গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের লোকসংগীত : ফরিদ আহমদ দুলাল > লোকসংগীত

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গজনপদে গানের প্রধান অনুষঙ্গ লোকসংগীত; আর বিশ্বসংগীত বিবেচনায় গানের আশ্রয় ধ্রæপদ সংগীত। আধুনিক গান লোকগানের কথা ও সুরের সাথে ধ্রæপদের ছোঁয়া নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়। লোকজীবনের সাথে লোকসংগীতের ঘনিষ্ঠ সংযোগের কারণেই হয়তো দেখতে পাই, আজো আমাদের গানে লোকসংগীতের প্রবল প্রভাব। বাংলাদেশে প্রচলিত লোকসংগীতের সবক’টি ধারা দেশের সর্বত্র প্রচলিত নয়; আবার একই আঙ্গিকের গান বিভিন্ন অঞ্চলে হয়তো ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে গীত হয়। তবে কিছু কিছু গান কোন কোন অঞ্চলকেই প্রতিনিধিত্ব করে; যেমন ঘাটুগান-গাইনের গীত-সঙযাত্রা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল, ভাওয়াইয়া গান বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল, গম্ভীরা গান রাজশাহী অঞ্চলের কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচলিত লোকসংগীতের প্রতিটি শাখা-ই ভাব-বিষয়-উপস্থাপনা এবং লোকপ্রিয়তায় অনন্য হবার পরও আজকের স্যাটেলাইট সংস্কৃতির আগ্রাসী বিস্তার এবং জীবনযাপনের নানা টানাপড়েনে লোকসংগীতের বেশকিছু শাখাই আজ বিলুপ্ত এবং অধিকাংশ শাখাই বিপন্ন প্রায়। বঙ্গজনপদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত লোকসংগীতগুলোর অন্যতম-
বাউলগান, ভাটিয়ালী, কিস্সাপালা, কবিগান, কীর্তন, ঘাটুগান, জারিগান, সারিগান, মুর্শিদী, ধামাইল গান, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, ঢপযাত্রা, সঙযাত্রা, বিয়ের গান, মেয়েলীগান, বিচ্ছেদী গান, বারমাসী, পুঁথিগান, পালকির গান, ধানকাটার গান, ধানভানার গান, হাইট্টারা গান, গাইনের গীত, বৃষ্টির গান, ধোয়া গান, শিবগৌরীর নৃত্য-গীত, গাজীর গান, পটগান, আদিবাসীদের গান ইত্যাদি।
লোকসংগীতের বিভিন্ন শাখার বিস্তারিত আলোচনার আগে সংগীতে লোকজীবনের নানা অনুষঙ্গ উচ্চারিত হবার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যায়। মৈমনসিং গীতিকার বিভিন্ন পালায় দেখি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আবাস স্থলের বর্ণনা। জীর্ণ ঘরের সন্ধান পাই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর আত্মকথন অংশে। একই পালায় গৃহ নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে তালপাতার ব্যবহার দেখতে পাই। মহুয়া পালায় দেখি গৃহ নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে নল খাগড়ার ব্যবহার-
‘নল খাগড়ের বেড়া আছে দক্ষিণ দোয়ারিয়া ঘর।’
মলুয়া পালায় শীতল পাটির ব্যবহার, চৌচালা-আটচালা ঘর এবং সন্দি বেতে বান্ধা আর উলুছনের ছানির তথ্যও পাই একই পালায়; অন্যদিকে মহুয়া পালায় পোষাক-আষাক ও সাজসজ্জার প্রসঙ্গ দেখি-
‘হাজার টাকার শাল দিল আরো টেকা কড়ি।’
অথবা-
‘বসন ভূষণ দিব আমি দিব নীলম্বরী।
নাকে কানে দিব ফুল কাঞ্চা সোনায় গড়ি।
গন্ধ তৈল দিয়া তোমার বাইন্ধা দিবাম কেশ
ঘরে আছে দাসী বান্দী তোমার নাই ক্লেশ।
হীরামণি যেথায় পাইবাম ভালা বাইন্যা দিয়া
লক্ষ টাকার হার তোমায় দিবাম গড়াইয়া।
আর যে কত দিবাম কন্যা নাহি লেখাযোখা
সোনাতে বান্ধাইয়া দিবাম কামরাঙা শাখা।
উদয়তারা সাড়ী দিবাম লক্ষ টাকা মূল
হীরামনি দিয়া তোমার জইরা দিবাম চুল।
চন্দ্রহার গড়াইয়া দিবাম নাকে দিবাম নথ
নূপুরে ঝুনঝুনি কন্যা দিবাম শত শত \’

মৈমনসিং গীতিকার বিভিন্ন পালায় অন্তত পাঁচটি মূল্যবান শাড়ির নাম পাওয়া যায়। শাড়িগুলো হচ্ছে- নীলাম্বরী শাড়ি, পাটের শাড়ি, অগ্নি পাটের শাড়ি, উদয়তারা শাড়ি ও আসমান তারা শাড়ি। কঙ্ক ও লীলা পালায় শিবু গাইনের বন্দনা অংশে আছে-

‘গাহানা গাহিয়া আমি ফিরি বাড়ী বাড়ী
সভার প্রসঙ্গে কিছু পাই চাউল কড়ি \
ইনাম বকসিস কিছু সভাপদে চাই
কর্মকর্তার কাছে একখান নববস্ত্র পাই।’
এভাবেই লোকসংগীতে সমকাল ও সমাজ বাস্তবতা বাক্সময় হয়ে ওঠে লোকশিল্পীদের মেধাবী পরিবেশনায়। নিচে বাংলায় প্রচলিত লোকসংগীতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শাখার উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট লোকসংগীতের ধারাবাহিক পরিচিতি, উৎপত্তিস্থল, বিস্তৃতি, ব্যবহার এলাকা, পরিবেশন কলা, সম্ভাবনা ও সংকটসহ নানা প্রসঙ্গ আলোচনার প্রয়াস থাকছে।

১. কীর্তন : গ্রাম বংলার প্রতিটি মহল্লায় প্রতিদিন শোনা যাবে কীর্তনের সুর, খোল আর মৃদঙ্গের ধ্বনি। আর প্রতিটি মন্দিরে বছরে একবার কি দু’বার আয়োজন হয় কীর্তনের আসর। কখনো একদিন কখনো দু’দিন আবার কখনো ছাপান্ন প্রহর কখনো বাহাত্তর প্রহর। এসব কীর্তনের আসরে ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় এ জনপদে কীর্তনের জনপ্রিয়তারই বহিঃপ্রকাশ। কখনো কখনো বিভিন্ন উপলক্ষে ধনাঢ্য হিন্দু বাড়ি অথবা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কীর্তনের আসর আয়োজিত হয়ে থাকে। এসব আয়োজনে পালাকীর্তন, লীলাকীর্তন, ঢপকীর্তন ইত্যাদি পরিবেশিত হয়ে থাকে। সময়ের বিবর্তনে আজ এ জনপদে কীর্তনের প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে; কীর্তন যেন আজ মন্দির আর আখড়া কেন্দ্রিক হয়ে গেছে।

