গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

কবিতার মানুষ : দীপু মাহমুদ > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বেলা বাড়তে বাড়তে মেঘ হয়ে গেল জমাট। ঘোর অন্ধকারে আকাশ ছেয়ে ফেলল। তখন শুরু হলো মুষলধারে ভারি বৃষ্টি। হুলুস্থূল উথালপাথাল বৃষ্টি।
অফিসের সব জানালা বন্ধ। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। অফিস ঘরের ভেতর প্যাচপেচে গরম। কবীর উঠে গিয়ে ঘরের একপাশের জানালা খুলে দিলো। অমনি দমকা ঠান্ডা তরতাজা বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরে। সেই সঙ্গে ঢুকল বৃষ্টির ছাট। তাতে জানালার পাশের টেবিলে রাখা কাগজপত্র ভিজে গেল।
অফিস কলিগরা হইচই শুরু করেছে। কেউ কেউ দৌড়ে এসে ভেজা কাগজ সরাতে গেল। কেউ কবীরকে জানালার পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করতে চাইল। কবীর নিজেই জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। কবিতার লাইন চলে এসেছে তার মাথায়।
কবীর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। প্রাইভেট অফিসে চাকরি করে। অফিসের নাম ইনোভেটিভ স্যাটেলাইট সিস্টেম। এখান থেকে বিভিন্ন বাসা আর অফিসে টেলিভিশনের ডিশ কানেকশন, ইন্টারনেট কানেকশন দেওয়া হয়। কিছুদিন হলো সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। পুরো শহরজুড়ে এদের কাজ। শহরে কয়েকটা ব্রাঞ্চ অফিস আছে। আয়-রোজগার বেশ ভালো। তবু প্রতি মাসে অফিসের সবাইকে বেতন দিতে পারে না। কবীরের ধারণা, ইচ্ছে করে দেয় না। পুরো বেতন পেলে দক্ষ স্টাফ এখান থেকে চলে যাবে। প্রত্যেক মাসে কাউকে অর্ধেক, কাউকে ৮০% বেতন দেয়। প্রতি মাসে সকলের বেতনের কিছু অংশ অফিসে জমা হতে থাকে। বেতন বাকি থাকতে থাকতে অফিসের খাতায় সবার এত বেশি টাকা জমা হয়ে গেছে যে, সেই টাকার মায়া ছেড়ে কেউ হুট করে এখানকার চাকরি থেকে চলে যেতে পারে না।
কবীর কোনো মাসে তার বেতনের ৭৫%-য়ের বেশি পায়নি। বেতন দেওয়ার সময় হলে অ্যাকাউন্টস অফিসার বলে, সামনের মাসে অ্যাডজাস্ট করে নেবেন।
পরের মাসে অফিসের খাতায় কবীরের নামে নতুনভাবে আরও টাকা জমা হয়ে যায়। অ্যাডজাস্ট হয় না। তাও আবার কখনো মাসের ১ তারিখে বেতন পাওয়া যায় না। সবাই যে একই দিনে বেতন পায়, তাও নয়। কেউ বেতন পায় মাসের ৫ তারিখে, কাউকে বেতন দেওয়া হয় মাসের ৭ কিংবা ১০ তারিখে। এ এক অদ্ভুত গোলকধাঁধার মতো অবস্থা।
অফিসে বিশাল বড়ো বড়ো দুটো রুম। সেখানে সারিসারি টেবিল পাতা। এই দুই রুমে ইঞ্জিনিয়ার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আর টেকনিশিয়ানরা বসে। অফিসের টেবিলগুলো ছাই রঙের। চেয়ারের রং কালো। প্রত্যেকের টেবিলের অপরপাশে একটা করে চেয়ার রাখা আছে। ক্লাইন্ট এলে বসে। স্টাফদের রুমে এসি নেই। এসি আছে শুধু এমডির রুমে আর সার্ভিসিং রুমে। স্টাফদের রুমে সিলিংফ্যান আছে কয়েকটা। তাতে বাতাসের চেয়ে শব্দ হয় বেশি। ঘরের সবগুলো ফ্যান একসঙ্গে চললে কেউ কারও কথা শুনতে পায় না। কথা বলতে হয় চিৎকার করে।
বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ার পর ঘরের জানালাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ভেতর শীতল আবহাওয়া। পুরো অফিস জুড়ে সুনসান বিষণ্নতা। কবীর মাথা নিচু করে বসে আছে। তার সামনে ছেঁড়া কাগজ। হাতে পেন্সিল। মিজান সাহেব কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন সে খেয়াল করেনি।
মিজান সাহেব কোয়ালিটি কন্ট্রোলার। তাকে অফিসের মেইন ব্রাঞ্চের ইঞ্জিনিয়ারদের সুপারভাইজার বানিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যালে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। চাকরিজীবন শুরু করেছেন এই ইনোভেটিভ স্যাটেলাইট সিস্টেম অফিসে। এখনো লেগে আছেন। বয়স অর্ধশত বছর পার হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। মাথার চুল বেশির ভাগ পেকে সাদা হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সেলুনে গিয়ে শেভ করেন। পুরো সপ্তাহ তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি থাকে। অফিসে সপ্তাহে একদিন সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়ার কথা। সাপ্তাহিক বা সরকারি ছুটি হঠাৎ কখনো পাওয়া যায়। সব সময় পাওয়া যায় না। মিজান সাহেবের মুখে কখনো কখনো দু-তিন সপ্তাহের না কামানো দাড়িও দেখা যায়।
কবীর মাথা নিচু করে আছে। মিজান সাহেব বললেন, কবি, ঝিমান কেন?
কবীর মাথা তুলে তাকাল। দুপুরে খাওয়ার পর তার ঘুম পাচ্ছিল। ঘুম হয়নি, এখন চোখ লাল হয়ে আছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, আমাকে কবি বলে ডাকবেন না।
তাহলে কি কবিরাজ বলতে হবে?
আমার একটা নাম আছে। কবীর। নজরুল কবীর। সেই নামেই ডাকবেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্র লিখতে হয় র, ব দীর্ঘ-ই-কার, দন্ত্য-ন দয়ে র-ফলা। রবি ঠাকুর লিখতে র, ব হ্রস্ব-ই-কার দিতে হয়। সেখানে দীর্ঘ-ই-কার চলে না। রবীন্দ্র থেকে যেমন রবি, সেরকম কবীর থেকে আপনাকে কবি বানিয়েছি।
কবীর উঠে পেছনের জানালা বন্ধ করে দিলো। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যখন তখন ঝাঁপিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে পড়বে। ঘুরে মিজান সাহেবের মুখোমুখি হয়ে বলল, আমার ভালো লাগে না। আমাকে পুরো নাম ধরে ডাকবেন। নজরুল কবীর না বলুন, অন্তত কবীর বলবেন। কবি বলবেন না।
আপনিও তো আমাকে বস বলেন। স্যার ডাকেন। আমি তাতে রাগ করি?
তাহলে কি এখন বলব, মিজান, আজ কোনো কাজ নেই?
বললে অসুবিধা কী? আপনি তো রাজ্জাককে রাজ্জাক ভাই বলেন না। বলেন রাজ্জাক। খুব বেশি হলে নায়করাজ রাজ্জাক। মিশা সওদাগরকেও ভাই বলেন না। মৌসুমি, পরীমনি, নুসরাত ফারিয়া, জয়া আহসান কাউকেই আপা ডাকেন না, নাম ধরে পরিচয় দেন। হাবিবুল বাশার সুমনকে শুধু সুমন বলেন। সাকিব আল হাসানকে বলেন সাকিব। বাইডেন, জনসন, পুুতিন সবাইকে নাম ধরে ডাকেন। আমাকে ডাকলে অসুবিধা কী?
