গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

কারবালা : মোস্তফা কামাল > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এক.
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে সফরে বের হলেন। তিনি সাহাবিদের নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন; আর মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে তাদের
অবহিত
করছিলেন।

তারা মহানবীর (সা.) কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। কখনো কখনো মাথা দুলিয়ে তার কথায় সায় দিচ্ছিলেন। হঠাৎ মহানবী (সা.) পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখাবয়ব বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বিড় বিড় করে কী যেন বললেন। মহানবীর সফরসঙ্গী সাহাবিরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ কী এমন ঘটল! মহানবীর (সা.) মুখাবয়ব মলিন হয়ে গেল কেন! দুশ্চিন্তার কারণ বটে! মহানবীর (সা.) দুই পাশে থাকা সাহাবিদের কেউ কেউ তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর একজন সাহাবি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে! আমরা কি এর কারণ জানতে পারি?
মহানবী (সা.) বললেন, আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তার দিকেই ফিরে যাব।
মহানবীর (সা.) এই কথার মর্মার্থ সাহাবিরা কেউ বুঝতে পারলেন না। তারা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাদের মনে প্রশ্ন, এ কথা তিনি কেন বলছেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণ ছাড়া তিনি কোনো কথা বলেন না! কিছুক্ষণ পর তারা লক্ষ্য করলেন, মহানবীর (সা.) দুই চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে তারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। এ পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় কী তা তারা বুঝতে পারছিলেন না। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তারা আল্লাহর রাসুলের কাছে জানতে চাইলেন, হে প্রাণপ্রিয় নবী! আমরা আপনার কথার গূঢ় রহস্য উদঘাটনে অক্ষম। দয়া করে আমাদেরকে খুলে বলুন।
মহানবী (সা.) ধরা গলায় বললেন, এইমাত্র জিবরাইল (আ.) আমাকে জানালেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় দুই নাতি হাসান ও হোসেন ষড়যন্ত্রের শিকার হবে। তাদেরকে মেরে ফেলা হবে। একজনকে বিষ প্রয়োগে আর অপরজনকে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে হত্যা করা হবে।
সাহাবিদের একজন জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কি জানতে পারি, এতোবড় বিশ্বাসঘাতক কে? কে বা কারা তাদেরকে হত্যা করবে?
মহানবী (সা.) চুপ করে রইলেন। তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুললেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ।
সাহাবিদের চোখ কপালে ওঠার দশা! তাদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়! তারা এসব কী শুনছেন মহানবীর মুখে! তারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছেন আর ভাবছেন, মহানবীর (সা.) কথা অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই! আবার বিশ্বাস করার মতো বাস্তব কোনো ভিত্তিও নেই। কারণ মুয়াবিয়া বিয়েই করেননি। তার পুত্র সন্তান আসবে কোত্থেকে? মহানবী যা বললেন তাতে কোনো ভুল নেই, অসত্য নেই। তারপরও তাদের মনে নানা প্রশ্ন। তারা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত।
একজন সাহাবি বিস্ময় আর ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, হে প্রাণপ্রিয় নবী! আপনি সবকিছু জেনেশুনেই বলছেন এবং আমরা আপনার কথা শতভাগ বিশ্বাস করি। কিন্তু মুয়াবিয়া তো এখনো বিয়েই করেননি! তার পুত্র সন্তান আসবে কোত্থেকে! আমরা তো মুয়াবিয়ার বড়ভাইর কথা জানি। তার নাম ইয়াজিদ।
মহানবী (সা.) বললেন, তোমরা ঠিকই জানো। মুয়াবিয়া বিয়ে করবে এবং তার ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেবে। সেই সন্তানের নামও ইয়াজিদ রাখা হবে। সে-ই হবে আমার দুই নাতির হন্তারক!
সাহাবিরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রিয়নবীর কষ্ট দেখে তারাও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। কেউ কেউ চোখের পানি মুছছেন। আবার কেউ মনে মনে মুয়াবিয়াকে বকা দিচ্ছেন! তারা বলছেন, ছি! মুয়াবিয়াকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এতো পছন্দ করেন! এতো বিশ্বাস করেন! আর তার পুত্রই কি না এমন বেঈমানী করবে! না না! এটা মানা যায় না! আমরা বিষয়টা মুয়াবিয়াকে বলব। মহানবীর উত্তরাধিকারদের প্রতি এতোটা নির্দয় সে হবে কী করে!
মহানবীর (সা.) মনে পড়ছে হাসানের সেই জন্মের সময়ের কথা। ৩য় হিজরি সনের ১৫ রমজান (৪ মার্চ, ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) তার জন্ম হয়। মহানবীর (সা.) কাছে এই সুখবর দেওয়া হলে তিনি তখনই প্রিয় নাতিকে দেখার জন্য ছুটে যান ফাতিমার বাড়িতে। তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.) বললেন, কই মা ফাতিমা! আমার নাতি কই? তার মুখটা একটু দেখি!
ফাতিমা মহানবীর (সা.) কণ্ঠস্বর শুনেই এগিয়ে গেলেন সামনের ঘরে। কোলের শিশুকে রাসুলুল্লাহর (সা.) দিকে এগিয়ে দিলেন।
মহানবী (সা.) নাতিকে কোলে নিয়ে প্রথমে তার মুখ দেখলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, বাহ! আমার নানাভাই তো খুব সুন্দর হয়েছে!
মহানবী (সা.) তাকে আদর করেন। তার কানে তিনি আজান ও ইকামত দেন। দুম্বা জবাই করে গবিরদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তার মাথার চুল কামানো হয় এবং সেই চুলের ওজনে রুপা দরিদ্র ও অভাবী মানুষকে দেন। পরে তিনি তার জামাতা হযরত আলীকে (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের কি নাম রেখেছ?
হযরত আলী বললেন, হরব।
মহানবী (সা.) বললেন, না। তোমার ছেলের নাম রাখো হাসান।
হযরত আলী ও ফাতিমা (রা.) মহানবীর (সা.) দেওয়া নামই চূড়ান্ত করলেন।
হাসানের জন্মের এক বছর পর জন্ম নেন দ্বিতীয় সন্তান।
মহানবী (সা.) যথারীতি তার জামাতা হযরত আলীর কাছে জানতে চাইলেন, আলী তোমার ছেলের নাম কি রেখেছ?
