গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

উদ্বাস্তু জাতক : হারুন হাবীব > বড় গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শীতের শক্তি কমতে শুরু করেছে। ডাল থেকে পুরনো পাতা খসে পড়ছে। সবুজ কচি পাতারা নতুনের ডালা সাজাতে ব্যস্ত। ফাল্গুনের প্রথম দিন আজ। বাঙালি তারুণ্য এ দিনে রঙিন হয়ে ওঠে। নব বসন্তের গীত ছড়িয়ে দেয় ওরা উদ্দাম নৃত্যে। সে গীত শহর থেকে গ্রাম আন্দোলিত করে। বসন্তের ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে লাগতেই দলে দলে বেরিয়ে পড়ে হাজারো উচ্ছল তরুণ-তরুণী। এ যেন আরেক উপঢৌকন।
উত্তরের দরজাটা খুলে নব বসন্তের উদ্দাম আগমনী উল্লাস দেখেন ষাটোর্ধ্ব আলী হাসান। গায়ে পাতলা চাদর। শীতের তেজ কমলেও এ বয়সে সাবধানতা প্রয়োজন হয়। বাইরের ধুলাবালি বাতাসে ভর করে হঠাৎ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। তবু আলী হাসান বসন্ত ঋতুর এই মনোমুগ্ধ আগমনী দেখতে চান।
সাত সকালে স্বামীকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্ত্রী বললেন, বাইরে তো ধুলা, দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে এসে বস না?
এরপরও গায়ে চাদর জড়িয়ে আলী হাসান সামনের সড়কটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। একসময় স্ত্রীও গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। সড়কজুড়ে তারুণ্যের স্রোত। নব বসন্তের হাতছানিতে ওরা বিভোর। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরে হাঁটছে ছোট ছোট মেয়েরা পর্যন্ত। ছেলেদের গায়ে লাল-হলদে পাঞ্জাবি। বাস, রিকশা ও ভ্যানে চেপে রং-বেরং কাপড় পরা হাজারো যুবক-যুবতী ভোরবেলাতেই ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। আজ পয়লা বসন্ত। ব্যস্ত সড়কের দিকে বেশ খানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে আলী হাসান স্ত্রীকে বললেন, আমাদের সময়ে এ রকম ছিল না – তাই না? ভালোই লাগে। দেখবে এরাই বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করবে।
মন্তব্যটা সরাসরি অস্বীকার না করেও মিসেস আলী অন্য কথা বললেন, বাঙালি যে হুজুগে জাতি সেটাও কিন্তু প্রমাণ হয়! উপলক্ষ একটা পেলেই হলো!
কথা বাড়ালেন না আলী হাসান। শুধু বললেন, কিছু ক্ষেত্রে এ অভিযোগ অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু আজকের উন্মাদনাকে কি হুজুগ বলা চলে? বাঙালিকে চিনবার, বোঝাবার জন্য পয়লা বৈশাখ কতটা অবদান রাখে- একবার মনে করে দেখ?
