গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

কবিরাজি : মঈন আহমেদ > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ও নানি, তুমি মরবা না?
নানি শাশুড়িকে উঠানে পেয়ে আম্বিয়া ধান পাড়াতে পাড়াতে মস্করা শুরু করে।
মরতাম না? মরব তো। আল্লাহ যখন ডাক পাড়ব, যামু গিয়া।
আর কখন ডাক পাড়ব! আল্লায় মনে লয় তোমারে ভুল্যা গেছে গা। আল্লাহ মিয়ার কবে ফুরসত হইব কেডায় কইব। আরো বিশ বছর লাগতে পারে!
তুই এগুলান কি কস রে বুইন। তোর মাথাত বেরাম হইছে। ওই লম্পা সিদ্দিক্যারে ডাক দে। তোরে জড়ি-বুটি দিয়া যাক। তারে কও, আমি ডাকছি।
না গো নানি। আমার মাথা ঠিকই আছে। তোমার বয়স হইছে না! তোমার মাথা আউলায় গেছে গা!
নানি বিরক্ত হয়, তুই তো বড় বেজন্মা রে।
মায়ে মোরে বেজন্মা করলে আমি কি করবাম, কও?
বুড়িটা চুপ মেরে যায়। তার মুখ ফসকে ‘বেজন্মা’ কথাটা বেরিয়ে গেছে। আদতে সে একটা গালি দিতে চেয়েছিল- মাগি কিংবা খানকি। যেটা হরহামেশা নাতবৌকে ছোটকালের ঢিল ছোড়াছুড়ির মতো গাল দেয়। এই গালাগাল না-নাতবৌ না-নানি কারো অন্তস্তলে আঁচড় কাটে না।
উঠানে বসে ফুলি নানি আর নাতবৌ আম্বিয়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে খিস্তিখেউড় করে নিজেদের মনের গভীরে লুকানো ব্যথার উপশম করার চেষ্টা চালায়। এ-খিস্তিখেউড় তাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ বলা যায়। তাদের মুখে হাসি ফোটে না। ফুলি নানির তো দুঃখ গোছেই না। আম্বিয়ারও বেহাল দশা।
সতেরো বছর বয়সে দশম ক্লাসে পড়তেই নূরুর নানি আম্বিয়াকে নিয়ে এসেছিল। আম্বিয়ার মায়ের কাছ থেকে চেয়ে-মেঙে, বলতে গেলে জোর করেই নাতবৌ করে ঘরে তুলেছিল।
আম্বিয়ার মাও খুশি মনেই বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল। আহা রে! বাপ-মা মরা ছেলে! সংসারে তো আর কেউ নেই- নানি আর নাতি।
তিন ছেলে আর একমাত্র মেয়ে সোহাগী। সেই সোহাগীর ঘরের ছেলে, নূরু। ফুলি তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল শ্রীপুরের এক বনেদি ঘরে। দেশের অবস্থা ভালো না। হরতাল আর মিছিলে দেশটা কেমন যেন বিদিশা হয়ে গেছে। ছয় দফার আন্দোলন চলছে। দেশের নেতা বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাত কোটি বাঙালি- মুক্তি চাই, মুক্তি চাই। এই সময় সোহাগীকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল চৌদ্দ মাইল দূরের শ্রীপুরের বাঘেরবাড়ি গ্রামে।
গোয়াল আর গোলা ভরা ধানের শ্বশুরবাড়িতে সুখে ছিল মেয়েটি। দেশে যখন মুক্তির যুদ্ধ চলছে এমন সময় মেয়েটি জন্ম দেয় একটি ছেলে-শিশুর- নূরুদ্দিনের।
তুমুল স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে দেশের আনাচে-কানাচে। আগে তো শুধু গুলির শব্দ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের খবর আসত। এখন ঝাঁক বেঁধে বোমারু বিমান উড়ে যায়, কখনো পুব থেকে পশ্চিমে তো কখনো দক্ষিণ থেকে উত্তরের আকাশে।
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বড় ফড়িংয়ের মতো উড়ন্ত বোমারু বিমানগুলো। তারা নাকি বোমা ফেলে আকাশ থেকে জমিনে- যেখানে শত্রæ থাকে, যেখানে নিরীহ মানুষও থাকে।
অনেক সময় গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়েও দেখা যায় না, গোঁ গোঁ শব্দ শোনা যায়। ভোঁও…ও সতর্কতা সাইরেন বাজে। লোকজন গভীর উদ্বেগ আর আশা নিয়ে জমিতে খোঁড়া সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে- আকাশ থেকে শত্রæ কিংবা মিত্র বাহিনী বোমা ফেললে যদি প্রাণে বাঁচা যায়!
