে যিনি আছেন দিলশাদ বানু, তার চেয়েও কম বয়সী, তার বাবার তৃতীয় স্ত্রী। জহরত আরার সমবয়সী। বছর দেড়েক এদিক-ওদিক হতে পারে।
এ রকম লুঙ্গিপরা একজন ব্যাপারির সাথে নিজের স্ত্রী প্রসঙ্গে আলাপ করতে তিনি দ্বিধান্বিতই ছিলেন। তারপরও বললেন, দেখুন আমি কোনো ভূমিকা দিতে চাচ্ছি না। সরাসরিই জিজ্ঞেস করছি। আপনি ডালিয়াকে বিয়ে করলেন কেন? আবার আপনাদের ডিভোর্সই বা হলো কেন? আপনি মুখের উপর বলে দিতে পারেন এটা আপনার পার্সোনাল ব্যাপার, আপনি আমাকে কিছু বলতে বাধ্য নন। কিন্তু আপনি এ কথা বললে, আমার জানার পথটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি বিশেষ করে, ডির্ভোস-এর কারণটা জানতে চাই।
আলী মর্তুজা রুটি ও কাবাব মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললেন, দুপুরের খাওয়াটা মার গেছে। ভেবেছিলাম আপনাকে নিয়ে রাতেরটা সেরে ফেলবো। যাকগে, যে প্রশ্ন আপনি করেছেন সে প্রশ্নটাই আমার ছিল কেনো বিয়ে করলাম, তালাকইবা কেন হলো?
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যাটা কার খুলে বলুন।
শুনুন স্যার, আমি তো জহরত আরাকে তালাক দিইনি। তিনি আমাকে দিয়েছেন-সমস্যা নিশ্চয়ই আমার।
আপনি বলতে চাচ্ছেন ডালিয়া ইননোসেন্ট, যাকে বলে নির্দোষ!
স্যার আপনার স্ত্রী জহরত আরা ভালো মানুষ। তার মন্দ কিছু আমার চোখে পড়েনি। তিনি ভালো বংশের মেয়ে উচ্চশিক্ষিত। আচার-ব্যবহার অতি উত্তম। আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল-শিক্ষিত বউ রান্নাঘরের জন্য নয়। তাকে তার পছন্দের কাজ আর পড়াশোনা করতে দাও। জহরত আরার যেন কোনো অযতœ না হয়। সংসারের সবাই তো আর যন্ত্রমানব নয়, রক্তমাংসের প্রাণী, হয়ত তার অযতœ হয়েও থাকতে পারে।
অধ্যাপক বললেন, তাহলে তো ডিভোর্স হবার কথা নয়।
ঠিক বলেছেন। আমি তালাক দিতে চাইনি। আমাকে তালাক দিতে হলে জহরত আরা সম্পর্কে কিছু মন্দকথা কাগজে লিখতে হতো। কিন্তু সে রকম মন্দ কিছু আমার যে চোখে পড়েনি। কী চলব-স্বামীর অবাধ্য! চরিত্র খারাপ। আসলে এমন একটা মেয়ে যে বউ হয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে এটাই তো সাত পুরুষের ভাগ্য। জহরত আরার মানে আপনার স্ত্রীর চাচা কি মনে করে, আধুনিক ও শিক্ষিত একটি মেয়েকে রড-সিমেন্ট-বালু ব্যাপারির হাতে তুলে দিলেন তিনিই ভালো জানেন। কনে দেখার দিনই বিয়ে। আপনার চাচাশ্বশুর আমার আব্বা আলী আহমদের হাতে ধরে বলেছেন, মেয়েটি বাবার আদর পায়নি। এই অভাবটা ঘুচিয়ে দেবেন।