২. গাইনের গীত : গাইনের গীত একসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। একজন গায়েন একদল দোহার নিয়ে গাইনের গীত পরিবেশন করে থাকেন। গায়েন দর্শক শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি হাস্যরসের মোড়কে সমাজের নানান অসঙ্গতিও তুলে ধরেন গীতের মাধ্যমে। হাস্যরস ও সুরের মাধ্যমে গাইন কখনো খণ্ড খণ্ড ঘটনা-গল্প তুলে ধরেন অথবা একটা কাহিনি-ই তুলে ধরেন দর্শক-শ্রোতার সামনে। কিসস্যাপালার মতো গাইনের গীতও বৃহত্তর ময়মনসিংহের গ্রাম-গঞ্জে গীত হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। এই গানের প্রচলন প্রধানত ভাটিঅঞ্চল, কেন্দুয়া, কিশোরগঞ্জ, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর অঞ্চলে। পালা কীর্তন পরিবেশনের যেমন নিজস্ব দল থাকে গাইনেরও তেমনি দল থাকে। হিন্দু পরিবারে কীর্তন পালার যেমন মানত থাকে মুসলিম পরিবারে তেমনি গাইনের গীতের মানত থাকতো। মানুষের বিশ্বাস ছিলো গাইনের গীতে যাদের নাম উল্লেখ করে গীত পরিবেশিত হয়ে থাকে তাদের নামের কৃপায় অমঙ্গল দূর হয়ে যাবে। পালা গানে যেমন গায়েন থাকে গাইনের গীতেও তেমনি গায়েন থাকে। পালা গানের মতো গাইনের গীতেও গায়েন বন্দনা দিয়ে গীত শুরু করেন। উদাহরণ দিচ্ছি-
আল্লা আল্লা বল ভাইগো নবী কর সার
নবীর কলেমা পড় হৈয়া যাবে পার \
আল্লা আল্লা বল ভাইগো যত মমিনগণ
গাজী জিন্দাপীরের কথা শোনো দিয়া মন।
সোয়া লক্ষ নবী বন্দি আশি হাজার পীর
সুন্দরবন মোকামে বন্দি গাজী জিন্দাপীর \
সভা কইরা বইছুইন যত হিন্দু মুসলমান
সবারই চরণে জানাই অধমের সালাম \
আমি অতি মূর্খমতি বিদ্যা-বুদ্ধি নাই
গীত গাইয়া শান্তি দেওয়ার আমার সাধ্য নাই \
বাড়ি আমার বকশীমূলে নাম আরজ আলী
আপনাদের ঠাঁই আইসা আইজ বিরক্ত করবাম খালি।
গাইনের গীতে শ্রোতাদের আনন্দ দিতে গাইন নানান মসকরার আশ্রয় নেন। জিন্দাপীর গাজীর কথা বলতে গিয়ে গাইন হয়তো বলেন-
গাজী বলে কালু ভাই গো আমার শল্যা লও
আলের দুইডা বলদ বেইচ্যা মুরগী কিন্যা লও
মুরগা নাচে মরগী নাচে চালঅ দুই ঠ্যাং থুইয়া
হউরি বউয়ে কাইজ্যা করে চ্যাপা ভত্তা লইয়া \
গাইনের গীতে গাইনের রসবোধের আরো সামান্য নমুনা তুলে ধরছি-
ও মোর পাগলা ঘুড়ারে কইঅতি কই লইয়া যাও
সে যে ডাইনে গেছে তামুক খাইতে আমি কিছু কই
হেলে (শিয়ালে) যহন বড়ই খাইছিল লবণ পাইছিল কই
কতার নাই আগামাতা ব্যাঙ্গে চিড়া খায়
বাপে বিয়া করবার আগে পুত হউর বাড়ি যায়।
ছাগল পালে পাগলে নিত্যি ছিড়ে দড়ি
হাজার টেহার বাগান খাইয়া লেদায় বড়ি বড়ি \
মইন্যার মায়ে গইন্যা খাইলো সাত কাডলের কুশ
নানার দাড়িত কষ লাগলে আমার কি-বা দুষ \
ছুইত্যার বউ হুইত্যা রইছে খেতা মুড়ি দিয়া
উইল্যা বিলাই রইছে চাইয়া ভাঙ্গা বেড়া দিয়া
সারা রাইত গীত গাইলাম মড়ল সাইবের বাড়িত
খালি মুহে তুল্যা দিলো ভাঙ্গা গরুর গাড়িত \
রং তামাসার মাধ্যমেই আয়োজকদের কাছে বকশিশ চাইতে গাইনরা ভুল করতো না। পরিবেশনার সমাপ্তিতে গাইন যেভাবে সালামীর কথা বলতেন তার একটা নমুনা দিচ্ছি-
ভুল তিরুডি করবেন ক্ষমা সভার গুণীজন
বিদ্যা-বুদ্ধি শূন্য আমরা মূর্খ অভাজন \
ভালোমন্দ যাই গাইলাম বাড়িঅলা ভাই
পান-সুবারি দেওহাইন এইবার বিদায় অইয়া যাই \
বাড়িঅলা গাইনের দলের লওহাইন সেলাম
পান-তামুক না খাওয়াইলে করিবাম বদনাম \
গাইনের গীতের শ্রোতা সবাই হলেও গাইনের দৃষ্টি থাকে মহিলা শ্রোতাদের সন্তুষ্টির দিকে। এ প্রবণতা পালা কীর্তনের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। হয়তো অধিক বকশিশ-সালামী-প্রণামীর আশায়ই নারী শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার প্রয়াশ। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে গানের বাণীর পরিবর্তন হয়ে থাকে। শহরাঞ্চলের নারীদের তুষ্টির জন্য যে গান গাওয়া হতো গ্রামাঞ্চলের নারীদের তুষ্টির জন্য গানের কথা পাল্টে যেতো। নিচের দীর্ঘ গীতটির প্রতি লক্ষ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন সব।
নারী হাসি নারী খুশি নারী ল²ীর মূল
নারী দুইন্যার নারী আখের নারী ভেস্তের ফুল \
মুখ আন্ধাইরা বেজার নারী-নারী মহাপাপ
দুষী নারী গলার ফাসি দুজখের উত্তাপ \
পদ্মিনী নারীর সইল্লে পদ্মের ঘেরান
আপন পতি বির্দুমানে নাইকো পরের টান \
শঙ্খনীয়া নারী ভাইরে উড়া-উড়া মন
দিবানিশি তার খালি সাজন আর পিন্দন \
হস্তিনীয়া নারী ভাইরে পায়ের গোছা মোটা
সেই না নারী রাইখ্যা যায় বংশের লাগি খোঁটা \
নাগিনী যে নারী আছে গেলে তার পাশে
ছয় মাসের আয়ু কমে আঞ্চলের বাতাসে \
চিন্তনীয়া নারী বালা চিন্তায় থাকে মন
দিবানিশি করে নারী স্বামীর ভজন \
থমথমাইয়া হাডে নারী চোখ পাকায়া চায়
রাক্ষসিনী সেই নারী খসম আগে খায় \
উচ-কপালী চিরলদাতি পিংলা মাথার কেশ
করলে বিয়া সেই নারী ভর্মন নানান দেশ \
এক জাইত্যা নারী আছে পাড়ায় পাড়ায় যায়
এর কতা হেরে কইয়া পান-সুবারি খায় \
ঝামটা দিয়া কয় কথা দপদপাইয়া চলে
সেই নারীর স্বামীর সংসার যায় রসাতলে \
লম্বা কাইকে চলে নারী কথা ভাংগা সুরে
সেই নারী করলে বিয়া অসুখ যায় না দূরে \
ঠ্যাস মাইরা কয় কথা মিছা ঠমক মারে
সেই নারী করলে বিয়া ল²ী পলায় দূরে \
চিক্কন পায়ের গোছা ভাইরে মাথায় পাতলা চুল
সেই নারী করলে বিয়া রয়না জাতি কুল \
আরেক জাইত্যা নারী সদাই গাল ফুলাইয়া রয়
ঘরের শান্তি নষ্ট করে স্বামীর দুঃখ অয় \
ঘোর সন্ধ্যায় যেইবা নারী হলদি বিলায়
হানজু বছর বেওয়া অইয়া বাপের বাড়ি যায় \
সইন্ধা বেলা যে নারী ঘরে দেয়না বাত্তি
ল²ী উইঠ্যা কয় তারে তর কপালে লাত্তি \
উডান হুইরা যেবা নারী দক্ষিণে দেয় ঝারা
ল²ী আইবার চাইলে থাহে সীমানায় খাড়া \
উগারে না উইঠ্যা নারী জুরে রাও করে
ল²ীয়ে কয় সেল মারিলা আমার অন্তরে \
ভর দুপুরে যেই নারী জুইড়া দেয় বাড়া
ল²ীয়ে কয় হায় ভগমান ছাইড়া গেলাম পাড়া \
সইন্দা বেলা যেই না নারী ঢেকিতে ধান ভানে
ষাইট দিনের রুজি তার কমে একদিনে \
সইন্দা বেলায় যেই নারী আড়চে মাথার চুল
ঝগড়া-বিবাদ তার সংসারে সদাই গণ্ডগোল \
চুল ছাইড়া পাও মেইল্যা বসে বিছানায়
ল²ী তো বাই দূরের কতা অল²ীও ভয় পায় \
রান্না-বান্না কইরা নারী স্বামীর আগে খায়
বাইরে গেলে তার স্বামী জুতার বারি খায় \
গুছল কইরা যেইনা নারী কাপড় চিপে পায়
আতে ধইরা চোদ্দ পুরুষ দুযখে ডুবায় \
গুছল কইরা যেবা নারী মুখেতে দেয় পান
ল²ী-মায়ে উইঠ্যা কয় সে আমারই সমান \
সতী নারীর পতি ভাইরে মজিদেরই চূড়া
অসতী নারীর পতি ভাইরে শয়তানের ঘুড়া \
কামশাস্ত্রে পদ্মিনী, শঙ্খিনী, চিত্রানী ও হস্তিনী চার প্রকারের নারীর উল্লেখ থাকলেও গাইনের পালায় আমরা চিত্রানী নারীর সাক্ষাৎ না পেলেও বিকল্প নাগীনি নারীর সাক্ষাৎ পেলাম। অন্য কোন গাইন হয়তো তার গানে চিত্রানীর উল্লেখ করে থাকবেন। অঞ্চলভেদে গাইনের গীতে পরিবর্তন বুঝে নিতে নিচে আরো একটি গাইনের গীত উপস্থাপন করছি, যা দেখে পাঠক সহজেই বুঝে যাবেন পরিবর্তনের রূপটি।