হযরত আলী বললেন, হরব।
মহানবী (সা.) বললেন, না। তোমার ছেলের নাম রাখো হোসেন।
মহানবীর (সা.) দুই নাতি তার কলিজার টুকরা। তার সবচেয়ে আদরের মেয়ে ফাতিমার (রা.) সন্তান। আদর করে তাদের উভয়ের মুখে, কপালে গলায় চুমু দেন। দুজনকে কাঁধে নিয়ে বলেন, হে প্রভু, হাসান ও হোসেনকে আমি ভালোবাসি। তুমিও ভালোবেসো। যে ব্যক্তি হাসান ও হোসেনকে ভালোবাসে প্রকৃতপক্ষে সে আমাকেই ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি হাসান ও হোসেনের সঙ্গে হিংসা করবে; এদের সঙ্গে শত্রæতা করবে; প্রকৃতপক্ষে সে আমার সঙ্গেই শত্রæতা করবে।
মহানবী (সা.) দুই নাতিকে এতোই ভালোবাসেন যে, তিনি অনেক সময়ই তাদের সঙ্গে খেলা করেন। দুজনকে পিঠে বসিয়ে ঘোড়ার মতো করে দুলে দুলে হাঁটেন। এতে তারা ভীষণ আনন্দ পায়। আবার অনেক সময়ই দুই নাতিকে কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যান। মসজিদে গেলে তাদেরকে কাছে ডেকে নেন।
মহানবী (সা.) তার দুই নাতি হাসান ও হোসেনকে বেহেশতে যুবকদের সর্দার হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ তার প্রাণপ্রিয় দুই নাতি সম্পর্কে মহান আল্লাহর দূত জিবরাইল (আ.) যে তথ্য দিয়ে গেলেন; তাতে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি তার সফর সংক্ষিপ্ত করে কাবাঘরে ফিরে এলেন। অস্থির ভঙ্গিতে তিনি কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। তারপর মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দেন। খুতবায় তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! আমি তোমার প্রেরিত রাসুল। আমি হাসান ও হোসেনকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু জিবরাইল (আ.) আমাকে জানালেন, তাদের উভয়কে হত্যা করা হবে। যদি তাই করা হয় তাহলে তুমি তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দিও।
মহানবীর (সা.) মুখে এসব কথা শুনে মুসল্লিরা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মুসল্লিদের কান্না সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। কিছুক্ষণের জন্য তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। আবার ফিরে এলেন। এ সময় একদল ফেরেশতা মসজিদে এসে হাজির হয়। তাদের আকৃতি ভিন্ন রকমের। তারা সাধারণ কোনো মানুষ নয়। তাদেরকে দেখে মহানবী চিনতে পারলেন। তারা মহানবীকে উদ্দেশ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি খুব কষ্ট পাচ্ছেন? আপনি মনে কষ্ট রাখবেন না। আপনার সন্তানকে আল্লাহর তরফ থেকে অধিক পরিমাণ সোয়াব দেওয়া হবে।
মহানবী (সা.) নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলেন না। তিনি চোখ বন্ধ করলেই তার চোখের সামনে হাসান ও হোসেনের চেহারা মোবারক ভেসে ওঠে। ভীষণ কষ্ট অনুভব করেন তিনি।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদায়বিয়ার যুদ্ধবিরতি আলোচনার সময় মুয়াবিয়া এবং তার বাবা আবু সুফিয়ান মহানবীর সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হন। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবী মুয়াবিয়ার বিধবা বোন উম্মে হাবিবার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান এবং তার দুই ছেলে ইয়াজিদ ও মুয়াবিয়া মহানবীর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন। এরপর থেকেই মুয়াবিয়া মহানবীর (সা.) সাহচর্যে থাকেন এবং রাসুলুল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এতোই প্রিয় যে তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ওহি লেখার দায়িত্বও দেন। যদিও মুয়াবিয়ার বাবা উমাইয়া বংশের নেতা আবু সুফিয়ান খুবই ইসলামবিদ্বেষী এবং ইসলামের ঘোর শত্রæ। তার মা হিন্দা। তিনিও ইসলামের বিপক্ষে। উহুদের যুদ্ধে মহানবীর (সা.) চাচা আমীর হামজা শহীদ হলে হিন্দা তার বুক চিড়ে কলিজা বের করে চিবিয়ে চরম পৈশাচিকতার পরিচয় দেন। তা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া মহানবীর (সা.) আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি মহানবীর ভীষণ অনুরক্ত এবং তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। তাকে কয়েকজন সাহাবি জানালেন, প্রিয় ভাই মুয়াবিয়া!
কয়েকজন সাহাবিকে একত্রে দেখে মুয়াবিয়ার সন্দেহ হলো। তিনি বিস্ময় আর সংশয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই তোমরা কি কিছু বলতে এসেছ?
একজন সাহাবি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ভাই তুমি কি করে বুঝলে?
তোমাদের চেহারা দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
তাহলে শোন। তোমাকে এমন একটা তথ্য দেব যা শুনলে তুমি চমকে উঠবে। অপর একজন সাহাবি বললেন।
কি এমন তথ্য যা শুনলে আমি চমকে উঠব!
রাসুলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে আমরা সফরে বের হয়েছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তার কাছে জিবরাইল (আ.) বার্তা দিলেন যে, তার দুই নাতিকে হত্যা করা হবে। আর সেই হত্যাকারী হবে তোমার ছেলে!
মুয়াবিয়া বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, এসব তুমি কি বলো! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! আমি নিশ্চিত, তোমাদের কারো মাথা ঠিক নেই। নাকি আমাকে পরীক্ষা করছ! তাছাড়া আমি তো বিয়েই করিনি। আমার পুত্র সন্তান কোথা থেকে আসবে!
তুমি বিয়ে করবে। তারপর তোমার ঘরে পুত্র সন্তান জন্ম নেবে।
মুয়াবিয়া আবারও বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, সর্বনাশ!
মুয়াবিয়া আর দাঁড়ালেন না। তিনি মহানবীর (সা.) কাছে ছুটে গেলেন। সাহাবিরা তাকে অনুসরণ করলেন। মুয়াবিয়া মহানবীর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি বলুন, সাহাবিরা এসব কি বলছে! সাহাবিদের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমি জীবনে কোনো দিন বিয়েই করব না। এ আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।
মহানবী (সা.) তাকে বাধা দিয়ে বললেন, মুয়াবিয়া এমন প্রতিজ্ঞা করো না; যা তুমি রাখতে পারবে না। শোন, আল্লাহর হুমুক ছাড়া কিছুই হয় না। তিনি কাকে দিয়ে কী করাবেন তা তিনিই ভালো জানেন। অন্য কারো তা জানা বা বোঝার সাধ্য নাই।
মুয়াবিয়া বললেন, হে প্রাণপ্রিয় নবী, আপনার উত্তরাধিকারদের ওপর নিষ্ঠুরতা হবে- এটা আমি কিছুতেই মানতে পারব না। তার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।
মহানবী (সা.) মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ করে বললেন, আল্লাহর হুকুম রদ করার সাধ্য কারো নাই! তুমি এমন প্রতিজ্ঞা করো না, যাতে আল্লাহ নারাজ হন।
মুয়াবিয়া রাসুলুল্লাহর (সা.) দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারেন না। তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। তিনি চোখে কেবল অন্ধকার দেখছেন।

দুই.
