গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

কমরেড : আবসার হাবীব > বড় গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কমরেড …

কমরেড ঘরে ঢুকেই বললেন, কেমন আছেন ফয়সল সাহেব।
কমরেডের পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী হাতা গোটানো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অতি সাধারণ একজন মানুষ। মনও তার নির্মল অমলিন পোশাকের মতোই। মানুষকে নিয়ে ভাবেন। গণ-মানসিকতা বিশ্লেষণ করেন। জাগরণের আলো ছড়ানোর জন্য ছুটছেন এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ও শহরে। শহর থেকে আবারো গ্রামে। মেহনতি মানুষের কাছে। ফয়সলের সঙ্গে কমরেডের কখন কীভাবে পরিচয়, তা তারও মনে পড়ছে না।
ফয়সল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ। সময়টা শোকার্ত। বিজয়ের উৎসবেও দেশ তখন ভাসছে। স্বজনহারা মানুষ কাঁদছে। যুদ্ধস্মৃতি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও জীবন-মরণ সময়ের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে দিতে চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। সহযোদ্ধা হারানোর দুঃখেও কাতর তারা। প্রিয় কোনো মুখ হারানোর বেদনায়ও হয় স্তব্ধ। স্বাধীনতার মর্মকথাও মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে এর পাশাপাশি।
কমরেড এদের দলের মানুষ। শহরে-গ্রামে শোষিত মানুষের স্বপ্নের স্বাধীনতার গল্প ছড়াতে ভালোবাসে। ‘জয় বাংলা’র যুগে লাল সালাম দিতে অভ্যস্ত মানুষ তিনি। একজন জাত কমরেড। সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত। তবে একসময় অবস্থার দাবি বুঝে স্বাধীনতার চারটি স্তম্ভ- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের চেতনায় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
কমরেডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আরেক কমরেড জলিল। মওলানা ভাসানীর রাজনীতি করতেন জলিল, কলেজের পড়ার সময়। একদিন বিকেলে কমরেডকে নিয়ে এসে বললেন, ফয়সল এই ভদ্রলোক কয়েক দিন আপনার আশ্রয়ে এখানে অবস্থান করবেন। শুধু এইটুকু বলেই জলিল বেরিয়ে গেলেন। এরকম অনেককেই তিনি ফয়সলের ঘরে এনে থাকতে দিয়ে গেছেন। জলিল ছিলেন ফয়সলের গৃহ-শিক্ষক। সেই সংস্পর্শে থাকার কালেই জলিলের রাজনীতির আদর্শে ফয়সলও ধীরে ধীরে অনুসারী হয়ে ওঠে। সাম্যবাদের দর্শনকে নিজের মধ্যে ধারণ করে। তখন থেকে ফয়সল ওই রাজনীতির একজন সমর্থক হয়ে যায়। একনিষ্ঠ সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই দেশগঠনে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়। তাদের মধ্যে একদল আদর্শের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির স্বপ্ন দেখে। আরেক দল হয় আদর্শচ্যুত লুটেরা লুম্পেন রাজনীতির ধারক-বাহকের অনুগত হয়ে দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। ক্রমশ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের মুক্তির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা। বঙ্গবন্ধু এদের নাম দিয়েছিলেন ‘চাটার দল’।
কমরেড ও তার সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করছিল মানুষের মুক্তির জন্য। কমরেড একজন মাঝ বয়সি মানুষ। ধীরে ধীরে ফয়সলের সঙ্গে একই রাজনৈতিক আদর্শের সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেই আদর্শে ফয়সল নিজেও জনগণের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখা- সেই থেকে শুরু হলো তারও। নিজের সেই আদর্শে ফয়সল অটল এখনো। তার কাছে এর কোনো বিকল্প নেই।
‘লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই।’ সেই ইতিহাসের হয়েছে করুণ পরিণতি। বাংলাদেশে সুবিধাবাদের বর্তমান পারস্পরিক সংঘাত দেখে যেতে পারেননি কমরেড। ফয়সল এখন সব দেখছে আর অন্তর্জালায় কখনো কখনো হতাশ হয়ে পড়ছে। আদর্শ যে এখনো তাকে তাড়া করে চলছে। ব্যর্থতা নিজেদের। তাই নিজের উপরই সে কখনো কখনো ক্ষোভ প্রকাশ করে। অথচ কিছু করার নেই।

কমরেড পার্টির রাজনৈতিক বৈঠকে প্রায়ই সমাজ বিশ্লেষণে বর্তমান বিরুদ্ধ সময়, স্বাধীনতার পরবর্তী লুটেরা সংস্কৃতি, ভোগবাদিতা- এসব নিয়ে বিতর্ক শুরু করতেন। বৈঠকে ব্যাখ্যা করতেন। সুবিধাবাদীরা ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে কীভাবে দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। স্বাধীনতোত্তরকালে তখন একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র-জনতা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কেউ লেনিন-স্টালিন, কেউ মাও সেতুং, চৌ এন লাই, কেউ চে-গুয়েভারা ও হো চি মিন আদর্শের পাঠ নিতে শুরু করেছে। কেউবা আবারও পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের খতমের রাজনীতির আদর্শে শ্রেণিশত্রæ খতমের ধ্যান-ধারণার দীক্ষায় আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি শুরু করে। কমরেড ছিল চারু মজুমদারের আদর্শে দীক্ষিত। প্রবীণে-নবীনে মিলে তাদের একটি গ্রুপ নিজেদের বিশ্বাস অনুসারে একটি দলীয় বিশ্বাসের তলে সমবেত হয়। মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখে।
ফয়সল সেই দলেরই একজন সাধারণ সমর্থক। শহরে ফয়সলের ঘরটি তাদের গোপন আস্তানা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ফয়সলরা ছিল তার সমবয়সি আরও আট-দশজনকে নিয়ে মোটামুটিভাবে একটি সংঘবদ্ধ দল। তারা গ্রামের পাশাপাশি শহরেও এই খতমের রাজনীতির আদর্শে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেই তারা একটি শক্ত ঘাঁটি বা আস্থার জায়গা তৈরি করেছিল। বিশেষ করে নদীর পাড়ের ঘাট শ্রমিক এবং রেলের ও বন্দরের শ্রমিক-মজদুরদের মধ্যে। নির্মাণ শ্রমিকদের মাঝেও সংগঠন গড়ে তোলার যোগাযোগ তৈরি হয়। কমরেডের নির্দেশিত পথে চা-বাগানের শ্রমিক, চায়ের দোকানের শ্রমিকদের মধ্যেও সংগঠনের শাখা গঠনের কাজ এগিয়ে গিয়েছিল।
জাহিদুল …