এরপর চায়ের কাপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে তিনি নিচের তলায় নামেন। সকালের নাশতা সেরে এক কাপ চা হাতে প্রতিদিন নিজের লেখালেখির ঘরে প্রবেশ করেন লেখক আলী হাসান। দোতলায় বসবাস করলেও নিচের তলাটা একান্তভাবে নিজের জন্যই ব্যবহার করেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর কয়েক। এখন লেখালেখিতেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন। মধ্যবিত্ত সংসার। নিচের তলাটা ভাড়া দিলে কিছু টাকার সংস্থান হতো। কিন্তু তিনি রাজি হননি। লেখালেখির জন্য একটা কম্পিউটার, পড়ার টেবিল, বড় একটি লাইব্রেরি। কাচের সেন্টার টেবিল ঘিরে কয়েকটা বেতের চেয়ার পাতা প্রথম কামরায়- যাতে লেখকের একান্ত অতিথিরাই কেবল বসেন। এর বাইরে নিচতলাটার বাড়তি সংযোজন দেয়ালজুড়ে টানানো অসংখ্য ছবি। সবগুলোই পুরনো এবং সাদাকালো।
চেয়ারে বসে, কয়েকবার চায়ে চুমুক দিতেই তার মনে হলো প্রথম বসন্তের এই সকালটা ব্যর্থ হবে, যদি না রবীন্দ্র সঙ্গীত না শোনা যায়! ভাবা মাত্র চেয়ার ছেড়ে কম্পিউটারে একটি সিডি ভরলেন এবং গান চালু করলেন। গানের ব্যবস্থাটা প্রথম থেকেই ছিল। লেখা বা বই পড়ার অবসরে রবীন্দ্র, ডিএল রায়, নজরুল, অতুল প্রসাদ আর হেমন্ত-সলিলের গান শোনা তার বহুকালের অভ্যাস। এর সঙ্গে আছে বাঁশের বাশির অনেকগুলো সিডি। নিঃশব্দে বসে একাকী ঘরে বাঁশিতে রাগরাগিনী শুনতে তার ভালো লাগে।
চায়ে কয়েকটা চুমুক দিয়ে আলী হাসান দিনের পত্রিকা পড়াতে মন দিলেন। সকালটা এভাবে মন্দ কাটে না তার। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ কানে যায়। নিজেই এগিয়ে যান গেট পর্যন্ত। বুঝতে পারেন যার আসার কথা ছিল সে এসে গেছে। প্রথমে একটা ছোট্ট কড়মর্দন, কিছুটা স্মিত হাস্য বিনিময়, এরপর পা ফেলে গৃহপ্রবেশ এক বিদেশি তরুণের। বসার চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে গৃহকর্তা সামনের দিকে যান। যুবকটি অবাক করা চোখ মেলে ঘরটি দেখতে থাকে। গৃহকর্তার দিকে তাকিয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে সে নিজের পরিচয় জানায়- আমার নাম রায়ান গুড। আমি কানাডার নাগরিক।
ইংরেজি বলার ধরন পাশ্চাত্য দেশীয়। কিন্তু সামনাসামনি তরুণটিকে সে রকমটা মনে হয় না আলী হাসানের। অতএব ইংরেজিতেই বললেন, তুমি আসবে আমাকে আগেই বলা হয়েছিল। বলতে পার অপেক্ষাই করছিলাম। এতক্ষণে আমার কম্পিউটারে বসার কথা।
-কম্পিউটারে কি কাজ কর তুমি?
-ই-মেইল দেখি, ইন্টারনেট ব্রাউজ করি এবং লিখি। লেখাটাই মূল কাজ আমার।
-কি লেখ?
-মূলত মুক্তিযুদ্ধ, আমদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পত্রিকার জন্যে কলাম, ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিচারণ- এসবই।
-তুমি তাহলে লেখক?
-যখন লেখি তখন লেখক বললে কি ভুল বলা হবে?
-না না তা নয়।
রায়ান গুড যে ঘরটায় বসেছে তা যে কোনো বিদেশির কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করতেই পারে। এ রকম ড্রইং রুম কমই দেখা যায়। দেয়ালজুড়ে অসংখ্য সাদাকালো ছবি। এভাবে ছবি সংরক্ষণ হয় কেবল জাদুঘরেই। কিন্তু এ বাড়িটা কোনো জাদুঘর নয়। সে রকম আয়োজনও নেই। দেয়ালজুড়ে একের পর এক আলোকচিত্র। আগুনে পোড়া ঘরবাড়ি, বিপন্ন নারীপুরুষ ও শিশু শরণার্থী, নিহত ও আহত মানুষের দেহ এবং অস্ত্রধারী তরুণ দলের ফ্রেমে বাঁধা আলোকচিত্র। কাচ দিয়ে বাঁধানো বড় বড় ফ্রেমগুলো যতœ করে দেয়ালে টানানো। বিদেশি তরুণটি, কী ভেবে, চেয়ার ছেড়ে উঠে ছবিগুলো দেখতে লাগল।
হালকা করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর বাজছে। গৃহকর্তা আগন্তুককে তাকিয়ে দেখতে থাকেন। গায়ের রং অনেকটাই লালচে। এরপরও খানিকটা বাঙালি কমনীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। গায়ে একটা রঙিন দেশি পাঞ্জাবি। বাংলাদেশে এসে অনেক বিদেশিই ইদানীং শখ করে স্থানীয় পোশাক পরে। বিদেশি মেয়েরা পেন্ট-শার্ট ছেড়ে শাড়ি পরে। পহেলা বৈশাখ বা বসন্তের প্রথম দিন হলে তো কথাই নেই।
-তুমি কি ফটোগ্রাফার?
