গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে : দিলারা হাফিজ > স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সূচনা

রবীন্দ্রনাথের প্রেমের এই সঙ্গীতের একটি ক্যাসেট আমাদের প্রেমের সূচনা পর্বেই কবি রফিক আজাদ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এই গানটি যে কত লক্ষ হাজার বার শুনেছি দুজনেই, তা আর বলতে পারবো না আজ।
তবে এখনো শুনি, শুনছি।
অবশ্য এর বেশ কিছুকাল আগে প্রথম তার সঙ্গে রিকশায় উঠে স্টেডিয়ামের ম্যারিয়েটা বুকশপে গিয়েছিলাম প্রথম তারই আহ্বানে।
কেননা, সেই সময় একমাত্র ঐ বুকশপে কিছু ইন্ডিয়ান বই পাওয়া যেতো।
কবি শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ এবং কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ শিরোনামের দুটো ছন্দের বই কিনে তিনি আমাকে গিফ্ট হিসেবে স্বাক্ষর যুক্ত করে দিয়েছিলেন।
কাব্যযাত্রার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কাব্যচর্চার দিক নির্দেশনা হিসেবেই তিনি তা করেছিলেন।
কবিতা চর্চা আর রবীন্দ্রনাথকে তুমুলভাবে শুনেছি,
সেই আগুনলাগা সবুজ সময়ে।
এই সময়ে আরো একটা আধুনিক গান শুনতাম আমি।
‘ভুল সবই ভুল এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা’ আসলেই কি ভুল?
তা নয়তো কি???
আমাদের প্রেম তখনো খুব স্পষ্ট নয়, তবু মনে হতো এই বুঝি গভীর কোনো গিরিখাদে পড়তে যাচ্ছি বোধ হয়। প্রেমের নানা রকম ব্যাখ্যা আসে মনে।
জার্নাল খুঁজে খুঁজে পড়ি, আর ভাবি বিজ্ঞের মতো। আবার নিজেকে বোঝাই নিজে।
মন শোন!
প্রেম মূলত এক সুগভীর মানসিক প্রক্রিয়াজাত সমস্যা বলে বৈজ্ঞানিকদের হাজারো রকম ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও প্রেমে পতিত মানুষের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলো প্রেমাস্পদের দেখা পাওয়া।
তা যে কোনো বয়সেই আসুক না কেন। ভালোবাসা বা প্রেমের মতো মূল্যবান সম্পদ মানুষের জীবনে দ্বিতীয়টি নেই।
নেই মানে? মানেও নেই। এই আর কি?
মানুষের জীবনে যত সমস্যা আসে-যায়, তার অধিকাংশ অপ্রিয় বটে। তবে প্রেম যখন সমস্যা হয়েও দেখা দেয়, তখনো তা পরম আকাক্সক্ষার বস্তু হিসেবেই জগতের সব মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। শুধু সমস্যা নয়, প্রেম কখনো কখনো মহামারির হুমকি নিয়েও দেখা দেয়। তখন কিন্ত দু’জনের কারু নিস্তার থাকে না। প্রেমের মধ্যে ভোরের সূর্যোদয়ের নরম আলোর রহস্যময় যে বিচ্ছুরণ লুকিয়ে থাকে, অনমনীয় সেই দুর্বার শক্তির মোহনীয় তেজেই ভালোবাসার সৌন্দর্য নিহিত থাকে। এবং তা থেকে বিকশিত অনাবিল মধুরিমা পরস্পরের প্রাণের মধ্যে যে অচেনা দ্যোতনা সৃষ্টি করে তাই বর্মরূপে সমাজের সকল সংকীর্ণ বাহুল্যতাকে অস্বীকার করতে সাহস অর্জন করে।
মানুষ দিব্যি পরস্পরের প্রেম-ভালোবাসার অমৃত সুধারস পান করে তারা শৈল্পিকভাবে বেঁচে থেকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে।
এখানেই প্রেমের অনাস্বাদিত অপূর্ব এক ঐশ্বরিক শক্তির মূল নিহিত থাকে বলে বিশ্বাস করি।
কিন্তু এখন কি করি আমি?
