গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

অচেনা বিস্ময় : মো. তানিম-উল-ইসলাম > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার বন্ধু খবির আলী বাদাম চিবুচ্ছিলো আর পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলো। যদিও ডাক্তার তাকে পত্রিকা পড়তে বারণ করেছে। বেশকিছুদিন ধরেই তার হৃদয় মহাশয় ঠিকঠাক কাজ করছে না। আমি খবিরের পাশে বসে বারান্দার গ্রিলে বসে থাকা কাক দেখছি। হঠাৎই খবির আমায় বলে : ‘দোস্ত নেক্সট ইয়ারেতো মনে হচ্ছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে নামতে হবে।’ খবির আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে অর্থনীতির অধ্যাপক। যেহেতু তার মনে হচ্ছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে নামতে হবে। তাহলে হয়তো তা হলেও হতে পারে। আমি তখনো কাক থেকে চোখ নামাইনি। তবে এখন একটা কাকের জায়গায় দুইটা এসেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! দ্বিতীয় কাকটা মুখে করে কী যেন নিয়ে এসেছে। আর সেটাই দেয়ার জন্য ঠোঁট বাড়িয়ে দিলো প্রথম কাকটার দিকে। এবং কাক তা নিলো, নিশ্চয়ই তার বেশ ক্ষুধা লেগেছে। পরম আগ্রহে সে তার খাওয়া খাচ্ছে দেখে ভালো লাগলো। হঠাৎই আমার মাথায় একটা চিন্তা ভর করে। অর্থনৈতিক চিন্তা! অর্থনীতির মানুষ যেহেতু পাশেই বসে আছে তাই তাকেই আমার মনের ভেতরে জেগে ওঠা কথাটা জানালাম।
‘দোস্ত তোর কী মনে হয় না… জাকাত সিস্টেমটা এখনি দেশে দেশে অ্যাপ্লাই করার মোক্ষম সময়। নয়তো কয়েক বছরের মধ্যে তোর কথা মতোই হাতে হারিকেন নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে।’
আমার দিকে খবির তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘হারিকেনের তেল কই পাবি হাসনাইন? তেলওতো হয়ে উঠছে অমূল্য! আচ্ছা যাই হোক হারিকেন নিয়ে নাম আর মোমবাতি নিয়েই নাম; ভিক্ষা যে করতে নামতে হবে সেটা একরকম নিশ্চিত। কিন্তু কথা হচ্ছে এখানে তুই জাকাতকে নিয়ে আসলি কেনো?’
কাক দুইটা উড়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু যার পেটে খিদে নেই সে তার অতিরিক্ত খাবারটুকুন দিয়ে দিলো তাকে, যার পেটে এখন রাজ্যের খিদে। তুচ্ছ কাক আমার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিলো জাকাতনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার কথা। আমি এটা খবিরকে বুঝিয়ে বলতেই, খবির তার নাকের উপর থেকে চশমা নামিয়ে টেবিলে রেখে আমার দিকে ভ্রæ কুঁচকে তাকিয়ে সরু ঠোঁটে বলে : ‘মানুষ মাত্রই স্বার্থপর… আর এটাই ইকোনোমিক্সের একটা গুরুত্বপূর্ণ এজামশন- তা কি তুই জানিস? ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেন হামলা করেছে এই স্বার্থের জন্যেই, ভøাদিমির পুতিনকে পশ্চিমা দেশগুলো অচ্যুত ঘোষণা করেছে সেই স্বার্থসিদ্ধির জন্যই। আজকে পত্রিকায় দেখলাম তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করছে ভøাদিমির পুতিন, তাও কিন্তু সেই…’
আমি খবিরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলাম ‘স্বার্থের কারণেই’।
খবির মুচকি হেসে বলে- ‘ঠিক তাই।’
আমি তার হাসির জবাবে হাসি দিয়ে বলি, ‘তোর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো তুই ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিস। আচ্ছা শোন আমার একটা কাজ পরে আছে, আমি দিন সাতেক পরে তোর সঙ্গে দেখা করবো। তবে তুই এই কয়দিন ইসলামিক অর্থব্যবস্থা ও জাকাত নিয়ে একটু পড়াশোনা করিস।’ বলেই আমি খবিরের বাসা থেকে বের হই। আমায় আজ একটু আসাদগেট যেতে হবে। অনেকদিন হলো এক বন্ধুর কাছে বেশকিছু টাকা পাই। আজ দিবো কাল দিবো বলে, অবশেষে গতকাল ফোন দিয়ে আমাকে তার সঙ্গে আজ দেখা করতে সময় দিলো। সে যাই হোক, বন্ধুর কথা অন্য কোনো এক সময়ে পাড়া যাবে। এখন সাতদিন পরের ঘটনা বলি।

দুই.