-না, ফটোগ্রাফার নই। বাড়িটাকে কোনো মিউজিয়াম বানাবার ইচ্ছাও নেই আমার।
-তাহলে?
-আমার নিজের তোলা আমার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি। এটা আমার লেখালেখির ঘর। এখানেই সময় কাটাই। ছবিগুলো আমার খুবই প্রিয়- সংরক্ষণ করেছি। কেন, খারাপ লাগছে?
– না না তা কেন। এগুলো তো হিসটরিক্যাল ডকুমেন্ট। মিউজিয়ামে দিলেই পার।
-হয়তো দেব।
রায়ান গুড এবার চেয়ারে এসে বসে। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর আলী হাসান জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করার কথা ভাবছ? আমাকে সে রকমই বলা হয়েছে। বল, কীভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
যুবক খানিকটা হেসে উল্টো প্রশ্ন করে, আমার সম্পর্কে আর কিছু বলা হয়নি তোমাকে?
আলী হাসান অবাক হলেন। আর কি বলার আছে! একজন বিদেশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী, এ নিয়ে কাজ করতে চায়, গবেষণা করতে চায়, আমার সাথে দেখা করতে চায় – এটুকুনই বলা হয়েছে তাকে। এবার তিনি ছেলেটার মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। কমনীয় একটি মুখ। চোখগুলো বিনয়ী। তার নিজের ছেলের চেয়ে বয়সে কম কি বেশি হবে ঠাহর করতে পারেন না।
রায়ান এবার চেয়ার ছেড়ে ফ্যানের সুইসটা চালু করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। বললো, বেশ গরম, তোমার অসুবিধে হবে না তো?
– না না, শীত প্রায় নেই। বসন্তকাল এসে গেছে। এখন গরম পড়বে। ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে ভালোই করেছ?
– তুমি নিশ্চয়ই জান আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাই?
– সে রকমই আমাকে বলা হয়েছে।
এরপর বিশেষ ভূমিকা না করেই রায়ান বলতে থাকলো, আমার পরিচয়টা তোমাকে আগে দেয়া উচিত। আমি জেনেছি তুমি তোমার দেশের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন পর্যায়ের একজন সৈনিক। তোমাদের যুদ্ধে আমার মায়ের অবদান আছে। আমি উনিশশ একাত্তরের একজন ‘ওয়ার বেবি’- তোমরা যাকে যুদ্ধশিশু বল। আমার যখন বয়স তেইশ দিন তখন কানাডার একটি পরিবার আমাকে দত্তক নিয়ে চলে যায়। আজ আমি বড় হয়েছি। আমি আমার শিকড় খুঁজতে চাই। যদি সম্ভব হয়, আমার মাকে খুঁজে পেতে চাই। তুমি যদি সাহায্য করতে পার খুশি হবো।
কোনো রকম সংকোচ না করে রায়ান গুড তার কথাগুলো বলে গেল। মুহূর্তে পরিবেশটা পাল্টে গেল। সে যেন আর তাকাতে পারছে না না ভালো করে। লেখক আলী হাসান ফ্যানটা আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। তিনি ঘামতে শুরু করেছেন। গায়ের চাদরটা খুলে পাশে রাখলেন। এ রকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন ভাবতেও পারেননি।
নতুন করে তিনি ভিনদেশি যুবককে দেখতে শুরু করলেন। সরাসরি তাকানো সম্ভব হচ্ছিল না। নিষ্পাপ একটি মুখ। এই বাংলাদেশে কে তাকে চিনবে? কে তার মা, কোন শহর, কোন গঞ্জ বা গাঁয়ে তার মায়ের ঠিকানা- বেঁচে আছে কি নেই, কে তার খোঁজ রাখে? অথচ রায়ান গুড তার মাকে খুঁজতে এসেছে!