ঘাট শ্রমিকের নেতৃত্বে ছিল জাহিদুল। আজকাল বদলে গেছে সেই ঘাট শ্রমিকদের নেতৃত্ব। এখন তাদের নেতৃত্বে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনী ও টাউটগণ। ঘাট শ্রমিকদের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব নিয়ে একসময় বিভক্তি দেখা দেয়। ধনিক শ্রেণির খপ্পরে পড়ে কয়েকজন শ্রমিক দালালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সুবিধাবাদী ও শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা নেয়। ওদের সংগঠনের নানা খবর পাচার করে দিতে থাকে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা সংগঠনের ধ্বংস অনিবার্য করে তোলে। এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে ক্ষমতা দখল ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ের লড়াই মুখ থুবড়ে পড়ে। সংগঠনকে এরূপ পতন থেকে বের করে আনার পথ খুঁজতে থাকে জাহিদুল। আলোহীন অন্ধকারে পথে চলছিল তার ঘুরপাক আর ঘুরপাক।
জনগণ একবার যদি আস্তাহীনতায় বিশ্বাস হারিয়ে কোনো রাজনীতি থেকে সরে যায়, তাদের আবারও সেই রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। এর সুযোগ নেয় উঠতি ধনিক শ্রেণির লুটেরাগণ। এরা স্বাধীনতার পরপরই লুটপাটের পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক জান্তার পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্ত-বৈভবে ও ক্ষমতায় দ্রুত প্রসার লাভ করে। তারপরের ইতিহাস হলো সামরিক জান্তা সরকারের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া। স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন ঘটে এতে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দলবদলের খেলারও শুরু। আর চলতে থাকে অগাধ টাকা-পয়সার লেনদেন। মৌলবাদের উত্থান। লুটেরাগণ ধর্মকে পুঁজি করে হয়ে পড়ে ক্ষমতার মসনদে অনুপ্রেবেশকারী। মন্ত্রিত্বের টোপ পেয়ে নানা দলগঠন। নতুন মোড়কে নিজেদের দেশপ্রেমিক সাচ্চা নাগরিক হিসেবে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা দখল করে ফটকাবাজি রাজনীতির চলচাতুরী। একশ্রেণির ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক নেতা এর সুযোগ নেয়। সর্বক্ষেত্রে সুবিধাবাদী শ্রেণির অনুপ্রবেশ সৎ রাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কঠিন করে তোলে। এই ধরনের পরিস্থিতির মুখে জাহিদুলরা চলমান স্রোতের বিরুদ্ধে নিজেদের সুসংগঠিত করার জন্য আদর্শবান তরুণদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার সংগ্রামও শুরু করে।
জাহিদুল দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে ঘাট শ্রমিকদের একটি শক্ত সংগঠন গড়ে তুলেছিল। সহযোগী ছিল আব্বাস, আলম, স্বপন গায়েন, খোরশেদ। ধীরে ধীরে ঘাট শ্রমিক সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মীরা নিজেদের দাবি-দাওয়া, মজুরির টাকা যথাসময়ে দেয়া, প্রতিদিনের মজুরি প্রতিদিন দেয়ার জন্য আন্দোলন গলে তোলে এবং এতে সাফল্যও পায়। জাহিদুল নিজে কলেজের ছাত্র। বন্দর এলাকায় বসবাস, নিজ বাড়ির পরিচিতি ও প্রভাব সব মিলিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব সমস্যা জাহিদুলের কাছে তুলে ধরে। দীর্ঘ আলোচনার পর কোনো একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে সিদ্ধান্তও হয়। তাতে জাহিদুল তার ভালো দিক, মন্দ দিক নিয়ে মতামত দিয়ে তাদের সহযোগিতা করে। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে।
শ্রমিকদের মধ্যে খোরশেদ একটু লিখতে ও পড়তে জানে। সেও মাঝেমধ্যে এসব ব্যাপারে শ্রমিক শ্রেণিকে সহযোগিতা করে। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত খোরশেদ শ্রমিকদের পড়ে শোনাতো এবং অগ্রণী ভূমিকা রাখতো। ফলে শ্রমিকদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে এবং নেতৃত্ব তার হাতে উঠে আসে। জাহিদুলের অনুপস্থিতিতে খোরশেদ সভা পরিচালনা করে এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিয়ে বসে। জাহিদুল অন্যান্য সাংগঠনিক কারণে নিয়মিত সভায় উপস্থিত হতে না পারায় জাহিদুলের উপর শ্রমিকদের নির্ভরশীলতা কমে আসে। খোরশেদও সুযোগটা কৌশলে কাজে লাগায়। শ্রমিকদের উপর পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন সভার খরচ, লিফলেট ছাপা, যাতায়াত ভাতার কথা বলে চাঁদা তোলা শুরু করে। ঢুকে পড়ে অর্থলোভ। ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলো সাধারণত সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
একদিন জাহিদুলের অনুপস্থিতিতে একক এবং অনেকটা খোরশেদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তে ঘাট শ্রমিকগণ ধর্মঘট ডেকে বসে। তখন ছোট-বড় জাহাজ ও বোটের মালিকরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তারা শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবে না। হঠাৎ ধর্মঘট ডাকা এবং পরিকল্পিত সংঘঠিত ধর্মঘট না-ডাকার ফলে শ্রমিকরা বেকায়দায় পড়ে যায়। তখনই মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ শুরু করে কৌশলে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে, তাদের অভাবের সুযোগ নিয়ে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে। কোনো হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে কখনো কখনো কোনো সংগঠন যে দুর্বল হয়ে পড়ে, তার প্রকৃত উদাহরণ ঘাট শ্রমিক সংগঠনটির ধর্মঘট।
মূল সংগঠনের আলোচনা বৈঠকে এটি একটি উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে। নেতৃত্বের স্বেচ্ছা সিদ্ধান্তে আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে নেতৃত্ব হারানো। নেতা আসলে সেই ভাবে তৈরি করতে হয় না। একজন শ্রমিক যদি তার স্বার্থ দ্ব›দ্ব বুঝে, তাহলে সে নিজ স্বার্থে একটি পরিকল্পিত আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সংগঠন হবে ইস্পাত দৃঢ়। কখনো ভাঙবে না। পার্টি সিদ্ধান্ত দেয় জাহিদুলের সঙ্গে ফয়সলও ঘাট শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করবে। আগামী পার্টি বৈঠকে এ সংগঠনের ব্যাপারে দুইজনে মিলে একটি রিপোর্ট দেবে- ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে। হতাশার মধ্যে আলোর পথ খোঁজাই একজন রাজনৈতিক কর্মীর দূরদৃষ্টির পরিচয় বহন করে। নেতৃত্বে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। এর অন্যথায়, ব্যর্থতার আগুনে পুড়ে সংগঠন ও নেতৃত্ব শেষ হয়ে যায়।

ফয়সল হায়দার …
ফয়সল হায়দার, পরিবারের অবস্থান আর অন্য সবকিছু মিলিয়ে পলায়নবাদী মানসিকতা তাকে বারবার বিবেক ও জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তার রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্বাসে কোনো চিড় ধরাতে পারেনি।