মক্কা শরিফ থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতরে অবস্থিত একটি পাহাড়। পাহাড়টির নাম জাবালে নূর। পাহাড়ের চূড়ায় একটি গুহা রয়েছে। এটি হেরা গুহা নামে পরিচিত। পাহাড় এবং আশপাশের এলাকা জনমানবহীন; গভীর নির্জন পরিবেশ। রাত-বিরাতে তো দূরের কথা; দিনে-দুপুরেও সেখানে যাওয়ার সাহস কোনো মানুষ করে না। কিন্তু একজন মানুষ প্রায় ওই পাহাড়ে যান। কেন যান, সেখানে গিয়ে কী করেন সেই প্রশ্ন মক্কার কোনো কোনো মানুষের মনে। কিন্তু তারা এর কোনো উত্তর খুঁজে পান না। তাদের কাছে বিষয়টি রহস্যের মতো। এ বিষয়ে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেন না।
তখন রমজান মাস। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন। ধ্যান করার সময় কখন রাত হয়; আবার রাত পেরিয়ে কখন দিনের আলো ফোটে সেদিকে তার কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। ইবাদত বন্দেগীর মধ্য দিয়েই তার দীর্ঘ সময় কেটে যায়। তার শরীর-মন সবকিছুই এক আল্লাহর কাছে সমর্পিত। দুনিয়ার কোনো ভাবনা তাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। তার সঙ্গে পুরো পাহাড়ও যেন সৃষ্টিকর্তার কৃপাপ্রত্যাশী।
মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট তারিখে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি নবুয়াত লাভ করেন। নবুয়াত লাভের আগে তিনি প্রতি বছর হেরা গুহায় যেতেন এবং পর্বতের গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। প্রায় এক মাসের মতো তিনি সেখানে অবস্থান করতেন এবং ইবাদত বন্দেগী করতেন। তিনি সঙ্গে খাবার-দাবার নিয়ে যেতেন। খাবার ফুরিয়ে গেলে কিছু সময়ের জন্য বাড়িতে ফিরে আসতেন। আবার খাবার নিয়ে গুহায় চলে যেতেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তিনি ইবাদত বন্দেগী করতেন। তারপর বাড়ি ফিরে আসতেন। তবে বাড়িতে ফেরার আগে তিনি কাবাঘরে যেতেন। সাতবার কিংবা যতবার আল্লাহ চাইতেন ততবার কাবাঘর প্রদক্ষিণ করতেন।
হঠাৎ এক গভীর রাতে ধ্যানমগ্ন মুহাম্মদ (সা.) আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠলেন। সেই আলো পুরো পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আল্লাহর দূত জিবরাইল (আ.) ধ্যানমগ্ন মুহাম্মদের (সা.) কাছে এলেন একটি রেশমি কাপড়ের আচ্ছাদন নিয়ে। সেই আচ্ছাদনে কী যেন লেখা ছিল। তা ঠিক বুঝতে পারেননি তিনি।
জিবরাইল (আ.) তার সামনে খুব কাছাকাছি বসলেন। দুজনের মাঝখানে একটি রেশমি কাপড়ের আচ্ছাদন। তিনি বিলম্ব না করে মুহাম্মদকে (সা.) উদ্দেশ করে বললেন, পড়–ন।
মুহাম্মদ (সা.) বললেন, কি পড়ব?
জিবরাইল সেই রেশমি কাপড়ের আচ্ছাদন দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলেন, তার কাছে মনে হলো, এই বুঝি তার মৃত্যু হলো! তারপর ছেড়ে দিয়ে জিবরাইল আবার বললেন, পড়–ন।
মুহাম্মদ (সা.) বললেন, কি পড়ব?
জিবরাইল আবার তাকে সেই কাপড়ের আচ্ছাদন দিয়ে জোরে চেপে ধরলেন। তখনো তিনি মনে মনে বললেন, এই বুঝি আমার মৃত্যু হলো!
জিবরাইল ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, পড়–ন।
তৃতীয়বারের মতো তিনি আবার সেই রেশমি কাপড় দিয়ে চেপে ধরলেন। আবার ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়–ন।
মুহাম্মদ (সা.) বললেন, আমি তাহলে কি পড়ব?
এবার জিবরাইল বললেন, পড়–ন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন;
যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন রক্তপিণ্ড থেকে।
পড়–ন, আপনার প্রতিপালক মহামহিম
যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন
মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না।
মুহাম্মদ (সা.) পড়লেন। পড়া শেষ করার পর জিবরাইল চলে গেলেন। মহান আল্লাহর কথাগুলো মুহাম্মদের হৃদয়ে যেন গেঁথে গেল। তিনি অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তার অন্তর্জগত আলোয় আলোকিত হলো। মহান আল্লাহর বাণী তিনি হৃদয়ে ধারণ করছেন! তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত এটি। সারাজীবনের সাধনার ফল। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই মুহূর্তটি তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
মুহাম্মদ (সা.) মনে মনে ভাবেন, তিনি কী স্বপ্ন দেখলেন! নাকি তিনি কোনো ঘোরের মধ্যে আছেন! সত্যিই কী জিবরাইল আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছেন! তার ভেতরে আনন্দের ধারা বইছে। মনটা খুশিতে বারবার নেচে উঠছে। আবার ভয়, সংশয়ও কাজ করছে। এ কী সত্যিই আল্লাহর দূত জিবরাইল!
মুহাম্মদ (সা.) উঠে দাঁড়ালেন। মাথাটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে। তাকে এবার বাড়ি যেতে হবে। তিনি একপা দুইপা করে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের মাঝখান পর্যন্ত আসার পর আসমানের দিক থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। হে মুহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রাসুল! আমি জিবরাইল বলছি!
মুহাম্মদ (সা.) মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। কী বিস্ময়কর ঘটনা! মানুষের বেশে জিবরাইল! তার দুই পা দুইদিকে। তিনি আবারও তাকে উদ্দেশ করে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসুল আর আমি জিবরাইল!