মিজান, আপনি আমাকে কিছু বলতে এসেছেন। বলেন কী বলবেন।
আচ্ছা, আপনার মাথায় কি সত্যি সব সময় কবিতা ঘোরে?
জি ঘোরে। এখন একটা লিখেছি। শুনুন,
টিসিবির লাইন আর উন্নতির যজ্ঞ
ছড়ি হাতে ভাবে তারা পাবলিক অজ্ঞ।
মিজান সাহেব ধাক্কা খেয়েছেন। জোর ধাক্কা। তিনি ডানে-বাঁয়ে তাকালেন। দেখলেন আশপাশে কেউ আছে কিনা। আশপাশে কেউ নেই। তার মানে কবীরের কবিতা কেউ শোনেনি। তিনি ফিসফিস করে বললেন, আপনি তো ডেঞ্জারাস মানুষ। এসব কবিতা লেখেন? জেল হয়ে যাবে। রিমান্ডে নেবে। এগ থেরাপি। গরম ডিম। দেশে এখন টার্কি মুরগি চলে এসেছে। কচ্ছপের ডিম অ্যাভেলেবল। সাইজে বিশাল। শুনেছি পুলিশ এখন আর দেশি মুরগির ডিম ব্যবহার করে না।
কবীর অতি শান্ত গলায় বলল, তাহলে এটা শুনুন,
চরকি চেয়েছিলাম একটা রথের এেলোায়
লাল হলুদ সবুজ রাঙানো রঙে,
বাবা বাড়ি নিয়ে এলেন ফিরে কাঁধে করে
বানিয়ে দিলেন চরকি নারকেল পাতা দিয়ে।
গাঢ় কণ্ঠে কবিতা পড়েছে কবীর। তাতে যথেষ্ট আবেগ ছিল। কবিতা বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কবিতা শুনে মিজান সাহেব খুশি হয়েছেন। তিনি বললেন, এটা হচ্ছে কবিতা। আঃ!, কী সুন্দর। এেলোায় গিয়ে বউ কিনে আনার মতো। ওই যে একটা গান আছে, শুনেছেন? আমি এেলোা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। না-না এটা নয়। ওই গানটা, ও দাদা পায়ে পড়ি রে, এেলোা থেকে বউ এনে দে।
কবীর হেসে বলল, আরও একটা আছে।
বলুন শুনি। আপনার লেখা কবিতা শুনতে ভালো লাগছে। আপনি কবিতা লেখেন অসাধারণ। যেন রিনরিনে গান।
কবীর মুখ বাড়িয়ে চাপাস্বরে টেনে টেনে বলল,
যেখানে-সেখানে খুন-
রাষ্ট্রের বড়ো গুণ।
মিজান সাহেব পুরোপুরি অস্থির হয়ে গেলেন। যত না কবিতা শুনে, তার চেয়ে বেশি কবীরের বলার ঢঙে। কপালে বিনবিনে ঘাম জমছে। বললেন, এমডির কানে এই কবিতা গেলে আপনার চাকরি থাকবে না।
কবীর বললেন, এমডি স্যারের জন্য আলাদা কবিতা। আপনাকে শোনাই,
তুমি গ্রিনটি আর আমি দুধ চা
এমন ঘটনা মোটেও হবে না।
মিজান সাহের স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। তার মুখ হয়ে গেছে হাসি-হাসি। তিনি বললেন, বাহঃ! এই কবিতাটি সুন্দর। অত্যধিক সুন্দর। আমাকে লিখে দেন। আপনার ভাবিকে শোনাব।
কবীর বলল, ভাবিকে অন্য কবিতা শোনাবেন।
মিজান সাহেব কৌতূহলী চোখে বললেন, কী কবিতা?
কবীর নাটকীয় গলায় বলল, রাতে যখন বিছানায় দুজন শুয়ে পড়বেন, ঘরে জ¦লবে নীল ডিএলোাইট। হালকা আলোয় ভাবির গায়ে আলতো করে হাত রাখবেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে যাবেন। ভাবির কানের পাশ থেকে একগোছা চুল আঙুলের ডগা দিয়ে আলগোছে সরিয়ে দেবেন। তারপর গাঢ় কণ্ঠে বলবেন,
তুমি নাও আমার উত্তাপ
তুমি হবে মা, আমি হব বাপ।
মিজান সাহের হতভম্ব হয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না কবীর নামের এই ছেলে তার সঙ্গে মশকরা করছে কিনা! কবীরের বয়স ৩২ বছর। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। হালকাপাতলা গঠন। লম্বাটে মুখ। মাথাভর্তি চুল। অসম্ভব সুদর্শন দেখতে। এই অফিসে সবচেয়ে রূপবান ছেলে হচ্ছে কবীর। তাকে সে পুত্রসম ¯েœহ করে। আর সেই ছেলে কিনা তার সাথে তামাশা করছে!
মিজান সাহেব কিছু বললেন না। তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন। গভীর কষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর মুখে ঘুরলেন। ধীর পায়ে হেঁটে নিজের কাজের টেবিলের দিকে রওনা হয়ে গেলেন।

দুই.
অফিস ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ বের হতে পারে না। সবার কিছু না কিছু কাজ থাকে। অফিস থেকে বেরুতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। মিজান সাহেব প্রতিদিন অফিস ছুটির পর নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকেন। তার সামনে টেবিলে কম্পিউটার অন করা থাকে। তিনি কী কাজ করেন বোঝা যায় না। তবে মিজান সাহেব বের না হলে অন্যরা অফিস থেকে বেরুতে পারে না। তার আগে কেউ অফিস থেকে বের হয়ে যাক সেটা তিনি পছন্দ করেন না।
কবীর অফিস ছুটি হলে কাজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম দিকে মিজান সাহেব বিরক্ত হতেন, কী খবর, কবীর, রওনা হলেন মনে হচ্ছে!
আমার আজকের কাজ শেষ।
আমাদের মূল সমস্যা কী জানেন?
জি, জানি। আমরা কাউকে বিশ্বাস করি না। আমাদের আত্মবিশ্বাস কম, তাই অন্যকেও চট করে অবিশ্বাস করি।
কবীরের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন মিজান সাহেব। তিনি ভাবতে পারেননি তার মুখের ওপর এমনভাবে কেউ উত্তর দিয়ে দেবে। অন্য যে কেউ হলে বিনীত ভঙ্গিতে বলত, স্যার, মূল সমস্যা কী জানি না।
মিজান সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। শীতল গলায় বললেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, আমরা কাজে ফাঁকি দিতে পছন্দ করি।
আপনার কথা সম্ভবত ঠিক নয়। আমরা অযথা সময় নষ্ট করি। আরেক জনের খুঁত ধরতে ব্যস্ত থাকি। সময়ের কাজ সময়ে করি না। অসময়ে কাজ করার ভান করি।
তারপর থেকে ছুটির সময় কবীর অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে মিজান সাহেব কিছু বলেন না।
কবীর অফিসরুম থেকে বের হয়ে দেখল একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। অফিসরুমের সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে সোফা রাখা আছে। সোফার ওপরের কভার ছিঁড়ে ফোম বের হয়ে গেছে অনেক দিন। অফিস ম্যানেজমেন্টকে কয়েকবার বলা হয়েছে। অফিস ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে, রিসেপশনের জায়গা নতুনভাবে সাজানো হবে। সেখানকার জন্য দামি ফার্নিচার আসছে। শিগগির একজন সুন্দরী রিসেপসনিস্ট নেওয়া হবে।
ম্যানেজমেন্টের এই কথায় যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে কবীর। বারবার রিসেপসনিস্টের রিকোয়ারমেন্টে সুন্দরী শব্দটা নিয়ে এসেছে। তার কাছে মনে হয়েছে তাদের অফিসের ম্যানেজমেন্ট নারীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না। তারা মনে করে নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। সে সেজেগুঁজে অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে বসে থাকবে। ক্লাইন্ট এলে ঢং করে হাসিমুখে কথা বলবে। সব ব্যবসায়ী ফন্দি। তারা ভাবতেই পারে না নারীরা চিন্তাশীল কোনো কাজ করতে পারে। টাকা যখন সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন নারীরা হয়ে পড়ে পণ্য। তাদের অফিস ম্যানেজমেন্টের কাছেও নারী পণ্য হিসেবেই গণ্য হয়।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পরনে তাঁতের শাড়ি। বেশ লম্বা একহারা গড়ন। কাঁধের একপাশে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলছে। তরুণ বয়স। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাএলোা। পাকা গমের মতো মসৃণ ত্বক। তাকে দেখাচ্ছে অবিশ্বাস্য সুন্দর। তীব্র আকর্ষণ আছে তার ভেতর। কবীর সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
মেয়েটি বলল, যদি ভুল না করি, এটা নিশ্চয় ইনোভেটিভ স্যাটেলাইট সিস্টেম অফিস?