উত্তর তার একটাই, আমাকে আগে নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রিত করার একটি সত্তার উপর দাঁড় করাতে হবে।
সেখানেও সময় ও সুযোগকে কাজে লাগানোর বিষয়টা তার কাছে এসে যায়। নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অন্যকে না ঠকিয়ে নিজের মধ্যে একটা আলোর মিছিল তৈরি করতে চেয়েছে ফয়সল।
ফয়সল পার্টির সভায় বলে, যে কোনো দলের জেলা বা স্থানীয় কমিটি গড়তে গেলে সকল শ্রেণির স্বার্থচিন্তার মানুষের প্রতিনিধি থাকা দরকার। আমাদের পার্টি খতমের রাজনীতি করে, কিন্তু সাধারণ গণতান্ত্রিক পার্টির মতো কমিটি করলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।
কমরেড জলিল বলেন, একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতো আমাদের কাছে।
ফয়সল বলে, একটি শহরে হোক আর কেন্দ্রীয় কমিটিতে হোক- একটি গণতান্ত্রিক পার্টির কমিটিতে দেখা যায় একসময় ছাত্র-রাজনীতি করতো, সে এখন জাতীয় রাজনৈতিক দলের সদস্য। বর্তমান সময়ের কোনো ছাত্র প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলগুলোতে নেই। শ্রমিক শ্রেণির ক্ষেত্রেও তাই। সত্যিকারের একজন শ্রমিক কি বাংলাদেশের কোনো ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছে? স্বাধীনতার আগে ও পরে শ্রমিক সংগঠনের নেতা হতো সাধারণত একজন শ্রমিক। বর্তমানের শ্রমিক নেতা হয় এখন একজন প্রতিষ্ঠিত ও উঠতি ব্যবসায়ী, পুঁজির মালিক। তাই শ্রমিক রাজনীতিতে এসব রাজনৈতিক নেতাদের কর্তৃত্ব শতভাগ শ্রমিকবান্ধব হতে পারে না।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব সত্যিকারে একজন কৃষক কিংবা একজন শ্রমিক পাওয়া যাবে না। এখন খোদ কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সমিতিও গঠন করে একশ্রেণির সুবিধাবাদী শ্রেণি। এই বিষয়গুলো আমাকে খুব পীড়া দেয়। সংকটের চরিত্রটা পরিষ্কার হওয়া দরকার প্রতিটি কর্মীর। একসময় ছাত্রনেতা কারখানায় চাকরি নিয়ে শ্রমিক রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। কেউ কেউ কৃষকদের স্বার্থে গ্রামে অবস্থান করে কৃষকের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছে। এই চিত্রটি বহুলাংশে পালটে গেছে।
বর্তমান সংসদ সদস্য কারা আমরা সবাই জানি। এখন একজন সাংসদও পাওয়া যাবে না, যাদের কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক কিংবা স্কুল শিক্ষক। হয়তো এমন দুয়েকজন পাওয়া যাবে যাদের কেউ একসময় কৃষক সংগঠন বা শ্রমিক সংগঠন করতো। ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শ্রেণিচরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এখন তারা আর ওই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে না। এখন প্রতিনিধিত্ব করে ধনিক শ্রেণির। অবশ্য তারা এখন সংসদে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দেয়, পার্টি প্রধানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করে। বিরোধী দলকে কদর্য ভাষায় গালি দিয়ে বাহবা কুড়ায়। হাততালি আর টেবিলে চাপড়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে। পার্টি প্রধানও মুচকি হাসে। বিরোধী দলের প্রতিনিধিরাও একই ভাবে নিজেদের কোনো নেতা বন্দি থাকলে কিংবা মিথ্যা মামলায় পালিয়ে বেড়ালে তাদের মুক্তির দাবি করে। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষকদের কথা প্রবলভাবে বলা হয় না।
আমার বক্তব্য স্পষ্ট। সকল শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করার মতো লোক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করলেই হয়তো সাফল্য আসতে পারে। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে এটা একটা অবাস্তব চিন্তা।
নির্মাণ শ্রমিকদের দায়িত্বে থাকা মনোয়ার বলে, এটা সম্ভব। তবে কঠিনও বটে। তাদের রাজনৈতিক অ আ ক খ শিখাতে হবে। শ্রেণিস্বার্থ কাকে বলে, শ্রমিক স্বার্থ কি- তা তাদের অনুধাবন করতে দেয়া দরকার। রাজনীতিতে আদর্শ নিয়েও ভাবতে হবে। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ হারানো এবং বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকিতেও যাওয়া যাবে না। এখন ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। আমরা জানি প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত লড়তে হলে প্রচুর টাকা-পয়সা দরকার। চাঁদা নির্ভর পার্টি শ্রমিকদের পক্ষে এভাবে লড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এখন এমন একটা সমাজব্যবস্থা ও ক্ষমতা-কাঠামোর ভেতর দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির আলো খুঁজতে যাওয়া তত সহজ নয়। তাদের শ্রেণিস্বার্থ এবং শ্রেণিদ্ব›েদ্বর রাজনীতি সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির কাছে তুলে ধরা, তাদের স্বার্থটা কোথায় বুঝতে দেয়া- খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের সহজ ভাষায় মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়ার লড়াইটা বোঝাতে হবে।
প্রাক্তন ছাত্রনেতা জলিল বলেন, এতো চিন্তা করে পার্টির এগোনো কঠিন। তবে এটা ঠিক ফয়সল আর মনোয়ারের কথাগুলো মাথায় নিয়ে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধিকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। যাতে নিজেরা সংগঠনকে আরো আপন করে নিতে পারে। আর যথেষ্ট সময় দেবে সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
দেখেন, ঊনসত্তরে গণআন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ছাত্রদের হাতে, নেতৃত্ব ছিল ছাত্রদের হাতে। ছাত্রদের ১১ দফা ছিল এই আন্দোলনের মূল শক্তি। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরে আসাদের মৃত্যু পর পুরো ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বদলে যায় জাতীয় রাজনীতিতে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সাধারণ মানুষের ভেতর ক্ষোভ ছিল। দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, নির্যাতনে তা একেবারে সামনে চলে আসে। ২৪ জানুয়ারি কিশোর ছাত্র মতিউরের মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বাঙালির জাতিসত্তা একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিসহ সব রাজনীতিবিদের মুক্তির দাবি উঠে।