আলী মর্তুজা বললেন, আমরা সবাই চেষ্টা করেছি, যেন কোনো কিছুরই অভাব বোধ না করে। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আসার জন্য বাবা একটা রিকন্ডিশনড গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আমাদের পরিবারের কোনো মেয়ে স্কুল ফাইনাল পেরোতে পারেননি, সেখানে জহর আরার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া-আসা আমাদের সবার জন্য উৎসবের মতোই ছিল। তারপরও সব বিয়েই তো আর সব দিক থেকে মেলে না। আমাদের বেলায় হয়ত দু-একটা তার ছেঁড়াই ছিল। তালাকটা জহরত আরাকেই দিতে হয়েছে, আর তা করতে গিয়ে উকিলের কথামতো আমার বিরুদ্ধে দু’চারটে কথা বলতেই হয়েছে। ঠিক বলতে নয়, উকিলের ড্রাফটে সই করতে হয়েছে। এটা ভুল কিছু করেনি। সিস্টেমটাই এমন হয় স্বামীকে নয় স্ত্রীকে কিছু মন্দকথা হজম করতে হয়।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন ডালিয়া আপনার সম্পর্কে কি বলেছেন? মানে তালাকের কি কারণ দেখিয়েছে।
এটা একটা বাঁধা গৎ। তালাকে শুনানিতে কনটেস্ট না করলে ওসব লেখা বা না লেখার কোনো মানে নেই। কিন্তু কনটেস্ট করলে প্রমাণের দায়িত্ব অভিযোগকারীর। আমি তো সবই মেনে নিয়েছি।
ডালিয়া কি বলেছে সেটা বলুন।
বলেছে তার স্বামী আলী মর্তুজা দুশ্চরিত্র, পরনারী আসক্ত, মদ্যপ, স্ত্রী নির্যাতনকারী, ভরণপোষণে অক্ষম, সর্বোপরি স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক শান্তিদানে ব্যর্থ একজন পুরুষ। তাকে উকিলও আমিই ঠিক করে দিয়েছি। উকিলের ফিসও আমারই দেওয়া। তবে একটা কথা ঠিক, জহরত আরা শুধু সই করেছেন, একটি লাইনও পড়ে দেখেনি।
প্রফেসর ইকবাল আহমেদের স্বরে প্রচণ্ড বিরক্তি। বললেন, তালাক দিল ডালিয়া। আপনি তাহলে তাকে কাবিনের দু’লক্ষ টাকা দিতে গেলেন কেন?
আলী মর্তুজা মাথা নিচু করে রইলেন। এটা তো কারো জানার কথা নয়।
শুনুন ব্যাপারি সাহেব, কিছু লুকোবার চেষ্টা করবেন না। টাকার কথা ডালিয়াই আমাকে বলেছে। টাকাটা আপনি তাকে কি উদ্দেশ্যে দিলেন শুনি? যাতে মেয়েটা অন্য কারো সঙ্গে ঘর করার সময়ও আপনার কথা স্মরণ করে, তাই নয় কি? এটা কোন ধরনের পারভার্সন বলুন তো?
আলী মর্তুজা বললেন, আপনার কথার মানে আমি পুরোটা বুঝতে পারিনি, তবে জহরত আরা যদি টাকা দেবার কথা আপানকে বলে থাকেন, তাহলে এটাই সত্যি, দিয়েছি। আমার উদ্দেশ্যটা ভিন্ন ছিল। একটা বিয়ে ভাঙার আর নতুন সর্ম্পক হওয়ার মাঝখানের সময়টাতে একজন মেয়েমানুষকে অনেক যাতনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে তিনি অর্থকষ্টে পড়েন। জহরত আরা যেন অর্থকষ্টে না ভোগেন সে জন্যই টাকাটা দেওয়া। তিনি নিতে চাননি। আমি জোর করে দিয়েছি। তখন তিনি শেষ পর্যন্ত বলেছেন, তাহলে এটা ধার হিসেবে নিচ্ছি। কখনো আমার হাতে টাকা এলে শোধ করব। আমি তার কথা মেনে নিয়ে বলেছি, আচ্ছা ধারই। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যেদিন ফেরত দিতে পারবেন, দিলে অবশ্যই ফেরত নেবো।
জহরত আরা তখন বলেছেন, কথাটা মনে থাকে যেন।
তার মানে আপনি ডালিয়ার মনের ভেতর একটা স্থায়ী আসন দখল করে রাখার জন্য উদারতার এক নাটক সাজিয়েছেন। আর আপনার এই উদারতার দাম দুই লক্ষ টাকা। ভুল বললাম নাতো?