একজন কবির সঙ্গে অপর কবির প্রেম, তার যতটা না দৃশ্যত, ততোধিক, অন্তর্গত। পারস্পরিক বেদনাবোধের বাতায়ন থেকে উৎসারিত দক্ষিণা হাওয়ার সারথি।

আমার শুরুর কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় রফিক আজাদকে দেখার আগেই পাঠক হিসেবে আমি তার প্রেমে পড়েছি প্রথম। কবির প্রেমে কে না পড়ে?
যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রেমে সদা ব্যাকুল। নজরুলের প্রেমের আকুতিও আমাদের স্পর্শ করে যায় ক্ষণে ক্ষণে। জীবনানন্দ দাশ তো মরণবাণ, কেবলি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়…।
১৯৮০ সাল।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাস করে, হলে থাকবার কথা ভেবে ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘শিক্ষা গবেক্ষণা প্রতিষ্ঠানে’ এর ডিপ-ইন-এড কোর্সে।
ড. হালিমা খাতুন আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার কোর্সে গ্রন্থ সমালোচনার জন্য আমাকে একটি বই দিলেন। কবিতার বই। ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবি রফিক আজাদ।
পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে রফিক আজাদের কবিতা পড়েছি বটে, তার বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’ তখনো আলোচিত, সমালোচিত বহুলভাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত রফিক আজাদকে চিনতাম না আমি, তখনো জানি না তাকে। বলা যায়, আমার কবিতা লেখা এবং প্রকাশের প্রণোদনার আকাক্সক্ষাই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল তার কাছে।
১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থেই কবির বেশ কিছু বিখ্যাত কবিতা অন্তর্ভুক্ত আছে, যা আবৃত্তিকারদের কাছেও জনপ্রিয় বটে। সেই প্রথম গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত পাঠ করে গ্রন্থ সমালোচনা লিখতে গিয়ে কবির কবিতার গভীরে প্রবেশ করি। নাম কবিতা ছাড়াও অন্যান্য বেশকিছু কবিতা পাঠ করে কবির সূ² মনোবীণায় যেন খুঁজে পেলাম আমার আপন সুরটিকে। সারা রাত জেগে অন্য কিছু নয়, শুধু বাতাসের শব্দ, যা কেবল দীর্ঘশ্বাসময়- এই হাহাকারের সঙ্গে কখন যে মন আমার একাত্ম হয়েছে নিজেরই অজান্তে।
আজ তা মনে করাও কষ্টের।
১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমির পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ এ কবিতা প্রকাশের জন্যে দুটো কবিতা দিতে গিয়েছিলাম কবি ও সম্পাদক রফিক আজাদের টেবিলে। সেই প্রথম দেখা। যেন সেই প্রথম নীলাচলে অপরূপ এক গৌরাঙ্গ সন্দর্শন। ভালো লাগায় জড়িয়ে গেল দেহমন।
সেখানেই প্রথম দেখি নাদিরা মজুমদার, শামীম আজাদ, শাহজাদী আন্জুমান আরা, রুদ্রসহ আরো অনেককে। তারাও মূলত কবিতা দিতেই আসতো উত্তরাধিকার পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। কিন্তু রফিক আজাদের তুমুল আড্ডা রেখে নড়তে পারতো না কেউ।
এভাবে কবি ও কবিতার আড্ডার জাদুতে পেয়ে বসেছিল আমাকেও। যখনই আড্ডার মধ্যমণি কবি রফিক আজাদকে ভাবি, ভালোলাগার সমুজ্জ্বল এক আতশবাজিতে পুড়তে থাকে নিজের মনের উঠানবাড়ি। নিজের ভেতরে জন্ম নেয় অন্য এক আমি।
বাংলা একাডেমির মাঠ পেরুতে গেলেই সবুজ তৃণে জড়িয়ে যায় আমার পদযুগ। প্রাচীন বটের সুমধুর হাওয়া সারাক্ষণ মরমে বাজে বিলাবল রাগে…..।

২. নেশা লাগিলো রে….