কমরেড বলেন, জলিল সেই আন্দোলনের একজন ছাত্রনেতা। আমি বলতে চাই, শহীদ আসাদের মৃত্যুতেও ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে আন্দোলন যৌক্তিকভাবে স্বাধীনতার দিকে এগিয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তর হচ্ছে আলোর পথের লালমশাল। স্বাধীনতার পথ-প্রদর্শক। যে আলোয় রাজনৈতিক নেতারা আজ ¤øান করছে। নিজেদের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে দাবি করছে। এই সংগ্রাম ছিল ছাত্র-জনতা-মেহনতি মানুষের।
এখনো ছাত্র-শ্রমিক-কৃষককে সংগঠিত করা যাবে। ছাত্রনেতা ও কৃষকনেতা আসাদের কথা কেন বললাম পরে ব্যাখ্যা করব। আগে ২০ জানুয়ারি প্রেক্ষাপট এবং তৎকালীন রাজনীতি কথা একটু বলি। মওলানা ভাসানী মাঠে-ময়দানে দাপিয়ে বেড়াছেন শ্রমিক-কৃষকের বাংলার মুক্তি নিয়ে। শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেনি। ১৯৬৬ সনের ৬ দফা দাবি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়ে তিনি জেলে। আদালতে মামলা চলছে। ছাত্ররাই তাদের ছাত্র আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনে পরিণত করলো। শহীদ আসাদের মৃত্যু এবং তৎকালীন ছাত্রনেতাদের একতা এই আন্দোলনের বড়ো শক্তি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নেতৃত্ব বহন করে। স্বাধীনতার কথাই ভাবতে শুরু করে।
শহীদ আসাদ প্রসঙ্গ আসার সঙ্গে সঙ্গে কমরেড বলেন, এই আসাদ কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। আমি একটু শহীদ আসাদের গড়ে ওঠার পেছনের রাজনীতির কথা বলি। আসাদের চিন্তা ও চেতনায় ছিল গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলা এবং কৃষকদের অধিকার নিয়ে একটি রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলা। যা ছিল, আসাদের ধ্যান এবং আদর্শ। সে তার নিজ গ্রাম থেকেই সেই কৃষক আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ শুরু করেছিল। একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে। আসাদুজ্জামান একজন কৃষক নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিল। গ্রাম ও শহরে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে একটি সুন্দর জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখার নায়ক আসাদুজ্জামান।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বরে গ্রামের হাট-বাজারে হরতাল পালনের আহ্বান জানালে আসাদুজ্জামান তার হাতিরদিয়ায় আন্দোলন ও হরতাল সফল করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। হাটে-বাজারের এই হরতালে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে গুলি চালায়। এই সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুস সালাম, কৃষক হাসান আলী, চেরাগ আলী ও মিয়া চান নিহত হন। আসাদও আহত হন এই সংঘর্ষে। এই খবর ব্যাপকতা পায় যখন আসাদ আহত অবস্থায় ঢাকা পৌঁছে এই সংঘর্ষের ঘটনা তুলে ধরে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পরদিন এই সংবাদ ছাপা হলে হাতিরদিয়ার এই হত্যাকাণ্ড সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলে। গ্রামগঞ্জেও এই আন্দোলনের ঢেউ লাগে।
কমরেড বলেন, চারুবাবুরা সত্তর দশকে যেভাবে গণসংঠন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং আন্ডারগ্রাউন্ড চলে যায়, গোপনে শ্রেণিশত্রæ খতমের রাজনীতি জোরদার করতে থাকে, বাংলাদেশে কিন্তু একাত্তরের আগে থেকেই গোপন রাজনীতির তৎপরতা ছিল, বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক সংগঠনও ছিল। শ্রেণিশত্রæ খতমের রাজনীতি শুরুর পরপরই দ্বিমত ও তৃতীয় মত করতে করতে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যবাদের দুই কুকুরের লড়াই এই বিতর্কের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। কেউ কেউ দেশের মধ্যে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আশ্রয়দান, খাবার-দাবারের জোগান, পাক আর্মির অবস্থান- এসব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে উঠে। ভূমিকা রাখে। তাদের কোনোভাবেই মূল্যায়নে না নেওয়ায়, কেউ কেউ আবার সংগঠনের হাল ধরে এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় এই সংগঠন এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
জলিল বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী প্রত্যাশায় আলোর চেয়ে অন্ধকারে যাত্রার ঘটনাবলি সচেতন মানুষের সামনে চলে আসে। মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল। লুটেরার স্বাধীনতা নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এ কথা কোনো এক জনসভায় কিংবা পার্টির সভায় সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন। কার কথা কে শোনে। ভেতরে ভেতরে সুবিধাবাদের ডালপালা বিস্তার লাভ করে। নব্যধনিক শ্রেণি নানাভাবে সংগঠনকে ব্যবহার করে নিজের আখের গুছাতে থাকে। এই অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিরোধী একটি শক্তি সংগঠিত হতে থাকে। তারই ফসল ঘরে তোলে সামরিক জান্তা। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। দেশে নেমে আসে ঘোর এক অন্ধকার সময়।
ফয়সল বলে, সামরিক জান্তা সরকারে আশ্রয় পেয়েছে বর্ণচোরা সুবিধাবাদী আওয়ামী নেতাসহ বিভিন্ন পার্টির কর্মীরা। বিশেষ করে মৌলবাদী সংগঠনের নেতা ও এতদিন আত্মগোপন করে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী দালাল শ্রেণি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের ফসল স্বাধীনতা। কিন্তু সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের মুক্তি রয়ে গেল অন্ধকারে। মুক্তির সুবর্ণ সুযোগটা আমরা সবাই নষ্ট করেছি। শুধু আমরা নই, ক্ষমতাসীন পার্টিও। যদিও তাদের পার্টি এই মুক্তির জন্য চিন্তা করেছে, কিন্তু মুক্তির রোডম্যাপ তৈরি করতে পারেনি।

কমরেড কমরুদ্দী …
ফটিকছড়ির রাঙাপানি চা বাগান এবং পাহাড়ি ঢালু জমির কৃষকরা সংগঠিত হয় কমরেড কমরুদ্দীর নেতৃত্বে। চারুবাবুরা যেভাবে কৃষকদের সংগঠিত করে বিভিন্ন কমিটি করে তা এখানেও গড়ে উঠে। কিন্তু লাঙল যার জমি তার- সেøাগানের আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা অনুযায়ীও সামান্য জমিও কৃষকরা লিজ নিতে পারেনি। খাসজমি, জলাশয়, মাছের ঘের কিছুই নিতে পারেনি। সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর এসব বন্দোবস্তি নেওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষি-মৎস্য অধিদপ্তর, উপজেলা নির্বাহী অফিসের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকদের বন্দোবস্তি দিয়ে নিজেরাও নিজেদের আখের ঘোচাতে থাকে।