ধুয়া: আরে, সভা বিদ্দুমান,
শুনেন সবে মমিসিংগা গাইনের বয়ান।
বয়ান: এই যে লম্বা যত আম্মক তত, নল্লুয়া বাশের কুডা
আইলসা-অধম লুহুন্দরা, পেটটা যাহার মুডা \
পুইট্যা-বাওনা, লেংরা-কানা, ভারি দুষ্টজন
পয়গম্বররাও কইয়া গেছুইন, আল্লার দুশমন \
চুরে চুরে কুটুম্বিতা, কিসের ঘটকালি
এক চুরে বিয়া করে আরেক চুরের হালি \
থমথমাইয়া আডে নারী ঝাকড়া মাথার চুল
সেই নারী বিয়া করলে লাগে গণ্ডগোল \
হস্তিনীয়া নারী নারে, পায়ের গোছা মুডা
এক পুরুষের ঘর করিয়া খাইতো চায় সে ছুডা \
সতী নারীর পতি ভাইগো মজিদের চূড়া
অসতীর পতি অইলো ভাংগা নাওয়ের গুড়া \
৩. ঘাটুগান: লোকজ সংস্কৃতির ধারায় ঘাটুগান অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, নরসিন্দী এবং ঢাকা জেলার কোন কোন অঞ্চলে এ ধারার গানের প্রচলন দেখা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলন শুরু হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর শেষার্ধেও এ অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলন দেখা গেছে, তবে সা¤প্রতিক সময়ে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া ঘাটুগান খুব একটা শোনা যায় না। ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, গফরগাঁও, ফুলবাড়ীয়া; নেত্রকোনার কেন্দুয়া, মদন, খালিয়াজুরি; কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর, ইটনা, করিমগঞ্জ, মিঠামইন, নিকলি; টাঙ্গাইলের কালিহাতি, ঘাটাইল, ভুয়াপুর এবং জামালপুর জেলার কোন কোন গ্রামে ঘাটুগানের প্রচলনের তথ্য পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ‘আইরাদি’ গ্রামের নাম ঘাটুগানের সাথে খুবই খ্যাতিমান। অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত ঘাটুগানের গীতিকারদের মুন্সীয়ানাও লক্ষণীয়। ঘাটুগানের ক্ষেত্রে আরো একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো যারা ঘাটু গানের নৃত্য-গীতি পরিবেশন করে তাদের মেয়েদের মতো দীর্ঘ চুল এবং গান পরিবেশনার সময় মেয়ে সেজে নৃত্য-গীত পরিবেশনের রীতি প্রচলিত। ঘাটুগান সম্পর্কে ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব গল্প কাহিনীর প্রচলন আছে তাতে সহজেই ধারণা করা যায় ঘাটুগানের সাথে সমকামিতার নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। অশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত রচয়িতাদের যোগ্যতা বোঝাতে এখানে সামান্য ক’টি ঘাটুগানের উল্লেখ করা হলো-

* আসিতে না পারি সইগো তোমার বাড়ি বাদলে
যখন উঠে মন পিরিতি
তেঁতই পাতায় দুইজন শুতি
মনের বান্থা আমার পূর্ণ হইল না।

* হায়রে পিতলের কলসী তরে লইয়া যাইমু যমুনায়
কলসীরে তোর গলায় ধরি
লইয়া যা মোরে বন্ধুর বাড়ি
ঐ দেখা যায় ছোকরা বন্ধু পানসি নাউয়ের গুণ টানায় \

* আরে কোকাফেতে যাওরে কোকিল
পতি আমার সেই বনে।
যাহার ঘরে আছেরে পতি
উল্লাস করে সারা রাতি পতিরে লয়ে
ওরে পতি হারা হইয়াগো আমি ঘুইরা বেড়াই নগরে \
* বহুদিনের পিরীত গো বন্ধু একই দিনে ভাইঙ্গো না
একই দিনে ভাইঙ্গো না গো একই দিনে ভাইঙ্গো না
বাপ ও ভাইয়ে হইছে গো রাজি
দূর দেশে দিলো গো সাদী সুখ তো হইলো না \
একই দিনে ভাইঙ্গো না…
আমি কি দুষ দিবাম পরের পুত্রে গো
আপন কর্ম ভালো না \
একই দিনে ভাইঙ্গো না…