মুহাম্মদের (সা.) চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। তিনি স্থির দৃষ্টিতে জিবরাইলের (আ.) দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মুহাম্মদ (সা.) পাহাড় থেকে ফিরে এসে প্রথমে কাবাঘরে গেলেন। বের হয়ে সাতবার কাবাঘর প্রদক্ষিণ করলেন। মহান আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন। তারপর বাড়িতে ফিরে তিনি তার স্ত্রী খাদিজার কাছে গিয়ে বসলেন। তাকে দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে খাদিজা বললেন, আপনি এসেছেন? আল্লাহর কসম; আপনাকে খোঁজার জন্য আমি লোক পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আপনাকে কোথাও খুঁজে পায়নি।
মুহাম্মদ (সা.) খাদিজাকে (রা.) পুরো ঘটনা খুলে বললেন। সব ঘটনা শুনে খাদিজা বিস্ময়ের সৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মহানবীর (সা.) দিকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তার চৈতন্য হলো। তিনি মহানবীকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি আনন্দ করুন, আপনার মন প্রফুল্ল করুন। আপনি এই জাতির জন্য আল্লাহর নবী হবেন।
তারপর খাদিজা কাপড়চোপড় পরে রওয়ানা হলেন তার চাচাতো ভাই ওয়াকারা ইবনে নওফেলের কাছে। ওয়াকারা খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাইবেল ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার কাছে গিয়ে মুহম্মদ (সা.) যা যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।
ওয়াকারা চিৎকার দিয়ে উঠলেন; মারহাবা! মারহাবা! খাদিজা আপনি যা বলেছেন তা যদি সত্যি হয় তাহলে তার কাছে জিবরাইল এসেছিলেন। এর আগে যেমন তিনি এসেছিলেন হযরত মুসার (আ.) কাছে। তার মানে তিনিই এই মানুষের নবী! তাকে প্রফুল্ল থাকতে বলবেন।
খাদিজা (রা.) ফিরে এলেন মহানবীর কাছে। ওয়ারাকা যা যা বললেন তা মহানবীকে জানালেন।
এতে মহানবীর (সা.) ভয় কিছুটা প্রশমিত হলো।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে এবং চূড়ান্ত নীতি নিয়ামক হিসেবে রমজান মাসে কোরআন নাজিল হলো। আমি একে অবতীর্ণ করেছি মহিমাময় রজনীতে। তুমি কি জানো, সেই মহিমাময় রজনী কি? মহিমাময় রজনী সহ¯্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রাতে প্রভুর অনুমতি নিয়ে ফেরেশতারা আসেন। প্রত্যুষ পর্যন্ত বিরাজিত থাকে সেই শান্তিময়তা।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ আরো বলেন, শপথ সুস্পষ্ট গ্রন্থের। নিশ্চয়ই আমি এই গ্রন্থ প্রেরণ করেছি এক শুভ রজনীতে। আমি এক সতর্ককারী। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই রজনীতেই। যদি তোমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো, বিশ্বাস করো যা আমি মীমাংসার দিন আমার দাসের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম যখন দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এই দুই দল হচ্ছে, মহানবী (সা.) এবং পৌত্তলিকেরা। মহানবীর সঙ্গে পৌত্তলিকদের মিলিত হওয়ার দিন ছিল ১৭ রমজান শুক্রবার।
মহানবী (সা.) আল্লাহ এবং তার প্রেরিত অহির প্রতি যখন সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন; তখন থেকেই পুরোদমে অহি আসা শুরু হলো। তিনি কায়মনবাক্যে তা গ্রহণ করা শুরু করলেন।
আল্লাহর বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েন মহানবী (সা.)। অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করতে হয়েছে তাকে। অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে তার অনেক অনুসারীকে। অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে সব বাধা-বিপত্তিকে তিনি তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। কোনো ধরনের বৈরিতা ও নির্যাতনে তিনি পিছপা হননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করে গেছেন।

তিন.
মুয়াবিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর থেকেই মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। মহানবী যখন যা বলেছেন তখন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। মোটকথা, তিনি নিজেকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করেন।
মুয়াবিয়া শুধু অহি লেখকই নন। মহানবীর (সা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষদের অভ্যর্থনা, থাকা খাওয়া ও তাদের তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন তিনি। এতে মহানবী (সা.) তার ওপর ভীষণ সন্তুষ্ট হন। তার বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দেখে তিনি তার জন্য দোয়া করেন। এতেই হয়তো তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন (১১ হিজরি, ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার) মহানবী (সা.) পরলোক গমন করেন। এরপর খিলাফতের দায়িত্ব পান হযরত আবু বকর (রা.)। তিনি মহানবীর প্রথম খলিফা। অপর তিন খলিফা হচ্ছেন, হযরত উমর (রা.), হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.)।
খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই হযরত আবু বকর (রা.) মুয়াবিয়ার বড় ভাই ইয়াজিদকে ডেকে পাঠান।
খলিফার বার্তা পেয়ে ইয়াজিদ বিলম্ব করলেন না। তিনি তার ছোটভাই মুয়াবিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আবু বকরের সামনে হাজির হলেন। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর আবু বকর বললেন, আমি একদল সৈন্যবাহিনী আপনাকে দিচ্ছি। আপনি আপনার ছোটভাই মুয়াবিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়াতে চলে যান। সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি জানি, আপনার পক্ষে এটা অসম্ভব ব্যাপার না। আপনি পারবেন।
ইয়াজিদ হযরত আবু বকরের কথায় সায় দিয়ে বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আমার বিশ্বাস, আপনার দেওয়া দায়িত্ব আমি অবশ্যই পারতে পারব। আমার ওপর আস্থা রাখার জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা।
আস্থা আছে বলেই তো আপনাকে পাঠাচ্ছি।
ইয়াজিদ সন্তুষ্ট চিত্তে তার ওপর ন্যস্ত করা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর হযরত আবু বকরের কাছ থেকে বিদায় নেন।
হযরত আবু বকরের দেওয়া সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইয়াজিদ ও মুয়াবিয়া সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ইয়াজিদ মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমার দায়িত্ব হচ্ছে সেনাবাহিনী সামলানো। আশা করি তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে।
মুয়াবিয়া সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব মাথা পেতে নেন। এ দায়িত্ব পালনে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। শুধু তাই নয়, সেখানে তিনি একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাতে তিনি সফল হন। ১৩ হিজরিতে তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধের অংশ নেন এবং বিজয় লাভ করেন।
হযরত আবু বকরের (রা.) মৃত্যুর পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। মুয়াবিয়া সম্পর্কে হযরত উমরের ধারণা অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি তাকে মহানবীর (সা.) কাছাকাছি থাকতে দেখেছেন। অহি লেখকের দায়িত্ব পালন করায় তিনিও মুয়াবিয়ার ওপর ভীষণ সন্তুষ্ট। তিনি মনে মনে বললেন, সবাই অহি লেখার দায়িত্ব পায় না। সেক্ষেত্রে মুয়াবিয়া অনেক ভাগ্যবান।
হযরত উমর মুয়াবিয়াকে ডেকে পাঠালেন। মুয়াবিয়া তার সামনে হাজির হলে তাকে আবারো ভালো করে দেখলেন। মুয়াবিয়ার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মতৎপরতার প্রশংসা করে উমর (রা.) বললেন, আপনাকে আমি জর্ডানের গভর্নর নিয়োগ করতে চাই। আপনার কী মত?