কৃষক ও জেলেরা সম্মিলিতভাবে বন্দোবস্তির আবেদন করে সমিতির নামে। তখন বলা হয়, সমিতির রেজিস্ট্রেশন লাগবে। রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে বলে- এখন তো বন্দোবস্তি দেয়া শেষ। কমরেড কমরুদ্দী এসব কথা এক নাগারে বলে হতাশার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবং বলে, আমাদের কোথাও হয়তো ভুল হচ্ছে। ভুল হলে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। হয়তো- খতমের রাজনীতি তীব্র করতে হবে। অথবা এদের সঙ্গে বোঝাপোড়া করতে হবে, তাহলে হয়তো কৃষক ও জেলেরা কিছু বন্দোবস্তি পেতে পারে।
নোয়াখালীর ল²ীপুরে মেঘনা নদীতে জলমহাল-ঘের বন্দোবস্তি নিতো একজন ব্যক্তি। এলাকায় সে, নুর মিয়া নামে পরিচিত। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সে দলের আপন লোক হয়ে যায়। চাঁদা দেয়, সভায় লোকজন দিয়ে সহায়তা করে। নুর মিয়া ধীরে ধীরে প্রশাসনেরও আপন লোক হয়ে উঠে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও ভেতরে ভেতরে খেপে উঠে। জেলেদের ভেতরে ভেতরে সংগঠিত করতে থাকে। জেলেরা যেন তাদের আন্দোলন জোরদার করে নুর মিয়ার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় হাটে জেলেদের এক জনসভায় এসে জেলা প্রশাসক নুর মিয়াকে পাশে বসায়। জেলেদের স্বার্থে নানা কথা বলার পর, বলে- এই এলাকার জেলেদের স্বার্থেই নুর মিয়া কাজ করছে, আপনারা তাকে সহযোগিতা করবেন। আপনাদের দাবিগুলো সে আমার কাছে তুলে ধরেছে। আমরা বিবেচনা করে দেখছি। এভাবে জেলেদের নানা প্রতিশ্রæতি দিয়ে চলে যায়। সভায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও বক্তব্য রাখে।
কিছুদিন পর দেখা যায়, বিভিন্ন জলাশয় ও ঘেরে নুর মিয়ার নামে সাইনবোর্ড। এসব জলাশয়ে মাছ ধরা, মাছের চাষ করার একমাত্র অধিকার নুর মিয়ার। এসব দেখে জেলে এবং স্থানীয় কৃষকরা সংগঠিত হতে থাকে কমরেড কমরুদ্দীর নেতৃত্বে।
প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ নেই। প্রতিক্রিয়া নেই। নুর মিয়ার চেলা-চামুন্ডারাও খুব খুশি। নুর মিয়াও যখন যেখানে ইচ্ছে ঘুরে ঘুরে ঘের দেখে। মাছের লাফালাফি দেখে খুশিতে মনও তার নেচে উঠে। এর মধ্যে একরাতে জেলে ও স্থানীয়রা মিলে একটি ঘেরের সব মাছ লুট করে নেয়। থানা-পুলিশ করে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। স্থানীয় পার্টির লোকজন গা ঢাকা দেয়। সাধারণ মানুষকে সামনে এগিয়ে দেয়। অনেক সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় নুর মিয়ার সঙ্গে। বোঝাপড়ার এক বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়। নুর মিয়ার হয়তো এটাই ছিল তার জীবনের শেষ দিন।
দুপুরের পরে বৈঠক বসে। নানা আলাপ-আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় নুর মিয়া নিজেই সেসব কাগজপত্র তৈরি করে জেলেদের বন্দোবস্তি দেবে। ফের এসব নিয়ে আবার বৈঠক বসবে। নুর মিয়া যে শর্ত দেয় জেলেদের ও স্থানীয়দের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শর্তগুলোর একটি হলো, জেলেদের নামে বন্দোবস্তি নিয়ে নুরু মিয়া সে জলাশয়ে মাছ চাষ করবে। জেলেরা নয়। জেলেরা নুরু মিয়ার ধার্য করা দামে মাছ কিনে বাজারে-আড়তে বিক্রি করবে। এ শর্তে জেলেরা ও স্থানীয় কৃষকরা রাজি হয়নি। নুর মিয়া রেগেমেগে সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সভাস্থল থেকে চলে যায়। এতে জেলেদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই বিরোধের সুযোগে নেতারা জেলেদের সংগঠিত করে। খতমের রাজনীতির এটা মোক্ষম সময় বলে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। গোপনে নিজেদের মধ্যে তা ভেতরে ভেতরে লালন করতে থাকে। বিরোধে একটা শীতলতা দেখা দিলে নুর মিয়াও মনে করে তার জয় হয়েছে। খুব খুশি।
এক সন্ধ্যায় হাট থেকে নুর মিয়া একা ফেরার পথে তাকে ধরে নিয়ে পরিত্যক্ত একটি ইটভাটায় হত্যা করা হয়। এরপর পুলিশ আসে। অনেককে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু, সত্যিকারের পার্টি কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। খতমে অংশগ্রহণ করা কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায়, কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিতে পারেনি। এলাকায় পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথার মধ্যে পার্টির কর্মীরা ধীরে ধীরে গ্রেপ্তার হওয়া জেলে ও কৃষকদের জামিনের আবেদন করায়। মুক্তি লাভ করায়, পার্টির কর্মীদের মধ্যে এতে স্বস্তি ফিরে আসে। রিমান্ডে ওদের কাছ থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায়, সাক্ষীও পাওয়া যায়নি। মামলার চার্জশিটও দেয়া যায়নি। এর মধ্যে আগের জেলা প্রশাসকও বদলি হয়েছে তার অপকর্ম ও বদনামের কারণে।
একজন কর্মী বলেন, এদেশের খতমের রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। আমার কাছে মনে হয় গোপন রাজনীতি লিফলেট বিলির মধ্যেই কেমন জানি স্থির হয়ে যায়। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয়। এসব পার্টিকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কীভাবে ব্যাপক জনগণকে পার্টি সঙ্গে একটা বন্ধনে তৈরি করা যায়, অংশগ্রহণও জোরদার করা যায় সে পদক্ষেপের দরকার আছে। খতমের রাজনীতিতে হয়তো এরকম দুয়েকটি উদাহরণ তৈরি করা যায় মাত্র। তবে তাতে, মানুষের মুক্তি আসবে না।
কমরেড কমরুদ্দী বলেন, এটা আমাদের ভাবতে হবে অবশ্যই কিন্তু পাশাপাশি এই ধরনের দুয়েকটি উদাহরণ, স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত হতে সাহস জোগাবে। আমরা বিশ্বাস করি সংগঠন শক্তিশালী হলে জনগণের মধ্যে ঐক্য আরো সুদৃঢ় হবে। আমরা সম্মিলিতভাবে জলাশয় বন্দোবস্তি নিতে পারবো। বিজয় অর্জন হবেই।

বিশেষ সভা …
