গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

রক্তপাত : আলী ইদরীস > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উথলী স্টেশনের পাশের একটি গ্রাম সোনাদীঘি থেকে মেয়েটিকে ধরে আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- সে একজন আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতিক। সে এবং তার দল অহরহ জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। একটি অপারেশনে যাওয়ার পথে অস্ত্রসহ ধরা পড়ে মেয়েটি।
ইন্সপেক্টর রশীদ ইতোমধ্যে তার কৃতিত্বের জন্য প্রশাসনের বাহাবা পেয়েছে। প্রমোশনের সোনালি দরজা খোলা তার সামনে।
তরুণ ইন্সপেক্টর রশীদ যখন তার অনাগত ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সেই সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন তার বস জামান আহমেদ। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো রশীদ। কণ্ঠে তার একরাশ বিস্ময়।
‘স্যার আপনি!’
‘হ্যাঁ, আমি। নিজেই চলে এলাম। তুমি বসো।’
রশীদ বসলো। তার মুখোমুখি বসলেন জামান আহমেদ। কোনো রকম ভূমিকা না করে বেশ জোর দিয়েই বললেন, ‘রিপোর্টটা আজকেই চাই।’
‘কাজের কোনো ত্রæটি হবে না স্যার।’
‘এই রিপোর্টের ওপরেই … ’
‘আমি জানি স্যার।’
‘ভোর হওয়ার আগেই সোনাদীঘি অ্যাটাক্ট হবে।’
‘ও কে, স্যার। তবে-’
‘বলো।’
‘সোনাদীঘি অ্যাটাকের পুরো দায়িত্বটা আমিই নিতে চাই।’
একটু হাসলেন জামান আহমেদ। তারপর উঠে দাঁড়ালেন এবং বিনা বাক্যে বেরিয়ে গেলেন। শব্দ করে স্যালুট ঠুকলো আত্মপ্রত্যয়ী ইন্সপেক্টর রশীদ।
সোনাদীঘি অ্যাটাক্ট … রিপোর্টটা এক্ষুণি রেডি করা দরকার … মেয়েটি কিছুতেই মুখ খুলছে না … রিপোর্টার ওপর … নাহ! সামান্য একটা মেয়ে … রিপোর্টটা তৈরি করতেই হবে।
কলিং বেল না টিপেই ‘কনস্টেবল’ বলে চিৎকার করে উঠলো রশীদ। টেবিলের ওপর রাখা দামি চুরুটের প্যাকেট থেকে একটি চুরুট বের করে তাতে অগ্নি সংযোগ করলো। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কী যেনো ভাবতে শুরু করলো।
খটাস্ করে শব্দ হলো। কনস্টেবলের স্যালুট।
‘কী, মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলে?’
‘কোনো কথাই বলে না স্যার।’
‘সবগুলো পানিশমেন্ট ঠিক ঠিক অ্যাপ্লাই করেছিলে তো?’
‘তার বেশিও করেছি স্যার।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’
রাগে এবং বিস্ময়ে দাঁতে দাঁত চাপে রশীদ। জংলি হিংস্র রক্তস্রোত ছড়িয়ে পড়ে তার সারা দেহে। পরক্ষণে আবারো তেঁতে ওঠে- ‘শুয়োরের বাচ্চাদের গোপন কথাগুলো বুকের মধ্যে লুকোনো থাকে। বুকে আঘাত দিলেই কথা বেরুবে। যাও বুকে চুরুটের ছ্যাঁকা লাগাও।’
রশীদের আঙ্গুলে গোঁজা জ্বলন্ত চুরুটটি মুহূর্তে কনস্টেবলের হাতে চলে গেলো।
একটু পরেই অসহায় করুণ আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। রশীদের বুকের মধ্যে চন্চনে একটি ব্যথা ঢেউ খেলে যায়। পাশাপাশি একটি অস্থির যন্ত্রণাও সারা বুক দাপিয়ে বেড়ায়। ঘরময় পায়চারী করতে থাকে সে। কী সাংঘাতিক মেয়ে! টর্চারের তালিকা নিঃশেষ অথচ কোনোভাবেই দলের খবরটা ছেঁকে বের করা যাচ্ছে না। তাহলে কী…
‘স্যার।’
‘কী হলো, বললো কিছু?’