মেয়েটির কণ্ঠ মোলায়েম এবং গভীর। স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলছে। কবীর ন¤্র গলায় বলল, জি, কাকে খুঁজছেন?
আপনি কি এখানে চাকরি করেন?
জি।
আমার আসতে দেরি হয়ে গেছে। একটা কাজ শেষ করে এখানে এসেছি। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি ভয়াবহ ট্র্যাফিক জ্যাম। ইন্টারভিউ কি শেষ?
কবীরের মনে হলো আজ তাদের অফিসে রিসেপসনিস্ট পদে নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা ছিল। এর আগেও কয়েকজন মেয়ে এসে ঘুরে গেছে।
আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
কবীর ঘুরে দেখেন মিজান সাহেব তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কখন এসে দাঁড়িয়েছেন কবীর খেয়াল করেনি। মেয়েটিও মিজান সাহেবের দিকে একবারও তাকায়নি। হয়তো তিনি মাত্র এলেন। শেষের কথাটুকু শুনে মেয়েটিকে তার সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার জন্য বলছেন।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ইন্টারভিউ কি শেষ হয়ে গেছে?
মিজান সাহেব বললেন, সেই কথা বলার জন্যই তো আপনাকে ডাকছি। কবি নজরুল নিশ্চয় আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
মেয়েটি বিভ্রান্ত হয়েছে। কাকে কবি নজরুল বলা হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মিজান সাহেব বললেন, আপনার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন বিখ্যাত কবি। মানে কবির নামে তার নাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ওরফে কবি নজরুল।
স্যার, আমার নাম নজরুল কবীর।
কবির নামে নাম হওয়ায় তিনি কবিতা লেখেন। গাহি সাম্যের গান। তার লেখা একটি কবিতাও আজ পর্যন্ত কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এ জন্মে প্রকাশিত হবে বলেও মনে হয় না। আমার ধারণা সে একজন কমিউনিস্ট। উলটাপালটা কবিতা লেখে।
মেয়েটির বিভ্রান্তি বাড়ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না তাকে কেন এসব শোনানো হচ্ছে। কবীর বিরক্ত হয়েছে চূড়ান্তমাত্রায়। তাকে আঁতকা এরকম অপমান করার কোনো কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না।
মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে বলল, এখুনি সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমাকে ফিরতে হবে। ইন্টারভিউ কি হয়ে গেছে?
মিজান সাহেব বললেন, বাই দ্য ওয়ে, আপনার নামটি কিন্তু এখনো জানা হয়নি।
অনিতা মুখার্জী।
এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলা শোভন দেখাচ্ছে না। ভেতরে আসুন। অফিস চলছে। ভেতরে সবাই আছে।
অনিতা চোখ তুলে কবীরের দিকে তাকাল। কবীর বিস্মিত হয়েছে। মানুষের চোখ এত প্রাণবন্ত হতে পারে সে খেয়াল করেনি। অনিতার চোখ কথা বলছে। সে জানতে চাইছে, ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা! মেয়েটি তাকে কেন এতটা ভরসা করছে!
কবীর কিছু বলল না। ঘুরে অফিসরুমে ঢুকে পড়ল। তার পেছন পেছন মিজান সাহেব আর অনিতা ঢুকেছে। কবীর গিয়ে তার চেয়ারে বসল। অনিতাকে সঙ্গে নিয়ে সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিজান সাহেব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কী কবি, নতুন কোনো কবিতার লাইন মনে পড়েছে, তুমি গা আমি তাপ, তুমি হবে মা, আমি হব বাপ?
ঠা ঠা করে হাসছেন মিজান সাহেব। মনে হচ্ছে যেন রাতের অন্ধকারে নেকড়ে ডাকছে।
কবীর টেবিলের একপাশ থেকে সাদা কাগজ টেনে নিল। পকেট থেকে কলম বের করেছে। কলমের ক্যাপ খুলে কবিতা লিখে গেল।

মিজান সাহেব বেশ টিপটপ হয়ে পিঠ সোজা করে নিজের চেয়ারে বসে থাকার চেষ্টা করছেন। অনিতা বসে আছে তার সামনে। তিনি পিঠ সোজা করে টিপটপ হয়ে বসতে পারছেন না। মাঝে মাঝে সামনে ঝুঁকে পড়ছেন। আবার টানটান হয়ে বসছেন। টেবিলের কাছাকাছি সরে এসেছে চেয়ার। তাতে ভুঁড়ি আটকে যাচ্ছে। চেয়ার পেছালে মনে হচ্ছে তার কাছ থেকে অনিতা অনেক দূরে।
অনিতা বলল, জল খাব।
অমনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মিজান সাহেব। তিনি বললেন, অবশ্যই। ঠান্ডা পানি নাকি নরমাল? সাথে বিস্কিট দিতে বলি? সলটেড বিস্কিট। নোনতা। জোনায়েদ এক দৌড়ে সামনের দোকান থেকে নিয়ে আসবে। জোনায়েদ ছেলে ভালো। শুধু বছর বছর তার বউয়ের বাচ্চা হয়। নিজের ওপর কন্ট্রোল নেই। সময় বেশি লাগবে না। বিস্কিটের সঙ্গে চা আনতে বলব। রং চা নাকি দুধ চা? এরা ভালো মালাই চা তৈরি করে। চায়ের ওপর দুধের সর ভাসে। খাওয়ার সময় মনে হবে আপনি চা খাচ্ছেন না, দুধ খাচ্ছেন। আমি তো চায়ে ভাসা দুধের সর চুষে চুষে খাই।
মিজান সাহেব হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছেন। আর এমনভাবে বলছেন যেন সামনে বসে থাকা অনিতার পুরো শরীর তিনি চেটে খাচ্ছেন। বিশেষ করে তিনি যখন বললেন, দুধের সর চুষে চুষে খাই।
অনিতা শান্ত গলায় বলল, জল আমার কাছে আছে। আপনার সামনে খাব, তাই অনুমতি চাইছিলাম।
ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মুখের সামনে তুলে ধরল অনিতা। মুখ অল্প খুলে পানি খেয়েছে। ঠোঁটে লেগে থাকা পানি আঙুল দিয়ে মুছে বোতলের মুখ আটকাল। পানির বোতল ব্যাগে রেখে বলল, থ্যাঙ্কস। চা-বিস্কিট খাব না। জল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি। বলতে পারেন ছুটতে ছুটতে এসেছি ইন্টারভিউ ধরার জন্য। সেটাই মিস হয়ে গেল। এখন ঠিক আছি।
মিজান সাহেব বললেন, আজ ইন্টারভিউ হলে আপনি নিশ্চিত ফার্স্ট হতেন। পানি খাওয়ার জন্য কেউ অনুমতি চায় এটা প্রথম দেখলাম। আই হ্যাভ নেভার সিন ইট বিফোর ইন মাই লাইফ। হা হা হা।
আবার মাঝরাতে ডেকে ওঠা নেকড়ের মতো ঠা ঠা করে হেসে উঠেছেন মিজান সাহেব।
অনিতা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আজ ইন্টারভিউ হয়নি তাহলে?