যথারীতি আমি খবিরের বাসায় উপস্থিত। এই বাসাতে আমার অবাধ বিচরণ। খবিরের বউ মারা যাবার পর আমাদের বন্ধুরা অনেক জোরাজোরি করেছিলো তাকে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে, কিন্তু তার এককথা… বিয়ে আর করছি না। সেই নিঃসঙ্গ খবিরকে কিছুটা সঙ্গ দিতে; নাকি খবিরকে নিজের সঙ্গী করতে আমার এখানে আসা- তা আমার আজো বোধগম্য হয়নি। নিঃসঙ্গ মানুষ দেখে বেশি বুঝে কম!
খবির আমাকে দেখে চোখ পাকিয়ে বলে, ‘ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়তো সুদ হারাম। তাহলে তুই সুদ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড করবি কীভাবে?’
আমায় দেখেই খবিরের আক্রমণাত্মক প্রশ্ন। বোঝাই যাচ্ছে সে কোনোকিছু নিয়ে খুবই ক্ষেপে আছে। আমি চেয়ারে বসতে বসতে শার্টের হাতা গুটিয়ে খবিরকে বলি : ‘সুদতো আর আমি খেতে নিষেধ করি নাই। যিনি নিষেধ করেছেন তিনি তোর আমার সবার সৃষ্টিকর্তা।’
তারপরে একটু থেমে আবারো বলি, ‘সৌদিআরবের ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম কীভাবে চালাচ্ছে?’
‘তাতো ওই ঘুরিয়েই খাওয়া।’ বলেই খবির নাক দিয়ে ফস করে দম ফেলে।
আমি খবিরের চোখে চোখ রেখে বলি, ‘আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তানের পিতামাতা হয়, তাতে কিন্তু কোনো দোষ নাই। কিন্তু যদি আল্লাহর বিধান না মেনে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে যদি সন্তান পৃথিবীতে আসে তাহলেই দেখ, তাকে আমরা জেনা বলি। কিন্তু জাস্ট কিছু বিষয় এদিক-সেদিক হলেই হারাম হয়ে যায় হালাল।’
একটু বিরতি নিয়ে পাশে রাখা গøাসে এক চুমুক দিয়ে পানি খেয়ে আবারো বলি,
‘তুই না আমাকে সেদিন স্বার্থপর দুনিয়ার গল্প শোনালি? তাহলে শোন; মানুষ যদি সত্যি সত্যিই নিজের স্বার্থের কথা ভাবতো তাহলে সে নিজেকে সুদ থেকে দূরে রাখতো। কেন না হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন- সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা।’
‘বাব্বাহ বিরাট মুহাদ্দিস হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে।’ খবির তাচ্ছিল্যের সুরে বলে আমায়।
‘তোর এখান থেকে যাবার পর আমিও সুদ আর জাকাত নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করেছি।’ বলে আমি মুচকি হাসি।
ইতোমধ্যে কফি চলে এসেছে। আমি কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বসে আছি। তখন খবির উঠে দাঁড়িয়ে তার পড়ার টেবিল থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসে আমায় পড়তে বলে। আমি বলি- কী এটা?