বিশেষ সভায় চারু মজুমদারকে উদ্ধৃত করে ফয়সল বলেন, সত্তর দশক মুক্তির দশক। কিন্তু বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন দেশ, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে এই স্বাধীনতা। মানুষ আবেগে আপ্লæত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারী। তার একটি ঘোষণায় পুরো জাতি একসুতোয় গাঁথা একটি মালা হয়ে যায়। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এই আবেগকে পাশ কাটিয়ে সত্যিকারে নিরন্ন মানুষের মুক্তির সংগ্রামের পথ তৈরি করতে হলে আরো ভাবনা, আরো কৌশলী হতে হবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বা চীন-রাশিয়ার পথ ধরে এই যুগে মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়া কঠিন। নকশালবাড়ির পথ ধরে আমাদের এগোতে হলে রেজিম্যান্ট বাহিনী তৈরি করতে হয়, এখন এই দেশে এটা সম্ভব নয়।
ফয়সলের এই বক্তব্যের পর বৈঠকে প্রচণ্ড বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তাহলে মুক্তির পথ কোনটি সেই প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। তাতে বলা হয়, এ নিয়ে আরো আলোচনা দরকার এবং বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নেওয়া দরকার। সংগঠনের অবস্থা এবং এলাকায় এর প্রভাব এবং জনগণের পার্টির প্রতি আস্থার দিকও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
এ সময় কমরেড বলেন, পার্টির এই আদর্শিক দ্ব›েদ্বর কথা বলতে বলতে পার্টি কোনো পেটি বুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হচ্ছে কিনা, সেটা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। বৈঠকি আলোচনায় পার্টির দ্ব›দ্ব ও লাইনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। বাংলাদেশের যত পার্টি আছে- ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বলে দাবি করে। ১৯২০ সালে ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় স্বদেশ থেকে বহুদূরে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে। তাদেরই অনুসারী কিছু উচ্চশিক্ষিত বিপ্লবীর সমন্বয়ে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি এদেশের আদিরূপ বলে দাবি করে। বাংলাদেশেও এ ধারায় প্রতিষ্ঠিত পার্টির সংখ্যাও কম নয়। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশেও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভারত ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নিজেরাই কৃষক-শ্রমিক এবং দরিদ্র-মধ্যবিত্তের মানসিকতা, চাওয়া-পাওয়া এবং মুক্তির আকাক্সক্ষার মশাল তুলতে পারেনি। তাই আজো পথের মাঝে পথ হারিয়ে পরস্পর রক্ত ঝরাচ্ছে। জনতার মুক্তি একদিন আসবেই। বহুধারায় বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তাই দাবি করে এবং এখনো মনে করে। আমাদের পার্টি মনে করে তারা সঠিক লাইন ও পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফয়সলের বক্তব্য, সব পার্টির একই প্রবণতা। পুরোনা কাসুন্দি ঘেঁটে নিজেদের ভেতর একটি অন্তর্দ্ব›দ্ব তৈরি করে। বিশেষ করে, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে জনতার মুক্তির লড়াইকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারা। পারলে হয়তো আমরা এখন ক্ষমতাসীন থাকতাম। আবার, কোনো কোনো পার্টি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে সরকারের ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে। তবে মানুষের মুক্তির, তথা অর্থনৈতিক-সামাজিক-অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার দাবিকে জোরদার করতে না পারা- আজকের দিনে এসে সব কমিউনিস্ট পার্টি স্বীকার করে। তাই চাই, মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য কাজ। নতুন চিন্তা এবং পথের সন্ধান করে এক হতে পারলে ছাত্র-জনতা-কৃষক সেই পতাকা তলে সমবেত হতে সাহসী হয়ে উঠবে এবং লড়াই করবে। কিছু লক্ষণ এখন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সেই আলোর রশ্মিকে মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দিতে পারেনি, তাদের নেতৃত্বের অহংকারী অবস্থান ধরে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত থাকায়।
চা শ্রমিকনেতা বেলাল তার বক্তব্যে ফয়সলকে সমর্থন দিয়ে বলেন, ফয়সলের সঙ্গে সব ব্যাপারে একমত নই, তবে বামপন্থি বা কমিউনিস্টরা ঠিক মতো মানুষের ভেতরের ক্ষোভ এবং আগুনকে উসকে দিতে পারেনি বলে পাতি-বুর্জোয়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল এবং সামরিক জান্তা সৃষ্ট দলগুলো মানুষের অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে দলের ভাঙনের পথে এগিয়ে যায়। এই সুযোগে শ্রমিক আর কৃষক-সমাজকে বিভ্রান্ত করে। এসব কারণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পার্টিগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
সামরিক সরকারগুলো আরেকটি বড় কাজ করে। তা হলো, পাকিস্তানপন্থি দালাল শ্রেণি, কিছু কিছু কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক এবং মৌলবাদী সমর্থকদের ব্যাপক হারে সরকারের অংশীদার করে নেওয়া। মৌলবাদীরা কখনো চিন্তা করেনি, এভাবে তারা ক্ষমতার অংশ হয়ে যাবে। কখনো কখনো তথাকথিত গণতান্ত্রিক পার্টিগুলোও মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলে জনগণের অধিকার আদায়ের কথা বলতে থাকে। এই সুযোগে মৌলবাদী সংগঠনগুলো একটি শক্ত অবস্থানে চলে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও দালালরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতি হিসেবে দুর্ভাগ্য আমাদের। পরবর্তী সময়ে সাধারণ ছাত্র-জনতার জাগরণ থেকেই সামরিক জান্তার পতন ঘটে এবং মৌলবাদী সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পালাবদলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাকিস্তানি দালালদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারে দালাল আইনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং কার্যকরও করা হয়।
এখন দেখা যায়, অন্য এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্থান। গণতান্ত্রিক জাগরণে জমজমাট ভোটের রাজনীতি জনগণের স্বার্থচিন্তা থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই দূরে সরে গিয়ে পোষে পেটুয়া বাহিনী। মাস্তান, আমলা, প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে তোলে। কমিউনিস্ট পার্টির কোনো অংশই শেষ পর্যন্ত ভোটের রাজনীতি বা শ্রেণিশত্রæ খতমের রাজনীতি বা সমাজবাদী সমাজব্যবস্থাকে মানুষের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। এই না পারার ব্যর্থতা আজও পার্টির নিষ্ঠাবান কর্মীদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এর থেকে বেরুতে পারলেই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে। শুধু আমি নই, আমরা সকলেই বিশ্বাস করি বলে আজো কাজ করে যাচ্ছি। খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির জন্য।