রায়ান চুপ করে থাকল। আলী হাসান ওর মুখের দিকে তাকালেন। রায়ান কিছুদিন হলো ঢাকায় এসেছে। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। মায়ের অবস্থান জানার চেষ্টা করছে। জানবার চেষ্টা করছে তার জন্মের ইতিহাস।
আলী হাসানের ঠিক সামনের চেয়ারটিতে রায়ান বসে আছে। ওকে দেখে জাতীয় ইতিহাসের ভয়ংকার এক যন্ত্রণার ছবি ভেসে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আলী হাসানের মনের পর্দায়। যে যুদ্ধ শিশুদের কথা তিনি জানতেন, যাদের কথা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, সেই দুর্ভাগাদেরই একজন তার সামনে বসে আছে! যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী সৈনিক হয়েও নিজেকে হঠাৎ পরাজিত, দুমড়ানো মুচড়ানো মনে হতে থাকে তার।
রায়ান বেশ কয়েকটি বাংলা শব্দ শিখে নিয়েছে। ‘ধন্যবাদ’, ‘আমি রায়ান গুড’, ‘আপনি কেমন আছেন?’, ‘আমি কানাডা থেকে এসেছি’, ‘আমার মাকে খুঁজতে এসেছি’, ‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন’- এ রকম কিছু শব্দ ওর নিজের আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে এরই মধ্যে। বলল, বেশ কয়েক সপ্তাহ আমি বাংলাদেশে থাকতে চাই। বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করছি। মায়ের দেশে মায়ের ভাষাতে কথা বলতে চাই।
রায়ান গুডের দত্তক মা-বাবার নাম ডরেন ও ডেলি। ১৯৭২ সালে, রায়ানের বয়স যখন ২৩ দিন, তখনই সে ঢাকা থেকে চলে যায় কানাডার ভিক্টোরিয়ায়। এক বোনও আছে ওর। নাম রচনা। যুদ্ধশিশু রচনাকেও সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে ডরেন ও ডেলি। কেবল ডরেন ও ডেলিই নয়, এমনি অসংখ্য পরিত্যক্ত শিশুকে নিয়ে গেছে নানা দেশের সমাজসেবীরা। এরা কে কোথায় আছে, কেমন আছে, কেউ কি সে খোঁজ নিয়েছে?
মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক আলী হাসান আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ১৯৭১ নিয়ে নিজের এতোদিনকার লেখালেখি তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। জাতীয় যুদ্ধের রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে লড়ে তিনি আহত হয়েছেন। যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে নিজের ক্যামেরায় রণাঙ্গনের ছবি তুলেছিলেন। বহু বছর নিগেটিভগুলো অযতেœ পড়ে ছিল। সম্প্রতি সেগুলো নিজের খরচে প্রিন্ট করিয়েছেন। টানিয়ে রেখেছেন নিজের ঘরের দেয়ালে। এ তার একান্ত নিজের জগৎ। এতো বছর পরও যখন ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ান, তখন জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়টি ভেসে ওঠে, দেয়ালের ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। মধ্য বয়সেও তিনি শক্তি সঞ্চয় করেন।
রায়ানের হাত চেপে ধরেন আলী হাসান। যে বাঙালি মায়ের পেটে ওর জন্ম তার হদিস সে কোনোদিন পাবে- এমন দিব্যি কে দেবে? ১৯৭১ এর প্রতিটি যুদ্ধশিশুকে, এ দেশের প্রতিটি নির্যাতিতা নারীকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তা পারেনি। জাতি তার ইতিহাসের ক্ষতচিহ্নগুলোকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজও সঠিক কোনো তথ্য নেই কতজন বাঙালি নারীকে নির্যাতিত করেছে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা- যারা একদিকে বাঙালি নারীর ওপর বীভৎস নিপীড়ন চালিয়েছে, অন্যদিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে স্বাধীনতাকামী মানুষকে। সে কারণেই ছেলেটির প্রতি তার শ্রদ্ধা হয়। এ সমাজ, এ রাষ্ট্র যে কাজটি করতে পারতো, যা করা উচিত ছিল, সেটিই করছে রায়ান গুড।
– আমি তোমার সাহায্য চাই মি. আলী হাসান। মা যদি বেঁচে থাকেন, কোথাও না কোথাও থাকেন, তাকে আমি খুঁজে বের করতে চাই। তুমি তো মুক্তিযুদ্ধ করেছ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ কর, লেখ- যদি সম্ভব হয় আমাকে সাহায্য করো।
– অবশ্যই, কিন্তু কীভাবে রায়ান? এ যে দুরূহ কাজ।
রায়ান ইতোমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে বলে মনে হলো। পকেট থেকে নোটবইটা বের করে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকলো। মাথা তুলে একবার বললো, এখান থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালটা কত দূর হবে?