হয়েছে কী, এমডি সাহেবের শ্যালিকার বিয়ে। ছোট শ্যালিকা। আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে টেকেনি। মেয়ের বয়স কম। বিবাহিত জীবন সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা ছিল না। বুঝতেই পারছেন। তবে এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেল বলতে পারেন। সংসার টেকানোর জন্য স্বামীর কাছে স্ত্রীর এক্সপেরিয়েন্স খুব জরুরি। তবে প্রথম রাতে সেটা প্রকাশ করতে নেই।
মিজান সাহেব কথাগুলো বলছেন খানিকটা অন্যদের আড়াল করে ফিসফিসে গলায়। অনিতার অস্বস্তি লাগছে। সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। একবার কবীরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে। কবীর এখনো অফিসে আছে। সে এদিকে তাকিয়ে তার নিজের চেয়ারে বসে আছে। অনিতার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানাল, ভয় পেয়ো না মেয়ে। তোমাকে কেউ একজন পাহারা দিচ্ছে। তোমার কোনো ক্ষতি সে হতে দেবে না।
মিজান সাহেব কিছুটা প্রশান্ত গলায় বললেন, এখন আর কোনো ভয় নেই। জোয়ান বুড়ো সব সামলে নিতে পারবে। হুট করে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে থাকে দুবাই। বিশাল ব্যবসায়ী। তারও আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে টেকেনি। তার বিয়ে কেন টেকেনি জানি না। মনে হয় খাঁটের সাথে বেঁধে মারত। এরা এসব করে। এমডি সাহেবের শ্যালিকার সাথে দুবাইয়ের সেই ব্যবসায়ীর বিয়ে আজ।
কবে ইন্টারভিউ হবে?
ডেট জানিয়ে দেবো। এই পজিশনে যে আসবে সে হবে রিসেপসনিস্ট কাম পিএস টু এমডি। ইন্টারভিউতে এমডি স্যারের উপস্থিতি তাই আবশ্যক। তিনি ডেট ফাইনাল করলেই ইন্টারভিউ হবে।
আজ তাহলে উঠি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
চা খেয়ে যান। দুধের সর দিয়ে বানানো মালাই চা।
আরেকদিন খাব।
এই পজিশনে আপনি সিলেকটেড। চাকরিতে ঢুকে তো দুধ চা আপনি খাওয়াবেন। রেগুলার। হা হা হা। ইন্টারভিউ নিয়ে টেনশন করবেন না। আমি আছি। হুট করে এমডি সাহেবের শ্যালিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই ফোন করে জানানো সম্ভব হয়নি। তবে ইন্টারভিউয়ের ডেট অবশ্যই ফোন করে জানানো হবে। সিভিতে আপনার টেলিফোন নম্বর আছে নিশ্চয়? আমি নিজে আপনাকে ফোন করব।
কবীর এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। সে অনিতার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে মিজান সাহেব সট করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভারী গলায় বললেন, কিছু বলবেন?
একটা কবিতা লিখেছি, স্যার। আপনার জন্য। শোনাতে এলোাম।
মিজান সাহেবের মুখের গাম্ভীর্য ভেঙে গেল। তিনি মুখ তেলতেলে করে ফেললেন। অনিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলেছিলাম, বিখ্যাত কবি! আমার জন্য কবিতা রচনা করেছে।
অনিতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে কবীরের দিকে তাকিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় বললেন, শোনান আপনার কবিতা।
কবীর খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল। হাতে ধরা কাগজের দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বলল, ঘরের ভেতর হায়েনা, কাউকে সে ছাড়ে না। সে অতি বদ কুকুর, ডাকছে দেখো ঘেকুর ঘেকুর।
অনিতার দমকা হাসি পেয়েছে। সে খুক মতো শব্দ করে হাসি চেপে রাখল। মিজান সাহেবের মুখ বাজ-পড়া তালগাছের মতো হয়ে গেছে। তিনি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছেন।
কবীর গম্ভীর মুখে হাতে লেখার কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে। সিরিয়াস গলায় বলল, হায়েনা আর কুকুর একসাথে হয়ে গেছে। কবিতাটা ঠিক করে আনি।
বলে ঘুরে নিজের টেবিলের কাছে চলে গেল।
একজন-দুজন করে অফিস থেকে বের হচ্ছে। অনিতা উঠে পড়েছে। সে হাসিচাপা মুখে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আসি।
মিজান সাহেব কিছু বললেন না। অনিতা মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে অফিসরুম থেকে বের হয়ে গেল। তার প্রবল হাসি পাচ্ছে। সে এখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে মন খুলে নিজের ইচ্ছেমতো হেসে নেবে।

তিন.
অনিতার সঙ্গে কবীরের আবার দেখা হলো পরদিন অফিস ছুটির পর। অফিস থেকে বের হয়ে কবীর সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, এখুনি বাড়ি ফিরবে নাকি কিছুদূর হেঁটে গিয়ে সামনে পার্কে বসে থাকবে! তার মন হয়ে আছে বিষণ্ন। মন কেন বিষণ্ন হয়ে আছে সেটা বুঝতে পারছে না। তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাকে ঘরে ফিরতে হবে। হয় হেঁটে কিংবা বাসে।
ঘরে ফিরতে কবীরের খারাপ লাগে না। পুপের সাথে খেলা করে। পুপে তার কন্যা। বয়স আড়াই বছর। স্ত্রী শাকিরা সংসার সাএলোায়। সে তাকে আদর করে ডাকে সাকি নামে। কন্যার নাম রেখেছে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় নাতনি পুপের নামে। তাদের নিয়ে আনন্দে থাকে।
তবু মন খারাপ হয় তার কোনো বন্ধু নেই ভেবে। সকালে অফিসে আসে, অফিস শেষ করে বাসায় যায়। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে কোথাও আড্ডা দিয়ে ফিরতে। কিন্তু তার আড্ডা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কেন নেই সেটাই বুঝতে পারে না।
অফিসের পাশ দিয়ে অনিতা যাচ্ছে। কবীর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে উচ্ছ¡সিত গলায় বলল, আরে আপনি, এখানে?
অনিতা ক্লান্ত গলায় বলল, এই তো ফিরছি।
আপনি কোথাও চাকরি করেন?
দুটো টিউশনি করি। খুব সকালে একটা আর বিকেলে একটা। বিকেলের টিউশনি শেষ করে বাসায় যাচ্ছি।
বাস ধরবেন?