খলিফা উমরের কথা শুনে মুয়ামিয়ার হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেল। তিনি এতো দ্রুত এতোবড় পদ পাবেন তা আশা করেননি। তবে তার উচ্চাকাক্সক্ষা নেই তা নয়। তিনি সেটা ভেতরে ভেতরে পোষণ করতেন। কারো কাছে প্রকাশ করতেন না। একদিন তাকে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মুয়াবিয়া তুমি সব সময় আল্লাহর পথে থেকো। আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করো।
মুয়াবিয়ার ভাবনা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই হযরত উমর বললেন, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
মুয়াবিয়া বিন¤্র স্বরে বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন! আপনার দেওয়া দায়িত্ব আমি যথাযথভাবে পালন করতে রাজি আছি।
হযরত উমর আর দেরি করলেন না। তাকে জর্ডানের গভর্নর পদে নিয়োগ দিলেন। দায়িত্ব পেয়ে মুয়াবিয়া সেখানে চলে যান। তিনি তার কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জর্ডান ও আশপাশের এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এতে হযরত উমর তার প্রতি ভীষণ সন্তুষ্ট হন।
আল্লাহর কী লীলাখেলা! হযরত উমর যখন মুয়াবিয়াকে আরো বেশি দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছিলেন; ঠিক সেই সময়ই তার বড় ভাই ইয়াজিদ মারা যান। তার মৃত্যুর পর দামেস্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান মুয়াবিয়া। দামেস্কের দায়িত্ব পেয়ে তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য রাতদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। সারাক্ষণ ভাবতে থাকেন, কীভাবে খলিফাকে সন্তুষ্ট করবেন। সুযোগও আসে তার সামনে। রোমান ও পারসিকরা দামেস্কের ওপর আগ্রাসনের পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনায় আঘাত হানেন মুয়াবিয়া। তার নেতৃত্বে রোমান ও পারসিকদের আগ্রাসনের ইচ্ছা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
হযরত উমর (রা.) প্রায় সাড়ে দশ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। তার কারণে অর্ধসভ্য আরব জাতি অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা পায়। তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে বিধর্মীরা ভীষণভাবে ঈর্ষা করে। অনেকে তাকে সহ্যই করতে পারে না।
এক রাতে হযরত উমর মসজিদে নববীতে এশার নামাজের ইমামতির জন্য দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ আবু লুলু নামে এক কাফের তার মাথা ও নাভিতে বিষাক্ত তরবারি দিয়ে আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। অচেতন অবস্থায় তিনি তিন দিন ছিলেন। তারপর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
হযরত উমর নিহত হওয়ার পর উসমান (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব পান। তিনিও দীর্ঘদিন খেলাফতের দায়িত্বে থেকে ইসলামের জন্য কাজ করেন। তার সময়কালে ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। তিনি উমরের মতোই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু তাকেও বিদ্রোহীরা বাঁচতে দেয়নি। মিসর, বসরা ও কুফার একদল বিদ্রোহী তার বাড়ি ঘেরাও করে। টানা চল্লিশ দিন ঘেরাও করে রাখার পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এ ঘটনার জন্য হযরত মুয়াবিয়া হযরত আলীকে (রা.) দায়ী করেন। এরপরই হযরত আলীর সঙ্গে হযরত মুয়াবিয়ার বিরোধ শুরু হয়। ধীরে ধীরে সেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে তা যুদ্ধে রূপ নেয় এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটে।

হযরত আলী যাতে খেলাফতের দায়িত্ব না পান সেজন্য হযরত মুয়াবিয়া নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তিনি হযরত উসমানের রক্তমাখা জামা দেখিয়ে উমাইয়া ও সিরিয়াবাসীকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। তার এক কথা, আগে হযরত উসমানের হত্যাকারীদের বিচার হোক, তারপর খেলাফতের দায়িত্ব কাকে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হবে।
আলী (রা.) সমর্থকরা হযরত মুয়াবিয়ার কাছে গিয়ে হাজির হন। তাকে উদ্দেশ করে তারা বললেন, উসমানকে যারা হত্যা করেছে তারা বিদ্রোহী। তাদের সঙ্গে হযরত আলীর কোনো যোগসাজশ নেই; কোনো রকম সম্পর্ক নেই। তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। আপনি শুধু শুধু তাকে দোষারোপ করছেন! না জেনে না শুনে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অন্যায়!
এ কথা শুনে গর্জে উঠলেন মুয়াবিয়া। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, না! মোটেই না। উনি নিশ্চয়ই জানেন।… তাহলে তদন্ত হোক! তদন্তে যা আসবে আমি তা মেনে নেব।
আলী (রা.) সমর্থকরা হযরত মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। দেখুন, হযরত আলী মহানবীর (সা.) ¯েœহছায়ায় বড় হয়েছেন। মহানবী (সা.) আলীকে পুত্রের মতো ভালোবাসেন। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। হযরত আলী মহানবীর চার খলিফার একজন। তিনি ইমাম হাসান, হোসেনের বাবা। আহলে বাইয়াতের একজন সদস্য। তিনিই একমাত্র খেলাফতের অধিকারী।
হযরত মুয়াবিয়া বললেন, সেখানে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমি চাই, আগে হত্যাকারীর বিচার হোক!
অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত হবে। বিচারও হবে। এই অজুহাতে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ বন্ধ থাকতে পারে না। হযরত আলীর সমর্থকরা বললেন।
মুয়াবিয়া আবার গর্জে উঠলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন, না! আমি মানি না! আমি কিছুতেই এটা হতে দেব না। এটা করা হলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে।
হযরত আলীর সমর্থকরা বললেন, আপনি চিৎকার করে কথা বললেই কি সব সিদ্ধান্ত পাল্টে যাবে? চিৎকার আমরাও করতে জানি। আমরা অযৌক্তিক কিছু বলছি না। অন্যায় কিছু হোক তাও চাই না। বুঝতে পারছেন?