আপনারা উচ্চশিক্ষিত মানুষ, ভুল কেমন করে বলবেন।
তাহলে এটা হচ্ছে আপনার ডার্টি কনস্পিরেসি।
আলী মর্তুজা বলেছেন, আমরা অশিক্ষিত মানুষ বিদ্যাশিক্ষার মর্যাদা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই, আমরা টাকা দিয়ে দাম দিতে চেষ্টা করি। আপনার মতো একজন অতি উচ্চশিক্ষিত মানুষ জহরত আরাকে বিয়ে করে যে মর্যাদা দিয়েছেন আমার সারাজীবনের কামাই আপনার পায়ে ঢেলে দিলেও তো তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারবো না।
প্রফেসর ইকবাল আহমেদ কিছুটা চটেই গেলেন, বললেন, ব্যাপারি সাহেব, পরনে ঢাকাই লুঙ্গি হলে মেয়ে পটানোর সবক দেখছি ভালোই নিয়েছেন। আপনি চেয়েছেন ডালিয়া যেখানেই থাক আপনাকে যেন মনে রাখে। আমাদের জন্য আপনার করুণাকে যেন মহত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করে।
তিনি অনুচ্চস্বরে বললেন, শালা মামদোবাজ নিজের বউ ধরে রাখার সামর্থ্য নেই, অন্যের বউয়ের মনে শালা ব্যাপারির বাচ্চা বেঁচে থাকতে চায়।
আলী মর্তুজা সনাতন ঢাকাইয়া ভাষায় বলতে পারতেন তোর মায়রে বাপ। কিন্তু সে পথে এগোলেন না। একবার ভানু বন্দোপাধ্যায়ের মতো বলতে চাইলেন এই নিন জনাব আমার বর্তমান স্ত্রীর ঠিকানা, চেষ্টা করে দেখুন তার মনে আপনার স্থান হয় কিনা।
প্রফেসর নিশ্চিত হলেন, ডালিয়া ঠিক কাজটিই করেছে। লুঙ্গিপরা এমন বিদঘুটে এক রড-সিমেন্ট পাইকার ডালিয়ার হাজব্যান্ড হতে পারে না। অসম্ভব! শুরুতেই ভুল করে ফেলেছিল, তবুও ভালো যে বুঝতে পেরে এই ভুলের চক্কর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আলী মর্তুজা জহরত আরার স্বামী হিসেবে নিজের অযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাবেক স্ত্রীর জন্য তার একটা সূ² টান থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য যে জহরত আরার টান নেই প্রফেসর সাহেব সম্ভবত সেটাই নিশ্চিত হতে এসেছেন। এটা আসলে তার দ্বিধামুুক্তির সাক্ষাৎকার।
জহরত আরার ডাকনাম ডালিয়া-আলী মর্তুজার পরিবারের সবাই জানত। কিন্তু শ্বশুর আলী আহমেদ ভরাট গলায় ডাকতেন জহরত আরা। একটুখানি ঢাকাই টান অবশ্যই ছিল। তার কারণেই ডাকনামটা এ বাড়িতে প্রচলিত হয়নি।
জহরত আরার বিদায়ের পর আলী মর্তুজা তার বাবাকে বলেছেন দোকানের নামটা বদলে ফেলব। তিনি রাজি হননি। বলেছেন, এই নামেইতো ব্যবসা এসেছে, সমস্যা কী? থাকুক নাম।
জহরত আরা ট্রেডার্সই রয়ে গেছে। সাবেক স্ত্রী নিয়ে এভাবে তার বর্তমান স্বামীর কাছে বিব্রতকর জেরার মুখে পড়তে হবে আলী মর্তুজা ভাবেননি। এক সময় তার বিরক্তি ধরে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারী ভেতরে একবার ঢুঁ মেরে জিজ্ঞেস করল, আর কিছু লাগবে?