তখন আমি সরকারি কুমুদিনী কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক। চারদিন টাঙ্গাইলে থাকি, বাকি তিন দিনের ন্যে বাসে দুলতে দুলতে ঢাকায় ফিরে আসি রফিক আজাদের আড্ডার নেশায়। মন গুনগুন করে গাইতে থাকে, হাছন রাজার গান।
‘নেশা লাগিলো রে,
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে,
হাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিলো রে..,
নেশা লাগিলো রে……’।
ইতোমধ্যে তিনি আমাকে একদিন রিকশায় পাশে বসিয়ে স্টেডিয়ামের ম্যারিয়টা বইয়ের দোকানে নিয়ে যান। এই প্রথম একাকী রফিক আজাদের পাশে আমি একলা। চাপা রিকশার সিটে আমরা দু’জন মাঝারি গড়নের নারী-পুরুষ। মাঝখানে এক ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁক নেই। পোশাকের আড়াল ছাপিয়ে কবির শরীরের সৌগন্ধে আমি প্রায় উন্মাতাল। সবুজ ধানক্ষেতে বাতাস বয়ে গেলে যেমন সুদূরের মূর্ছনায় কাঁদে আকাশ-নদী-চরাচর, তেমনি আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অচেনা ঢেউ খেলে যায় অজান্তে। প্রথম একজন প্রার্থিত কবি-পুরুষকারের পাশে বসে তার সঙ্গসুধার সৌগন্ধে তুমুলভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম বলাই বাহুল্য। নতুন এই বিস্ময়কর অনুভূতি আমাকে কেমন যেন বিমোহিত করে রেখেছিল সারাটা পথ। লজ্জা, বিভাবনা, আনন্দরতি মিলেমিশে একাকার হলো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ বইটি হাতে পেয়ে। গল্পচ্ছলে ছন্দের কলা-কৌশল শেখানো, নীরেনদার গুরুত্বপূর্ণ বইটি কিনে তিনি আমাকে উপহার দিলেন এবং কবিতা লেখার জন্য ছন্দ জানাটা কতটা অপরিহার্য সে বিষয়ে ফিরতি পথে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ততোধিক আমার মুগ্ধতা হরণ করে নিলেন তিনি। মনে মনে ভাবলাম বড় কবি হওয়ার এই সুবিধে!!!
সেই সময় একমাত্র ম্যারিয়টায় কলকাতার বইপত্র কিছু পাওয়া যেত। ভালো কবিতা লেখালেখির জন্য আরো কী কী বই পড়া উচিত, সেসব বিষয়ে উপদেশ দেন দেখা হলেই। মান্যবর শিক্ষক-বন্ধুর মতো আমার কবিতা, কবিতার শব্দ চয়ন, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা তথা কবিতায় শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার ব্যবহারের কলা-কৌশল ও শুদ্ধ বানানে লেখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে নানা বিষয়ে সরস আলোচনা করেন আমার সঙ্গে।
আমাকে আর পায় কে?
মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের মতো আমি তো মাটির দেড় ইঞ্চির উপর দিয়ে হাঁটি। নতুন কথা, নতুন কিছু শিখি তার কাছে। জানার এই আনন্দ আমাকে যুগপৎ কবি ও কবিতার আরো বেশি কাছাকাছি নিয়ে যায় স্বর্গদূতের মতো।
কিছুদিনের মধ্যে আমিও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে তার আগ্রহের মাত্রাটি দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে, কবি বোধ হয় আমার দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন নিজেরই অজান্তে।
ক’মাসের পরিচয় মাত্র। বাংলা একাডেমির বাইরে কবির অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই জানি না যে আমি!! কিবা বয়স, কোথায় তার বাড়ি-ঘর, সংসার আছে কি নেই, কোনো কিছুই জানা নেই আমার। তার বয়সটাও অনুমানে বুঝতে পারি না। তাছাড়া কবিদের বয়স কি কোনো কালেই বোঝা গেছে?
পূর্বরাগের রাধাই বোঝেনি কিছু তার আকুল মন আর ব্যাকুল প্রাণ লয়ে।
আমি কোন্ ছাড়!!!