জলিল চৌধুরী …
জলিল চৌধুরী, যার হাত ধরেই ফয়সলসহ কয়েকজন তরুণের রাজনীতিতে প্রবেশ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের রাজনৈতিক চর্চার দীক্ষা। মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখা। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে শোষণের কৌশল এবং রাজনৈতিক রণকৌশলের চমৎকার বিশ্লেষণ করতেন কমরেড জলিল চৌধুরী। এই চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতির অ আ ক খ শেখা এই তরুণরা এখন শোষিত শ্রেণির মুক্তির শপথ নেয়া তারুণ্য। একসময় তারাও হতাশায় নিমজ্জিত হন। জলিল চৌধুরীর আদর্শে-বিশ্বাসে আলোকিত- ফয়সল, খোরশেদ, মনোয়ার, স্বপন গায়েনসহ অন্যরা যত দিন যাচ্ছে জলিল চৌধুরীর রাজনৈতিক আদর্শের স্খলন দেখে বিস্মিত হচ্ছে। তার কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে সুবিধাবাদের গন্ধ আঁচ করা গেছে।
জলিল চৌধুরী যতদিন সরকারি চাকরিতে ছিলেন দরিদ্র মানুষের সেবা, বিপদে বন্ধু হয়ে সহযোগিতা করেছেন। এসব দিয়ে কর্মীদের মুগ্ধ করে রাখতেন। আত্মীয়-স্বজনেরও উপকার করতেন। নিজ গ্রামের তরুণদের চাকরি দেয়া সবই সত্য এবং বিশ্বাসযোগ্য।
জলিল চৌধুরী হঠাৎ করে একদিন পার্টির সান্ধ্যকালীন বৈঠকে, পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়া পুরোনো একজন নেতার নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হতাশ হন। উপস্থিত সদস্যরা তাতে ধিক্কার জানায়। তখন জলিল চৌধুরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
ফয়সল বলেন, তিনি তো পচে যাওয়া এক আদর্শচ্যুত একজন মানুষ মাত্র। আমাদের কাছেও। বিশ্বাসঘাতকও বটে। আপনি এই নেতা পার্টিকে সহযোগিতা করতে চায় বলাতে আমরা মর্মাহত হয়েছি। ঘাট-শ্রমিকের করুণ পরিণতির জন্য এই নেতাই দায়ী। আমরা সরেজমিন তদন্ত করে তাই পেয়েছি।
খোরশেদ বলেন, আপনি উনাকে পার্টির ওয়েলউইসার বা পার্টির জন্য মোটা দাগের চাঁদা দেয়ার কথা বললেন। এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ আমাদের কর্মীদের ধরে ধরে জেলে দেয়, রিমান্ডের নামে টর্চার সেলে দিনের পর দিন মারধর করে। এসব কর্মীর মুক্তির জন্য কোনো সুপারিশ করতে পারেন না। দেশদ্রোহী কেস দেয়। বছরের পর বছর বিচারহীনতার সংস্কৃতির আড়ালে এখনো অনেক নেতাকর্মী জেলে পড়ে আছেন। এদের অনেকেই নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি।
জলিল চৌধুরী এক পর্যায়ে বলেন, চাঁদা ছাড়া তো পার্টি চালানো সম্ভব হবে না।
মনোয়ার তখন বলেন, অবশ্যই পার্টি চাঁদা সংগ্রহ করবে। তবে ক্ষমতাসীন পার্টির কারো কাছ থেকে নয়। পার্টিকে ভালোবাসে, শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির স্বপ্ন দেখেন, এমন কিছু নিবেদিত সাধারণ মানুষ এবং শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির চাঁদা বা সহযোগিতা নিয়ে পার্টি অতীতে চলেছে। আমার বিশ্বাস আগামী দিনগুলোতে চলতে পারবে। গণহারে সবার কাছ থেকে চাঁদা নিলে তথাকথিত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মতো চাঁদাবাজে পরিণত হতে হবে। মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করলে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।
জলিল চৌধুরী বলেন, আপনারা পার্টির নানান ফোরামে অনেক কথা বলেন, যা বাস্তব বর্জিত। আমি শুনি আর হাসি। আপনারা যে স্বপ্ন দেখেন তা বাস্তব বর্জিত। ক্ষমতার কাছাকাছি গেলেই দরিদ্র মানুষের সেবা করা যায়। মুক্তির আলো ছড়িয়ে দেয়া যায়।
ফয়সল বলেন, দেখেন তথাকথিত গণতান্ত্রিক ক্ষমতাসীন পার্টিগুলো আপনার মতো জনগণের ভাত-কাপড়ের গ্যারান্টি দিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন, ভোটের আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে। কিন্তু পরে সেই দরিদ্র মানুষগুলোর কোনো উন্নয়ন ঘটে না। বিভিন্ন সংকটকালে চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়তে থাকে। আপনি সেই ক্ষমতার সিন্ডিকেট ও মজুতদারের কাছে যাওয়ার জন্য বলছেন জনগণের সেবা করার জন্য! সেই পথ আমাদের নয়, তা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের।
পার্টির কর্মীরা আগে থেকেই জানতেন জলিল চৌধুরী পুরোনো নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন পার্টির হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। তাই আলোচনাকালে পার্টির কর্মীদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জলিল চৌধুরীর পছন্দ হয়নি। তিনি নিজেও পার্টির মনোভাব বোঝার জন্য সভায় এসব কথাবার্তা উত্থাপন করেছেন।
জলিল চৌধুরীর এরপর থেকে পার্টি থেকে দূরে সরে যাওয়ার অজুহাত তৈরি করে। ধীরে ধীরে পার্টির সভায়, মাঝেমধ্যে ব্যস্ততা দেখিয়ে আসেন না। তাই জলিল চৌধুরীর প্রতি পার্টির তরুণ কর্মীদের মধ্যে একটা অনাস্থার জায়গা তৈরি হয়। পার্টির কর্মকাণ্ড নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে কিছু প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন ফয়সল। সমর্থন করে অন্যান্য নেতা ও কর্মীরা। সবারই এককথা, সামরিক জান্তার ছত্রছায়ায় গঠিত সরকারের পার্টিতে যোগ দিলে জনগণের জন্য কাজ করা তো হবে না। বরং পার্টির কর্মীদের মধ্যে নানামুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে পার্টি কি আবার ভাগ হতে যাচ্ছে? না কি একজন জলিল চৌধুরীই কেবল পার্টি থেকে চলে যাবেন। শেষ পর্যন্ত পার্টি ভাগ হয়নি। জলিল চৌধুরী সরকারের পার্টিতে যোগ দিয়েছেন কয়েকজন কর্মীসহ। নৈতিক স্খলনে একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ও কমরেডের পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে এক্ষেত্রে। উপজেলার সভাপতির পদেই তার রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটে। আদর্শচ্যুত মানুষ কেবল কিছুদূর এগোতে পারে, বেশিদূর এগোতে পারে না। কখনও কখনও একজন বামপন্থি নেতা বেশি নিচে নামতে পারে না। বিবেক তাকে থামিয়ে দেয়। এদের সংখ্যা খুব কম। বর্তমানেও দেশের চলমান রাজনীতিতে বিবেকহীন মানুষের সমাবেশ বেশি ঘটেছে। লুটেরাদের রাজত্বে ক্রমাগত ক্ষমতার রাজনীতির দাপট দেখে দেখে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে একসময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ রাজনীতি জনগণের কোনো পরিবর্তন বয়ে আনে না।

