গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

সেলিব্রিটি রহস্য : মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নামকরা শিল্পী আয়ান চৌধুরী। নন্দিত শিল্পী হিসেবে দেশের বাইরেও তার খ্যাতি রয়েছে। এই শিল্পীর সিডিউল পাওয়া মুশকিল। সিডিউল পেতে হলে অনেক আগে বলে রাখতে হয়। আয়ান চৌধুরী কম কথা বলেন। তবে কোনো অহংকার নেই। কিন্তু তার একটি অদ্ভুত স্বভার রয়েছে। কোথাও গেলে গাড়িতে তার পাশের সিটটি খালি রাখেন। কেউ বসতে গেলে বিনয়ের সাথে বলেন এই সিটে বসা যাবে না। কোন অনুষ্ঠানে গেলেও একই অবস্থা, খালি রাখতে হয় পাশের চেয়ারটি। মিডিয়া পাড়ার সবাই এক কথা জানে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এটা করেন, তা আয়ান চৌধুরী ছাড়া সকলের অজানা। গণমাধ্যমকর্মীরা তার কাছে বহুবার এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু কখনও উত্তর পায়নি। তাই রহস্যটি অজানা রয়ে গেছে। এখন আর কেউ প্রশ্নই করে না।
এভাবে সময় গড়াতে থাকে। এক সময় আয়ান চৌধুরী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তিনি বুঝতে পারেন মৃত্যু খুব কাছে। তাই সিট খালি রাখার রহস্য বলতে চান। ডাকেন সাংবাদিক রাশেদ আহমেদকে। শর্ত থাকে এটা ছাপতে হবে তার মৃত্যুর পরে।
নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয় সাংবাদিক। বেশ কিছু প্রশ্ন করার পর যথরীতি পাশের সিট খালি রাখার প্রসঙ্গ চলে আসে। বলেন, আমার বয়স তখন ১০-১২ বছর। ঢাকাতে আব্বু-আম্মু এবং চাচার সঙ্গে থাকে। আমি ছোটবেলা থেকে গান শিখতাম, কিন্তু তেমন মন ছিল না। ঘটনাক্রমে একদিন মনোজ কাকুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন মনোজ কাকুর বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। দেখতে সুদর্শন। সুঠাম দেহের অধিকারী। মানুষ হিসেবে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। নিজের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। রাজধানীতে নিজের বাড়িতে থাকেন। তার অন্য ভাইবোনের সবাই আমেরিকায় স্থায়ী। তার স্ত্রী-সন্তান ছিল না। সংসারের কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। জীবনটা বেশ মানিয়ে নিয়েছেন।
নিজের টাকা-পযসার অর্থ-বিত্তের অভাব ছিল না তার। তিনি খুব গান ভালোবাসতেন। কোনো বাজে অভ্যাস ছিল না মনোজ কাকুর। কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। বাকিটা সময় বই পড়ে, কিংবা টিভি দেখে সময় পার করেন।
একবার এক অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয়। আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন কাকু। পরে বাসায় আসা-যাওয়া এবং ঘনিষ্ঠতা। এক সময় তিনি যেন আমাদের পরিবারের লোক হয়ে উঠলেন। মনোজ কাকুর অম্ভুত ক্ষমতা ছিল মানুষকে আপন করে নেওয়ার। সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যে তিনি আমার বন্ধুর মতো হয়ে গেলেন। কাকু আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন, শপিং করে দিতেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন আমি কীভাবে গানে উন্নতি করব সেদিকে। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার গানে মন আসে। আমি গান করতাম কাকু পাশে বসে থাকতেন। তিনি এত গুছিয়ে এবং কাব্য করে কথা বলতেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কাকু বলতেন একদিন আমার আয়ান পৃথিবী সেরা গায়ক হবে। এক কথায় আমি তার ছেলে হয়ে উঠছিলাম। একবার এক অনুষ্ঠানে ইচ্ছে করে অন্য একটি মেয়েকে জিতিয়ে দেয়া হয়। সেবার অনেক কান্নাকাটি করে গান ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি আব্বু-আম্মু গানের মাস্টার কারো কথা শুনছিলাম না। পরে কাকুই আমাকে গানে ফিরিয়ে আনলেন।