সম্ভবত সে বলতে চেয়েছে খামাখা আর কতক্ষণ? দু’পাশের দোকানের শাটার টানছে। জহরত আরা ট্রেডার্সে এখন তালা ঝুলবে।
জেরা করার বিষয়টি অধ্যাপক ইকবাল আহমেদের জন্যও কম বিব্রতকর নয়। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, ডালিয়ার সঙ্গে আপনার সেক্সুয়াল লাইফ কেমন ছিল?
অনেক্ষণ মাথা নুয়ে রেখে তিক্তস্বরে বললেন, ছিল আরকি কোনো রকম। স্যার আপনি ধরে নিন আমি একটা আস্ত ধ্বজভঙ্গ।
আলোচনা আর এগোয়নি। নাক দিয়ে ঘোড়ার মতো একটা ধ্বনি ঝেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর টাইম অ্যান্ড কো-অপারেশন। আপনার সাথে আর একটা সেশন বসতে হবে। আরও কিছু জানার ছিল। বিশেষ করে ডালিয়া চলে যাবার এতোদিন পরও দোকানের নাম রেখে দিয়েছেন জহরত আরা ট্রেডার্স? এটা কি স্বাভাবিক মানুষের আচরণ, যা অস্বাভাবিক, তাই পারর্ভাসন।
ডিপার্টমেন্টের ডিনার ধরার জন্য তড়িঘড়ি করে তিনি রাস্তায় নামলেন। গাড়িটা রাস্তার কোন প্রান্তে মনে করার চেষ্টা করলেন। তার আগে আরো একবার সাইনবোর্ড দেখে নিলেন, ঠিকই আছে, জহরত আরার নামেই। আলী মর্তুজাও দোকানের বাইরে পা দিয়ে বললেন, স্যার তো কিছু খেলেন না। আসসালামু আলাইকুম।
ডক্টর ইকবাল আহমেদ তার গাড়ির কাছে চলে গেলেন।
আলী মর্তুজা কর্মচারীটিকে ডেকে বললেন, তোমার ভাগের খাবার রেখে বাকিটা প্যাকেট করে দাও। বাসায় নিয়ে যাবো।
যাতে এই খদ্দের নিয়ে কানাঘুষা না হয় সেজন্য জোর গলায় বললেন, শালা ছোটলোক রডের যে দাম বলল, মিলগেটে দামও তো তার চেয়ে বেশি। সময়টা নষ্ট।
কর্মচারী বলল, রড কেনার যখন মুরোদ নেই, হালারে জিংলা কিনতে কন, সন্ধ্যাটা মাইর দিল।
আলী মর্তুজা বললেন, তা হোক তবুও কাস্টমার ল²ী। হেলা করতে নেই।
সন্ধ্যাটা নষ্ট হওয়ায় ক্ষিপ্ত কর্মচারী বলল, হালায় মনে হয়ে গোয়েন্দা। মালের ধান্ধায় আইছে। সামনে ঈদ। আবার আইতে পারে।
বাসায় ফেরার পথে আলী মর্তুজা নিজেকে শোনালেন, যা বলেছি আশা করি প্রফেসর সাহেব এ মুখো হবেন না।
নিজেকে নপুংসক হিসেবে উপস্থাপন করার মজাটাই অন্যরকম।

যখন প্রফেসর ইকবাল আহমেদ ডাইনিং হলে ঢুকছেন আর সহকর্মীদের কেউ কেউ হাত ধুয়ে মুছে সস্ত্রীক টুথপিক দিতে দাঁত খোঁচাতে শুরু করেছেন। ক্ষুদ্র খাদ্যকণা দাঁতের ফাঁকে আশ্রয় নিয়েছে, মাংসের আঁশও। পান মুখে ঢুকিয়ে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরিতে এলে যে, বউ আনোনি? কখনো এনেছো বলে মনে করতে পারছি না।
চেয়ারম্যানের স্ত্রী বললেন, ঠিক বলোনি। পিকনিকে এসেছিলেন। তোমার জোর করে ভাবীকে দিয়ে একটা গানও গাইয়েছিলেন। মনে নেই ওই যে গেয়েছিলেন, লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলে।
