গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

শিশু লালনের বর্তমান কিছু চ্যালেঞ্জ : শ্যামল আতিক > প্রবন্ধ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১০, ২০২৪ , ৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

শিশু প্রতিপালন নিয়ে অভিভাবকরা বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের তা মোকাবিলা করতে হয়নি। গত দুই দশকে প্রযুক্তির প্রসার ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো খুব দ্রুত আমাদের সামনে ঘটে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে শিশুদের লালন করতে অভিভাবকদের করণীয় কী- তা অনেক শিক্ষিত মা-বাবাও বুঝে উঠতে পারছেন না। শিক্ষাবঞ্চিত অভিভাবকদের কথা বাদই দিলাম।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি শিশুর বিকাশের ঠিক কোন জায়গাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অভিভাবকদের ভুল আচরণ শিশুদের জীবনে কী ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসছে? চ্যালেঞ্জ উত্তরণে অভিভাবকদের করণীয় কী- এই বিষয়গুলোর উত্তর জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন কিছু বিষয় তুলে ধরাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। আশাকরছি অভিভাবকরা উপকৃত হবেন।

শিশুর স্ক্রিন আসক্তি
আমাদের শৈশবে বর্তমান শহুরে শিশুদের মতো ছিল না। প্রতিদিন খোলা মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পেয়েছি, পুকুর বা নদীতে সাঁতার কেটেছি, দু-চোখ ভরে নীল আকাশ দেখতে পেতাম, দূর-দিগন্তের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ ছিল অবারিত, বুক ভরে নির্মল বাতাস নিতে পারতাম ইত্যাদি। এই প্রজন্মের শিশুদের জন্য এই সুযোগগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। তাদের কাছে এই বিষয়গুলো অনেকটা কল্পনার মতো।
যেহেতু খোলামাঠ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব, তাই বাধ্য হয়েই শিশুদের ঘরের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। অভিভাবকরাও নিরুপায়। নিরাপত্তাজনিত কারণে ইচ্ছে করলেই শিশুকে ঘরের বাইরে যেতে দিতে পারছেন না। ছোট্ট শিশু চঞ্চলতাই যার স্বভাব, কতক্ষণ বন্দি থাকতে চাইবে। কিছুক্ষণ আপনার কাছে আসবে, তারপর আরেকজনের কাছে যাবে, খেলাধুলা করতে চাইবে। ব্যস্ততার কারণে আপনিও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না।
অনেক অভিভাবক শান্ত রাখার জন্যে শিশুকে টেলিভিশন, ট্যাব অথবা মোবাইল ফোনের সামনে বসিয়ে দিচ্ছেন। টিভিতে কার্টুন দেখে অথবা কম্পিউটারে গেমস খেলে অথবা স্মার্টফোনে ইউটিউব দেখে শিশু সময় কাটাচ্ছে। আপনিও খুশি কারণ শিশু এখন বিরক্ত করছে না।
কিন্তু আসল সত্য জানলে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না, খুশি হওয়া তো দূরের কথা। স্ক্রিনে বেশিক্ষণ সময় কাটালে শিশুর মধ্যে এক ধরনের আসক্তি জেগে ওঠে। বিজ্ঞানীদের মতে এই আসক্তি কোকেনের মতোই ভয়াবহ। ব্রেন স্ক্যানিং করে দেখা গেছে কোকেন আসক্ত ও স্ক্রিন আসক্ত উভয় দলেরই মস্তিষ্কের সামনের দিকের হোয়াইট ম্যাটার ক্ষয়ে যাওয়া। অথচ আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এই হোয়াইট ম্যাটার অংশ।
আরো ভয়ংকর দিক হচ্ছে স্ক্রিন আসক্ত শিশু বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে অসামাজিক হয়ে ওঠে। মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে যাওয়ার কারণে ব্যক্তির চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি তারা বুঝতে পারে না। ফলে অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