হানাদার বাহিনীরা এ রকম মার খেয়ে যখন দিশাহারা- যখন-তখন দেশটা তাদের মুঠোর বাইরে চলে যাবে ঠিক এমনই এক ভোরে বাঘেরবাড়ি গ্রামে ঢোকে এক দঙ্গল মিলিটারি আর তাদের নিমকহারামি দোসররা, যাদের এই মাটিতে জন্ম হয়েছিল। তারা এসেছিল ‘মুক্তি’দের খুঁজতে।
সেদিন তখন সাইরেন বাজেনি শুধু শোনা গিয়েছিল বন্দুকের গুলি আর গাড়ির ঘড়ঘড়ানি শব্দ। এই শব্দের আতঙ্কেই সবাই সুড়ঙ্গে ঢুকেছিল, প্রাণে বাঁচার জন্য! কিন্তু সেদিন বাঘেরবাড়ি গ্রামের পুরুষ কিংবা নারীরা কেউ প্রাণে বাঁচেনি। বোমার আঘাতে নয়, নির্মম মরেছিল হানাদারদের গুলি খেয়ে।
মুক্তির আস্তানার বাহানায় নারী-পুরুষ সবাইকে দেদারসে গুলি করে, বেয়নেট খুঁচিয়ে খুন করে গ্রাম উজাড় করে চলে যায় তারা, হায়েনার দল।
তিন মাসের শিশু নূরু গুলি খাওয়া মরা মায়ের বুক চুষতে চুষতে বেঁচে গিয়েছিল। শিশুর কান্না থামাতে হয়তো মাইটা ঠুসে দিয়েছিল নূরুর মা- মা জননী।
সেই তিন মাসের নূরুকে বুকে-পিঠে বড় করেছে নানি। নানা তো যুদ্ধে গিয়েছিল আর ফেরেনি। বিশ বছরের বড় ছেলেটাও গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে দল পাকিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে কিন্তু যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত যেতেই পারেনি। শ্রীপুর থেকে শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে ওপারে গিয়েই ধরা পড়েছিল মিলিটারিদের হাতে। তারপর আর কেউ কিছু বলতে পারে না।
তারা তো নিজের জীবন দিয়ে দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছে। কিন্তু যারা বেঁচে ছিল, তারা? তারা কী আসলে বেঁচে ছিল।
বর্গা চাষি ফোকু দশ মণ ধান দিয়ে গেছে। ভেজা ধান। দশ মণের বেশি ধান আজ পর্যন্ত দেয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার তিন বছর হয়ে গেল। ফোকু এখন পর্যন্ত দশ মণের কমও দেয় না বেশিও দেয় না। কোন নিয়ম বেঁধেছে আল্লা মাবুদ জানে। ভ্যানে করে পোল্ট্রির সাদা সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে ধান নিয়ে এসে দাওয়ায় তুলে দেয়। ধান শুকানোর পর ওজন দিলে সাত কি আট মণ ধান হয়। শুকনা ধান দিতে পইপই করে বলেছে আম্বিয়া। কাজ হয়নি। কে শোনে কার কথা!