চেয়ারম্যান বললেন, আরে হ্যাঁ, তাইতো। পিকনিকে পর ক’দিন আমরা ইকবালকে মজনু মিয়া ডেকেছি। অবশ্য নামটা স্যুট করেনি। মজনুকে তো হতে হয় দিওয়ানা। কাপড়-চোপড়ের কোনো বাছ-বিচার ও নিশানা থাকবে না। চুল এলোমেলো, চোখে উদাস ভাব। কিন্তু আমাদের ইকবাল বলতে গেলে অল সিজন স্যুটেড বুটেড, নিপাট চুলের ভাজ, চোখে নকল ধরার সার্চ লাইট।
পরক্ষণেই বললেই বললেন, যাও ইকবাল তাড়াতাড়ি প্লেট নাও। দেখ উচ্ছিষ্ট কী আছে। মুরগির রোস্ট যে নেই, আমি নিশ্চিত। বুফেতে খাবার শৃখলা ও উদার মানসিকতা আমরা এখনো অর্জন করিনি। দেখো দু-এক টুকরো মাটন পাও কিনা।
যথেষ্ট খিদে ছিল তার। রোস্ট সত্যিই পাননি। মিনিট দশেক দেরি হলে মাটনও মিলতো না। খাবারটা মুখে তুলে চিবোতে শুরু করতেই জিহ্বায় কামড় পড়ল। ডালিয়ার প্রথম স্বামীজনিত দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। একটা অনুচ্চ আর্তচিৎকার দিয়ে তিনি প্লেটটা রেখে দিলেন। ততক্ষণে চোখেতে পানি এসে গেছে, কামড়ের যন্ত্রণায়। প্রফেসর আশরাফ এগিয়ে এসে বললেন, মাংসটা খুব ঝাল করে ফেলেছে। আমিও তোমার মতো প্লেট রেখে দিয়েছি।
চেয়ারম্যান আফটার ডিনার স্পিচ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তিনি পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লেন। ক্ষুধা জিহ্বায় দাঁতের কামড় এবং আলী মর্তুজার উপর ক্রোধ-সব মিলিয়ে বিগড়ানো মেজাজ নিয়ে অন্তত পাঁচবার কলিং বেল টিপলেন ভেতর থেকে কেউ দরজা খুললেন না। ডালিয়া ছাড়া দরজা খোলার মতো আর কেউ নেই।
মেজাজ আরো খারাপ হলো। দরজায় ধাক্কা দিলেন। ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে ডালিয়া দরজা খুললেন। বললেন, সরি গোসল করছিলাম।
তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, রাত দশটায় আবার কিসের গোসল?
আমি তো রাতেই গোসল করি।
সারাদিন কি করো?
তোমাকে তার জবাবদিহি করতে হবে নাকি?
মেজাজ খারাপ হলে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। তিনি দ্রুত দুটো প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আর দেড় গøাস পানি খেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, জহরত আরা রড ব্যাপারির সাথে তোমার তালাকের কারণটা কি জানতে পারি।
মানে?
প্রশ্নটা বোঝনি?
এখন জানতে চাচ্ছো কেন? বিয়ের আগেই তোমাকে বলেছি, মেলেনি তাই ডিভোর্স হয়েছে। তুমি এর বেশি শুনতে চাওনি এমনকি মেলেনি যে সেটাও আমি সেধে তোমাকে বলেছি। এখন তোমার সমস্যাটা কী শুনি।
তুমি আমাকে আসল কারণটি বলোনি। আজ সেটা বের করেছি?