বিকেলে হাঁটতে ভালো লাগে। হেঁটে বাসায় ফিরি।
আমিও হাঁটি।
ফুটপাত দিয়ে অনিতার পাশে হেঁটে যাচ্ছে কবীর। তার ঘরে ফেরার পথ এদিকে নয়। অনিতার সঙ্গে হাঁটতে ভালো লাগছে। কিছু বলা দরকার। কথা না বলে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া অস্বস্তিকর। অনিতা কিছু বলছে না। সে বিরক্ত হয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না। কবীরের একবার মনে হলো তার বোধহয় চলে যাওয়া উচিত। সে বলল, আমাদের অফিসটা কেমন যেন। মানে, ঠিক সময়মতো বেতন দেয় না। বেতন দিতে ঢিলেমি করে। তাছাড়া এরা উইমেন কলিগদের যে ভ্যালু দেয় এমন মনে হয়নি। আমাদের অফিসে ক্লিনার আর বুয়া ছাড়া কোনো নারী কর্মী নেই। তারা ধরেই নিয়েছে মেয়েরা কোনো টেকনিক্যাল কাজ করতে পারে না।
তার মানে আপনি বলছেন আপনাদের অফিসে চাকরি না করতে?
ঠিক সেটা বলছি না। আপনার প্রয়োজন আগে। সিচ্যুয়েশন বললাম।
তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। নতুন বন্ধুদের সাথে স্বাধীন জীবনে মেতে উঠেছি। বন্ধুরা ভার্সিটির হলে থাকে। খুব সকালে বাসা থেকে আমি ভার্সিটি ক্যাম্পাসে চলে যাই। সারাদিন টো টো করে ঘুরি। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরি।
অনিতা আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে। যেন তার বুকের ভেতর জমানো কথা। অনেক দিন আটকে ছিল। আজ সে কথাগুলোকে মুক্তি দিচ্ছে। তারা বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। কবীর হেঁটে যাচ্ছে অনিতার পাশে।
অনিতা বলল, হঠাৎ কিছু টাকা হাতে পেলাম। আমার বহুদিনের শখ ছিল গিটারের। গিটার কিনলাম। বাজানো শিখব কোথায়? কে আমাকে গিটার বাজানো শেখাবে? এক বন্ধু নিয়ে গেল সুবর্ণনগরে। সেখানে অমিতাভ নামে মধ্যবয়সী এক লোক গিটার বাজানো শেখান। নিজের কথা বলছি। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন?
কবীর তাড়াতাড়ি বলল, না-না, একদম না। শুনছি, বলুন।
দূর থেকে যেতাম বলে আমি সবার আগে পৌঁছতাম। সেদিনও আগেই গিয়েছিলাম। অন্যরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। গিটারের কড চেপে ধরে টুং টাং করছি। আমার প্রাথমিক পাঠ চলছে। সেই লোক আমার জন্য চা নিয়ে এলো। যে আমাকে গিটার বাজানো শেখাত।
অনিতার মুখে ‘সেই লোক’ কথাটা খটকা লাগল। কবীর কিছু বলল না।
অনিতা বলে গেল, খানিক বিস্মিত হলেও ব্যাপারটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল। হাতে এক কাপ চা পেয়ে বরং ভালো লাগল। আকাশে মেঘ করেছিল। ঘন মেঘ। জোর বাতাস শুরু হলো। ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করার পর আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। বাসায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। গিটার শিখতে সেদিন অন্যরা আসতে পারেনি। বাইরে এলোপাতাড়ি ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। বিক্ষুব্ধ, বিশৃঙ্খল ঝড়।
অনিতা চুপ করে আছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা কবীর বুঝতে পারছে না। ঘটনা সে নিজে থেকে বলছে। কতটুকু বলবে সে জানে। হয়তো নিজের মনে বাকি কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে ভেবে কবীরও চুপ করে থাকল।
রাস্তায় গাড়ির হর্ন, গাড়ি ছুটে যাওয়ার শব্দ। তারপরও নৈঃশব্দ্যে ডুবে যেতে থাকল কবীর। ডুবে যেতে যেতে অনিতার কথায় চমকে উঠল।
অনিতা বলল, সেদিন আমার শখের গিটার ভাঙলাম। গিটারের প্রথম পাঠ শেষ না হলেও জীবনের প্রথম পাঠ পেলাম। তুমুল বৃষ্টির ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে বড়ো হতে থাকলাম। বড়ো হতে হতে এত বড়ো হয়ে গেলাম যে পায়ের কাছে সবকিছুকে তুচ্ছ বোধ হতে লাগল। তারপর থেকে চারপাশের নোংরা আবর্জনাকে অনায়াসে অবহেলা করতে শিখে গেছি।
রাস্তার মোড়ে এসে অনিতা থমকে দাঁড়াল। সে আর কিছু বলছে না। এটা চার রাস্তার মোড়। অনিতাকে দেখে মনে হচ্ছে রাস্তা পার হবে। তবে সে সোজা যাবে না। যাবে ডানে। কবীর তাকিয়ে আছে অনিতার মুখের দিকে। সেখানে বিষণ্ন ভাব ছিল। এখন নেই।
অনিতা বলল, আমি ওদিকে যাব।
এখানে থাকেন বুঝি?
আমার বন্ধুর বাসা। পথে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
লাল বাতি জ¦লেছে। রাস্তার গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। অনিতা হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। সে জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছে। যেন এখানে কোনো জরুরি কাজ আছে। আসতে দেরি হয়ে গেছে।
কবীর বুঝেছে এরপর আর অনিতার সঙ্গে যাওয়া মানায় না। সে ঘুরে কাছের বাস কাউন্টারের দিকে গেল। তাকে এখন বাসায় ফিরতে হবে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনের এক বিকেল। সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল। একটানা না, থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। এখন বৃষ্টি নেই। আকাশে অনেক দূরে কালো মেঘ বাতাসের ধাক্কার আরও দূরে ভেসে যাচ্ছে।
পুরো সকাল ঘুমিয়েছে কবীর। আজ অফিস যেতে হয়নি। যদিও মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অফিসে যেতে হয়। বস আগের দিন বলে দেন, নতুন অর্ডার আছে। আগামীকাল সকালে অফিসে চলে আসবেন।
এই যে আমরা ছুটির দিন অফিস করি। ওভারটাইম কাজ করি। আমাদের বেনিফিট কী?
আপনারা কি লেবার নাকি যে ওভারটাইম ক্লেইম করবেন? আপনারা হচ্ছেন অফিসার। অফিসের হাই লেভেল স্টাফ।
কবীর এসেছে সুবর্ণনগরে। সে অমিতাভ নামের মধ্যবয়সি একজন গিটারবাদককে খুঁজছে। যে অন্যদের গিটার বাজানো শেখায়।
অমিতাভকে যত সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে কবীর ভেবেছিল কাজটা তত সহজ হলো না। সুবর্ণনগরে এসে জানতে পারল জায়গাটা দুভাগে বিভক্ত। উত্তর সুবর্ণনগর আর দক্ষিণ সুবর্ণনগর। অমিতাভ কোন অংশে থাকে কবীর জানে না। সে আছে উত্তর সুবর্ণনগরে। জেদের মাথায় চলে এসেছে। অনিতার ঘটনার শেষ জানতে চায়।
এখানে এসে থিতু হয়ে ভাবল, সে কেন এসেছে! অমিতাভের ওপর তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে! অমিতাভকে অতি খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে! অনিতাকে সে কষ্ট দিয়েছে বলে রেগেমেগে ছুটে এসেছে! কোন অধিকারে!