‘না স্যার।’
‘বলবে না। তোমরা বলাতে পারবে না। আমিই যাচ্ছি।’
টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা ক্যাপটা মাথায় দিয়ে রশীদ বেরিয়ে গেলো। টর্চার রুমের চৌকাঠ পেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সরাসরি তাকালো মেয়েটির দিকে। গোলগাল ফর্সা দুটি হাত দেয়ালের দুটো লোহার আংটার সাথে শক্ত করে বাঁধা। জংলি ছাপার শাড়িটা সামনের লম্বা বেঞ্চে তালগোল পাকানো। চুরুটের ছ্যাঁকায় ব্লাউজ-ব্রেসিয়ার ফুটো ফুটো হয়ে গেছে- তা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরুচ্ছে রক্তকষ!
এগিয়ে গেলো রশীদ। বুকের মধ্যের চন্চনে ব্যথাটা আবারো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এই প্রথম সে তৃতীয় নয়নে দেখতে শুরু করলো :
লাবণ্যের কারুকাজ সারা শরীরে, শিল্পীর তুলিতে টানা চোখ, জীবনের সুন্দরতম সকল উপমা খুঁজে পাওয়া যায়…
আরো এগিয়ে গেলো রশীদ। মেয়েটি যথাসম্ভব সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। চোখে ক্ষুব্ধ গন্গনে আঁচ। রশীদ বললো, ‘তোমাকে এ অবস্থায় দেখে আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।’
মেয়েটির ঠোঁটময় তী² হাসি।
‘কষ্ট! আপনার!’
‘তুমি ইচ্ছা করলেই এ কষ্টকে এড়াতে পারো। দলের আসল খবরটুকু দিলেই তোমাকে যথোপযুক্ত সম্মান দেয়া হবে।’
ফুঁসে উঠে মেয়েটি।
‘আগেও বলেছি, আবারো বলছি, দলের আসল-নকল খবরের একটি শব্দও বলবো না।’
‘তুমি ভুল করছো।’
‘না।’
‘আমি বলছি, তুমি ভুল করছো।’
‘না।’
হঠাৎ রশীদের রক্তে আগুন জ্বলে উঠলো। মেয়েটির একদম সামনে সে চলে এলো। বললো, ‘এখনো বলো বলছি। নইলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে- তুমি পায়ে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য হবে।’
বিদ্রুপাত্মক হাসি ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটির সারা ঠোঁটে। বলে, ‘চোখ রাঙিয়ে আর ভয় দেখিয়ে কোনো কাজ হবে না।’
‘বটে!’
রশীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। হিংস্র জন্তুর মতো এক থাবায় ছিঁড়ে ফেলে ব্লাউজ। মেয়েটির বুকে এখন শুধু ফুটো ফুটো ব্রেসিয়ার। রশীদ থামে না।
অশ্লীল রাহুর দৃষ্টির রোলার চালিয়ে দেয় মেয়েটির সারা শরীরে। তারপর মুখ নামিয়ে আনে তার কানের কাছে।
‘ঐ দড়িটা আর হুকগুলো একটা একটা করে খুলে ফেললে কী বেরুবে লজ্জাশীলা নারী? বলো, কোনগুলো লুকোবার প্রয়োজনীয়তা তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি- শরীরের লোভনীয় সম্পদগুলো, না বুকের কথাগুলো?’
প্রথম ধাক্কায় ভয়, কিছুটা লজ্জায় চোখ-মন কুঁকড়ে আসলেও পরক্ষণে তা সামলে নিয়ে মেয়েটি স্পষ্ট জবাব দেয়,
‘বুকের কথাগুলো। দেশের মানুষ আমার আসল সম্পদ। তাদের পাশে আমার দল আছে, থাকবে। দলের খবর বলে দলের বুকে ছুরি বিঁধাতে পারবো না।’
‘আমি তোমাকে নষ্ট করবো।’
‘আমার দল তোমাকে ক্ষমা করবে না।’
‘সে শক্তি তোমার দলের নেই। তোমরা ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছো।’
‘সারাদেশে আমরা অসংখ্য সোনার মানুষের সন্ধান পেয়েছি। তারা ভুল নয়। বৈষম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার নিপাত হবেই। সাধারণ মানুষ জেগে উঠছে। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।’
হঠাৎ করেই চন্চনে ব্যথাটা রশীদের বুকের মধ্যে আবারো জেগে ওঠে। কর্তব্যপরায়ণ দুই চোখের দৃষ্টিকে হার মানিয়ে তৃতীয় দৃষ্টি অত্যন্ত নির্ভরতায় হেঁটে বেড়ায় মেয়েটির সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। এক ধরনের পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে আসে। রশীদ ক্রমেই হারিয়ে ফেলে কর্তব্যজ্ঞান। অন্যরকম ভাবনায় আচ্ছন্ন তার মন। ইন্সপেক্টর রশীদ ক্রমান্বয়ে কেবলমাত্র রশীদে রূপান্তরিত হচ্ছে … মহাবিপ্লব ঘটছে তার শিরা উপ-শিরায়…।

দুই.