শুধু জানি যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের সমকালীন সময়ের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি, একজন খ্যাতিমান কবি হিসেবে, অস্ত্র হাতে মহান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক। যার হাত বাহিত হয়ে কারু প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলে ‘কবি’ বলে তার নামটি লিপিবদ্ধ হয়ে যায় হাজার বছরের বাংলা কাব্যের খেরো খাতায়; উপরন্তু উতল করা আড্ডা তার প্রিয় প্যাশন। এই মানুষটিকে এড়িয়ে চলা তরুণ কবিদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, বরং তিনি ছিলেন তখন অনেকেরই আইডল।
কবি হিসেবে যে মানুষটি তাকেই যেন ভালোবাসতে শুরু করেছি ক্রমান্বয়ে। আমিও যেন ঝুঁকে পড়ছি এক রহস্যময় তরঙ্গ অভিমুখে, অলৌকিক অনুপ্রেরণায়, তার কবিতাও সম্মোহন মন্ত্রের মতো আমাকে টেনে নিয়ে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলে দেয় তার চরণতলে। যেখানে যাই, সেখানেই শুনি কবির জয়গান এবং তার কবিতার উন্মুখ আলোচনা-সমালোচনা। আমার চারপাশের বাতাসে যেন কবির শ্বাস-প্রশ্বাসের উষ্ণ সুবাস ভেসে বেড়ায় গোপন হিল্লোলে। প্রাণ-মন সদাই ছুটে যেতে চায় সেইখানে। বুড়ো চণ্ডিদাসের রাধার মতো,
সদাই ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
আড্ডার পরে, যথারীতি অফিসও ছুটি হয়ে যায়। মনে হয়,
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাইনে’। এরকম আড্ডা শেষের একদিনে পড়ন্ত বেলায় একাডেমির বটতলায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, চলো তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো আজ।
কোথায়?
জিজ্ঞেস করতেই বললেন, খারাপ কোনো জায়গা নয়, সাকুরা, রেস্তোরাঁ সাইটে বসবো তোমাকে নিয়ে।
নির্জনে বসে কথা বলার জন্য জায়গাটি বেশ ভালো। ভয় নেই।
আধুনিক কবি হতে হলে এতো ভয় পেলে কী চলবে?
ভাবলাম, তাই তো!
তাছাড়া এভাবে চন্দন বৃক্ষের মতো এক কবির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম সেদিনই প্রথম। ভেতরটা একটু কেঁপেও উঠেছিল। পায়ের নিচে বাংলা একাডেমির সবুজ দীঘল দুর্বাঘাস, মাথার পরে ছায়াময় অশরীরী প্রাচীনেরা। পাতার ফাঁক গলিয়ে ডুবন্ত সূর্যের সোনালি উঁকিঝুঁকি। অপরাহ্নের গোধূলি আলোয় তাঁকে মনে হলো ঝাঁকরা চুলের অসাধারণ এক পৌরষদীপ্ত দেব-মানব। বহুজনমের এক কাক্সিক্ষত প্রেমিক পুরুষ। যার শক্ত হাতে
কৃষ্ণের অদৃশ্য বাঁশি বাজে রাগে-অনুরাগে।
বাংলা একাডেমির শ্যামল প্রান্তর আমার কাছে তখন কদমতলার মথুরা-বৃন্দাবন।
তাহলে ইনি কি তিনি??
বারবার নিজের কাছেই নিজের জিজ্ঞাসা অধীর। যমুনার জলে মৃদুমন্দ ঢেউ তুলে জানান দেয় অন্তরের বার্তা যেন। হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো এক জ্যোতির্ময় অন্ধ-আলো, সেই আমাকে পথ দেখায়। পথ বলে দেয় পথের ঠিকানা; আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরি ভেতরের নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ এক আমির অদ্বৈত সত্তাকে। কানে কানে বলে দিল সে অন্তরের সেই গূঢ় কথাটি।

৩. সর্বদাই বুকে ব্যথা

কবিকে আমি ভালোবাসি।
কবিতাকে আমরা দু’জনই ভালোবাসি।
কাজেই কিছুতেই তিনি আমার জন্য ক্ষতিকর হবেন না। আমি অনায়াসে যেতে পারি তার সঙ্গে যে কোনো স্থানে। কাজেই তাকে ‘না’ বলা আর সম্ভব হলো না।
উপরন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন যেভাবে ছুটে যায় সকলে, আমার অবস্থাও তার চেয়ে কম কিছু নয়।
এই কবিকে ভালোবাসা কী ঠিক হচ্ছে আমার? তার সম্পর্কে তো প্রায় কিছুই জানি না। অথচ দিনে দিনে প্রেমের গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে একদিন তার কাছেই জানতে চাইলাম তার নিজের কথা। সেদিন কিছু না বলে পরের দিন আবার সেই সাকুরায় বসে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার হলে গিয়ে পড়ো। বলেই উঠে বাথরুমে চলে গেলেন। আমি বসে আছি একা, চিঠিখানা নেড়েচেড়ে দেখলাম বার দুয়েক। হাতের লেখা দেখলাম, মনে হলো বাহ্ চমৎকার। তার হাতের লেখাকেও যেন ভালোবেসে ফেললাম মুহূর্তেই। ফিরে এসে টেবিলে বসতে গিয়ে রফিক আজাদ হঠাৎই টুক করে আমার ঠোঁটে চুমু খেলেন। কমলালেবুর কোয়ার মতো
পরিপুষ্ট তার অধরোষ্ঠ আমার আরক্তিম ঠোঁটে, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি একেবারে হতবিহবল। এরকম ঘটনা ঘটতে পারে তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। পরবর্তী তিন দিন আমি সেই চুমুর শিহরণ অনুভব করেছি বিদ্যুৎ চমকের মতো। বাথরুমে যাই, যখনই কোথাও একা হই, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত চরম এক পুলক অনুভব করি, আর মনে মনে ভাবি একটা চুমুর এতো শক্তি, তিন দিন আমাকে প্রায় শয্যাগত করে ফেলেছিল সেই শিহরণ রহস্য।
তাহলে এর নামই কী তবে প্রেম বা ভালোবাসা?