আলী হাসান বললেন, ঢাকার অন্য প্রান্তে- পুরান ঢাকায়। কিন্তু সদরঘাট কেন?
– জানি না আমি সঠিক তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি কিনা, যা জোগাড় করেছি হয়তো তা খুবই অপর্যাপ্ত। যাদের কথা জেনেছি তাদের মধ্যে আমার মা ছিলেন কিনা- তাও জানি না। তবু তোমাকে বলি।
এটুকুন বলে রায়ান গুড দেয়ালে টানানো একটি বড় ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ত্রিপুরার একটি শরণার্থী শিবিরে একদল উদ্বাস্তু অসহায় নারী বিমর্ষ মুখে বসে আছে। অনিশ্চিতের পথে তাদের যাত্রা। খুঁটে খুঁটে প্রতিটি উদ্বাস্তু নারীর মুখ দেখলো রায়ান। তারপর চেয়ারে গিয়ে আলী হাসানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল- এই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকেই এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ২০ জন মেয়েকে জোর করে মিলিটারি লরিতে উঠিয়ে নিয়ে যায় একদল পাকিস্তানি সৈন্য। বাঙালি রাজাকার বাহিনী ওদের সাহায্য করে। ঢাকা তখন অবরুদ্ধ নগরী। সারা শহরে কারফিউ। এর মাঝেও মৃত্যুপুরী থেকে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নারী ও পুরুষ। শহরের নানা এলাকা থেকে একদল মেয়ে এসে জড়ো হয় লঞ্চ টার্মিনালে। লঞ্চ-স্টিমার যা পাবে, তাতে করেই ওরা ঢাকা ছাড়বে। পুরুষদের যারা শক্ত সামর্থ্য, গুলি করে হত্যা করতে শুরু করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। কারণ ওরা প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। কিন্তু যুবতী মেয়েদের ওরা লুণ্ঠন করেছে- জোর করে সেনা ছাউনিতে নিয়ে গেছে।

কথাগুলো বলতে গিয়ে রায়ান হাঁপিয়ে ওঠে। গোমট পরিবেশটাকে কিছুটা হালকা করার চেষ্টা করেন আলী হাসান। তিনি যেন আর পারছেন না। একাত্তরের দুঃসহ দিনরাত্রী এসে তাকে কামড়াতে থাকে। একবার বললেন – কাণ্ড দেখ, কথায় কথায় চায়ের কথা বলতেই ভুলে গেছি। তুমি একটু বস। বলেই তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। সেন্ডেলের শব্দগুলো তাকে আঘাত করতে থাকল। খানিকক্ষণ সময় তিনি দোতলায় কাটালেন। ফিরে এসে দেখলেন, রায়ান গুড মনোযোগ সহকারে ওর নোট বইটার পাতা উলটাচ্ছে। তাকে দেখে রায়ান গুড বলতে থাকে।
– আমাকে ও আমার বোনকে দত্তক নিয়েছিল ‘ফ্যামেলিস ফর চিলড্রেন’ নামের একটি সেবা সংস্থা। সংস্থাটি ঢাকা শহরের নানা এলাকা থেকে পরিত্যাক্ত নবজাতক সংগ্রহ করেছিল। রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট, বস্তি এবং বাসাবাড়ি- এসব জায়গা থেকেই জোগাড় করেছিল এসব নবজাতক। যুদ্ধের শেষদিকে, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও এসব যুদ্ধশিশুর একটি অংশ নীরবে দেশের বাইরে চলে গেছে। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলেছি। পুরনো কাগজপত্র ঘেটেছি। পুরনো কর্মকর্তাদের দু-একজনই মাত্র আছেন।