হঠাৎ একদিন আমি কিডন্যাপ হয়ে গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন আমাকে পাওয়া গেল না, তখন বাসায় ফোন এলো ১০ লাখ টাকা হলে আমার মুক্তি দেয়া হবে। আব্বু রাজি হয়ে গেলেন। আব্বু যখন কথা বলছেন তখন পাশে কেউ একজন বলছিলেন মনোজ বাবু উনি রাজি হয়ে গেছেন, মুক্তিপণের টাকা পাবো। বুঝতে বাকি থাকল না মনোজ কাকু আমাকে কিডন্যাপ করেছেন। তাছাড়া মনোজ কাকুর ফোনও অফ ছিল। যাই হোক টাকা দিয়ে আমায় মুক্ত করে আনা হয়। দুই দিন পর আমাদের বাসায় আসেন কাকু। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুলিশে দেয়া হলো। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকাও আদায় করা হলো। সেদিন কাকু কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না।
কাকু জেলে চলে যাওয়ার পর আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। তার জেল হলো দুই বছরের। আব্বু-আম্মু যতই তার মন্দ কথা বলেন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। বারবার মনে হয় কাকু এমন কাজ করতে পারেন না। আমি একদিন চুরি করে কাকুকে জেলে দেখতেও গিয়েছিলাম। কাকু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- ‘তোমার গান কেমন চলছে বাবা? গানটা মন দিয়ে করবে। গান তোমাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আর আমাকে কখন এভাবে দেখতে আসবে না। আব্বু-আম্মু চিন্তা করবেন। মুক্তি পেলে তোমার খোঁজ নেব।’
তার শাস্তির মেয়াদ প্রায় শেষ। একদিন আম্মু চাচার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শুনলেন ‘চাচা বলছেন বেটা মনোজ বাবুকে কীভাবে ফাঁসিয়ে দিলাম। আমি কিডন্যাপ করলাম আর মনোজ বাবু জেল খাটছে। জানো সেদিন পাশের থেকে যদি আমি মনোজ সাহেবের নাম না বলতাম, তাহলে তাহলে কিন্তু নাটক জমত না। বড় ভাই বিশ্বাসই করত না’।
চাচার কথা শুনে আম্মু-আব্বু খেই হারিয়ে ফেললেন। তার পরের দিনই আমরা গেলাম মনোজ কাকুর জামিনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম ঘণ্টাখানেক আগে কাকু সুগার নীল হয়ে মারা গেছেন। তার এক বন্ধু এসেছেন লাশ রিসিভ করতে। তিনি আব্বুকে বললেন সব ঘটনা। যৌবনে ভালোবাসার মানুষটি মারা যাওয়ায় তিনি বিয়ে করেননি। আর আমার মধ্যে তিনি নিজের সন্তানকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর আমি গান ছেড়ে দিই। শত চেষ্টা করেও আমাকে কেউ গানে ফিরাতে পারেনি। একদিন রাতে স্বপ্নে দেখি কাকু আমার মাথায় হাত রেখে বলছেন বাবা তুমি গান না গাইলে আমি খুব কষ্ট পাবো। আমি প্রতিদিন তোমার গান শুনতে আসি। তুমি গান করবে। আমি সারাক্ষণ তোমার পাশে পাশে থাকব। তার পর থেকে আবার গানে ফিরে আসি আমি। সত্যি বলতে কী আমি এখনো প্রতিদিন কাকুকে দেখতে পাই। তিনি আমার সাথে সাথে থাকেন। তার সম্মানেই আমি পাশের সিটটা খালি রাখি। আমার এত দূরে আসার পেছনে একমাত্র তিনিই রয়েছেন। তার মতো মানুষ পৃথিবীতে বিরল। আমার কাছে তিনি মানুষ ঈশ্বর। আমার মতো প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে এ রকম একজন মানুষ থাকে। কোনো মূল্য দিয়ে তার ঋণ শোধ করা যায় না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়