সে বলে- ‘পড়ে দেখ।’
আমি কাগজটায় চোখ বুলাই। ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং-এর উপরে লেখা একটা আর্টিকেল।
আমার দিকে না তাকিয়েই খবির আমায় প্রশ্ন করে, ‘এখন এই ডেভেলপমেন্ট গোল তুই কীভাবে বাস্তবায়ন করবি যদি না তুই ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করিস, আবার সুদ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কীভাবে করবি তাওতো একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খবিরের চোখে চোখ রেখে বলি : ‘শোন তোরে একটা কথা বলি, মিশেল দু মতেনিয়া নামের একজন বেশ বড় দার্শনিক জন্মেছিলেন ফ্রান্সে। তিনি একটা সাধারণ বিষয়কেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারতেন। আর এ কারণেই তিনি ছিলেন জগদ্বিখ্যাত। তো, আমিতো আর তার মতো দার্শনিক না; তবে তোকে এটুকু বলতে পারি- আজ থেকে অনেক বছর আগেও এই পৃথিবীতে সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কিন্তু ফলাফলতো সেই একই ছিলো। কিছু মানুষ হয়ে ওঠে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তির মালিক। আর তার বিপরীতে অনেক মানুষ চক্রবৃদ্ধি সুদের খপ্পরে পড়ে হয়ে পড়ে নিঃস্ব, রিক্ত! খামাখাতো আর আলবার্ট আইনস্টাইন চক্রবৃদ্ধি সুদকে এই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলেননি! আর শোন তুই যদি আল্লাহ খোদা মানিস তাহলে তোকে সৃষ্টিকর্তা যা বলেছেন তাও মানতে হবে। আর উনি চান না ওনার সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাক। আমরা বিপদে পড়ি উনি এটা চান না। আর যদি তুই এটা মানিস তাহলে অবশ্যই তুই সুরা বাকারার ২৭৫ নাম্বার আয়াতকেও অস্বীকার করতে পারবি না। সেখানে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন : আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’
কফিতে চুমুক দিয়ে আবারো বলি, ‘আর শোন, হারাম দিয়ে আর যাই হোক সুখে থাকা যায় না। তোকে নিয়েইতো পরিবার, পরিবার নিয়েই সমাজ, সমাজ নিয়েই দেশ। আর দেশ নিয়েই পৃথিবী। এভাবেই একটা সহজ সুন্দর সুখী পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।’
খবির কিছুটা সময় চোখ বুজে কী যেন ভাবলো। তারপরে ফস করে নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে ভ্রæ কুঁচকে তাকিয়ে বলে : ‘তাহলে তুই বলছিস সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থাই আমাদের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য দায়ী?’
‘হুম। তবে এটা আমি বলছি না। বলছেন আমাদের শেষ নবী (সা.)। একটু আগেইতো তোকে বললাম। দাঁড়া তোকে আবারো বলি। বলেই আমি আমার পকেট থেকে লম্বা একটা কাগজ বের করে খবিরের চোখের সামনে এনে ধরি। খবির চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে, ‘বাব্বাহ তুইতো দেখা যাচ্ছে ভালোই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিস।’
‘ইকোনোমিক্সের প্রফেসরের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামছি আর এতোটুকু প্রিপারেশন নিবো না তাই কি হয় কখনো। আচ্ছা দেখ তিন নাম্বার হাদিসটা পড়।’
খবির বিড়বিড় করে যা পড়লো তা হলো : সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা।
পড়ে সে আবারো ফস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। ইদানীং লক্ষ্য করছি সে হুটহাট ফস ফস করে শ্বাস ফেলে। খুব জানতে ইচ্ছে করে সুজানা যখন খবিরের বউ ছিলো তখনো কি সে এমনি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো?
খবির চোখ থেকে চশমা নামিয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে, আহ ঠাণ্ডা হয়ে গেলোতো!
‘কোনো কিছুইতো কারো জন্য অপেক্ষা করে না দোস্ত। যার যেই কাজ তাতো সে মুখ বুজে করে যাবেই। কফির ধর্মই হলো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। আর সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ধর্মই হলো একটা পঙ্গু অথর্ব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা।’
বলে আমি একটুখানি দম নিয়ে তাকে এবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি- তুই কি এখনো সুজানার জন্য মন খারাপ করিস? এখনো কি ভাবিস কার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য তুইই দায়ী?