কিছুক্ষণ পর দোতলা থেকে ট্রেতে চা-নাশতা হাতে মিসেস আলী হাসান নিচে নামলেন। ছেলেটির দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমি মিসেস আলী। কিছু মুখে দাও, পরে গল্প করো।
রায়ান চেয়ার থেকে উঠে মাথা নিচু করে নিজের পরিচয় দিল। মিসেস আলী বললেন, বাহ তোমার পাঞ্জাবিটা খুব সুন্দর-তো! তোমাকে বেশ মানিয়েছে।
আলী হাসান ইংরেজিতে স্ত্রীর বক্তব্য কিছুটা বুঝিয়ে দিতেই রায়ান হেসে বললো, আমি কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি। পাঞ্জাবি ড্রেসটা আমার বেশ পছন্দ। আজ বসন্ত। দিন কয়েক এদিক-সেদিক হেঁটেছি। রিকশায় ঘুরেছি। সবাই ব্যস্ত হয়ে কেনাকাটা করছে। ভাবলাম আমিও একটা কিনি।
– খুবই ভালো মানিয়েছে তোমাকে। কথা শেষ করে উপরে আসবে কিন্তু। আমাদের সাথে ভাত খেয়ে যাবে। আমিতো তোমার মায়ের মতোই।
গৃহকত্রী এরপর রায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। আলী হাসান রায়ানকে নিয়ে পাশের ঘরের লাইব্রেরিতে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে কয়েকশ বই সেলফে থরে থরে সাজানো। বেশির ভাগ বাংলায়, যা রায়ানের পড়তে পারার কথা নয়। সেলফ থেকে হাতে নিয়ে কয়েকটা ইংরেজি বই সে পাতা উল্টে দেখতে থাকলো। বললো- এখানে কি ‘ওয়ার বেবিদের’ ওপর রিসার্স হয়েছে, তোমার লাইব্রেরিতে এ রকম কোনো ইংরেজি বই আছে?
তার নিজের অনেকগুলো বই সহ বহু লেখকের পুস্তক আছে আলী হাসানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে। বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত। গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, কবিতা। বেশ সচেতনভাবেই তিনি পাঠাগারটি গড়ে তুলেছেন। প্রতিবার বাংলা একাডেমির বইমেলায় যান মুক্তিযুদ্ধের নতুন বই কেনেন। কিন্তু তিনি জানেন এসব বই রায়ানের কাজে আসবে না।
বললেন- যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে, আমার জানা মতে, পূর্ণাঙ্গ গবেষণা খুব একটা হয়নি। তবে নির্যাতিত নারীদের নিয়ে এক-দুজন কাজ করেছেন। ওদের সংখ্যা কেউ বলেছেন আড়াই লক্ষ, কেউ বলেছেন চার লক্ষ।
স্পষ্টই বোঝা গেল রায়ান এ অপূর্ণাঙ্গতা মেনে নিতে পারছে না। হাতের বইটা সেলফে রেখে বললো- কেন, এ কাজটি কি জাতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়?