আম্বিয়া বেশি করে বলতে পারে না। তার বরের পেয়ারের লোক। একসঙ্গে মদ গিলেছে, গাঁজা টেনেছে, তাস পিটিয়েছে- এটুকুন জানে আম্বিয়া। মাগিবাজি করেছে কি না- জানে না।
ফোকুর দুষ্ট চরিত্র- একান-সেকান ঘুরে তার কানেও এসেছে। আম্বিয়ার বর নূরু মারা যাওয়ার পর ফোকু নিয়মিত এসে খোঁজখবর করে। নূরু বেঁচে থাকতে একদিন তো পানিভরা গøাস ধরতে গিয়ে বেশ ভালো করেই আম্বিয়ার হাতটাই ধরেছিল ফোকু। আম্বিয়া তাকে কিছু বলেনি। সন্তর্পণে হাতটা টেনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল।
বিছানায় সোহাগ নিতে নিতে বরকে বলেছিল ফোকুর কথা- লোকটার নজর খারাপ।
নূরু উত্তরে বলেছিল, তুই দেখলি কেম্পে?
বরের কথা শুনে একবারে চুপসে যায় আম্বিয়া। বরের দলাই-মলাই খেয়েও নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি সেই রাতে। কেবলি মনে হচ্ছিল ফোকু বুঝি টিনের ফুটো দিয়ে দেখছে।
সেই ফোকু এখনো উঠানে আসে, চা-পান খায়, ড্যাব ড্যাব করে তাকায়, গায়ে জ্বালা ধরায়। কিন্তু আম্বিয়া উচ্চবাচ্য করতে পারে না। দুটা কচি ছেলে-মেয়ে, নানি শাশুড়িকে নিয়ে দিন গুজরান করতে হয়। নিজে তো কখনো হাট-বাজার করেনি। জীবনকে কীভাবে গুছিয়ে টানতে হয়, জানা নেই, এখন একটু একটু শিখতে হচ্ছে।
আম্বিয়ার বর নূরু লেখাপড়া তেমন করেনি। নানি তাকে পড়াতে পারেনি। হাল ধরতে শিখিয়েছিল। নাহ! নানি শেখায়নি নূরুকেই শিখতে হয়েছে- জীবনের তাগিদে।
দশ বছর বয়স হতে না হতেই মামা দুজন বিয়ে-শাদি করে নিজেরা ভালো থাকার জন্য শহরমুখো হয়েছিল। গ্রামের প্রতি তাদের টান নাই, বুড়ো মায়ের জন্যও না। নূরুর নানি পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পেয়ে খামচাখামচি করে কিছু ডোবা জমি কিনতে পেরেছিল। সেই জমিতে ধান হয় না হয় না করেও বর্গা দিয়ে বছরে দশ মণ ধান পাওয়া যায়। আম্বিয়া পায় বরের পেয়ারের বন্ধু ফোকুর বদৌলতে।
আম্বিয়ার বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে। বিয়ের পাঁচ বছর সন্তান হয়নি তার। বাইশে পড়ে ছেলের মা হয়েছিল। এক বছর যেতে না যেতেই আবারো সে মা হয়- মেয়ের মা। সেবার মরতে মরতে বেঁচে গেছে। হাসপাতালের ডাক্তারনি তার বাচ্চাদানিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল- আম্বিয়া আর মা হতে পারেনি। দুসন্তানের মা ত্রিশে পা রাখতেই বরকে খেয়ে ফেলেছে- সবাই সেটাই তো বলে! আসলে সে তো খায়নি বরকে, খেয়েছে মশায়। মশার কামড় খেয়েও জোয়ান মরদ মরে! শুনেছে কেউ?
হ্যাঁ মরেছে। আম্বিয়ার বর নূরু মরেছে।
দুটি শিশু সন্তান আর বুড়ি নানি শাশুড়িকে নিয়ে বিধবা আম্বিয়ার সংসার। ভাতের চালটা পায় আর তেল, নুন, মশলাপাতির জন্য হাঁস-মুরগি-কবুতর-ছাগল পুষে দিন গুজরান করে।
নানি বুড়ি চোখে দেখতে পারে ভালো। বিছানায় তেলাপোকা উঠলে শলার ঝাড়– দিয়ে ঝেটিয়ে মারে। আঙিনায় বসে গায়ে সোনা-রোদ মাখতে মাখতে হাতের লাঠি দিয়ে কবুতর-মুরগি-শালিখ-চড়ুই তাড়ায়, ছড়ানো ধানে তাদের হক বসাতে দেয় না।
আম্বিয়া সারাদিন বাড়ির কাজ করতে করতে নানির কাছে এসে তাকে উত্তেজিত করে- ও নানি তোমার বয়স কত হইছে গো?