খবির কফির মগটা ওভেনের ভেতরে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে, যে গাড়ি চালায় দোষতো তারই। তারতো আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।
‘পৃথিবীর শাসকদের এখনি সামনে যেই অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয় আসছে তা মোকাবিলা করতে যথাসম্ভব সাবধান হওয়া উচিত। এখনি জাকাত ব্যবস্থা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এখনি সময় সাবধানে দেশ চালানোর। জাকাত ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটা সম্ভব। নয়তো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একদমই ধ্বসে পড়বে। দেশে দেশে দেখা দিবে নির্মম দুর্ভিক্ষ।’
আমার কথা শুনে খবির হাই তুলে বলে : ‘কিসের সঙ্গে কী মেলাস?’
তারপর আবারো সে ভ্রæ কুঁচকায়। ভ্রæ কুঁচকিয়েই আবারো আমাকে তার প্রশ্ন : ‘কিন্তু ইনফ্লেশন রেইট এখন আকাশচুম্বী। এটাকে আটকাবি কীভাবে?’
‘জানিসতো, ব্রেইনে যখন ডোপামিন রিলিজ হয় তখন আমরা আনন্দে থাকি। আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু আনন্দ বানায় না, অর্থাৎ আনন্দ নিঃসরণ করে না, সে নিঃসরণ করে ডোপামিন। আর তাতেই আমরা সুখে থাকি, আনন্দে থাকি। তার মানে হলো একটার সঙ্গে আরেকটার কোরিলেশান। জাকাত ব্যবস্থাটা যদি টেকসই উপায়ে সত্যিকার অর্থেই এস্টাবলিশ করা যায় তাহলে দেখবি অর্থনীতির সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গেছে। মহানবী (সা.)-এর সময়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এমনভাবেই হয়েছিলো যে, তখন জাকাতগ্রহনকারী লোকজন খুঁজে পাওয়া যেতো না। আর এখন দেখ দেশে দেশে চলছে চরম হাহাকার। প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয়া এ পৃথিবীর আসলেই কভিাবে জন্ম হয়েছে, তা নিয়ে এখনো পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও; জাকাত ব্যবস্থা যে সত্যি সত্যিই একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে তাতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহের অবকাশ নেই। কেনো না জাকাতের কথা বলেছেন স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রাসুল (সা.)।’ বলে আমি খবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি।
‘তুইতো ব্যাটা ভালোই ওয়াজ দেয়া শিখছিস। চালিয়ে যা। হয়তো টুকটাক কামাই রোজগারও করতে পারবি।’ বলেই খবির জানালার পর্দা টেনে দেয়। বাইরে আজ বেজায় রোদ। পর্দা টেনে আবারো সে এগিয়ে আসে তার প্রিয় রকিং চেয়ারের কাছে। চেয়ারে বসে আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মানুষ যে স্বার্থপর তাতেতো তোর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই, নাকি আছে?’
‘আছে।’
কেমন?
‘মানুষ আসলে বোঝে না তার সত্যিকারের স্বার্থের জায়গা কোনটা!’
আমার জবাব শুনে খবির মুখ কালো করে বলে, ‘এতো প্যাচাস ক্যান? সোজাসাপটা বল কী বলতে চাস।’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলি,
‘তুই সুজানার জন্য এখনো মন খারাপ করিস কিসের স্বার্থে?’
সে ফিসফিস করে বলে,
‘এই মন খারাপ করে থাকতেও আমার ভালো লাগে। আর এই ভালো লাগাটার জন্যই আমি মন খারাপ করি। তাহলে এটা কি আমার স্বার্থ না?’
‘হুম স্বার্থ। বাট যখন তোর মন খারাপ হয়, আইমিন, তুই মন খারাপ নিয়ে ক্লাসে ভালো করে পড়াতে পারিস? আমি খুব ভালো করেই জানি; তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই ফেমাস টিচার। স্টুডেন্টরা তোর লেকচার মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে। আর তোর কাছেতো টিচিং শুধু প্রফেশন না, এটা তোর কাছে প্যাশান। তাহলে এখন আমায় বল… যখন তোর খুব বেশি মন খারাপ হয় তখন তুই কেমন পড়াস?’