অবসন্ন বোধ করছে কবীর। নিজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যাপারটা হয়তো অধিকারের নয়, লড়াই। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। পুঁজির উল্লাসে বেঁকে যাওয়া সমাজে কতক্ষণ সে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে জানে না। তবু থামবে না কোনোদিন।
সুবর্ণনগরের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এলো। সূর্য ডুবেছে। চারদিক অন্ধকার করে রাত নামছে। আকাশে কালো মেঘ। বাতাস দম ধরে আছে। বৃষ্টি শুরু হবে। ঝড় হতে পারে জোর। সেদিনের মতো, অনিতা যেদিন তার শখের গিটার ভেঙে অমিতাভের ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। থমথম করছে চারপাশ।
কবীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বৃষ্টিতে ভিজবে। তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরবে।

চার.
ইনোভেটিভ স্যাটেলাইট সিস্টেম অফিসের মেইন ব্রাঞ্চে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়েছে। অফিস থেকে বেরুনোর স্পেসে কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি একসঙ্গে কাজ করছে। একদিনে কাজ শেষ করার হুকুম দিয়েছেন এমডি সাহেব। সেখানে রিসেপসনিস্টের বসার ব্যবস্থা হচ্ছে। পুরো জায়গাটা ঘেরা থাকবে গøাস দিয়ে। কাঠের ওপর ঝকঝকে বেলজিয়াম গøাস। এমডি সাহেবের ইচ্ছে ছিল সেখানে এসি লাগানোর। এসি লাগানো যাচ্ছে না। ভালো ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হালকা রং, শব্দ হয় না, বাতাস হয় বেশি।
এমডি সাহেবের ছোট শ্যালিকার ননদ রিসেপসনিস্ট কাম পিএস টু এমডি হিসেবে শিগগির জয়েন করবে।
মিজান সাহেব দুবার হেঁটে চলে গেছেন কবীরের টেবিলের সামনে দিয়ে। আবার এসে যেতে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে অস্থির দেখাচ্ছে। তিনি থেকে থেকে বাইরে যাচ্ছেন। মিস্ত্রিদের কাজ দেখে আসছেন।
কবীর বলল, কিছু বলবেন?
আমার ইচ্ছে করে কি জানেন, আপনার সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ি। মিছিলে যাই। স্লোগান দেবো, জ¦ালো জ¦ালো, আগুন জ¦ালো। জ¦ালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও। গুঁড়িয়ে দাও, মুড়িয়ে দাও।
হাসি আড়াল করে কবীর জানতে চাইল, এরকম ইচ্ছে কেন করছে?
কবীরের টেবিলের এপাশে রাখা চেয়ারে মিজান সাহেব ধপাস করে বসে পড়লেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আশপাশে কেউ কান খাড়া করে তাদের কথা শুনছে কিনা। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত। কেউ কান খাড়া করে তাদের কথা শুনছে না।
মিজান সাহেব গলার স্বর অতিনিচু করে বললেন, গুটিকয়েক মানুষের জন্য দেশটা নষ্ট হয়ে গেল। করাপশন, স্বজনপ্রীতি, চুরি, জোচ্চুরি দেশটাকে শেষ করে ফেলল। আচ্ছা বলুন, সেদিন যে মেয়েটি এসেছিল, ওই যে অনিতা মুখার্জ্জী, আ কোয়ালিফাইড লেডি। দুর্দান্ত স্মার্ট। তার ভেতর বুনো ভাব আছে। ঝোপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করবেন, বন্য উগ্রগন্ধ আপনাকে মাতাল করে দেবে। সে হচ্ছে সেরকম। আ ওয়াইল্ড লেডি। ঠিক কি না বলুন? আপনি তো তাকে দেখেছেন। তার ভেতর একটা ভাঙচুর ভাব আছে কিনা?
অনিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিজান সাহেব বেশ উত্তেজনা বোধ করছেন। আলাদা ধরনের নিষিদ্ধ উত্তেজনা। তার কথাতে বোঝা যাচ্ছে। কবীর স্থির চোখে তাকিয়ে আছে মিজান সাহেবের দিকে। সে একটি কথাও বলেনি।
মিজান সাহেব আগের মতো অস্থির গলায় বললেন, তার ইন্টারভিউ আমি নিয়ে রেখেছি। এই অফিসের রিসেপসনিস্ট হিসেবে সে সিলেকটেড। দুম করে এমডি সাহেব তার শ্যালিকার ননদকে নিয়ে এলেন! আর শ্যালিকার কাণ্ডজ্ঞানটা দেখুন। বিয়ে হতে না হতেই ননদকে দুলাভাইয়ের অফিসে গছিয়ে দিলি! এখন অনিতা মেয়েটিকে কী জবাব দেব আমি!
তবে অনিতাকে নিয়ে মিজান সাহেব যত উত্তেজনাই দেখাক, এ ঘটনায় তাকে খুব বেশি দুঃখিত বলে মনে হচ্ছে না। বরং অফিসে একজন উইমেন স্টাফ আসছে তাতে তিনি বেশ আনন্দে আছেন। ঘুরেফিরে বাইরে গিয়ে কাজের তদারকি করছেন। রিসেপসনিস্টের জন্য কোন ব্র্যান্ডের কম্পিউটার কেনা হবে তার ফিরিস্তি দিয়েছেন। ল্যাপটপ কেনার কথা বলেছিলেন। পরে বাতিল করে বলেছেন, ল্যাপটপের স্ক্রিন ছোট। তাতে সবকিছু দেখে আরাম পাওয়া যায় না। একজন কলিগ বলেছে তাকে নাকি গতকাল অফিস ছুটির পর আতরের মার্কেটে দেখা গেছে।
কবীর আগ্রহ নিয়ে বলল, স্যার, চলুন ক্যান্টিনে যাই। গরম-গরম শিঙাড়া খেয়ে আসি।
মিজান সাহেব কথা থামিয়ে চুপ করে গেলেন। চোখের ওপর দুই ভুরু কুঁচকে কাছাকাছি চলে এসেছে। তিনি কবীরের মতলব বোঝার চেষ্টা করছেন। তার অস্বস্তি হচ্ছে। কবীরের মতলব ধরতে পারছেন না। একবার মানুষের ভেতরটা বুঝতে পারলে অস্বস্তি চলে যায়। যতক্ষণ সেখানে ধোঁয়াশা থাকে ততক্ষণ অস্বস্তি কাটতে চায় না। তার মনে হলো এই ছেলে বিরাট ধড়িবাজ। ওপরে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। সে আদতে ইবলিশের খাস চেলা। আজ থেকে এই ছেলের জন্য তার পুত্রসম ¯েœহ বাতিল।
গতদিন বিরাট কেলেঙ্কারি থেকে তিনি বেঁচে গেছেন মিজান সাহেব। অফিস থেকে ফেরার পথে নীল ডিএলোাইট কিনেছেন। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডেকে বেডরুমে ডিএলোাইট লাগানোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখলেন লাইন নষ্ট। কানেকশন পাওয়া যাচ্ছে না। মিজান সাহেবের স্ত্রীর নাম আতিয়া। তিনি বললেন, হঠাৎ ঘরে ডিএলোাইট লাগানোর দরকার কেন পড়ল, বলো দেখি?
মিজান সাহেব মিনমিন করে বললেন, বয়স বাড়ছে। অন্ধকারে ভয় লাগে। রাতে পেশাবের ঘনঘন বেগ আসে। উঠে বাথরুমে যেতে ভয় পাই।
আতিয়া বললেন, ঘরে ডিএলোাইট না লাগিয়ে ব্লাডের সুগার টেস্ট করাও। ডায়াবেটিস বাঁধিয়েছ কিনা দেখো! হাঁটাহাঁটি তো বন্ধ। বুকের নিচে ভুঁড়ি নাকি বিশাল তরমুজ বোঝা যায় না!