নড়াচড়া করতে হয় না বলে শিশুরা মুটিয়ে যাচ্ছে, হাড় ও মাংসপেশী মজবুত হচ্ছে না। চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, অটিজমের হার বাড়ছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছ বলে এই শিশুদের মধ্যে হতাশা, বিরক্তি, জেদ ধরা ইত্যাদি আচরণগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও অসহায়। অনেকেই বুঝতে পারছেন না- শিশুকে স্ক্রিন আসক্তি থেকে কীভাবে মুক্ত করবেন। তারা যখন শিশুকে ধমকান বা মোবাইল/ ট্যাব কেড়ে নেন, এতে শিশু খুব প্রতিক্রিয়া দেখায়। চিৎকার চেচামেচি করে, প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখায় এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পারে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মাদকাসক্তির মতো এটিও এক ধরনের আসক্তি। তাই শোধরানোর কাজটি করতে হবে ধীরে ধীরে, যাতে শিশু বুঝতে না পারে। স্ক্রিনে সময় কাটানোর পরিমাণ কমাতে হবে ধাপে ধাপে। ধরুন আপনার শিশু দিনে সাত ঘণ্টা স্ক্রিনে সময় কাটায়। তাকে বলতে পারেন, এখন থেকে তুমি পাঁচ ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে থাকতে পারবে- সকালে দুই ঘণ্টা, বিকেলে দুই ঘণ্টা, রাতে এক ঘণ্টা। এভাবে আস্তে আস্তে সময়ের পরিমাণ কমাবেন। তবে প্রথম দিকে খুব বেশি সময় কমাতে যাবেন না।
অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ যতক্ষণ বাসায় থাকবেন, শিশুকে গুণগত সময় দেয়ার চেষ্টা করবেন। এই সময়টা টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে ব্যয় না করে সন্তানের সাথে খেলাধুলা করুন। খেলাধুলার সঙ্গী পেলে শিশু স্ক্রিন থেকে দূরে থাকবে। এ সময়ে শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া (অর্থাৎ পরিবার ও আশপাশের মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ) এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা (গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তুসহ প্রকৃতির সাহতে পরিচয় ঘটানো)।
তাই তাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন, প্রকৃতির কাছে যান, সবুজ ঘাসের ওপর হাটুন। যদি এই কাজগুলো করতে পারেন, তাহলে শিশু স্ক্রিন আসক্তি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে পারবে। তবে সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ শুরু থেকেই শিশুকে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন।
শিশু খেতে চায় না
এই অভিযোগ বেশিরভাগ মায়ের। দরিদ্র পরিবারে শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা নেই বললেই চলে। যত অভিযোগ সচ্ছল পরিবারে। গ্রামে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যেও এই সমস্যা অনেক কম। শহরের শিশুদের মধ্যে কেন এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল?- তা আমরা তলিয়ে দেখছি না। সমস্যার কারণ চিহ্নিত না করে উল্টো আমরা শিশুদের খাওয়ানোর জন্য তোড়জোড় করছি।
প্রথম কারণ হচ্ছে, ক্ষুধার্ত হওয়ার আগেই শিশুকে খাওয়ানোর জন্য জোরজবরদস্তি করা। আমরা ভুলে যাই যে শিশু তখনই খাবে যখন তার ক্ষুধা লাগবে। যেহেতু শহুরে শিশুরা ঘরের বাইরে খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না, তাই তাদের ক্ষুধার মাত্রাও কম। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জাঙ্ক ফুডের অনাচার। স্বাভাবিক খাবারের আগে চিপস, বিস্কুট, আইস্ক্রিম, ফাস্ট ফুড, চানাচুর ইত্যাদি মুখরোচক খাবার দিয়ে শিশুর পাকস্থলি ভরাট হয়ে যায় বলে, শিশু আর স্বাভাবিক খাবার খেতে আগ্রহ দেখায় না।
তখন আদরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মা, বাবা, দাদা-দাদি অথবা নানা-নানি সবাই মিলে শিশুকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবারের জন্য চাপাচাপি করেন। এতে শিশু চরম বিরক্ত হয়, খাবারের প্রতি অনীহা দেখায়। প্রতিদিন একই খাবার দিলে যে শিশুদের মধ্যে খাবারের প্রতি একঘেয়েমি চলে আসে, সেটাও আমরা বুঝতে চাই না।