মেয়েটি অর্থাৎ কমরেড এল (পার্টির সবাই তাকে এ নামে ডাকে এবং চেনে) অলৌকিকভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে। তার ফেরা এবং বেঁচে থাকাকে পার্টির সবাই ‘অত্যাশ্চার্যজনক’ বলে অভিহিত করেছে। কেননা এর আগে জাফর, হিজল বা এমনি যারা ধরা পড়েছে তারা কেউ আর ফিরে আসেনি।
ও যখন শেল্টারে ফিরেছে তখন পুবাকাশে লালছে আভা। প্রথম সকালের পদক্ষেপ সোনাদীঘির লম্বা লম্বা নারকেল গাছের মাথায় ইতস্তত ছড়িয়ে।
তারপর সকাল গড়িয়ে দুপুর। কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শফিউদ্দিন, বাবলু, হীরু, দেবতোষসহ আরো অনেকে একে একে এসে ঘটনা শুনে ওকে বাহবা দিয়ে গেছে। সবশেষে এসেছে সোনাদীঘি সেক্টরের লিডার কমরেড আলতাফ ওরফে আলতু ভাই। কাজের সুবিধার জন্য শেষোক্ত নামটাই সব সময় ব্যবহার করে। এ এলাকায় ‘আলতু ভাই’ নামটাই প্রচলিত। শুধু আলতুই বলেছিলো,
‘তোমার ওপর অত্যাচারের কথা শুনেছি। ডাক্তারের ব্যবস্থা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।’
কিন্তু কমরেড এল ভাবছিলো অন্য কথা। এ পর্যন্ত যারা তার সাথে দেখা করতে এসেছে, তারা সবাই কেমন একটা ফরমালিটি বজায় রেখে কথা বললো। ভাব-গম্ভীর পরিবেশ, থমথমে ছায়া সবার মুখে। ও প্রশ্ন করে বসলো, ‘পার্টির খবর কী?’
‘কিছুই যখন শোনোনি, তখন আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। সন্ধ্যার পরই মিটিং, সেখানেই সব জানতে পারবে।’
কমরেড এল-এর বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো। মনে পড়লো ইন্সপেক্টর রশীদের কথা : ‘তোমরা ভুল করছো।’ ও ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো, ‘খারাপ কিছু কী… ’
‘বেশ কিছুদিন ধরে দলের মধ্যে অন্তর্দ্ব›দ্ব চলছিলো। কেন্দ্রে তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। আজকের মিটিংয়ে আমাদেরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
ঐ পর্যন্তই। আর কথা এগোয়নি। ‘অনেক কাজ পড়ে আছে’ বলে আলতু চলে গিয়েছিলো।
সেই সন্ধ্যা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। মিটিং এখনো শুরু হয়নি। সোনাদীঘি গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া আধা-মরা গাঙয়ের পাড়ের বটগাছ তলায় বরাবরের মতো আজকের মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শরতের জ্যোৎস্না রাত। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি জ্যোৎস্না উপস্থিত সবার চোখে মুখে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মধ্যেই একটি চাপা গুঞ্জন।
কমরেড এল-এর কাছে ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার নয়। আজকের মিটিংয়ের প্রধান বক্তা আলতুর বক্তব্য থেকেই সব কিছু বুঝে নিতে হবে। অনেক ভালো ভালো কর্মীর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করছে সে।
হঠাৎ শফিউদ্দিনের গলা শোনা গেলো, ‘আলতু ভাই, শুরু করে দিন।’
আলতু উঠে দাঁড়ালো। এক ফালি জ্যোৎস্না ওর মুখটাকে দুভাগ করে দিয়েছে। এক পাশে আলো, অন্য পাশে অন্ধকার। বেশ চিন্তিত এবং গম্ভীর। বললো, ‘রহমান, কাজল আর হিবলুদের অনুপস্থিতিতে আলোচনা করা ঠিক হবে না।’
‘ওরা সোনাদীঘির বাইরে। কেন্দ্রে গেছে। আমাদের মিটিংয়ে থাকবে না।’ দেবতোষের চড়া গলা।
‘কেন্দ্রে তো এখন চূড়ান্ত ফাটল। কোন দলে যাবে ওরা?’
