গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

দাবার ঘুঁটি যখন মানুষ : ইউসুফ খান > খেলা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দাবা বিশ্বের একটি জনপ্রিয় খেলা। কথিত আছে দাবা খেলার সর্বপ্রথম সূচনা হয় ভারতবর্ষে। যিনি দাবা খেলেন তাকে দাবাড়ু বলা হয়। আর চাল দিয়ে যখন বিপক্ষের রাজাকে কোণঠাসা করা হয় তখন একে দাবার পরিভাষায় বলে কিস্তিমাত। বাংলাদেশের দাবার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই এক সোনালি অতীতের। কয়েকজন এই খেলায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হন। পরে অবশ্য আরো কয়েকজন গ্র্যান্ড মাস্টার হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের সেরা মহিলা দাবাড়ু রানী হামিদ। তাকে কে-না চিনে-যিনি গৃহিণী থেকে দাবার রানী হয়ে উঠেন?
চাকরির সুবাদে বহু দেশ ঘোরার সুযোগ হয় আমার। আর তখনই ওসব দেশের কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় মনের মধ্যে রেখাপাত করে। আজকে এমনই দুটি দেশের নাম বলব যে দুটি দেশ বিশ্বব্যাপী দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত। একটি দেশ হলো ইউরোপের আর্মেনিয়া যেখানে দাবা খেলা স্কুল থেকেই বাধ্যকতামূলক। দাবাড়ুরাই সেদেশের সবচেয়ে বড় তারকা। তার আগে আর্মেনিয়া দেশটি সম্পর্কে কিছু ধারণা নিয়ে নেই। আর্মেনিয়া পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। লোকসংখ্যা মাত্র ৩০ লাখ যার বেশির ভাগই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
দেশটির মুদ্রার নাম আর্মেনিয়ান ড্রাম। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ওই দেশটির মুদ্রার মান অনেক কম। আর্মেনিয়ান এক ড্রাম সমান বাংলাদেশের ২৮ পয়সার মতো। এটি একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। সবাই আর্মেনিয়া ভাষায় কথা বলে। তবে ইদানীং ইংরেজি ভাষার প্রচলনও বেড়েছে। ইয়েরেবান দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। দাবা দেশটির জাতীয় খেলা। এই দাবা খেলার পেছনে তারা প্রতি বছর ১৫ লাখ ডলার খরচ করে থাকে।
দাবা একদিকে যেমন কৌশলী হতে শেখায় অন্যদিকে মেধার বিকাশ ঘটায়। তাইতো দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করেন, ছোটবেলা থেকে দাবা খেললে শিশুরা একটি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের’ মধ্য দিয়ে যাবে যা ভবিষ্যতে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে কাজে দেবে। যে কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে শিশুটি একটা ভাবনার স্তর পার হবে, যা তাকে স্পষ্ট ধারণা পেতে সাহায্য করবে। আর্মেনিয়ায় এখন ৩ হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষিত দাবা শিক্ষক রয়েছেন।
এই দেশের দাবাড়ুরা আক্ষরিক অর্থেই বড় তারকা, গ্র্যান্ড মাস্টারদের জন্য বাড়তি সম্মান এবং শহরের বড় বড় স্ক্রিনে চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচগুলো দেখানো হয়, সাধারণ মানুষ ট্রাফিকে বসে বা কেবল দাবা খেলা দেখার উদ্দেশ্যেই সেসব স্ক্রিনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন, উত্তেজিত হন, প্রতিপক্ষকে হারাতে পারলে আনন্দ প্রকাশ করেন, বড় করে উদযাপন করেন সব জয়-যেটা সাধারণত দেখা যায় ফুটবল খেলা নিয়ে, তা দাবার ক্ষেত্রেও হয় আর্মেনিয়ায়।
দেশটির জনসংখ্যা খুবই কম তারপরও এই দেশ থেকে যেসব দাবাড়ু উঠে আসছেন তারা রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্রর মতো দেশের দাবাড়ুদের প্রায়ই হারাচ্ছেন। এমনকি তাদের জাতীয় দাবাড়ু দল ইন্টারন্যাশনাল চেস অলিম্পিয়াডে তিন তিনবার বিজয়ী হন।