মিজান সাহেব স্ত্রীর কথা মেনে নিলেন। তিনি অনেক দিন থেকে ভাবছেন সন্ধ্যার পর কমপক্ষে ৪০ মিনিট হাঁটবেন। ডাক্তারও নিয়মিত হাঁটার কথা বলেছেন। কিন্তু হাঁটি-হাঁটব করে হাঁটা শুরু করা হয়নি।
অনেক ঝক্কি পেরিয়ে ঘরে নীল ডিএলোাইট লাগানো গেছে।
রাত। মিজান সাহেব শুয়ে আছেন। ঘরের মূল বাতি নিভিয়ে ডিএলোাইট জ¦ালানো হয়েছে। ঘর উজ্জ্বল নীল আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। স্ত্রী ঘরের কাজ শেষ করে শোয়ার জন্য আসবে। প্রতিরাতে মিজান সাহেব বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। স্ত্রী কখন বিছানায় আসে তিনি জানেন না। আজ পণ করেছেন ঘুমাবেন না।
মিজান সাহেবকে অবাক করে দিয়ে আতিয়া তাড়াতাড়ি ঘুমুতে এলেন। মশারি উঁচু করে বিছানায় উঠলেন। শাড়ির আঁচল ফেলে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন।
পাশ ফিরে মিজান সাহেব আলতো করে হাত রাখলেন স্ত্রীর গায়ে। আতিয়া কিছু বললেন না। তিনি ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। তাকে ভোরে উঠতে হয়। বড়ো ছেলে অফিসে যায় কাজে। দুই মেয়ে কলেজে যায়। ছোট যমজ মেয়ে দুজন যায় ইশকুলে। তাদের জন্য সকালের নাস্তা বানাতে হয়। তাদের টিফিন দিতে হয়।
মিজান সাহেব গাঢ় গলায় বললেন, আতিয়া, শোনো।
গায়ের ওপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে আতিয়া বললেন, ঘুমাও তো, ঢং কোরো না! এই শুনতে গিয়েই পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে।
হুট করে মিজান সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। তার ঘুম ছুটে গেছে। খানিকবাদে আতিয়ার ঘন নিশ্বাসের শব্দ তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলল। আতিয়া ঘুমিয়ে পড়েছেন। মিজান সাহেব মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। সব রাগ গিয়ে পড়ল কবীরের ওপর। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কবীরের সঙ্গে আর কথা বলবেন না। তার জীবন থেকে কবীর আউট।
মিজান সাহেব ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। ঘুম এলো না। ঘনঘন পেশাবের বেগ পাচ্ছে। তিনি বিছানা থেকে উঠে বারবার বাথরুমে যাচ্ছেন পেশাব করতে।
অফিসে এসে নতুন রিসেপসনিস্ট জয়েন করছে শুনে গতরাতের কথা ভুলে গেলেন। প্রশান্তমনে কবীরের সামনে এসে বসেছেন।
মিজান সাহেব নিচুস্বরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, আপনি ব্লগে লেখেন? ব্লগার, নাস্তিক? অবশ্য কমিউনিস্টমাত্রই নাস্তিক। আল্লাহ, ভগবানে তাদের বিশ্বাস নেই।
কবীর হাসছে। মিজান সাহেবের কথা শুনে মজা পেয়েছে। হাসিমুখে বলল, আমার ধারণা আমি অতিনি¤œমানের লেখক। আমার লেখা কেউ পড়ে না। তাই আমি ব্লগে লিখি না। নিজের মনের আনন্দে লিখে যাই। মাথায় সব সময় কবিতা ঘোরে।
মিজান সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। তার মনে হলো এই ছেলে এখুনি তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো কবিতা শোনাবে। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি ফেসবুকে লেখেন?
কবীর বলল, মনুষ্যসমাজে আমি সেই বিরল প্রাণী একজন, যার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।
আচমকা মিজান সাহেব খুশি হয়ে উঠলেন। তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন, আপনি কবি-মানুষ। আমাকে জটিল-টাইপ একটা স্ট্যাটাস লিখে দিন। অভাবনীয়। হালকা কিছু নয়। জ্ঞানের কথা। ফেসবুকে দেবো। ১০০ লাইক পাওয়া যায়, এমন স্ট্যাটাস।
রাস্তার পাশে চট বিছিয়ে বই বিক্রি করে দেখবেন। সেখানে খোঁজ করলে ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ নামে বই পাবেন। বইতে বার্থ ডে, লাভ ডে, প্রপোজ ডে সবকিছুর স্ট্যাটাস পাওয়া যায়।
সেসব দিয়ে আমার চলবে না। ওসব বাজারে কথাবার্তা। আমার চাই কড়কড়া নতুন স্ট্যাটাস। বিশেষ কিছু।
রগরগে?
আরেহ্ না! কী যে সব বলেন আপনি! জ্ঞানের কথা লিখবেন। যা পড়ে আমার ফেসবুক ফলোয়ার আর ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আছে তারা হতভম্ভ হয়ে যাবে। নিউ জেনারেশনের ভাষায় টাসকি খাওয়া। আমার জ্ঞানের গভীরতায় তারা আমাকে ঈর্ষা করবে। তব্দা লেগে যাবে।
এসব কোথায় শিখেছেন জটিল, টাসকি, তব্দা?
আরও আছে কুল, অসাম, ফাটাফাটি, ব্রো, সিস, হাবি, বেবি। ফেসবুক থাকা মজা আছে। বয়স বাড়ে না। সেদিন এক মেয়ে আমাকে মেসেঞ্জার ইনবক্সে মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজ দেখে আমার চান্দি গরম হয়ে গেল। আমি পড়লাম, হাই বুড়ো। পরে ভালো করে দেখি সে লিখেছে, হাই ব্রো!
এসব লেখে!
শুধু এসব! বুকের কাপড় খুলে ছবি দেয়। সব নেট থেকে নেওয়া। এমন ভাব দেখায় যেন নিজের ছবি। তারপর বলে, তোমার জিনিস দেখাও।
আপনি দেখান?
পাগল হয়েছেন! আমি সব বুঝি। এসব গে। সমকামী ছেলেরা ফেসবুকে মেয়ে সেজে ফাঁদ পাতে। বুড়ো মানুষ তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। বিশেষ করে যাদের গোঁফ আছে।
সেরকম কিছু লিখে দিই? আমি তো চেটে চেটে খাই টাইপ?