বয়স পুছ করস কেন?
না কবে জানি তুমি মরো! তাই একটু পুছ করি। আগেভাগে জানলে…
তুই আমার মরণের দিকে তাকায় থাকস! কেন, লাং জুটাইছস নাকি?
না নানি লাং জুটাইতে তোমার মরণের অপেক্ষা করন লাগপে না। তোমার তো ছয় কুত্তার বয়স হইছে, হইছে না?
নানি বুড়ি উত্তর করে না। আপন মনে হিসাব করে ছয় কুত্তার বয়স এক করলে কত হয়- সত্তর, আশি, নব্বই, কত?
তুমি অহন মরবা না নানি, বুঝবার পারছ তো?
অহন মরলে কি হবে রে মাগি?
তুমি তো আমার ব্যবস্থা করো নাইক্যা এখনো। তুমি মরলে তো ডোবা জমির ভাগ নিতে আসপে তোমার ছেলেরা। আসপে না কও? তখন আমার ছেলে-মেয়ের পেটে ভাত দিমু কেমতে? আমাগোর একটা গতি করে দিয়া তুমি চোখটা মুইদো, তার আগে মইরো না কইলাম।
তুই মাগি বহুত সেয়ানা! তোরে জমিটা দিয়া পায়ে কুড়াল মারবার কস আমারে। সেটা হবে না, বুঝছস?
তাইলে তুমি আরো দুই কুত্তার বয়স বাঁইচ। আমার ছেলে-মেয়েরে মানুষ কইরা নিই, বুঝপার পারছ।
বুড়ি ভাবে- আম্বিয়া ঠিকই তো বলছে। সে মরে গেলে তার ছেলে দুটা জমির ভাগ নিতে হামলে পড়বে। এখন তো তারা বছর ঘুরে গেলেও মায়ের কাছে আসে না! নাতি-পুতিদের দেখতে কত আকুলি-বিকুলি করে মনটা।
ফুলি বুড়ি ভাবে। কদিন ধরে ভাবে আর ভাবে। কী করা উচিত তার। এই যে অল্পবিস্তর ধানি জমি আর এক টুকরা ভিটা। আম্বিয়াকে পছন্দ করে নাতবৌ করে এনেছিল। আম্বিয়া তার বিশ্বাসে চিড় ধরায়নি।
একমাত্র মেয়ে সোহাগীকে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। সবাই বলেছিল দেশের অবস্থা ভালো না, কোনদিন জানি কী হয়! সবাই পরামর্শ দিয়েছিল বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে মেয়ের, তাকে জলে ফেলো না, তুলে দাও সেই আঙিনায়- মাইয়া সুখে থাকপে। মেয়ের বাপেরও খুব ইচ্ছা সেই ঘরেই বিয়ে দেয়ার। আর কি আপত্তি করার থাকে! বিয়ে দেয়ার পর মেয়েকে আর চোখে দেখেনি ফুলি। মেয়ে আর মেয়ে-জামাইয়ের মৃত্যুর পর দৌড়ে যেতে পারেনি সৎকারে। যাওয়ার অবস্থা ছিল না। চৌদ্দ মাইল পেরিয়ে তাকে কেউ মেয়ের মরা মুখ দেখতে নিয়ে যাওয়ার সাহস করতে পারেনি। কেঁদে কেঁদে চার দিন পার করেছে। তারপর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে তিন মাসের শিশু নূরুদ্দিনকে দিয়ে গিয়েছিল তার কোলে। সে আর এক কাহিনি! তিন মাসের শিশু কী আর তার শুকনা বুকে মুখ দেয়! সেই নাতিকে সে মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছিল। সেই নাতিও তার চোখের সামনে জ্বরে পুড়ে মরে গেল। কোন জঙ্গলে বসে মদ গিলতে গিয়ে মশার কামড় খেয়েছিল। সেই মশার বিষে নিজের প্রাণ থেকে হাত ধুয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল, দুটা টলটলে শিশুকে আম্বিয়ার জিম্মায় রেখে।
নানি বুড়ি ভাবে- এই শিশুদের মানুষ করে গড়ে তুলতে হলে আম্বিয়াকে দিয়ে যেতে হবে তার স্থাবর সম্পদ।
আম্বিয়া, ওরে আম্বিয়া!