হযরত আলীর সমর্থকরা আর দাঁড়ালেন না। তারা হযরত আলীর কাছে ছুটে যান এবং হযরত মুয়াবিয়ার আপত্তির কথা সবিস্তারে তাকে অবহিত করেন। তারা মুয়াবিয়ার কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, মুয়াবিয়া কিছুতেই চান না, আপনি খেলাফতের দায়িত্ব নিন। তিনি বলেছেন, আপনি খেলাফতের দায়িত¦ নিলে তিনি তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবেন।
সমর্থকদের কথা শুনে হযরত আলী বললেন, একজন ব্যক্তি বিশেষের আপত্তির কারণে খেলাফতের নিয়মনীতি অমান্য করা যায় না। মহানবী (সা.) নিজেই এ ব্যাপারে ফয়সালা করে গেছেন। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পর থেকে খেলাফতের দায়িত্ব বণ্টনে যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে তা বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায়।
হযরত মুয়াবিয়ার বাড়াবাড়ির কারণে হযরত আলীর সঙ্গে সিফফিনের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ যখন খুব খারাপের দিকে যাচ্ছিল, তখন দুপক্ষ আলোচনায় বসল। আলোচনায় যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে একটি চুক্তি সই হয়। এরপর যুদ্ধ থেমে যায়।
শেষ পর্যন্ত হযরত আলীই খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ৬৫৬ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফা হিসেবে মুসলিম বিশ্ব পরিচালনা করেন। কিন্তু শত্রæরা তাকেও বেশিদিন বাঁচতে দেয়নি। হযরত উমর ও হযরত উসমানের মতো হযরত আলীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইবনে মুসলিম নামে এক ব্যক্তি কুফার শাহী মসজিদে নামাজরত অবস্থায় বিষমাখা তলোয়ার দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। আঘাতের দুই দিন পর তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীকে হত্যার নেপথ্যে কে ভূমিকা রেখেছিল, তা রহস্যঘেরা। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মুয়াবিয়ার হাত ছিল বলে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন।
অবশ্য হযরত আলীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে হযরত মুয়াবিয়া কান্নাকাটি করেন। তাকে কাঁদতে দেখে তার স্ত্রী মায়সুন বিস্মিত হন। তিনি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, কি ব্যাপার! আপনি কাঁদছেন কেন?
হযরত মুয়াবিয়া বললেন, একটা দুঃখজনক সংবাদ শুনলাম।
দুঃখজনক সংবাদ! সেটা কি? মায়সুন জানতে চাইলেন।
মুয়াবিয়া বললেন, হযরত আলী মারা গেছেন।
মায়সুন আবারও বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আপনি তার জন্য কাঁদছেন! আপনিই তো তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন!
মুয়াবিয়া বললেন, সেটা ভিন্ন কথা। তিনি একজন বিদ্বান ও সৎগুণের অধিকারী ছিলেন। যে কোনো সমস্যায় তার পরামর্শ চাইলে তিনি সঠিক পরামর্শ দিতেন। তার মৃত্যুতে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হলো।

চার.
হযরত আলীর (রা.) শাহাদাত বরণের পর হযরত মুয়াবিয়া নিজেই নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে বসলেন। তার অবস্থা এমন যে, তিনি এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। আসলে তিনি হযরত আলীকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে বললেন, হযরত আলীর মৃত্যুর পর আমিই একমাত্র খেলাফতের দাবিদার! দ্বিতীয় কেউ নয়।
হযরত মুয়াবিয়া নিজেকে খলিফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মক্কা-মদিনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমানরা আওয়াজ তোলেন, মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে মানি না; মানব না! আমাদের খলিফা ইমাম হাসান। মক্কা-মদিনাবাসীর খলিফা ইমাম হাসান।
বাদ-প্রতিবাদ চলল কিছুদিন। হযরত মুয়াবিয়াও নানা কূটকৌশল করতে শুরু করলেন। এতে মুসলমানরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তারা কেউই মুয়াবিয়ার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তারা দলে দলে ইমাম হাসানের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতে শুরু করলেন। তারা তাকে খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানালেন।
ইমাম হাসান পিতার অকাল মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এক সময় তিনি ছিলেন পিতার সর্বক্ষণের সঙ্গী। পিতার সমস্ত আদর্শ, ন্যায়পরায়নতা ও সততার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সেই আদর্শ তিনি মেনে চলার শপথ নিয়েছেন। পিতাকে সহযোগিতা করেছেন। পিতার নীতিবাক্যকে বুকে ধারণ করেন। সেই পিতা আজ পরলোকগত। তিনি কি জানতেন, এত দ্রুত তাকে চলে যেতে হবে!
হযরত আলী কি সেই জন্যই প্রিয় পুত্রকে ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন! মহান আল্লাহর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, কোনো মানুষ যাতে তার দ্বারা কষ্ট না পায়। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে হাসান-হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, হাসান ও আমার সব সন্তান এবং আমার পরিবার, আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি- তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ় হস্তে ধারণ করো। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আমি তোমাদের কড়জোরে বলছি, আল্লাহর কসম, এতিমদের প্রতি সদয় হও। তারা যখন তোমাদের সঙ্গে থাকে তখন তাদের চুপ করিয়ে দিও না বা অবজ্ঞা করো না। আমি তোমাদের করজোড়ে বলছি, আল্লাহর কসম, তোমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে অসদাচরণ করো না। কেননা, নবী করিম (সা.) তাগিদ দিতেন এবং এত বেশি দেবেন যেন তাদের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।
আমি তোমাদের করজোড়ে বলছি, আল্লাহর কসম, তোমরা পবিত্র কুরআনের প্রতি যতœশীল হও। কুরআন চর্চায় নিজেদের অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখো। তোমরা নামাজ কায়েম করো। তোমরা মসজিদমুখী হও এবং যতদিন বেঁচে থাকো কখনো মসজিদকে পরিত্যাগ করো না। তোমরা যতদিন বেঁচে থাকো তোমাদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করো। তোমরা জাকাত দাও এবং দাস-দাসীর প্রতি খেয়াল রাখো।
পিতার সেই কথাগুলো বারবার হাসানের মনে পড়ছে। পিতার অপঘাতে মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তারপরও তিনি মনে মনে বলেন, এটাই হয়তো আল্লাহ চেয়েছেন। তা না হলে এমন ঘটনা কেন ঘটবে?