আবার শিশু সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বললেও শিশু খাবার খেতে অনীহা দেখাতে পারে। যেমন সবার সামনে যদি বলা হয় ‘আমার বাচ্চা খায় না’, এতে শিশুর আত্মসম্মানে লাগে। প্রতিশোধ হিসেবে শিশুও খাবার খেতে চায় না। মা-বাবার কাছ থেকে গুণগত সময় না পেলেও শিশু খাবার নিয়ে দুষ্টুমি করতে পারে।
মাঝে মধ্যে শিশু এমনিতেই কম খেতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। বিষয়টি সাময়িক, রুচি ফিরে আসলে তা আবার ঠিক হয়ে যায়। আসলে খাবার গ্রহণ যে কোনো প্রাণীর মধ্যে স্বভাবজাত। বাঁচার প্রয়োজনেই শিশু খাবার খাবে। তাই খাবার নিয়ে শিশুর সাথে চাপাচাপি নয়, শিশু যখন খেতে চায় তখনই খেতে দিন। প্রয়োজনে প্রতিদিন একই মেন্যু না দিয়ে, খাবারে বৈচিত্র্য আনুন। দেখবেন, শিশু ঠিকই খাচ্ছে।
এরপরও যদি খেতে না চায়, বুঝতে হবে শিশুর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

কর্মজীবী মা-বাবাদের বিপদ
অনেক পরিবারে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীও কর্মজীবী। কারণ একজনের উপার্জনে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা বেশ কঠিন। আবার সচ্ছলতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা নারীরা নিজ যোগ্যতা বলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। নিঃসন্দেহে এটা সামাজিক অগ্রগতির লক্ষণ।
তবে বিপত্তি ঘটে শিশুর লালন পালনের ক্ষেত্রে, শিশু কার কাছে থাকবে? পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ মা-বাবা অথবা মুরব্বি থাকলে কোনো রকমে রক্ষা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাসায় গৃহকর্মী রেখে সাময়িক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এর ফলে শিশুর বিকাশে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার খবর কী আমরা কেউ রাখছি।
মা-বাবার অনুপস্থিতিতে শিশু গৃহকর্মীর কাছে বড় হচ্ছে। গৃহকর্মীর ভাষা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করছে। গৃহকর্মীর যতেœ যদি মমতা ও আন্তরিকতার অভাব থাকে তাহলে শিশুর আবেগীয় চাহিদায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। ক্রমাগত স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে মা-বাবার সঙ্গে শিশুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরিবারে বাস করেও সে বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে।
কর্মজীবী মা-বাবা সারাদিন কাজ সেরে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম প্রত্যাশা করেন। বাসায় এসে শিশুকে যতটুকে সময় দেন তাতেও মনোযোগের ঘাটতি থাকে। শিশু প্রশ্ন করলে ঠিক মতো উত্তর দিচ্ছেন না, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না, মোবাইল ফোন বা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকছেন- এই বিষয়গুলো শিশু বুঝতে পারে। তখন মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা বা প্রতিশোধ হিসেবে শিশু নানা ধরনের সমস্যাপূর্ণ আচরণ করে।
তাই কর্মজীবী মা-বাবার জন্য পরামর্শ হচ্ছে বাসায় ফিরে শিশুকে ১৫ মিনিট বিশেষ সম্য় দিন। এটা পারিবারিক সময় থেকে ভিন্ন। আসলে পারিবারিক সময় আর বিশেষ সময় এক জিনিস নয়। পারিবারিক সময়ে আপনি সবার সঙ্গে থাকছেন ঠিকই, কিন্তু কারও প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু বিশেষ সময়ে শিশুর প্রতি কিছুক্ষণের জন্য পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছেন। এই ব্যাপারটি দারুণ কাজ করে। এর ফলে শিশু নিজেকে সম্মানিত মনে করে, অনেক সমস্যা এমনিতেই কেটে যায়।
আরেকটি কাজ করা যেতে পারে। বাসার কাছে কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে সেখানে শিশুকে দিতে পারেন। শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক না কেন শিশুর সামাজিকীকরণে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। ডে-কেয়ারে শিশু অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়, খেলাধুলা করতে পারে, কিছুটা আত্মনির্ভরশীল হতে শেখে। স্কুলে ভর্তির সময় এই শিশুরা খুব দ্রুত নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। আর ডে-কেয়ার সেন্টারে যদি আদব, শিষ্টাচার ও প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞান শেখানো হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা বাড়তি পাওয়া।