‘কেন্দ্রের আসল খবর আমরা জানতে চাই।’
হিরু বেশ ক্ষোভের সাথে কথাটা বললো। সাথে সাথে উপস্থিত অন্যদের মধ্যের চাপা গুঞ্জনটা বেশ ব্যাপকতর হলো। কমরেড এল অস্থির হয়ে উঠলো। বললো, ‘চুপ করুন। এত গুঞ্জন কিসের?’
‘এখন চুপ করার সময় নয়। কেন্দ্রের সাথে আলতু ভাইয়ের কী কথা হয়েছে, আমরা পরিষ্কার জানতে চাই।’
তিন-চারজনের কণ্ঠ এক সাথে চিৎকার করে উঠলো। ‘নইলে আমরাও রহমানদের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবো।’
‘পথ বেছে নেয়ার জন্যই সবাইকে এখানে ডাকা হয়েছে। যারা ভ্রান্ত পথে যেতে চায়, যাক। কিন্তু আমার একটি কথা’- আলতু বলতে শুরু করলো, ‘নেতৃত্ব নিয়ে কেন্দ্রের দ্বিমত সম্মিলিত শক্তিকে দুভাগ করে ফেলেছে। এক পক্ষের বক্তব্য : আর কাল বিলম্ব না করে জোদ্দারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষেপিয়ে তাদের গোলার ধান, ক্ষেতের ফসল লুট করা হোক। অন্যপক্ষ- যারা ইলেকশন আর পার্লামেন্ট চাইছে, তাদের সাথে আপস ফর্মুলায় উপনীত হয়ে ইলেকশনে যেতে চায়, ক্ষমতায় যেতে চায়। দেশের বর্তমান অবস্থায় কোনো পক্ষেরই বক্তব্য সঠিক নয় বলে আমি মনে করি। দেশের খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমরা যদি ভুল নেতৃত্ব দিই, ভুল সিদ্ধান্তে এগিয়ে যাই, তবে তার খেসারত দেশের সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। সংগঠনকে জোরদার না করে এই মুহূর্তে সশস্ত্র বিপ্লব ঘোষণা করা যেমন অসময়োচিত পদক্ষেপ, তেমনি ক্ষমতা লোভী সাম্রাজ্যবাদের দোসর হয়ে ক্ষমতায় যাবার নাম হবে দেশের সাথে-মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমি তাই বলতে চাই- এখন থেকে সোনাদীঘি হবে আমাদের কেন্দ্র। এখান থেকেই আমরা গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে গণসংগঠন গড়ে তুলবো। পর্যায়ক্রমে আমরা…’
‘আলতু ভাই! আলতু ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো বাবলু, ‘পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলেছে।’
মাঝপথে মিটিং থমকে দাঁড়ালো। এবার আর গুঞ্জন নয়, কথা নয়। নীরব দৃষ্টিতে শুধু চোখাচোখি। সবার চোখেমুখে একটা হিংস্র ভাব ক্রমেই ফুটে উঠতে লাগলো।
এক সাথে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ হলো। উদভ্রান্তের মতো কর্মীদের ওপর দৃষ্টি বোলালো আলতু। এক জায়গায় গিয়ে তার চোখ আটকে গেলো। কমরেড এল দেখলো, লাল গোলা গোলা দুটি চোখ যেনো তাকে বিদ্ধ করতে চাইছে। এর অর্থ কী? কমরেড এল ভাববার চেষ্টা করলো।
আবার গুলির শব্দ। একটানা কয়েক রাউন্ড। আগের চেয়ে অনেক কাছে। শফিউদ্দিন চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠলো, ‘আমাদেরকে কিছু বলুন আলতু ভাই। জানতে চাই কে এই সর্বনাশ করলো?’
‘শুধু একটি গুলির খরচে আমি তার বুক ফুটো করে দিতে চাই।’
হিরু হিস্ হিস্ করে উঠলো।
‘সর্বনাশ যেই করুক, এখন তা দেখার সময় নয়। আমাদের সবাইকে বাঁচা প্রয়োজন। তোমরা সবাই গাঙ পার হয়ে ওপারে চলে যাও।’
‘আলতু ভাই, আপনি?’