আমার প্রশ্ন শুনে খবির আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তবে সে খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘আমি সেদিন ভালো পড়াতে পারি না। ভুলে যাস না আমিও মানুষ। আমারো মন খারাপ হয়। আর এভাবেই চলে যায় জীবন।’
‘তোর কথার সূত্র ধরেই বলি : রবার্ট ফ্রস্ট এরতো নাম শুনেছিস! এই মহান কবি জীবনের ডেফিনেশন দিতে গিয়ে কেবলমাত্র তিনটি শব্দের ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন : লাইফ গোউজ অন। জীবন চলেই যায়। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে- সেই জীবনটা কেমনভাবে চলে গেলো সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা জীবন চলে যাবার পরে বেঁচে থাকা জীবনগুলো সেই চলে যাওয়া জীবনকে মনে রাখলো কিনা তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সঙ্গে অর্থপূর্ণ। দেশ-বিদেশের অনেক ভালো ভালো চাকরি ছেড়ে তুই এসেছিস মাস্টারিতে। কেন না তোর পড়াতে ভালো লাগে। এটা তোর স্বার্থ। কারণ এখানে তোর ভালো লাগা জড়িত। কিন্তু তোর এ ভালো লাগার কারণে এ দেশে অনেক ছাত্রছাত্রী ‘জ্ঞান আহরণ’টাও যে একটা বিনোদন- তা জানতে পেরেছে। যদি না তুই তোর ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিতি তাহলে দেশের একটা অংশ তোকে পেতো না, তারা নিজেরা হতো ক্ষতিগ্রস্ত সঙ্গে সঙ্গে দেশেরও হতো চরম ক্ষতি। তার মানে, তোর স্বার্থের সঙ্গে এত্তগুলা মানুষের স্বার্থ জড়িত। এখন আয়… তোর মন খারাপের ভালো লাগার কথায়।’
আমার দিকে খবির ভ্রæ কুঁচকে তাকিয়ে বলে : ‘মন খারাপের ভালো লাগার কথার মানে কী?’
‘ওই যে তুই না বললি, সুজানার জন্য তোর মন খারাপ করতে ভালো লাগে। আর এটাই তোর স্বার্থ। কিন্তু তোর এই স্বার্থের কারণে উপকারতো হয়ই না বরং, তোর ক্লাসে তোকে সেভাবে স্টুডেন্টরা না পেয়ে তারা কিন্তু নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মানে- তোর স্বার্থসিদ্ধি হলেও তোর পাশের মানুষগুলো অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু জীবনকে এভাবে চালানো উচিত না। জীবনে পদচিহ্ন রেখে যেতে হবে যাতে করে মরার পরেও মানুষ বলে : এখানে কেউ একজন এসেছিলো! আসলে দোস্ত আমাদের সত্যিকারের স্বার্থের জায়গাটা খুঁজে নেয়া দরকার। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই তুই আমার চেয়ে ভালো বুঝতে পারবি। বুঝতে পারবি- জাকাত ব্যবস্থাই হতে পারে আগামীদিনের অর্থনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান।’
খবির আমার কথা শুনে আবারো ফস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর চেয়ারের হাতলে রাখা তোয়ালেতে নিজের মুখ মুছে আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে আস্তে বলে : ‘তোকেতো সাহিত্যিক হিসেবেই জানতাম, এখনতো দেখছি ভালো লেকচারও দিতে পারিস।’
আমি হেসে বলি, ‘আমার বলা কথাগুলো তোর কাছে লজিক্যাল মনে হয়েছে?’