কোনটা আসল কারণ?
তোমার আগের হাজব্যান্ডের ধ্বজভঙ্গ রোগ ছিল?
মানে?
মানে জিজ্ঞেস করছো কেন? ওল্ড টাউনের সংসার করেছ আর ধ্বজভঙ্গ মানে জানো না? বেশ না জানলে বলে দিই। তোমার ওই রড ব্যাপারির ইরেকশন হতো না।
ডালিয়া অবাক হলেন, বিব্রতও। ইকবাল আহমেদ তাকে কখনো জহরত আরা নামে ডাকেনি। ডাকতেন আলী মর্তুজা। ইকবাল ডাকেন ডালিয়া। হঠাৎ জহরত আরা ডাকতে গেলেন কেন?
আলী মর্তুজা বলতেন, ডাক নামে ডাকলে পুরো মানুষটার ছবি তার চোখের সামনে ভাসে না। জহরত আরা ধ্বনিটা যখন কানে পৌঁছে চোখের সামনে দ্রুত পা থেকে মাথা পর্যন্ত জীবন্ত ও সুন্দর একজন মেয়ে মানুষের ছবি দাঁড়িয়ে যায়।
ডালিয়া সুশিক্ষিত স্বামীর মুখে ধ্বজভঙ্গের মতো শব্দ শুনতে মোটেও আগ্রহী নন। সাবেক স্বামীর সঙ্গে যৌনজীবন কেমন ছিল, সেই স্বামীর ইরেকশন হতো কি হতো না এটা তার আলাপের বিষয় হতে পারে না। সোজা কথা এটা রুচিকর নয়। তখন তার মনে হলো আলী মর্তুজা তাহলে একজন রুচিশীল মানুষ ছিলেন। ইকবাল আহমেদ চিৎকার করে বললেন, কথা বলছো না কেনো? ইরেকশন হতো, না হতো না।
আজেবাজে কথা বলো না।
তিনি চোখমুখে খিঁচিয়ে বললেন, আজেবাজে কথা হবে কেন? দিস ইজ অ্যা ফ্যাক্ট অব লাইফ। সত্যি হলে হ্যাঁ মিথ্যে হলে না সরাসরি বলে দাও। এখানে লুকোচুরির কি আছে?
ডালিয়া বললেন, আমি এসব ডার্টি ডিসকাশনে নেই।
তার মানে শুধু এ জন্যেই রড ব্যাপারিকে ছেড়ে এসেছো নতুবা ছাড়তে না?
ডালিয়া ইকবাল আহমেদকে আর বাড়তে দিতে রাজি নন।
এবার তিনিই উচ্ছস্বরে বললেন, তুমি যে কত বড় বীর বাহাদুর তা আমার জানা আছে।
অধ্যাপক ইকবাল আহমেদে পৌরুষের দৌড় সম্ভবত ডালিয়ার জানা বলেই তিনি হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
সে রাতে ইকবাল আহমেদের খাওয়া হয়নি। বেডরুমেও ঢোকেননি। গেস্ট রুম নামের বাড়তি রুমটিতে শার্ট-প্যান্ট পরা অবস্থাতেই শুয়ে পড়লেন। টানা ঘুম হলো। সকালে টেবিলে নাস্তা ছিল। তিনি একবার নাস্তার দিকে তাকিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, কথাও বললেন না স্ত্রী সাথে।
স্বামীর এই অপ্রত্যাশিত আচরণের কারণ খুঁজে পেলেন। ডালিয়া আহমেদ অনুচ্চস্বরে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখলেন : ইকবাল তুমি আলী মর্তুজাকে টানছে কেন? আমি কখনো আমান্দাকে আলোচনায় এনেছি? ¯্রফে কৌতূহল থেকে একবার ইকবালের মুখ থেকে শোনা দরকার ছিল। শুনেছি, বিশ্বাসও করেছি। দ্বিতীয়বার তো জিজ্ঞেস করিনি। তাহলে ইকবাল কেন এই প্রসঙ্গ টানছে।