‘আমার কথা আমিই ভাববো। তোমাদেরকে সময় মতো খুঁজে নেবো। যাও, আর দেরি নয়- যাও।’
আলতু ভাইকে একা রেখে চলে যেতে মন না চাইলেও তার আদেশ কেউ অমান্য করতে পারে না। সবাই ইতস্তত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো গাঙের দিকে।
কিন্তু কমরেড এল স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। আলতু কয়েক পা এগিয়ে গেলো। দাঁড়ালো মুখোমুখি। চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে তার। মুখের পেশিগুলো দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ক্রমেই কঠিন হচ্ছে।
এবার একটানা গুলির শব্দ। দুদিক থেকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কমরেড এল-এর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। চুরুটের ছ্যাঁকার ব্যথা নয়- এ অন্য রকম ব্যথা। ও ব্যাকুল হয়ে বললো, ‘আলতু, আলতু, তুমি আমাকে… আমাকে বিশ্বাস করো আলতু।’
‘সবাই জেনে যাক আমি তা চাইনি বলেই সবাইকে সরিয়ে দিলোম। আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে এবং তোমার পিছে পিছে পুলিশও আসবে।’
‘কী, কী বলছো তুমি! আমি তোমাকে ভালোবাসি, পার্টিকে ভালোবাাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’
‘এগুলো সত্যি হলে আমি সত্যিই খুশি হতাম।’
‘বিশ্বাস করো আলতু, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যা ভাবছো আমি তা নই।’
‘এর আগে যারা ইন্সপেক্টর রশীদের হাতে ধরা পড়েছে, তারা কেউই জীবন নিয়ে ফিরে আসেনি। তোমার সুস্থ দেহে ফিরে আসার পেছনে কোনো রহস্য নেই বলতে চাও?’
‘তাহলে আমি ফিরে আসি- তুমি চাওনি?’
‘চেয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে নয়।’
‘আলতু তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। তুমি আমাকে ভালোবাসো!’
‘আমি পার্টিকে ভালোবাসি।’
‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে- অ্যাঁ…
কথা শেষ না হতেই কমরেড এল আর্তনাদ করে ওঠে। বসে পড়ে মাটিতে। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের বাহু চেপে ধরে। গরম রক্তে ভিজে ওঠে হাত। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলির একটি তার বাঁ হাতের বাহুর মধ্যেই বিদ্ধ হয়ে রইলো।
শুকনো পাতার মচমচ শব্দে রাতের আঁধার ভেঙে এগিয়ে আসছে বুটের শব্দ। কাছে- অনেক কাছে।
আলতু নিচু হয়ে মুখ নিয়ে গেলো কমরেড এল-এর মুখের কাছে। বললো, ‘তুমি এখানেই থাকবে। ইন্সপেক্টর রশীদের সাথে ফিরে যাবে শহরে এবং আমি চাই, তুমি আর কোনোদিন ফিরে না আসো। চলি।’
কথা কটি বলে প্রায় দৌঁড়ে ছুটে গেলো গাঙের দিকে। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো।
বাহুর যন্ত্রণা নিয়েই কমরেড এল উঠে দাঁড়ালো। তাকালো নিজের শরীরের দিকে। এই শরীর- বাইশ বসন্তের হৃষ্টপুষ্ট শরীর। ইন্সপেক্টর রশীদ ইচ্ছা করলেই নষ্ট করে দিতে পারতো। কিন্তু সে তা না করে যথেষ্ট সম্মানের সাথে ছেড়ে দিয়েছে। কমরেড এল-এর হঠাৎ মনে হলো- ছাড়া পেয়েই সোজা শেল্টারে ছুটে আসা তার উচিত হয়নি। ইন্সপেক্টর রশীদ এই সুযোগটাই ব্যবহার করেছে।
এ কথা মনে হতেই নিজের প্রতি রাগে-ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে। না, কিছুতেই সে রশীদের হাতে ধরা দেবে না। তাকালো গাঙের দিকে। দেখলো, আলতু দ্রুত ফিরে আসছে। কমরেড এল মুহূর্তে বাহুর যন্ত্রণা ভুলে গেলো। একটি আনন্দমিশ্রিত অনুভূতি ওকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেলো আলতুর দিকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়