সকল সভ্যতা, জন-মানব, জায়-জঙ্গল, নিন্দা-মন্দ, সমূহ কটূক্তি, সকল উজিয়ে নব আনন্দে যা বয়ে চলে স্বর্গ অভিমুখে, তাই-ই প্রেম।
তখনো আমি রোকেয়া হলে সহকারী সুপার হিসেবে পার্ট টাইম কাজ করি, বিনিময়ে থাকা ফ্রি। মেইন বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা কক্ষে থাকি। আমার রুম শেয়ার করি অঞ্জলি বণিক নামে ঢাবির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অপর এক ছাত্রীর সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার লেনাদেনা সিনিয়র জুনিয়র বন্ধুর মতো। আমার সব ব্যাপারেই তার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু কবির সঙ্গে আমার সম্পর্কে যে নতুন মোড় নিয়েছে, সে কথা আমি অঞ্জলিকে বলি না, প্রসঙ্গ তুললেই বড় বোনের মতো গম্ভীর হয়ে যাই।
কাজেই সেদিন হলে ফিরেই দেখি অঞ্জলি আমার জন্য রান্না করে অপেক্ষা করছে। খাওয়া, গল্প নানাভাবে আমাকে আটকে রাখলো অনেকক্ষণ, কিছুতেই একা হতে পারছি না। এদিকে পত্রখানি পাঠের জন্য মন আকুল হয়ে উঠেছে। হলের পুকুরপারে গিয়ে যে পড়বো তারও উপায় নেই সঙ্গে সঙ্গে সেও যাবে। কাজেই বাধ্য হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে মন খুলে পড়লাম জীবনের প্রথম চিঠিখানা। কবি আত্মার কুসুমের নরম পাপড়িগুলো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে সেখানে। চোখের জলের এক সরোবর সত্ত্বেও ভালোবাসার সৌরভে গৌরবে সেদিন ছোট্ট বাথরুমের জায়গাটি যেন অমল আকাশেরছোঁয়া পেল। কবি লিখেছেন এক জায়গায়-
দিলা আমার,
তোমাকে, একমাত্র তোমাকেই আমি ভালোবাসি- তোমাকে ছাড়া চলবে না আমার, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। আমি একটা ঝকঝকে শাদা দেয়াল নিয়ে ঘর করতে পারি কিন্তু বাঁচতে পারি না। বাঁচার জন্যে, প্রচণ্ডভাবে বাঁচার জন্যে, সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচার জন্যে তোমাকে প্রয়োজন। একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্যে তোমাকে প্রয়োজন। কবিতাই আমার কাছে জীবন, দৈনন্দিন ক্লেশকর আটপৌরে দুঃস্বপ্নে ভরা বাস্তবতাকে মেনে নিই মাত্র- আকর্ষিত হই না, আকাক্সক্ষা করি না। আকাক্সক্ষা আমার অমৃতের জন্যে- যে অমৃতের স্বাদ আমি তো এই প্রথম তোমার কাছেই পেয়েছি। সব জেনেশুনে যে তা দিতে পারে, তাকে ‘অসাধারণ’ বলল না তো কাকে বলল বলো? তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ। ভালোবেসে আমি তোমাকে ধুলোয় নামাতে পারি না। তুমি নিজে কবি এবং নিরপেক্ষ থেকেই বলছি তুমি খুব ভালো লেখো। নিজেকে অযথা ছোট করে দেখো না, দোহাই দিলা।