অনেক ভাবনাচিন্তার পর ইমাম হাসান তার সমর্থকদের উদ্দেশে বললেন, আমি এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিতে চাই না। হযরত মুয়াবিয়া যে কাণ্ড করলেন, তারপর খলিফার দায়িত্ব নেয়া আমার ঠিক হবে না। তিনি আমাকে শান্তিতে দায়িত্ব পালন করতে দেবেন না। অশান্তি সৃষ্টি করবেন।
হাসান সমর্থকরা বললেন, আমরা আপনার আপত্তি শুনব না। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি ছাড়া অন্য কাউকে এই দায়িত্বে দেখতে চাই না।
ইমাম হাসান তার সমর্থকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। দেখুন, আমরা আব্বাজানের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার আগেই মুয়াবিয়া নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে বসলেন! এর অর্থ কি? তিনি তো আব্বাজানকে মেনেই নিতে পারেননি! আপনারা এও জানেন, হযরত উসমানের মৃত্যুর জন্য তিনি আব্বাজানকে দায়ী করেন এবং এ নিয়ে তার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। আব্বাজানের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। আমার খলিফা হওয়ার বিষয়টি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। এ নিয়ে তিনি অশান্তি করবেন।
হাসানের ভক্ত-অনুসারীরা বললেন, সেটা আমরা জানি। সেজন্যই তো আমরা তার কাছে বাইয়াত নিতে রাজি হইনি। উনি ক্ষমতালোভী, সুযোগসন্ধানী। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ পেয়েই দামেস্ক থেকে ছুটে এসেছেন মদিনায়। তিনি মক্কা-মদিনা শাসন করতে চান। সেই সুযোগ আমরা তাকে দেব না!
আপনারা দেবেন না! উনি কৌশল করে ক্ষমতা করায়ত্ত করবেন। আমি আগাম কথাটা বলে রাখলাম। ভবিষ্যতে আপনারা নিশ্চয়ই টের পাবেন।
সমর্থকরা তারপরও ইমাম হাসানকে ছাড়লেন না। তারা তাকে খেলাফত নেওয়ার জন্য চেপে ধরলেন।
মক্কা-মদিনার মুসলমানদের ব্যাপক চাপের মুখে ইমাম হাসান খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। তিনি শান্তিপূর্ণ মানুষ। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। কিন্তু তাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না মুয়াবিয়া। তিনি জানেন, ইমাম হাসান সফল হলে মুয়াবিয়া কোনোদিনই মক্কা-মদিনায় ঢুকতে পারবেন না। মুয়াবিয়া ইমাম হাসানকে ব্যর্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। তিনি নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এক পর্যায়ে তিনি সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। এছাড়া ইমাম হাসানের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিজের পক্ষে টানার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ প্রদান করেন।
হযরত মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্র প্রকাশ্য রূপ নিলে ইমাম হাসান তাকে ডেকে পাঠান। তার ডাকে সাড়া দেন মুয়াবিয়া। তিনি যথারীতি ইমাম হাসানের সামনে হাজির হন। তখন হযরত মুয়াবিয়ার কাছে ইমাম হাসান জানতে চান, আপনি কি কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন? আব্বাজানের সঙ্গেও আপনি শত্রæতা করেছিলেন। আপনার কারণে তিনি মোটেই স্বস্তিতে ছিলেন না। সব সময় আপনি তাকে অস্থির করে রেখেছেন। একই ধরনের শত্রæতা আমার সঙ্গেও করছেন। আপনি আসলে কি চান?
হযরত মুয়াবিয়া কোনো বনিতা না করে বললেন, আমার একটাই দাবি, আমি খলিফা হতে চাই। আপনি ওই পদ ছেড়ে দিন। এতে আপনার আমার তথা আমাদের সকলের মঙ্গল।
ইমাম হাসান বললেন, আমি তো নিজের ইচ্ছায় খলিফা হইনি। মক্কা ও মদিনাবাসী আমাকে খলিফা নির্বাচন করেছেন। তারা চাইলে অবশ্যই আমি খলিফার পদ ছেড়ে দেব।
তারা চান বা না চান; আপনাকে ওই পদ ছাড়তে হবে। আমি চাই না আপনি ওই পদে থাকুন।
কেন চান না?
বললাম তো, আমি খলিফা হতে চাই। আরেকটা কথা তো সত্যি; আপনি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আপনাকে এসব রাজনৈতিক পদে মানায় না। আপনি নিশ্চয়ই মক্কা-মদিনার শান্তি চান!
অবশ্যই চাই।
আপনি যতই চেষ্টা করুন, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না।
আপনি সহযোগিতা করেন। আপনি সহযোগিতা করলে নিশ্চয়ই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারব। ইমাম হাসান বললেন।
মুয়াবিয়া বললেন, আমি সহযোগিতা করতে পারি এক শর্তে!
কি সেই শর্ত? ইমাম হাসান জানতে চাইলেন।
হযরত মুয়াবিয়া বললেন, আপনাকে খেলাফতের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। বিনিময়ে আপনাদের দুই ভাইকে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ভাতা দেওয়া হবে। আমার মৃত্যুর পর আপনি খেলাফতের দায়িত্ব পাবেন।
মুখের কথায় বিশ্বাস কি? ইমাম হাসান বললেন।
হযরত মুয়াবিয়া সঙ্গে সঙ্গে চুক্তির প্রস্তাব দিলেন। ইমাম হাসান মক্কা-মদিনার শাস্তির কথা বিবেচনা করে চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হন। চুক্তিতে যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয় তা এখানে তুলে ধরা হলো।
১. হযরত মুয়াবিয়া খেলাফত, কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক খোলাফায়ে রাশেদীনের মতো শাসনকার্য পরিচালনা করবেন।
২. মুয়াবিয়ার পর ইমাম হাসান খলিফা হবেন।
৩. মুয়াবিয়া কোনো উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে পারবেন না।
৪. মুসলিম জনগণকে কোনো প্রকার কষ্ট দিতে পারবেন না। হযরত আলীর বংশধর কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারবেন না। তাদের সঙ্গে সব সময় সদ্ভাব বজায় রেখে চলবেন।
৫. হযরত হাসানের যাবতীয় ঋণ মুয়াবিয়া পরিশোধ করে দেবেন। হাদিয়া ও তোহফার ওপর আওলাদে রাসুল ও হাশেমী বংশের প্রাধান্য থাকবে। আহরান এলাকার সমুদয় রাজস্ব ইমাম হাসান পাবেন এবং ইমাম হোসেনকে পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য বাৎসরিক দুই লাখ দিরহাম ভাতা দিতে হবে।
৬. সন্ধিপত্রে উল্লেখিত শর্ত মুয়াবিয়া অমান্য করলে জনসাধারণ ভোটের মাধ্যমে তাদের খলিফা নির্বাচন করতে পারবেন।
হযরত মুয়াবিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইমাম হাসান খলিফার পদ ছেড়ে দিলেন। ৬৬১ সালের ২৮ জুলাই তারিখে মুয়াবিয়া উমাইয়া খিলাফতের প্রথম খলিফা হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। শুরু হলো মুয়াবিয়ার শাসন। মক্কা-মদিনা, ইরাক ও সিরিয়াজুড়ে মুয়াবিয়ার বিশাল সাম্রাজ্য।
খলিফার পদ ছেড়ে দেওয়ার পরপরই ইমাম হাসান কুফা ত্যাগ করলেন। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে মদিনায় বসবাস শুরু করলেন। এর এক মাস পর ইমাম হাসান খলিফা মুয়াবিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য দামেস্কে যান। তাকে দেখে খলিফা মুয়াবিয়া খুশি হয়ে বললেন, আপনাকে আমি এমন একটা উপহার দেব যা অতীতে কেউ দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না।
ইমাম হাসান বিস্ময়ের দৃষ্টিতে খলিফা মুয়াবিয়ার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর তিনি জানতে চাইলেন, কী সেই পুরস্কার?