তবে ডে-কেয়ারে দেওয়ার আগে অবশ্যই খোঁজখবর নেবেন। কারণ ডে-কেয়ার সেন্টারের কর্মীদের যদি শিশু লালন ও প্যারেন্টিং সম্পর্কে প্রশিক্ষণ না থাকে, তাহলে হিতে বিপরীতে হতে পারে। অনেক সময় আমরা শুনতে পাই টিভিতে কার্টুন ছেড়ে শিশুদের শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। ভয় দেখিয়ে বা প্রহার করে শিশুদের শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের ডে-কেয়ার সেন্টারে শিশুকে না দেয়াই ভালো।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টার ও পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে সমন্বয় করে রাখতে পারেন। দিনের কিছুটা সময় (৪-৫ ঘণ্টা) ডে-কেয়ারে, বাকি সময়টা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানির কাছে রাখা যেতে পারে। দিনশেষে বাসায় ফিরে শিশুকে একান্তে সময় দেবেন। ঘরে যতক্ষণ থাকবেন শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, প্রশ্নের উত্তর দেবেন এবং শিশুর সঙ্গে খেলা করবেন। আর ছুটির দিনগুলোতে শিশুকে নিয়ে অবশ্যই ঘুরতে বের হবেন।

নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ
শিশু মনে রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ইত্যাদি আবেগীয় ঝড় উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার দুষ্টুমি, চিৎকার, চেঁচামেচি, বায়না ধরা, জেদ করা, কান্নাকাটি করা এই ব্যাপারগুলোও সহজাত। এগুলো শিশুর অপরিণত মস্তিষ্ক ও আবেগের ফল, শিশু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনি চাইলেও তা বন্ধ করতে পারবেন না। তবে যদি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে শিশুকে চালিত করা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
বড় শিশুদের ক্ষেত্রে আবেগীয় সমস্যাগুলো একটু ভিন্ন। সামান্য ব্যর্থতায় ভেঙে পড়া বা হতাশ হয়ে যাওয়া, কিছু না পেলে নিজেকে দুঃখী মনে করা, অল্পতেই মেজাজ হারানো- এই কথাগুলো ইদানীং খুব বেশি শুনতে পাই। পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখতে পাই, কত তুচ্ছ কারণে আমাদের সন্তানরা আত্মহত্যা করছে। শিক্ষক বা অভিভাবক বকা দিয়েছে, পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে, বাবা স্মার্টফোন কিনে দেয়নি, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা কারণে শিশুরা আত্মহত্যা করছে।
কেন এই সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে, তা প্রত্যেক মা-বাবার জানা প্রয়োজন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- পারিবারিক অশান্তি এবং ভুল প্যারেন্টিং। পরিবারে মা-বাবার মধ্যে দাম্পত্য কহল থাকলে শিশুদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক ও আবেগীয় সমস্যা দেখা দেয়। আবার পরিবারের সদস্যরা যদি প্রতিনিয়ত শিশুর সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে, উপহাস বা নেতিবাচক কথা বলে, প্রহার করে বা ভয় দেখায় তাদের মধ্যেও আবেগীয় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
শৈশবে আমরা যে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হইনি, ব্যাপারটি তা নয়। মার খাইনি এমন সপ্তাহ খুব কমই গিয়েছে। হয় বাড়িতে, না হয় স্কুলে। মাঝে মধ্যে থাপ্পরও জুটত। তারপরও কেন ভেঙে পড়তাম না? কারণ ঘটনার পরক্ষণেই হয় গোল্লাছুট খেলতাম, পুকুরে ঝাঁপ দিতাম অথবা বন্ধুদের সঙ্গে অন্য খেলায় মগ্ন হয়ে যেতাম। দুঃখ যে কোথায় উবে যেত টেরই পেতাম না।
এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রহার বা বকাঝকা বা শাসনের শিকার হলে শিশু মনে নেতিবাচক আবেগের যে ঝড় ওঠে, তা প্রশমনের সুযোগ নেই বললেই চলে। খোলা মাঠ, খেলার সঙ্গী এবং মুক্ত পরিবেশের সংস্পর্শ পায় না বলেই শিশুদের নেতিবাচক আবেগ প্রশমিত হচ্ছে না। চার দেয়ালে বন্দি শিশুর কাছে খুব সামান্য বিষয়ও মারাত্মক অনুভূতি সৃষ্টি করে।
ভুল প্যারেন্টিংয়ের দায়ও অস্বীকার করা উপায় নেই। বর্তমানে শিশুদের আমরা বাস্তবতা বিবর্জিত করে লালন করছি। অন্ধ স্নেহ-মমতার প্রকাশ হিসেবে অথবা শিশুকে সব সময় খুশি রাখতে গিয়ে, শিশুদের সব আবদার-বায়না পূরণ করার চেষ্টা করি। চাওয়ার আগেই সবকিছু দিয়ে দেই। এভাবে সব কিছু পেতে পেতে শিশু মনে করে সবকিছুই তার প্রাপ্য, তাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ঘুরে। একটা সময় আসে যখন শিশু কোনো কিছু পায় না, তখন নিজেকে ব্যর্থ মনে করে মুষড়ে পড়ে অথবা চিৎকার-চেঁচামেচি-ভাংচুরের মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।
শিশুকে পরাজয়ের অভিজ্ঞতা না দিলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক ভুল করেন। শিশুর সঙ্গে খেলার সময় তাকে সবসময় জিতিয়ে দেন। এই শিশুরা বড় হয়ে ব্যর্থতাকে সহজে মেনে নিতে পারে না, সামান্য পরাজয়ে ভেঙে পড়েন। কারণ জয়-পরাজয় যে জীবনের অংশ- এই বাস্তবতা শিশুকে শেখানো হয়নি।
এর বাইরেও আমরা যত সতর্কই থাকি না কেন- শিশুদের জীবনে নানা আবেগীয় ঝড় উঠবেই। তাই শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শিখিয়ে দেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। সহজ একটি কৌশল হচ্ছে- ঘধসব রঃ, ধহফ ঞধসব রঃ. অর্থাৎ শিশুর আবেগকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে একে বশ করা। আপনার কাজ হলো- কোনটা রাগ, কোনটা ঈর্ষা, কোনটা ভয়, কোনটা হতাশা, কোনটা আনন্দ, কোনটা দুঃখ ইত্যাদি শিশুকে ধরিয়ে দেয়া। শিশুর প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই আবেগগুলোকে ধরিয়ে দিন। আসলে যে শিশু নিজের আবেগকে চিহ্নিত করতে বা বুঝতে (াবৎনধষরুব) পারে আবেগের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকে।
দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে শিশুকে পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ দেয়া। প্রায় প্রতিদিনই শিশুদের জীবনে এমন কিছু ঘটে যা তাদের মধ্যে উদ্বেগ বা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। খেলাধুলার ফলে শিশুর ভয়, মানসিক চাপ, অস্বস্তি বা উদ্বিগ্নতা প্রশমিত হয়। খোলামাঠে বাধাহীন খেলার সুযোগ পেলে শিশুরা সহজেই মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে পারে এবং ব্যর্থতা কাটিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারে।
তৃতীয়ত শিশুকে বয়স উপযোগী ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম শেখানো। টিন এজ শিশুদের জন্য এটা খুব জরুরি। এ সময়ে তাদের আবেগের উত্থান পতন হয় সবচেয়ে বেশি। আসলে ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামের কার্যকারিতা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। নিয়মিত মেডিটেশনে হতাশা ও মানসিক চাপ প্রশমিত হয়, ধৈর্যশক্তি বাড়ে, চালচলনে স্থিরতা আসে, আবেগ নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামের যুগপৎ চর্চা দেহ-মনে ঐক্যতান সৃষ্টি করে, হরমোন গ্রন্থিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনে।
উন্নত বিশ্বের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। সেখানে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শেখানোর পাশাপাশি ধ্যান, দমচর্চা এবং যোগ ব্যায়ামের নানা কলাকৌশল শেখানো হচ্ছে। এই কাজগুলোকে সহজ করার জন্য শিক্ষকদেরও নিয়মিত এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়