* অতি রসের বন্ধু আমার তাস খেলাইতে জানে না
কুড়ি চৌদ্দ টেক্কা লইয়া বইসা আছো বাবু অইয়া
ঘাতের পোডা মাইরা নিলো
বাবু আমার রং তুরুপ তো করলা না \
অতি রসের বন্ধু আমার তাস খেলাইতে জানে না…

* ও তোরা নাচ দেখলো সই
মোদের রশিক নাগর কই
রশিক নাগর কই গো মোদের রশিক নাগর কই \
যমুনার জল দেখতে কালো
জল ভরিতে লাগে ভালো
সেই জলেতে সান করিয়া আমরা শীতল হই \
মোদের রশিক নাগর কই…
ওরে আমার কলসী কানা
বসতে দিব ফুল বিছানা
খাইতে দিব মাখন ছানা খই মিশানো দই \
মোদের রশিক নাগর কই…

* গাঙ্গে আইলো নতুন পানি
সবাই দিল বানা
প্রাণ বন্ধুর পিরিতের লাগি নাইওর দিলাম মানা \

* বন্ধু একবার আইসা আমায় দেইখা যাও রে \
জ্বালাইছে চান্দের বাত্তি একলা কাটে না রতিরে
বন্ধু একবার আইসা আমায় দেইখা যাওরে \
চিঠিতে তো লিখি কত কতা
সব কতা কি যায় ওরে লেখারে বন্ধু \
লণ্ঠনো জ্বালাইয়ারে লিখি
না দেখে যে ননদী শাশুড়ি
পন্থ পানে চাইয়ারে থাকি তোমারি আশায় \

* বাবু মহিমচন্দ্র রায়
ধোপীর সনে প্রেম করিয়া কইলকাতা পলায় \
আর্শি কান্দে পড়শি কান্দে
তেমাল্লার উপরে গো কান্দে বাবুর দুই কইন্যায় \
আডারো বাড়ির জমিগোদারীর কি অইবো উপায়
বাবু বলে লেইখা গো দিবাম
ধোপীনির মাইয়ায় \

* যাওরে ভাই ঘরে যাও
শেষ দেখা দেইখা যাও
খুদিরামের আশা কইরো না।
আমি খুদি মইরা গেলে
আছে খুদির লক্ষ ভাই
ফেরাঙ্গিরে ভয় কইরো না \
এসব ঘাটুগানের কোন লিখিত রূপ নেই। সবই ঘাটু শিল্পীদের মুখে মুখে প্রচারিত, যা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলো উদ্ধার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ যত দ্রুত নেয়া যাবে ততই মঙ্গল।

৪. বাউল গান : বঙ্গজনপদের বিভিন্ন অংশেই লোকজ গানের গাতক বাউল সাধকদের বিস্তৃতির কথা জানা যায়। বাউল গানের শিল্পীরা আনেকেই আবার গীতিকারও। এসব শিল্পী স্বল্পশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত হলেও তাদের গানের বাণীর গভীরতা যে কোন সচেতন মানুষের অন্তরেই নাড়া দিয়ে যায়। বাংলার বাউল গানের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে সামনে আসে বাউল শিরোমণি লালন শাহ্র কথা; যিনি তাঁর গান দিয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন; যা কিংবদন্তিরও অধিক।
বাউল লালন শাহ’র জীবনকাল (১৭৭২/৭৪-১৭ অক্টোবর ১৮৯০) এমন কোন অতীতের ঘটনা নয়, কিন্তু তারপরও আমাদের কাছে তাঁর জীবনী সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত নয়। কারণ লালনের যে সামাজিক অবস্থান, তাঁর যে পারিবারিক পরিচয় (যদিও তা সর্বজন স্বীকৃত নয়) তাতে তাঁর সর্বসমক্ষে পরিচিত হয়ে উঠবার সুযোগ নিতান্ত কম; যাপিতজীবনে লালন প্রচারালোকের বাইরেই ছিলেন, যদিও ভক্তদের কাছে লালনের গান খুবই প্রিয় ছিল; লালনের অগণন অনুসারী নিজের কণ্ঠে লালনের গান ধারণ করে মানুষের মাঝে গেয়ে বেড়াতেন এবং এভাবেই লালনের গান রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লালনের গান শুনে কেবল মুগ্ধ নন প্রভাবিতও হয়েছিলেন; রবীন্দ্রসংগীতে বাউল আঙ্গিকের যে সুরের সাক্ষাৎ আমরা পাই, তা-ও তিনি গ্রহণ করেছিলেন প্রধানত বাউল লালন ফকিরের গান থেকে। লালন তাঁর গানে যে কাব্যশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন, যা তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ অতিক্রান্ত হবার পর আজো মলিন হয়ে যায়নি; বরং আজো লালন বিকশিত-আলোকিত-আলোচিত হচ্ছেন প্রতিদিন।
জন্মসূত্রে লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা ভিন্নমত দেখেছি; যদিও লালন নিজে তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে নিজস্ব চিন্তার কথা তাঁর গানে উচ্চারণ করেছেন এভাবে-
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কীরূপ দেখলাম না দুই নজরে \
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান নারী জাতির কী হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতা প্রমাণ বামনি চিনি কী করে \
সমাজে জাত্যাভিজাত্য আর জাতিভেদের কারণে নানান অনাচারে অতিষ্ঠ লালনকে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করতেও দেখি, যে প্রতিবাদের সাথে মিশে থাকে প্রবল ঘৃণা-
জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সব দেখি তানানানা \
আসবার কালে কী জাত ছিলে এসে তুমি কী জাত নিলে
কী জাত হবা যাবার কালে সে কথা ভেবে বল না \
ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি সবই তো এক জলে শূচি
দেখে শুনে হয় না রুচি জমে তো কারে ছাড়বে না \
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয় সে ভ্রম তো আর গেল না \
ভক্তদের মুখে মুখে প্রচারিত গানগুলোই আজ আমাদের সম্পদ; যদিও লালন-এর প্রয়াণের এত বছর পর লোকমুখে উচ্চারিত এবং সংগৃহীত গানগুলোর সবই লালনের রচনা কি-না, অথবা এর বাইরে লালনের অন্য কোন গান আছে কি-না সে সিদ্ধান্তকে আমরা চূড়ান্ত বলতে পারি না। হয়তো এ যাবৎ সংগৃহীত গানের বাইরেও লালনের কিছু গান রয়ে গেছে, অথবা হয়তো সংগৃহীত গানের কোনো কোনটি আদৌ লালনের গানই নয়। তারপরও আমরা লালনকে যতটা উদ্ধার করতে পেরেছি, তাতে এ সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হতে পারি, লালন তাঁর সময়ের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা; কেবল তাঁর সময়ের নয় সর্বকালেই লালন এক অনন্য প্রতিভার নাম। এবং লালন প্রতিভার সবচেয়ে বড় দিক তাঁর আত্মানুসন্ধান। লালন তাঁর যাপিত জীবনে বারবার ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিদ্বেষজনিত হানাহানি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নিজে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কূপমণ্ডূকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন; কিন্তু জীবনবোধের গভীরতায় তিনি নিজে এবং সতীর্থদের নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। লালনের সেই সংগ্রামের কথা উচ্চারিত হয়েছে, তেমন একটি গানের কথা স্মরণ করছি-
জলের উপর পানি না পানির উপর জল
বল খোদা বল খোদা বল \
আলীর উপর কালি না কালির উপর আলী \
জমিন তলায় আসমান উপর
না-কি আসমান জমিন সব বরারবর\
হিঁদুর পোড়া শ্মশান না মিয়ার গোরস্তান
কার থিকা কে ছোট কহ কার কী অবস্থান \
লালন তাঁর যাপিত জীবনে সহ¯্রাধিক গান রচনা করেছেন জানা যায়; লালনের জীবনদর্শন-জীবনতৃষ্ণা নিয়ে ভাবতে বসে মনে হয়, লালন-আবিষ্কারের জন্য তাঁর প্রতিটি গানের বাণী আলোচিত হবার দাবি রাখে; কিন্তু সে আয়োজনের জন্য লালন বিষয়ে সন্দর্ভ রচনা করা প্রয়োজন; কিন্তু সে সুযোগ আমার নেই, আমি কেবল আমার পাঠককে তার আবশ্যিকতার কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে পারি।
বাউল কবি আত্মনির্ভর; স্বশাসিত; কবি কখনো তাই নত হতে জানে না। কবি নত হয় তার নিজের কাছে; আত্মসমর্পণ করেন তাঁর ভেতরে যে সাঁই বসত করেন তাঁর কাছে; অতঃপর যেন নিজেরই সাথে পুনর্মিলন হয় মহাসিন্ধুতে। যে মহামিলনের জন্য কবির বুকে নিত্য আর্তি-
মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে \
চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালো শশী
হবো বলে চরণ দাসী (২) ও তা হয় না কপাল গুণে \
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন লুকালে না পাই অন্বেষণ।
কালারে হারায়ে যেমন (২) ওই রূপ হেরি দর্পনে \
সাধক লালনকে নিয়ে আমাদের গভীর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; সে গবেষণা যেনো লোক দেখানো কার্যক্রম না হয়ে যায়; প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে গবেষণা কাজে সহযোগিতা এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা আবশ্যক এবং আমি বিশ্বাস করি এ প্রয়োজন বাঙালির গৌরব চিহ্নিতকরণের জন্যই অত্যাবশ্যক।
পাঞ্জু শাহ, হাসন রাজা, উপেন্দ্র সরকার, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, উমেদ আলী, উকিল মুন্সী, শাহ আবদুল করিম, চান মিয়া, মিরাজ আলী, তৈয়ব আলী, জমির ফকির প্রমুখের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ বাউল গানের আঙ্গিনা আজ অনেকটাই ¤øান। তারপরও বাংলার প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জ জনপদ আজো বাউলগানের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে বাউল গানের পরম্পরা যাঁরা নিষ্ঠার সাথে ধরে আছেন তাঁদের মধ্যে আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল সম্রাট ইদ্রিস আলী, আব্দুল খালেক দেওয়ান, আবেদ আলী, অন্ধসিরাজ, ফাইজ উদ্দিন, মাহাতাব উদ্দিন, ছদর উদ্দিন, একদিল মিয়া, মমতাজ উদ্দিন, রামলাল, খালেক সরকার, শনতারা, আলেয়া বেগম, জালাল উদ্দিন, আবুল কাশেম তালুকদার, সুনীল কর্মকার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাউল সম্রাট জালাল খাঁ, উপেন্দ্র সরকার, রশিদ উদ্দিন ও জমির মুন্সির গান বাংলা গীতি কবিতার ভাণ্ডারে এক অমূল্য সংযোজন। বাউল গানের গায়কী এবং পরিবেশন শৈলির চমৎকারিত্বের জন্য আজো বাউলগান সারাদেশে জনপ্রিয়। বাউলদের অধিকাংশই প্রচলিত লোক সঙ্গীত, পূর্ববর্তী বাউলদের লোকপ্রিয় গান পরিবেশনের পাশাপাশি নিজেদের লেখা গানও পরিবেশন করতেন। বাউল গান প্রধানত ধর্মভিত্তিক গান; শরিয়তি-মারফতি-মুর্শিদি ইত্যাদি আঙ্গিকে দেহতত্ব, ধর্মীয়তত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মবাদ, হাদিস-কুরআন-রামায়ন-মহাভারতসহ নানান ধর্মীয় মতাদর্শ, ধর্মীয় পুরাণ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের জীবন-কর্ম নিয়ে বাউলগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। বাউলগানের এক বড় আকর্ষণ দুই বাউলের গানের লড়াই। একজন শরিয়তের পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন মারেফতের পক্ষে; একজন নারীর পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন নারীর বিপক্ষে এবং পুরুষের পক্ষে; একজন পরকাল, বেহেস্ত-দোযখ-স্বর্গ-নরকের পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন জীবন-পৃথিবী-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পক্ষে। নিজের অবস্থানের পক্ষে নানান যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টা চলবে। বাউল শিল্পীদের মধ্যে কোনো শিল্পী জনমনে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। তাঁদের গান আজো গীত হতে শোনা যায়। তেমনি কিছু সফল বাউলের কথা স্মরণ করছি-