মরি নাইক্যা আমি, কি কইবা কও- এক বোঝা খড়ি উঠানের কোণে পেয়ারা গাছের তলায় নামাতে নামাতে আম্বিয়া ক্লান্ত কণ্ঠে বলে।
কই গেছিলি? টেকোত?
হয়।
তোরে কইছি না আমি হে মুড়ায় যাবি না। সুনসান জায়গা, জিন-ভূতের আস্তানা।
এতগুলান খড়ি আমি পাইবাম কই। হেই মুড়ায় কেউ যায় না। নইলে খড়ি পাওয়া যায়? গরুও তো নাই যে ঘুটা দিমু।
গ্যাস কেনার টাকা কই! ঘুটা-পাতা-খড়ি পুড়িয়েই তো দুবেলা রান্না হয়। ফুলি বোঝে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়।
সিদ্দিক্যারে কইছস, আমি যে তারে ডাকছি?
হ। মজনুর তন খবর দিছি তো। পাল্কি নিয়া আইবার কইছি।
বুড়ি আজকে আর মাতে না। আনমনে হাতের লাঠি জমিনে ঠুকে ঠকঠক শব্দ করে চড়–ই-শালিখ তাড়ায়।
সিদ্দিক ফুলির শৈশবের বন্ধু। একসঙ্গে লাফিয়ে-কুদে হাঁড়িকুড়ি খেলা করেছে। গাছে চড়ে পাখির ডিম চুরি করেছে, পুকুরে বড়শি ফেলে ঠা ঠা দুপুর কাটিয়েছে, মাঠ জঙ্গল চষে বেড়িয়েছে, আরো কত কি যে করেছে- সেসব এখন স্মৃতির কথা!
সিদ্দিক ছোটকাল থেকেই লম্বা আর কুচকুচে কালো। এখন তার এক মাথা কালো-সাদা চুল ঘাড় বেয়ে পিঠে লুটিয়ে থাকে। কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে কবিরাজি করে। নাম ডাক নাকি আছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ফোকুর নানা তো আর ফেরেনি। নানির দুজন দেবর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাইরে কোনো সম্পত্তির ভাগ দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে রাজাকার আখ্যা দিয়ে সব সম্পদ নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। দাওয়া থেকেও নামিয়ে দেয় ফুলিকে। তখন এই সিদ্দিকই ফুলির পাশে লাঠিয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সম্পদের ভাগ তো নিয়ে দিতে পারেনি তবে উঠান থেকে পেছনে সরে চেয়ারম্যান, মেম্বরকে ধরে তিন শতাংশ জমি ফুলির নামে লিখিয়ে দেয়। তারপর বাপের সম্পদের ভাগ আর শেখ মুজিবের দেয়া এককালীন ভাতা দুই হাজার টাকা দিয়ে তিন কানি ডোবা জমির কাগজপত্র সিদ্দিকই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
সিদ্দিক না থাকলে ফুলি দুটা ছেলে আর নূরুকে নিয়ে যে কই যেত, কে বলবে!
সেই সিদ্দিক এখন কবিরাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবুও ফুলির ডাকে সাড়া দেয়। আম্বিয়া খবর যখন পাঠিয়েছে তখন সময় করে নিশ্চয় আসবে সিদ্দিক- বিশ্বাস আছে।
সিদ্দিক কবিরাজ ফুলির ডাকে সাড়া দিয়ে এক ঘুঘু-ডাকা অলস দুপুরে এসেও ছিল।
সিদ্দিক কবিরাজ এক নির্মল সকালে এক-তোড়া কাগজ হাতে আরো একদিন এসেছিল। দেশ ও দশের মায়া ভুলে ফুলি তখন ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে, শান্তিতে।
ফুলি নাই তবে আম্বিয়াকে সিদ্দিক কবিরাজ নিশ্চিত করে গেছে- বসতের ভিটা-মাটি, ডোবা ধানি জমি সব এখন আম্বিয়ার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়