আরে নাহ্। আপনি লিখবেন জ্ঞানের কথা। জ্ঞানের কথার আড়ালে চাপা পড়ে যাবে বয়সের ক্রাইসিস।
কবীর বলল, ঠিক বলেছেন। এটা আপনার মিড এইজ ক্রাইসিস চলছে। অল্পবয়সের ছেলেমেয়েরা তার সুযোগ নিচ্ছে।
আপনি হচ্ছেন জ্ঞানের চিরন্তনী। মুখ দেখে মানুষ বোঝেন। আপনি বুঝবেন বলে আপনার কাছে এসেছি। দুর্দান্ত টাইপ একখানা জ্ঞানের স্ট্যাটাস লিখে দিন।
মিজান সাহেবের জন্য কবীর দুর্দান্ত টাইপের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখে দিতে রাজি হয়ে গেল।
মিজান সাহেব আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বললেন, ক্যান্টিনে গিয়ে আজ আমি আপনাকে শিঙাড়া আর চা খাওয়াব।
কবীর কাগজ-কলম টেনে নিয়ে লিখছে। মিজান সাহেব উঠে এসে কবীরের পেছনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কবীরের কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে লেখা পড়ছেন।
কবীর লিখল, শব্দের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। লোকে শব্দের অর্থ আরোপ করে। তা-ই তার অর্থ। ছোটবেলা থেকে আমরা শব্দের অনেক অর্থ শিখি। বড়ো হতে হতে শব্দের সেই অর্থ বদলে যায়। ছোটবেলায় ‘মাল’ বলতে শিখেছিলাম সম্পদ। বড়ো হতে হতে শিখলাম, ‘মাল’ মানে টাকা-পয়সা মানে মাল-কড়ি। অস্ত্র- অ্যাই মাল বের কর তো। শালাকে টেসে দিই। আবার ‘মাল’ মানে মানব সন্তান। হেব্বি মাল দোস্ত। চোখ ফেরানো যায় না। মাল খেয়ে মানুষ মাতাল হয়। মাল হচ্ছে মদ। রোজ রোজ আমি মাল খাওয়াব না। আজ তুই খাওয়াবি। সেরকম শিখলাম ‘ক্রসফায়ার’ আর ‘বন্দুকযুদ্ধ’। মানে হাতে হাতকড়া পরিয়ে সরাসরি গুলি করে কাউকে মেরে ফেলা।
এ পর্যন্ত পড়ে মিজান সাহেব জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগলেন। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তিনি অস্থির হয়ে গেছেন। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, ছিঁড়ে ফেলুন। এখুনি ছিঁড়ে ফেলুন।
কবীর কিছু বলল না। তাকে কেমন যেন খ্যাপাটে দেখাচ্ছে। সে লেখা কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো।

পাঁচ.
সূর্য ডুববে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে আছে। কবীর অফিস থেকে বের হয়েছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন ঘোরলাগা অনুভব হচ্ছে। কী বিচিত্র রং আকাশে। রং মিশে মেঘগুলোর চেহারা হয়েছে অনন্যসাধারণ। কোথাও টকটকে লাল, খানিক দূরে সেই লাল ফিকে হয়ে এসেছে। ওপাশে মেঘের চেহারা বেগুনি আর লাল মেশানো। এ যেন বাস্তব নয়, অতিপ্রাকৃত, অনৈসর্গিক।
কবীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এখানে দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখবে। শুধু সূর্য ডোবা দেখবে না, যতক্ষণ সূর্যের এমন অদ্ভুত আভা থাকে ততক্ষণ দেখবে।
মনে হলো পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কবীর আকাশ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে এলো। অনিতা দাঁড়িয়ে আছে। অনিতা কখন এসেছে কবীর খেয়াল করেনি। মুগ্ধ দুজন এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কবীর বলল, আপনি!
অনিতা বলল, আপনার ধ্যান ভেঙে দিলাম। আকাশ দেখছিলেন।
আচমকা ঝলএলো করে উঠেছে কবিরের ভেতরটা। সূর্য ডুবছে। সূর্যের শেষ রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে অনিতার মুখে। তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। গতদিনের মতো বিষণ্ন নয়, সতেজ তরতাজা। কবীর চনমনে গলায় বলল, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কী অসম্ভব সুন্দর!
দেখেছি। আপনি যখন মুগ্ধ চোখে আকাশ দেখছিলেন তখন।
বাসায় ফিরছেন?
কথা না বলে আসুন আমরা দুজন একসঙ্গে সূর্যডোবা দেখি। এমন সুন্দর মুহূর্ত হয়তো সব সময় পাওয়া যাবে না।
কবীরের বুকের ভেতর ধক্ ধক্ শব্দ হচ্ছে। বিব্রত বোধ করছে সে। মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতরের আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। অনিতা শুনতে পাচ্ছে।
অনিতা তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তার চোখে বিহ্বল মুগ্ধতা। অনিতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে কবীর আকাশের দিকে তাকাল।
গাছপালার আড়ালে সূর্য ডুবে গেল। ধীরে ধীরে আকাশ রং বদলাচ্ছে। সন্ধ্যা গাঢ় হচ্ছে। খানিকবাদে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে। অনিতা বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে চলুন কোথাও বসে চা খাই আর কথা বলি।
কবীর হেসে ফেলেছে। বিব্রতভাব কাটানোর জন্য হাসতে গিয়ে নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। অনিতা জিজ্ঞেস করল, হাসছেন যে! বাসায় ফেরার তাড়া আছে বুঝি?
রাস্তার পাশের টি-স্টল ছাড়া আর কোনো জায়গা আমার চেনা নেই। যেখানে আপনাকে নিয়ে যাব চা খেতে।
সে দায়িত্ব আমার। রাস্তার পাশের টি-স্টলে এর পরে চা খাব। প্রথম দিন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
অনিতা বেশ শান্ত পায়ে হাঁটছে। যেন তার কোনো তাড়া নেই। অফিসে যেদিন গিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বলে বারবার ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। আজ সন্ধ্যা মিলিয়েছে। অনিতার ভেতর কোনো ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। আজও অনিতা শাড়ি পড়েছে। গতদিনও শাড়ি পরেছিল। সেই তাঁতের শাড়ি। তবে এটা আলাদা। তাকে দেখতে ভালো লাগছে। সম্মোহিত হওয়ার মতো।
অনিতার পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে কবীর। তার নিশ্চিন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ তার দায়িত্ব নিয়েছে।
কথা বলা দরকার। কী কথা বলবে বুঝতে পারছে না। অমিতাভর কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না এটা বুঝেছে। নিজে থেকে বললে বলবে, না বললে জানতে চাইবে না।
রাতের প্রথম আলোয় অনিতার চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। আন্তরিক গলায় বলল, আচ্ছা অফিসে বসে চট করে অমন দুলাইনের কবিতা বানিয়ে ফেললেন সেদিন?
অনিতার দৃষ্টিতে চোখ ধাঁধানো হাসি। মুখে রাস্তার আলো এসে পড়েছে। তার চোখ হাসছে। চোখে হাসির চমক ধরে রেখে বলল, বেচারা!
অনিতাকে আজ অন্য রকম লাগছে। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত। অফিসের পরে আরও একদিন তাদের দেখা হয়েছে সে কথা যেন ভুলে গেছে।
তারা দুজন রাস্তা পার হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্ট। আশপাশে এমন রেস্টুরেন্ট আছে কবীরের জানা ছিল না। রেস্টুরেন্টের নাম ক্রাউন ক্যাফে।
দেয়ালের কাছাকাছি ফাঁকা টেবিল পাওয়া গেছে। ছাইরঙের চারকোনা ছোট্ট টেবিলের দুপাশে কালো চেয়ার। তাতে মেরুন কাপড়ের কভার আর ছোট্ট কুশন।
বসতে বসতে অনিতা বলল, এরা ভালো কফি বানায়, কফি দিতে বলি?
কবীর মুখে কিছু বলল না। একপাশে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। অনিতা বলল, সঙ্গে কী খাবেন, চিকেন উইং, ভেজিটেবল রোল অথবা পাকোড়া?
শুধু কফি খাব।
তাই হয় নাকি? সঙ্গে কিছু নিন।
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। কফি হলেই চলবে।
দু-তিনজন করে মানুষ ঢুকছে। রেস্টুরেন্টে লোক বাড়ছে। ওয়েটারদের তৎপরতা দেখে মনে হলো বেশ ভালো চলে এই রেস্টুরেন্ট।
একজনকে ডেকে অনিতা দুকাপ কফির কথা বলল। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেয়েছে। বোতল কবীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জল খান। অনেকখানি হাঁটিয়েছি আপনাকে।
কোনো কোনে

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়