পাঞ্জু শাহ : লোকবাংলার বাউল জগৎ বাউল শিরোমণি লালন শাহ ফকিরের পরই যাঁকে সম্মানের আসনে রাখে, তিনি বাউল পাঞ্জু শাহ ফকির (১৮৫১- ১৯১৪)। জানা যায় যুবক বয়সে পাঞ্জুশাহ বৃদ্ধ লালন শাহ ফকিরের সাথে পাল্লায় গান গেয়েছেন; লালন ফকিরের শিষ্য না হলেও পাঞ্জুশাহ তাঁর পিতা খাদেম আলী খন্দকার-এর সাথে বর্তমান হরিণাকুণ্ড থানার হরিশপুর গ্রামে বাস করতেন; যেখানে এসে তিনি লালন ফকিরসহ অন্যান্য সাধকের রচিত ভাবগানে গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। পাঞ্জু শাহ ১৮৫১ (বাংলা ১২৫৮) খ্রিস্টাব্দে শৈলকূপা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার জমিদারি ছিল। জমিদারি হারিয়েই তাঁর বাবা হরিশপুরে এসেছিলেন। জীবনের শেষ দিকে পাঞ্জু শাহ খেরকা গ্রহণ করে ফকিরি জীবনযাপন শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি লালনের মতো সংসারত্যাগী ফকির ছিলেন না। পাঞ্জু শাহ ১৩২১ বঙ্গাব্দের ২৮ শে শ্রাবণ ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

হাসন রাজা : অহিদুর রেজা চৌধুরী বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী (হাসন রাজা ছিল তাঁর ছদ্মনাম) ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৯২২-এর ৬ ডিসেম্বর (২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের সুরমা নদী তীরে তাঁর প্রতিপত্তি থাকলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। তাঁর অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে গীত হতো। সুর সাধনায় দর্শনচেতনার সাথে তিনি তাঁর ভাবসংগীতের অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। যাঁরা বাউলতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের অধিকাংশের মতে হাসন রাজাই ছিলেন ফকির লালন শাহ্?’র প্রধান উত্তরসূরি। তাঁর পাশাপাশি দুদ্দু শাহ্?, পাঞ্জু শাহ্?, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, জালাল খাঁসহ হয়তো আরো অনেকের নামই আসে; কিন্তু দর্শনচেতনার তুল্যমূল্য বিচারে লালন শাহ’র পর যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নামটি উচ্চারিত হয়, সেটি হাসন রাজা। হাসন রাজার অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। অসংখ্য থেকে দু’টি নিচে উদ্ধৃত হলো-
১.
না জানি কী মন্ত্র ফড়ি যাদু করিল
সোনা বন্ধে আমারে দিউয়ানা বানাইলো
সোনা বন্ধে আমারে ফাগল করিল \
রূপের ঝলক দেখিয়া তার আমি হইলাম কানা
সেই অবধি লাগলো আমার শ্যাম পিরিতির টানা \
হাসন রাজা পাগল হইল লোকের হইল জানা
নাচে নাচে পাগল আল্লাহ আর গায় গানা \
২.
লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার \
ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার \
এই ভাবিয়া হাসন রাজা ঘরদুয়ার না বান্দে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লা তার লাগিয়া কান্দে \
জানতো যদি হাসন রাজা কয়দিন বাচবো আর
বানাইতো দালান কোঠা করিয়া রঙিন \