বেলালউদ্দিন …
চায়ের দোকানের কর্মরত শ্রমিকদের নেতৃত্বে ছিল বেলালউদ্দিন। বেলাল শহরের একটি চায়ের দোকানের ম্যানেজার। সেখান থেকে ধীরে ধীরে চা দোকানের শ্রমিকদের নেতা হয়ে উঠে। চায়ের দোকানের কর্মরতদের শ্রমঘণ্টা দেখে নিজের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১টা-দেড়টা পর্যন্ত কাজ করা এই শ্রমিকদের নিয়ে তার চিন্তা। মাঝে এক ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম। কোনো চা-দোকানের শ্রমিক যদি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে তাকে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য ছুটি দিয়ে দেয় মালিক। কিন্তু ছুটি শেষে ফিরে এসে দেখে তার আর চাকরি নেই। মালিকের এসব কূটকৌশল ম্যানেজার বেলালকে ভাবিয়েছে। শ্রমিকরাও তাকে ঘৃণা করতো। তার উপর অসন্তুষ্ট ছিল। বেলালউদ্দিন কয়েকবার চাকরিচ্যুত ও চাকরিরত শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনায় বসে। চা দোকানের কাজের এসব নিয়মনীতি শোষণ প্রক্রিয়া তারও পছন্দ নয়। পেটের দায়ে সেও চাকরি করছে। শ্রমিকদের মতো। বেলালউদ্দিন তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়, চাকরিতে রাখা না রাখা মালিকের সিদ্ধান্ত। মাঝেমধ্যে বেলাল ম্যানেজার হয়েও শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলে, পুনরায় চাকরিতে বহাল করতে বলে। এটা নিয়ে মালিকও মনে মনে তার উপর অসন্তুষ্ট ছিল।

বেলালউদ্দিন মেট্রিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেনি অর্থনৈতিক কারণে। বাধ্য হয়ে চা-ভাতের হোটেলে চাকরি নেয়। চাকরি পাওয়ার পর সে লেখাপড়ায় আবার মনোযোগী হয়। শহরের সান্ধ্যকালীন কলেজে ভর্তি হয়। স্কুলে পড়ার সময় রাজনীতিতে ছিল মোটামুটি সক্রিয়। বেলাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ফয়সল, খোরশেদ ও স্বপন গায়েন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচয় হয়। চায়ের দোকানে কাজ করায় শ্রমিকশ্রেণির দুঃখ-দুর্দশা তার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। মালিকের কাছে শ্রমিকরা জিম্মি। চাকরি এই আছে, এই নেই। বেলাল এই শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সে নিজেও একজন শ্রমজীবী মানুষ।
বেলালউদ্দিনদের চায়ের দোকানে ফয়সলদের আড্ডায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কথাবার্তা শুনতে শুনতে তার মধ্যে এই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ফয়সলরা চায়ের দোকানের আড্ডা দিতে দিতে অধিক রাত হলে এ আড্ডায় গিয়ে বসতো, যখন কাস্টমার কমে আসতো। ফয়সল, খোরশেদ, গায়েন, মনোয়ার একদিন তাদের পার্টির সঙ্গে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এ রাজনীতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সাধারণ ভোটের রাজনীতি নয়। মানুষের অধিকার আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। বেলাল তাদের নি¤œকণ্ঠের আড্ডা থেকে বুঝতে পারে এই রাজনীতির ধারা ও কৌশলে ভিন্নতা রয়েছে। অনেকটা আদর্শিক। ধীরে ধীরে সে এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।

বেলালউদ্দিন পার্টির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর পরই নিজে থেকেই আগ্রহী হয়, চায়ের দোকানের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন গড়ে তোলায়। বেলালউদ্দিন অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে প্রথমে সংগঠন গড়ে তোলে অন্যান্য চায়ের দোকানের শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে। মালিক যেন বুঝতে না পারে যে, এটা সকল চায়ের দোকানের মালিকদের বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম। চায়ের দোকানের শ্রমিকদের সংগঠন বেশ সংগঠিত হয়ে পড়ে বিশেষ করে বড়ো বড়ো চায়ের দোকান ও বেকারি শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলায়। এই সংগঠনের কারণে চা ও বেকারি শ্রমিকদের সহজে চাকরি এখন যায় না, সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া। শুধু এখনও রোজার সময় যেসব চায়ের দোকান একেবারে বন্ধ থাকে তাদের ক্ষেত্রে এখনো সংগঠন খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই তথ্য বেলাল জানিয়েছে নিজেই। এভাবে স্পষ্ট বক্তব্য রাখার জন্য পার্টিতে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
শাপলা দাশ…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কমরেডের চিঠি ও ঠিকানা নিয়ে ফয়সলের বাড়িতে হাজির হয় শাপলা দাশ। ফয়সল এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। শাপলা দাশ আসে পার্টির আরেক ফুল-টাইমার কর্মী আয়শা খাতুনকে সঙ্গে করে। চিঠিতে কমরেড লেখে- ‘এদের কিছুদিন আপনার বাসায় অথবা কোনো আত্মীয়ের বাসায় রাখলে ওদের এবং পার্টির জন্য ভালো হবে।’ উদ্যোগী কর্মীদের বিপদের সময় নিরাপদে রাখতে না পারলে সংগঠনেরও বিপদ। তাই দ্বিধা না করে বললাম বসেন। সে রাজশাহী অঞ্চলের পার্টির নিষ্ঠাবান কর্মী। আগে কখনো দেখা হয়নি। নামে চিনি এবং জানি।
শাপলা দাশ বললেন, আপনার অসুবিধা হলে ঢাকা হয়ে রাজশাহী চলে যেতে হবে। তাতে একটু রিস্ক থাকে। তাই কমরেড আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। আমরা এখন গোয়েন্দাদের নজরদারীতে আছি। চট্টগ্রামে আমার এক আত্মীয়র বাড়িতে এতো দিন ছিলাম। বেড়াতে এসেছি বলে বেশ কিছুদিন ছিলাম। দীর্ঘদিন থাকলে একটা সন্দেহের তীর হয়তো আমাদের উপর পড়তে পারে।
বেশ কয়েক মাসে কেটে গেল। শাপলা আর আয়শার সঙ্গে দুইবার এলাকার পার্টির লোকজন নিয়ে একটা বৈঠক করি। এখানকার কর্মীদের কাজ করার ক্ষেত্রে একটা সুবিধা বড়ো শহর বলে কেউ কারো প্রতি দৃষ্টি দেয়া সময় থাকে না। যে যার মতো করে চলছে। কোনো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত বুঝতে পারে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হয়। পুলিশি তৎপরতা বাড়ে। কিন্তু রাজশাহী অঞ্চলে বাম ঘরানার লোক যেমন আছে, মৌলবাদী সংগঠনের লোকও আছে। আমাদের পার্টির সঙ্গে অন্যান্য পার্টির তফাৎ,

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়