-না, তা নয় রায়ান। আমাদের অনেককিছুই করা হয়নি। নানা সংকট জাতীয় জীবনকে আঘাত করেছে, যা করা উচিত ছিল- সেটিও আমরা করে উঠতে পারিনি। এ আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমি আশাবাদী।
রায়ানকে তখন বেশ খানিকটা হতাস মনে হতে লাগল। চোখেমুখে বেদনার প্রলেপ লক্ষ্য করা গেল। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো আলী হাসানের। সে জানে, মুক্তিযুদ্ধের নারী নিগ্রহের ওপরও তেমন কিছু ভালো কাজ হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই দুস্থ নারীদের পুনর্বাসনে সরকার থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিছু নারী সংগঠনও এগিয়ে এসেছিল। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে খোলা হয়েছিল দুস্থ নারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। এ কেন্দ্রেও জন্মেছিলো বেশ কিছু শিশু। আত্মহত্যা করেছিলো অনেক মা। হারিয়ে গিয়েছিলো চিরদিনের মতো। সরকার থেকে নির্যাতিতাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দেয়া হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল মুক্তিযুদ্ধের এই হতভাগীদের সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে যায়নি।
রায়ান গুড এসব শুনে আরো গম্ভীর হলো। চেয়ারে বসে নোট বইটা আবার মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। একবার মাথা তুলে বললো – আমার বিশ্বাস, আমি আমার মাকে খুঁজে পাবোই। বড় হবার পর থেকে এ বিশ্বাস নিয়েই আছি। ডিলি ও ডরেন আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। স্নেহ দিয়ে, আদর দিয়ে বড় করেছে। ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

এটুকুন বলেই রায়ান থামলো। একবার উঠে দাঁড়ালো, আবার বসলো। সে তার বিশ্বাসের কথায় নতুন করে ফিরে গেলো।
– অনেকেই বলেন আমি আমার মায়ের খোঁজ পাবো না। কিন্তু আমি জানি- আমি পাবো। আমি সব জায়গায় যাবো। কেউ না কেউ জানবে। কেউ না কেউ খোঁজ দিতে পারবে।
এ পরিস্থিতিতে কী বলবেন ভেবে পান না আলী হাসান। তিনি জানেন এ যুবককে তার বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া কঠিন কাজ। কিছু বলতে পারেন না তিনি। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, সেই ভালো রায়ান গুড ওর মায়ের সন্ধানে গোটা বাংলাদেশ ঘুরতে থাকুক। এতে সে শান্তি লাভ করবে।
আলী হাসান নিজেও নিশ্চুপ থাকেন। মাথার ওপর বিদ্যুতের পাখাটা জোরে ঘুরতে থাকে। এরপরও নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। ঘর থেকে বাইরে বেরোতে পারলে হয়তো মুক্তি পাওয়া যেতো। আলী হাসান চেয়ার থেকে উঠে দুটো জানালা খুলে দিলেন। সাথে সাথে ধুলাবালিসহ শীত শেষের বারতামাখা অবাধ্য বাতাস ঢুকে তার লেখার কাগজ, টেবিলে রাখা বই অগোছাল করে দিল। রায়ানের চুলগুলো অবিন্যস্থ হলো। দেয়ালে টানানো মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো নড়েচড়ে উঠলো।
রায়ান গুড আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে। একবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়, বলে- আজ আমি উঠি। আরো কয়েকটা জায়গায় যাবো। তোমার বাড়িতে আবার আমি আসবো। যদি আমার মাকে পাই তোমাকে জানাবো। পারলে আবিষ্কারের এ কাহিনিটা তুমি লিখ।
আলী হাসান হঠাৎ করেই রায়ানকে প্রশ্ন করে- তুমি মায়ের খোঁজ করতে এসেছ, বাবার খোঁজ করতে গেছ, পাকিস্তানে?
প্রশ্নটার উত্তর কী দেবে রায়ান গুড? ওর চোয়ালগুলো শক্ত হয়ে উঠলো। কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল- ওই বাবার খোঁজ কোনোদিন আমি নিতে চাইনে – যে আমাকে জারজ বলে পরিচিতি দিয়েছে, যে বাবা পশুর মতো আচরণ করেছে। হি ইজ এ ক্রিমিনাল, নট এ হিউম্যান বিং।
এরপর রায়ান গুড ঘর থেকে বেরোলো। যেতে যেতে বললো, তোমার স্ত্রীর নিমন্ত্রণ অন্য একদিন রক্ষা করবো। ওনি তো আমার মায়ের মতো। নিশ্চয়ই আমি আসবো। কিন্তু আজ নয়। আজ অনেক কাজ।
পিতৃস্নেহে আলী হাসান ওর কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন- আমি আশীর্বাদ করি তুমি তোমার মাকে খুঁজে পাও।
বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আলী হাসান দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। দরজার খিল খুলে সামনের সড়কের দিকে তাকালেন। স্ত্রী এরই মধ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই দেখলেন, রঙিন পাঞ্জাবি পরা রায়ান গুড নব বসন্তের উদ্দাম তারুণ্যের ভিড়ে মিশে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়