শাহ আবদুল করিম : শাহ আবদুল করিমের জন্ম ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। ভাটিবাংলার কিংবদন্তি বাউলশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম। তিনি তাঁর গায়কী ও সুর মূর্ছনায় বাউল গানকে এমন এক উচ্চাতায় নিয়ে যান, যে কারণে সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘বাউল স¤্রাট’ উপাধিতে ভূষিত করে। সংগীত জীবনে তিনি পাঁচ শতাধিক গান রচনা করেন। বাংলা সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০১ সালে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাউল আবদুল করিমের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কয়েকটির কথা মনে করা যাক-
১.
সখী কুঞ্জ সাজাও গো
আইজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।
মনে চায় প্রাণে চায় দিলে চায় যারে \
২.
গান গাই আমার মনরে বুঝাই
মন থাকে পাগল পারা
আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া (২) \
৩.
তুমি বিনে আকুল পরান থাকতে চায় না ঘরে রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে।
এই মিনতি করি রে (২) \
৪.
কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভোমরা \
৫.
গ্রামের নওযুয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া মুর্শিদী আর বাউলা গান গাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম \

* উপেন্দ্র সরকার : প্রথমত উপেন্দ্র সরকারের যাত্রা শুরু কবিগান দিয়ে। কবিগান গাইতে গাইতে নিজের প্রতিভাগুণে উপেন্দ্র সরকার হয়ে উঠলেন তাঁর সময়ের খ্যাতিমান বাউল শিল্পী ও গীতিকার। সব মিলিয়ে সাত শতাধিক গানের সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর। তাঁর ৩৫২টি গান নিয়ে বাংলা একাডেমি ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ‘উপেন্দ্র সংগীত’ শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছে, যার সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন আমিনুর রহমান সুলতান। আগ্রহী পাঠক চাইলে বইটি সংগ্রহ করে উপেন্দ্র সরকারের গানের গভীরতা জেনে নিতে পারেন। উপেন্দ্র সরকারের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার শাকুয়াই বন্দের পাড়া গ্রামে এবং ১৯৬২ তে মাত্র পয়ষট্টি বছরের জীবন শেষ করেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি নিজেকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন সফল কবিয়াল হিসেবে, তেমনি সফল যন্ত্রশিল্পী হিসেবে- বাউলশিল্পী হিসেবে-গীতিকার হিসেবে এবং অবশ্যই একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে। উপেন্দ্র সরকারের অসংখ্য গান থেকে একটি উদ্ধৃত করছি-
ভব মাঝে আপন বলতে
কেহ নাই আমার।
শুধু পরের জন্য বেগার খেটে
অস্তিচর্ম করিলাম সার \
আপন বলিয়া যারে করিতাম বিশ্বাস
সে আমার সর্বস্ব ধন করিয়াছে নাশ।
এখন নাইকো কিছু হাতে আমার
পথের ভিখারি সেজেছি এবার \
সকলি অসার হরি তুমি ভবে সার
তুমি বিনে দুঃখী জীবের আপন নাই কেউ আর
তোমার পদতরি দিয়ে হরি
দীন উপেন্দ্রকে করিও পার \

* কানা জইমত : কানা জইমত ছিলেন জন্মান্ধ শিল্পী। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর গোবিন্দপুরে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন বাউল শিল্পী কানা জইমত। অসাধারণ মেধা ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী কানা জইমত একবার শুনেই যে কোনো গান ও সুর মনে রাখতে পারতেন। মুখে মুখে গান রচনা করে তিনি নিজে গাইতেন এবং শিষ্যদের শেখাতেন। এই শিল্পীর কোনো গান আজো মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। ১৩৩৯-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ময়মনসিংহ কারাগার ভেঙে যাবার ঘটনা নিয়ে তাঁর রচিত গানটি ছিল-
ঘটলো আজব লীলা
ময়মনসিংহ জিলা
সোমবারে বৈকাল বেলা ভাঙ্গলো জেলখানা।
১৩৩৯ সনে বৈশাখেরই ছাব্বিশ দিনে
আসিয়া দারুন তুফান লাগায় লাঞ্ছনা \
দালান-কুঠা ভাইঙ্গা পড়ে
কত কয়েদি পইরা মরে
কত কয়েদী ভাগে ডরে নিষেধ শুনে না \
তুফান আইসা মারে ঠেলা
সবাই বলে আল্লা আল্লা
ভাঙ্গলা দালানের মাল্লা বাকি রাখলা না \
তুফান আইসা জুর করে
সব বাবুরা চিৎকার পারে
হরি যুদি উদ্ধার করে বাইস্কুপ দেখবো না \
বাউল শিল্পী কানা জইমত-এর আরো একটি লোকপ্রিয় গান, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণে রেখে তিনি রচনা করেছিলেন; তা স্মরণ করতে চেষ্টা করছি-
পাপের জন্য ল²ী শূন্য
জমিতে হয়না ধান্য
দেশে আইলো দারুণ দুর্ভিক্ষ।
পাপেরই কারণে
ল²ী গেল অন্তর্ধানে
অল²ী আসিয়া দেশে করে রাজত্ব \
জমিনেতে ধান্য হয়না
গাভীর বানে দুধ মিলে না
মায়ের বুকে দুধ আসে না ছেলে খাবে কী
বিশ ট্যাকা চাইলের মন
একট্যাকা হইলো লবণ
বার আনা কাপড়ের গজ পাঁচ ট্যাকা সের ঘি \
কানা জইমতের এ সব গানের কোনো লিখিত রূপ না থাকায় কালের আবর্তে সব হারাতে বসেছে।

* রশিদ উদ্দিন: নেত্রকোনা জেলার বাইরচাপড়া গ্রামে বাউল রশিদ উদ্দিনের জন্ম উনিশ শতকের শেষ দশকে। বয়সে বাউল জালাল খাঁ’র সমসাময়িক হলেও রশিদ উদ্দিন জালাল খাঁ’র সম্মানের পাত্র ছিলেন। এক সাথে সংগীত সাধনা করলেও রশিদ উদ্দিনের গানের বাণী বাউল জালাল খাঁকে নতুন দিগন্তের দিশা দিয়েছিল। রশিদ উদ্দিন অসংখ্য জনপ্রিয় গান লেখার পাশাপাশি নিজে একজন লোকপ্রিয় বাউল শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাউল রশিদ উদ্দিনের অসংখ্য গান আজো বাংলার অনেক বাউল গেয়ে থাকেন। রশিদ উদ্দিনের অনেক গান থেকে একটি গানের কথা স্মরণ করছি-
আমি বলবো কি শুনবে কে
বুঝবে কিরে ধুন্দা
এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা \
বহুরূপী রঙ বাজারে ঘুম থাকে না মনের ঘরে
রূপ দেখাইয়া প্রাণে মারে খাওয়াইয়া ধান্দা \