এবার আরেকটি দেশের কথা বলবো যে দেশে এক অদ্ভুত ধরনের দাবা খেলা হয়ে থাকে। জীবন্ত মানুষকেই দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইতালির ভেনিস নগরীর নিকটবর্তী ছোট্ট একটি শহর নাম মারোসটিসা। এই শহরে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মানব দাবা খেলা প্রদর্শিত হয়। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী দাবা খেলা। কেউ কেউ একে চলনশীল দাবা অথবা জীবন্ত দাবাও বলে থাকে যেখানে মানুষ দাবার ঘুঁটির ভূমিকা পালন করে। মানব দাবা খেলাটি সাধারণত বহিরাঙ্গনে কোনো বড় মাঠে কৃত্রিম দাবাবোর্ডে হয়ে থাকে। এই মানব দাবা খেলার মাধ্যমে কিংবদন্তিতুল্য দাবা খেলার ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। তিন দিনব্যাপী এই মানব দাবার অনুষ্ঠান চলে। খেলার অংশগ্রহণকারীরা বিশেষ ধরনের ঐতিহাসিক পোশাক পরিধান করে থাকেন। এই খেলার জন্য দাবা কমিটির কিছু ধরাবাধা নিয়ম রয়েছে যা মেনে চলতে হয়।
ওই সময়টায় ছোট্ট শহর মারোসটিসায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানব দাবার প্রদর্শনীতে পর্যটকদের ঢল নামে। উপচে পড়া ভিড়, যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াস। গোটা শহরটা এক নতুন সাজে সজ্জিত হয়। জীবন একটাই তা তারা প্রাণভরে উপভোগ করে।
সামারের উজ্জ্বল ঝকঝকে দিনে, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে যখন ছুটির এক হালকা মেজাজ চলে, আবহাওয়ায় থাকে এক ফুরফুরে আরামদায়ক উত্তাপ- ঠিক সেই সময়ে ইউরোপের নানান শহরের পার্কে, স্কোয়ারে, খোলা জায়গায় প্রায়ই অতি পরিচিত এক দৃশ্য দেখা যায়- তাহলো দাবা খেলার মারপ্যাঁচ, চাল আর কুটবুদ্ধির কৌশল। পৃথিবীর নামি মানুষ- নেপোলিয়ন, রানী ভিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে চার্চিল এরা সবাই অবসর সময়ে নিজের বুদ্ধিকে শানিয়ে নিতে কাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা বাড়াতে দাবা নিয়ে বসে যেত।
দাবা একটি বৈশ্বিক খেলা যা সব পর্যায়েই খেলা যায়। মাত্র চার বছর বয়সি যে কেউ ১০৪ বছরের বয়স্ক মানুষের বিপক্ষে খেলতে পারে। কেউ একজন হয়তো হাঁটতে পারে না, তিনি শারীরিকভাবে শক্তিশালী কাউকে হারাতে পারেন। এর জন্য কোনো অতিরিক্ত পয়সাও খরচ করতে হয় না।
ব্রিটেনের খ্যাতনামা অধ্যাপক পিটার ডওভার্ন যিনি একজন দাবাড়ুও বটে, তার গবেষণাতে উঠে এসেছে দাবা খেললে আই-কিউ স্কোর বাড়ে এবং এটা শুধু চিন্তার গভীরতাই বৃদ্ধি করে না, স্মৃতি শক্তিও বৃদ্ধি করে। নাইজেরিয়ান বিজ্ঞানী অনাকোয়া মনে করেন, দাবা খেলা তাকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। এখন তিনি চেষ্টা করছেন নাইজেরিয়ায় তো বটেই আফ্রিকার অনেক সুবিধা বঞ্চিত জায়গায় দাবা খেলাটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে। তিনি আরো মনে করেন দাবা খেলাটি অনেক সস্তা তাই যে কোনো জায়গায় যে কোনো আয়ের মানুষ দাবা খেলতে পারে।
তবে মানুষের জীবন দাবার চালের চেয়েও অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত- দাবা খেলা মানুষকে জীবনের অসীম সম্ভাবনায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে, ভাবতে সাহায্য করে- আর তাই, এই সাদাকালো ছক কাটা নকশা ও বত্রিশটা ঘুঁটি, হাজার বছরের পথ অতিক্রম করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, ভাবায় ও গন্তব্যস্থলের পথ বাতলে দেয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়