তোমার কষ্ট কি আমি বুঝি না। নিজে আমি কোনো কাজই করতে পারছি না- পদ্য লেখার ইচ্ছা পর্যন্ত হয় না-সর্বদাই বুকে ব্যথা-কী যে কষ্ট ভালো লাগে না কিছুই, সর্বদাই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে, শুনতে ইচ্ছে করে, স্পর্শ পেতে চাই, গোপনে অন্যদের চোখ এড়িয়ে তোমার ছবিতে যে কতোবার চুমু খাই, দেখি, কি বলবো আমার আর কিছুই ভালো লাগে না, তুমি ঠিকই বলেছো, ‘একজন মানুষের জন্য একজন মানুষই যথেষ্ট- পৃথিবীর অন্য সব লোক ঈশ্বরের ব্যর্থ সৃষ্টি। ভালোবাসার কাছে সবই তুচ্ছ’।
এ রকম পরিস্থিতি বিবেচনা করেই কি রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন,
‘কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ
সশরীরে কোন নর গেছে সেইখানে
মানস সরসী তীরে বিরহ শয়ানে……
এ রকম মানসিক অবস্থায় রফিক আজাদ প্রায় দিগভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান। কখনো যান টাঙ্গাইলে মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবার ছলে। কখনো বা তার রাত কাটে কমলাপুর রেল স্টেশনে। ঢাকার বন্ধুরা অসহযোগিতায় হাল ধরে আছেন। বাধ্য হয়ে দু’দিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে দিনাজপুরে প্রিয় বন্ধু অলোক মিত্রের কাছে চলে গেলেন। দুদিন থাকলেন সেখানে, কান্তজীর মন্দির, রামসাগর ছাড়াও বিভিন্ন স্পট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন অলোকদা। বন্ধুর দুঃসময়ে প্রকৃত বন্ধু যেভাবে দাঁড়ায় পাশে, সেভাবেই অলোক মিত্র দাঁড়িয়েছিলেন নিঃশব্দে। ফেরার সময় আমার কথা বলে দিনাজপুরের চিড়া, দই আর পাঁপর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কবির হাতে। কবি নিজেও খুব পছন্দ করতেন পাঁপরভাজা ড্রিংসের সঙ্গে। অলোকদা যখনই ঢাকায় এসেছেন- এসব প্রিয় খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কবির জন্যে বারবার।

৪. প্রতীক্ষা

শেষ দিকটায় দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য কেন হলেন, সে কথা কবিকে একান্তে জানিয়ে, শেষাবধি জন্মভূমির মাটি ছেড়ে ভারতে পরবাসী হলেন পরম দুঃখের পারাবার পাড়ি দিয়ে।
ঢাকায় ফিরে এসে সেসব স্মৃতিকাতরতা নিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ’৮১ তে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা- ‘প্রতীক্ষা’।
আমাকে চিঠিতে লিখলেন, ‘তুমি লিখেছো, তোমার কবিতা পড়েই তোমার হৃদয় আত্মস্থ করতে হয়, যা আগেই করেছি- এখনো তাই করতে হবে?’ না, সখি না, প্রশ্নই ওঠে না; এখন থেকে একমাত্র তোমাকে উদ্দেশ্য করেই সব পদ্য রচিত হবে। ছাপার অক্ষরে অন্যরা দেখবে তুমি দেখবে খসড়া থেকে শুরু করে ভরহধষ পড়ঢ়ু। আমার সাধারণ পাঠক/ পাঠিকার উদ্দেশে নয় হৃদয়ের নিভৃতে যার নিবাস তার জন্যে, শুধুই তার জন্যে লিখে যেতে চাই বাকী জীবন।
কবির এই অঙ্গীকার আজ আমার চলার পথের পাথেয়। আমারও বাকি জীবন তার ধ্যানে, অনুধ্যানে, কালজয়ী তার পঙক্তিমালার সাধনায় অবগাহন করেই সকল শেষ হবে একদিন। হ
১১/৩/২৪
ধানমন্ডি, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়