* বাউল জালাল খাঁ : বাংলার বাউল গানের প্রথম সারির একজন সাধক কবি জালাল খাঁ। মিডিয়ার দৃষ্টি হয়তো তার দিকে সে ভাবে পড়েনি, অথবা যাদের দায়িত্ব ছিল জালালের গানকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার হয়তো তারা নিজেদের নিয়ে অধিক মগ্ন ছিলেন, যে কারণে জালাল খাঁর গান সমস্ত বঙ্গে যতটা লোকপ্রিয় হওয়া সঙ্গত ছিল ততটা হয়ে ওঠেনি; তাতে সাধক কবি জালাল খাঁর কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেনি- ক্ষতি হয়েছে আমাদের। সাধক কবি জালাল উদ্দীন খাঁর জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। পাঁচখণ্ডে সমাপ্ত ‘জালাল গীতিকা’ ছাড়াও তিনি ‘বিশ্ব রহস্য’ শিরোনামের প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেছেন। ১৯৭২-এর ৩১ জুলাই তিনি কেন্দুয়ার সিংহেরগাঁও নিজগৃহে পরলোকেযাত্রা করেন। জালাল খাঁর বিপুল জনপ্রিয় একটি গান স্মরণ করছি-
মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে \
খোদার নাহি ছায়া কায়া স্বরূপে ধরেছে মায়া
রূপে মিশে রূপের ছায়া, ফুল কলি ছয় প্রেমের গাছে \
আরব দেশে মক্কার ঘর, মদিনায় রছুলের কবর
বয়তুল্লায় শূন্যের পাথর, মানুষে সব করিয়াছে \
মানুষে করিছে কর্ম, কত পাপ কত ধর্ম
বুঝিতে সেই নিগূঢ় মর্ম, মন-মহাজন মধ্যে আছে \
… … … … …
মানুষের ছবি আঁক, পায়ের ধূলি গায়ে মাখ
শরিয়ত সঙ্গে রাখ, তত্ত্ব-বিষয় গোপন আছে \
জালালে কয় মনরে পাজি, করলে কত বে-লেহাজি
মানুষ তোমার নায়ের মাঝি, একদিন গিয়া হবে পাছে \
লোকবাংলার এসব বাউল সাধকদের গান যখন নাম উচ্চারণ না করে গাওয়া হয়, তখন বেদনার সীমা থাকে না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
কেহই করে বেচা কেনা কেহই কান্দে
রাস্তায় পড়ে ধরবি যদি তারে চল মুর্শিদের বাজারে \
ষাটের দশকে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অবাঞ্ছিত’ তে আবদুল আলীমে গাওয়া জননন্দিত এ গানটির গীতিকার জালাল খাঁ হলেও ছবিতে তাঁর নামটি ব্যবহার করা হয়নি।
* উকিল মুন্সি : নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার বোয়ালি গ্রামে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বাউল সাধক উকিল মুন্সির জন্ম। ভাটির অঞ্চল ছাপিয়ে উকিল মুন্সির গান লোকবাংলার ঘরে ঘরে মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছে। আজো উকিল মুন্সির গান মানুষের মুখে মুখে। বলা হয়ে থাকে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাউল গানের চরম উৎকর্ষ লাভ ঘটে। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একজন সফল গায়ক ও গীতিকার ছিলেন বাউল উকিল মুন্সি। নিচে উকিল মুন্সির অনেক গানের একটির উল্লেখ করছি-

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে কর তোমার মনে যাহা লয় \
নিঠুর বন্ধুরে.. .. .. ..
বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষী কেউ ছিলোনা সেই সময়।
সাক্ষী শুধু চন্দ্র তারা
একদিন তুমি পড়বে ধরা
ত্রি-ভুবনের বিচার যেদিন হয় \
নিঠুর বন্ধুরে … .. ..
দুঃখ দিয়া হিয়ার ভিতর
একদিনও না লইলে খবর
এই কি তোমার প্রেমের পরিচয়।
কি জানি কি আশা দিয়া
কেন বা প্রেম শিখাইলা রে.. .. ..
দূরে থাকা উচিত কি আর হয় \
নিঠুর বন্ধুরে .. .. ..
৫. গম্ভীরা: বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের লোকসংগীতের প্রসঙ্গ এলেই উচ্চারিত হয় ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার কথা। অবিভক্ত ভারতের মালদহ জেলায় ব্রিটিশ আমলে প্রধানত শিবের বন্দনাগীত হিসেবে এ ধারার উৎপত্তি হলেও মুসলমান সমাজেও এর বিস্তৃতি ঘটে। দেশ ভাগের পর মুসলমান গম্ভীরা শিল্পীদের অনেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসে এবং তখন থেকে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে এ গানের বিস্তার ঘটে। রাতারাতি লোকপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে এ গানের চর্চাও বেড়ে যায়। সময়ের বিবর্তনে গম্ভীরা গানে যুক্ত হতে থাকে সমাজবাস্তবতার নানান চিত্র। পরবর্তী কালে মিডিয়ার কল্যাণে এ গান দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পায়। এ গানের সাথে যুক্ত থাকে নৃত্য-গীত ও অভিনয়। তিন শিল্পের সুচারু সমন্বিত পরিবেশনায় সহজেই গম্ভীরা তার দর্শক শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে। নানা-নাতির সংলাপ-গীত ও নৃত্য এবং সহযোগীদের (দোহার) বাদ্য বাদন পলকেই মুখরিত করে তোলে দর্শক-শ্রোতাদের। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যেহেতু গম্ভীরা সাধারণের পরিবেশনা; সে কারণে গানে অংশ গ্রহণকারী শিল্পীদের পোষাক-আশাক থেকে শুরু করে বিষয়, সবই সাধারণের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হয়। পরিবেশনাকে মনোরঞ্জক করে তুলতে গানে প্রচুর হাস্যরসাত্মক কথাবার্তার পাশাপাশি রস-কৌতুকও পরিবেশন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গম্ভীরা গানে আমরা যুগোপযোগী অনুষঙ্গ যুক্ত হতে দেখি; আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, বয়স্ক শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের কুফল, যৌন নিপীড়ন, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস এবং ইভটিজিং, বাদ যায় না কিছুই। সামাজিক অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি, বঞ্চনা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গম্ভীরার ব্যবহার হতে দেখি। নিচে একটি গানের উদ্ধৃতি দেয়া হলো-
হে নানা শুনাছিস হায়রে
সর্বনাশ হয়্যাছে ষোল আনা।
কাণ্ডকীর্তি দিখ্যা শুন্যা বিগড়্যা গেছে মেজাজ খানা \
বাংলাদেশের কিশোর যুবক বেশির ভাগই গিলছে মদ গতি নাই হামার জানা \
যত আছে নানা,
ধরছে তাড়িখানা।
নানা দ্যাখোতো কাণ্ডখানা \
প্রায় বিশ লাখ বাঙালি
হয়্যাছে আসক্ত
ফেনসিডিল ও ইয়াবায়
কত শত ভক্ত
এদের ভবিষ্যৎ মরণ ছাড়া
চেষ্টা তদবির চলছে নানা
সরকারি মহলে
কমন করে ছাড়ানো যায়
এসব কি কৌশলে
নানা এভাবে দ্যাশকি চলে?
ভাইসব তোমরা হচ্ছে দ্যাশের মা-বাপ
তোমরাই ভবিষ্যৎ কি না?