আমান্দার কথা মৃদুভাষী স্বামীর কাছে শুনে কেবল বলেছে, ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভাগিস্য তুমি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে এসেছো। নতুবা তোমাকে ঠিকই খুন করে ফেলতো। বর্ণবাদ নিয়ে যা-ই বলুক না কেনো আফ্রিকান কালোগুলো কিন্তু ভেরি ডেঞ্জারাস।
তখনও ডালিয়া স্বামীর চোখেমুখে আতঙ্কের আভাস দেখেছে।

ইকবাল আহমেদ পিএইচডির শেষ বছর শেফিল্ডের একটি টেকঅ্যাওয়ে রেস্তোরায় শনি, রবি দু’দিন কাজ করতেন। পেরুর মেয়ে আমান্দা সিগফ্রিড ওকাম্পো আগে থেকেই এখানে কাজ করে আসছিল। রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কারণেই তিনি পরিচয়ের দিনই জিজ্ঞেস করেন, ওই নামের কেউ কি তার আত্মীয়?
আমান্দা জবাব দেয়, নেভার হার্ড অব হার। ডিড শি ডাম্প ইউ? আই অ্যাম নট দ্যাট টাইপ।
তাকে ডাম্প করার প্রশ্নই আসে না। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সর্ম্পকে তার ধারণাই নেই। কখনো নামই শোনেনি। গাছের পাকা ফল মানুষ সেভাবে নিচ থেকে আলতো করে স্পর্শ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঠিক তেমন করে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্তন ছুঁয়েছিলেন। এ কথা রবীন্দ্রনাথ জনে জনে বলে বেড়াননি। ভিক্টোরিয়ার ছাপা হওয়া ডায়েরিতে সে বৃত্তান্ত নিজেই লিখেছেন।
ওকাম্পো নামের কারণে এবং আমান্দা তার বয়ফ্রেন্ডকে ডাম্প করার মতো মেয়ে নয় সে আশ্বাসের কারণে ইকবালের সাথে তার সম্পর্ক ঘনীভূত হতে থাকে। পিএইচডি হয়ে গেলেই ইকবালের বাজারদর বেড়ে যাবে, এমনকি হাতছাড়াও হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় আমান্দা তাকে দ্রুত নিজের সাথে গেঁথে ফেলতে চেষ্টা করল। আর ইকবাল উইকএন্ডের কাজ শেষ করে মাঝরাতে ডরমিটরিতে না ফিরে মাঝপথে একসাথে চলে যেত আমান্দার ছোট্ট কাউন্সিল ফ্ল্যাটে। দেখতে সুন্দর, গায়ের রং ফর্সা এমন একটি মেমবউ বাংলাদেশে নিয়ে গেলে মন্দ হবে না। চিন্তাটা মাথায় পাকাপাকিভাবে গেঁথে যেতেই ইকবাল আমান্দাকে প্রপোজ করলেন।
আমান্দা বলল, ডোন্ট রাশ ইনটু ম্যারেজ।
তখন ইকবালের মনে হলো আমান্দা তাকে এড়াতে চাচ্ছে।
সুতরাং আমান্দার জন্য তার টান আরো বেড়ে গেল। প্রায় জোর করেই আমান্দাকে বিয়ে করল। ডরমিটরির পাট চুকিয়ে আমান্দার ফ্ল্যাটে বসতি স্থাপন করল। প্রথম দিককার উত্তেজনা ও আনন্দ এবং নিজস্ব অধিকারে একজন ক্যারিবীয় নারী রাখার চ্যালেঞ্জ তাকে আর্থিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করল এবং থিসিস ডিফেল্ড করা সময়টা পিছিয়ে দিল পুরো একটা বছর। পিএইচডি নিশ্চিত হবার পর পরই তিনি

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়