খবির বলে, ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ যখন লাহোর প্রস্তাব আনেন, তখন কিন্তু অনেকেই তাকে বাহবা দিয়েছিলো। অনেকেই বলেছিল ঞড়ি হধঃরড়হ ঃযবড়ৎু রং ঃড়ঃধষষু ংঁঢ়বৎন. হিন্দুদের জন্য আলাদা দেশ, মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ। ভালোইতো! কিন্তু দেখ… জিন্নার এই থিউরি পরে কিন্তু মার খেয়ে গেলো, আর মাঝখান থেকে কষ্ট পেল লাখ লাখ মানুষ।’
আমি হো হো করে হেসে বলি,
‘তুই যদি কাদা মাটিকে ডার্ক চকোলেট মনে করে মুখে দিস তাহলে তোকে পাগল বলা ছাড়া আমি আর কীইবা বলতে পারি।’
‘তার মানে?’ সরু ঠোঁটে আমায় জিজ্ঞেস করে খবির আলী।
‘আমি তোকে যেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছি তার প্রবক্তা কোনো মানুষ নন, তার সৃষ্টি হয়েছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতে। কোথায় কাদামাটি আর কোথায় ডার্ক চকোলেট! কোথায় জিন্নাহ আর কোথায় সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ!’

খবির আলী আমার কথা শুনে এবারে চুপ মেরে যায়। তবে বোঝা যাচ্ছে সে আমাকে চরম আঘাত দেবার জন্যে মনেমনে কথার পিঠে কথা সাজাচ্ছে। আমিও তার আক্রমণের আশঙ্কায় চুপিচুপি অপেক্ষা করছি। কিন্তু হঠাৎই সে আমায় বলে বসে, ‘আজ যা ভাগ। ভালো লাগছে না। অরেকদিন আসিস। তখন এটা নিয়ে আবারো কথা হবে।’
আমি হাসতে হাসতে বলি, ‘তোরা অর্থনীতিবিদরা সবসময় বাইরের দিকটাই দেখিস, কিন্তু ভেতরেরটা দেখার তোদের সময় কই? যেমন দেখ- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যদি জন্ম না হতো তাহলে এদেশে নারীশিক্ষা এতোখানি আগাতে পারতো না! কিন্তু আজকালকার কয়টা মেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এ অবদানের কথা জানে। আবার দেখ… আমরা ব্যস্ত সবাই এৎড়ংং হধঃরড়হধষ ঢ়ৎড়ফঁপঃ নিয়ে কিন্তু আসল ব্যাপারটাতো হচ্ছে সুখ। ভুটানের রাজাতো সেদিন বলেই দিলো- ‘গ্রস ন্যাশনাল প্রডাক্টের চেয়ে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ যা দেখিস তাই কি সত্য? আর যা দেখিস না তাই কি মিথ্যা? এখন একটু চোখ মেলে তাকানোর সময় এসেছে বন্ধু। ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে আশপাশে তাকা। দেখবি অনেক কিছুরই উত্তর পেয়ে যাবি।’
খবির উঠে দাঁড়িয়ে আমায় দরজা দেখিয়ে দেয়। বোঝাই যাচ্ছে আমার উপরে সে মহা ক্ষ্যাপা। আমিও দাঁড়িয়ে তাকে বলি, ‘রাতের খাওয়াটা অন্তত খেয়ে যাই। নইলে বাসায় গিয়ে এই অসময়ে রান্না চড়াতে হবে।’
‘আমার একটু একা থাকতে হবে।’
বলেই সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়।
আমি বের হতে হতে তাকে বলি, ‘জাকাত ব্যবস্থাটা এখন আমাদের জন্য এক অচেনা বিস্ময়। তুই প্লিজ এটা নিয়ে আরো স্টাডি করে তোর মতো করে মানুষকে বোঝা। এটাই পারে আমাদেরকে উদ্ধার করতে!’
আমি বাইরে বের হই। মাথার উপরে বিশাল আকাশ আর অচেনা-অজানা মানুষকে সাথী করে এগিয়ে চলি সামনের দিকে। মানুষ কখনোই একা না। সৃষ্টিকর্তা একা মানুষকে সঙ্গ দিতেই আশপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে কতোই না বিস্ময়। আমি হলুদ রোদ মাখতে মাখতে এগিয়ে চলি সেই বিস্ময়ের সন্ধানে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়