৬. আলকাপ: বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত হলো ‘আলকাপ’, তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এর চর্চা ও প্রসার বেশি দেখা যায়। মানুষের জীবনের নানান অনুষঙ্গ, হোক তা ধর্মীয়, সামাজিক সমস্যা, ইতিহাস, রাজনীতি, প্রেম, এমনকি লোকবিশ্বাস, সবই আলকাপ গানে পরিবেশিত হতে দেখা যায়। নৃত্য, সংগীত ও নাট্যগুণ সম্পন্ন আলকাপ গাওয়া হয়, আসর বন্দনা, দেশ বন্দনা, খ্যামটা, হাস্যরস এবং পরিশেষে পালা এভাবে এর পরিবেশন এবং উপস্থাপনশৈলী নির্ধারিত হয়। আলকাপে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দল প্রধান সরকার ছাড়াও দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছোকরা, কাইপ্যা ও অভিনেতা। ছেলেরা মেয়ের পোষাক পরিধান করে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে আলকাপ গানে। পালা পর্বে স্ত্রী চরিত্রে তারা অভিনয় করে। সাধারণত পূজা-পার্বণ, অন্নপ্রাশন, বৈশাখী মেলা উপলক্ষে এগানের আসর বসে। আসর বলতে সামান্য উঁচু একটি স্থান যা দর্শক শ্রোতাদের মাঝখানে বানানো হয়; অথবা বলতে পারি, যাত্রা মঞ্চের মতো মঞ্চের চারপাশে দর্শকদের বসবার ব্যবস্থা থাকে। শিল্পীরা সবাই আসরেই বসে থাকেন। যাঁর ভূমিকা যখন আসে তখন নৃত্যগীতসহ মঞ্চে উঠে যান। পরিবেশনশৈলীর এ দৃশ্যের কিছু কিছু আমরা ঘাটুগান, গাইনেরগীত বা ঢপযাত্রায় দেখতে পাই। এ গানের আসর বসানো যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ, তদুপরি এর পরিশেনা থেকে শিল্পীদের অর্থাগম নেই বলে এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ গান এখন খুব একটা গীত হতে দেখা যায় না। নিচে আলকাপ গানের একটি বন্দনা অংশ উদ্ধৃত করছি-
প্রথমে মোনাকষার বোনাকানা
আলকাপ গান করে রচনা।
তারপরেতে সুবেদার আলী ভাই
বাড়ি তাহার মালদহেতে হয়।
তার পরেতে ঝাকসু সরকার নামটি শুনি জাগিরুদ্দীন যাহার নাম এবার শুনেন সুবল কানার গান
তার জঙ্গীপুরে বাড়ি জানি। আলকাপেতে সে বিখ্যাতরে ভাই \
তার নূরপুরেতে হয়গো ধাম।
ঝকসু জগু এক সঙ্গেতে গায়।
সিরাজ মাস্টার তাকে রেখেছিল ভাই \
কার বা কতো করবো নাম
এই বলে ভাই
আমি দশের কাছে প্রণাম জানাই \

৭. ভাওয়াইয়া: ‘ভাব’ বা ভাওয়া (নিচু জমি) শব্দ হতে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি। নিচু অঞ্চল গরু মহিষের চারণ ক্ষেত্র থেকে মৈষাল বা বাউদিয়ার কণ্ঠ হতে বেয়ে আসা ভাবের গানের নামই হচ্ছে ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের গান হলেও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে এ গানের প্রচলন বেশি। প্রেম, বিরহ এবং নারীমনের অপ্রাপ্তিজনিত ভাব এই গানে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এ গানে রয়েছে দীর্ঘ এবং উঁচু নিচু টান। এ গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র দোতরা; তাল অনুষঙ্গ হিসেবে এ গানে খোল-করতাল-মন্দিরা এবং খমকের ব্যবহারও দেখা যায়। চটকা, খেমটা, ক্ষিরল ইত্যাদি ভাওয়াইয়া গানেরই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক। সাধারণত প্রেম-বিষয়ক হালকা, চটুল ও আদিরসাত্মক গীতি সমাজের প্রতি কটাক্ষ ও শ্লেষের ভাবটিও এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে। সমাজের করুণ ছবি ও মর্মবেদনার চিত্রও প্রতিফলিত হতে দেখা যায় ভাওয়াইয়া গানে। নিচে কয়েকটি ভাওয়াইয়া গান উদ্ধৃত করা হলো-

১.
বাওকুমটা বাতাস য্যামন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে
ওকি ও রে ওই মতন মোর গাড়ির চাকা
পন্থে পন্থে ঘোরে রে \
ও কি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজো পন্থে
বিয়ানে উঠিয়া গরু গাড়িত দিয়্যা জুড়ি
ও কি ওরে সোনা মালা সোনার বাদে চান্দের দ্যাশে ঘুরি রে \

গাড়ির চাকা ঘোরে আরও মধ্যে করে রাও
ও কি ওরে ওই মতন কান্দিয়া ওঠে আমার সর্ব গাও রে..
দ্যাশ বিদ্যাশে ব্যাড়াং রে মুই সোনা সোনার বাদে
ও কি ওরে সে ও সোনা অবশেষে ঘরোত বসি কান্দে রে…

২.
ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে
ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া
ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে \
ফান্দে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা
ওরে আহারে কুংকুরার সুতা, হল লোহার গুনারে \
ফান্দে পড়িয়া বগা করে হায়রে হায়
ওরে আহারে দারুণ বিধি সাথী ছাইড়া যায় রে \
আর বগা আহার করে ধল্লা নদীর পারেরে \
উড়িয়া যায় চখুয়ার পঙ্খী বগীক বলে ঠারে
ওরে তোমার বগা বন্দি হইছে ধল্লা নদীর পারে রে।
এই কথা শুনিয়া রে বগী দুই পাখা মেলিল
ওরে ধল্লা নদীর পারে যাইয়া দরশন দিল রে।
বগাক্ দেখিয়া বগিক কান্দে রে
বগীক্ দেখিয়া বগা কান্দেরে।

৩.
ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে \
যদি বন্ধু যাবার চাও
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে
বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে \

বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে।
বন্ধুরে, বন্ধুরে, বন্ধুরে।
বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে \

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাওয়াইয়া গান বাঙালি যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনি একটা গানের কথা স্মরণ করছি-

ও বগিলা রে
কেন বা আলু বাংলা দ্যাশে
মাছের আশা নিয়া…

৮. বিয়ের গান মেয়েলী গীত : বৃহত্তর ময়মনসিংহের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিয়ে অনুষ্ঠনের নানা পর্যায়ে বিভিন্ন গীত গাওয়া হয়ে থাকে। এসব গীত সাধারণত মেয়েরাই গেয়ে থাকে। বিয়ের গীতের বৈচিত্র্য নিয়ে গত বছর ঈদসংখ্যায় লিখেছিলাম মনে পড়ছে, তাই এখানে সে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছি না। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য গীত লোকজীবনের বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়ে থাকে। এসব গীত বিভিন্ন এলাকায় নানান বাণী ও সুরে প্রচলিত আছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়