খলিফা মুয়াবিয়া দেরি করলেন না। তিনি হাসানের হাতে বিপুল অংকের অর্থ তুলে দিয়ে বললেন, এটা আমার উপহার।
ইমাম হাসান খুশি হয়ে তা গ্রহণ করলেন। এরপর প্রতি মাসেই একবার তিনি খলিফা মুয়াবিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। হযরত মুয়াবিয়া তাকে পরিবার ও তার আওলাদদের ভরণপোষণের জন্য অর্থ দেন। একবার ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার দরবারে যাননি। তাই মুয়াবিয়াও হাসানের কাছে কোনো অর্থ পাঠাননি। এতে হাসানের পরিবারের ভরণপোষণের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে মুয়াবিয়ার কাছে চিঠি লিখবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে লেখার কিছু পেলেন না বলে লেখা হয়নি। হঠাৎ তার ঘুম চলে আসে। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের ঘোরে তিনি দেখেন, মহানবী (সা.) তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাকে বললেন, হাসান তুমি কি তোমার সৃষ্টিকর্তার পরিবর্তে তার এক সৃষ্টির কাছে তোমার প্রয়োজনের কথা বলছ?
হাসান বললেন, হে আল্লাহর রাসুল। আমার অনেক ঋণ আছে। আপনিই বলে দিন এক্ষেত্রে আমার কী করা উচিত?
মুহাম্মদ (সা.) হাসানকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি বলো, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন প্রত্যেকটি বিষয় কামনা করছি, যা আমি নিজ শক্তিবলে অর্জন করতে পারিনি; যা আমি অর্জনের আকাক্সক্ষা করিনি; যা আমার চিন্তাভাবনায় আসেনি; যার ব্যাপারে আমার কোনো আশা ছিল না এবং দৃঢ় ঈমানের কারণে যা আমার জবান দ্বারা উচ্চারিত হয়নি, যা আপনি আপনার প্রথম সৃষ্টি বা মুহাজির বা আনসারদের দিয়ে থাকেন। আমি আপনার কাছে তা-ই কামনা করছি। হে আমার দয়াময়, দয়া প্রদর্শন করুন।
রাসুলুল্লাহর (সা.) শেখানো কথাগুলো ইমাম হাসান মুখস্ত করে ফেললেন। তারপর তিনি মনে মনে তা বলতে লাগলেন। এর কিছুদিন পরই খলিফা মুয়াবিয়া তার লোক মারফত জানতে চাইলেন, হাসান তার মাসিক খরচের অর্থ পেয়েছেন কিনা?
হাসান বললেন, না। তিনি খলিফা মুয়াবিয়ার দরবারে যাননি।
হযরত মুয়াবিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দিলেন, হাসানকে যেন দুই মাসের খরচের টাকা একসঙ্গে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে রাজকোষ থেকে অর্থ পাঠানো হলো ইমাম হাসানের কাছে।
পরে আবার এক রাতে হাসান মহানবীকে (সা.) স্বপ্নে দেখলেন। মহানবী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নানাভাই হাসান কেমন আছো?
ইমাম হাসান বললেন, হে আল্লাহর রাসুল; আমি ভালো আছি।
ইমাম হাসান খলিফা মুয়াবিয়ার অর্থ পাঠানোর কথা মহানবীকে জানালেন। তখন মহানবী (সা.) তাকে বললেন, যে বান্দা তার আশা সৃষ্টির ওপর নয়; সৃষ্টিকর্তার ওপর রাখে, সেটাই হলো তার কর্মফল।
ইমাম হাসানের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি বিছানা থেকে উঠলেন। তারপর স্থির হয়ে কতক্ষণ বসে রইলেন। মহানবীর (সা.) কথাগুলো তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। তিনি কথাগুলো মুখে আওড়াতে আওড়াতে আবার গভীর ভাবনায় ডুবে যান।

পাঁচ.
হযরত মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। খলিফা হিসেবে মুয়াবিয়ার দাপটও বাড়তে থাকে। মুয়াবিয়া যখন খলিফার পদ লাভ করেন তখন ইয়াজিদ চৌদ্দ বছরের যুবক। দামেস্কের রাজপুত্রের চোখে নতুন স্বপ্ন। সে পিতার উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে খলিফার পদে কল্পনা করছে। পুত্রের অভিলাষের কথা পিতা হয়তো জানেন। কিংবা পিতাও মনে মনে পুত্রকে খলিফা হিসেবে চিন্তা করছেন। কিন্তু তার পথের কাঁটা ইমাম হাসান। ইয়াজিদকে খলিফা নির্বাচন করা মোটেই সহজ কাজ নয়। চুক্তির শর্তে বলা আছে। হযরত মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হাসান খলিফা হবেন।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী তা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যান হযরত মুয়াবিয়া। ভাবতে ভাবতে যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ানের কথা তার মনে পড়ে। ইবনে যিয়াদ প্রথম দিকে হযরত আলীর সমর্থক ছিলেন। পরে তিনি মুয়াবিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। হযরত মুয়াবিয়া তাকে নিজের সৎভাইয়ের স্বীকৃতি দিয়ে বসরার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন। ইবনে যিয়াদ অনেক বুদ্ধিমান ও দক্ষ শাসক। তাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবলেন হযরত মুয়াবিয়া। তিনি যিয়াদকে দামেস্কে ডেকে পাঠালেন।
গভর্নর যিয়াদ দেরি করলেন না। তিনি খবর পাওয়ার পরপরই হযরত মুয়াবিয়ার দরবারে হাজির হলেন। তাকে পেয়ে বুকে টেনে নিলেন মুয়াবিয়া। তারপর দুজন মুখোমুখি বসলেন। খলিফা মুয়াবিয়া তাকে উদ্দেশ করে বললেন, ভাই আমার!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়