গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ স্পন্দনে জেগে উঠবে প্রাণ : দুয়ারে বৈশাখ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** বাঙালির প্রধান অসা¤প্রদায়িক উৎসব **
ঝর্ণা মনি : একদিকে বাজছে ঋতুরাজ বসন্তের বিদায় ঘণ্টা, অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে খরতাপের গ্রীষ্ম, পয়লা বৈশাখ। ভোরের নতুন সূর্য নতুন আলো ছড়িয়ে আবাহন করবে নতুন দিনের। নতুন সুরে বাঁধবে তান। প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠবে প্রাণ। আলোকরশ্মির ছোঁয়ায় নব তরঙ্গে উদ্বেলিত হবে হৃদয়। হৃদয়ের সব দুয়ার খোলা। কারণ চৈত্র দিনের ক্লান্তি শেষে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আসবে বৈশাখ। আর মাত্র চার দিন পরই বিদায় নেবে বঙ্গাব্দ ১৪৩০, হিসাবের খাতায় বসবে নতুন সংখ্যা ১৪৩১। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে বরাবরের মতো এবারো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আগামী রবিবার (১৪ এপ্রিল) পুরো দেশ মেতে উঠবে বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘নববর্ষ বরণ’ উদযাপনে।
মূলত. নববর্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার মোহনা। যে মোহনায় একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নববর্ষ। ধর্মান্ধ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই, প্রতিবাদ, অহিংস আন্দোলনের নাম বাংলা নববর্ষ।
পয়লা বৈশাখ লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধ। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন- এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে

জাতীয়তাবোধে। সারাদেশে এই অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রতিটি বাঙালির শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। তবে বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়; বাংলা ভাষাভাষী নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে জাতি। বর্ণিল উৎসবে মেতে আমন্ত্রণ জানায় প্রাণের উৎসবকে। পয়লা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম এই দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশ-বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালি নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সে হিসেবে এটি বাঙালির সর্বজনীন প্রাণের উৎসব।
যেভাবে বাংলা নববর্ষ : ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের আমলে বৈশাখে প্রথম বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। পরে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশে পরিবর্তিত করেন। উইকিপিডিয়িা থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে অনুকূল সময়ের বিবেচনায় মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আকবরের সময় থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন সবাই বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। মূলত. বাঙালির এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলায় থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো- গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল।
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ : ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে সর্বপ্রথম পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করে ছায়ানট। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসা¤প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
পয়লা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশ মেতে উঠবে উৎসবে; রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন দেবে সুদিনের পথে এগিয়ে চলার মন্ত্র, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা জানাবে শান্তির আবাহন। সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আয়োজনে তপ্ত এই বৈশাখ বর্ণিল হবে উৎসবে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রেখে অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতার ‘আমরা তো তিমির বিনিশী হতে চাই’ লাইনটি।
নতুন প্রাণের উচ্ছ¡াসে বাঙালির বাংলা নববর্ষ বরণে চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। দিনরাত এক করে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এবার বড় হবে যাত্রাপথ। সাম্য ও সহিষ্ণুতার প্রতীক মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা নতুন বছরকে বরণে চলছে তারই প্রস্তুতি। রং-তুলির আঁচড়, আলপনা আর প্রতিকৃতি নির্মাণে ব্যস্ত চারুকলার শিক্ষার্থীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার দেখা যাবে বাঘ ও পেঁচার মুখোশ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে হাতি। বাহারি রঙের মুখোশ মনে করিয়ে দেবে বাংলার ঐতিহ্য। চারুকলার শিক্ষার্থীরা বলছেন, সবাই কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। তাই দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। সেইসঙ্গে বৈশাখ ঘিরে সিনিয়র ও জুনিয়রদের মধ্যে বন্ধনটা ভালোভাবে তৈরি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমরা যদি পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করি, তাহলে মৌলবাদ শক্তিশালী হবে। পহেলা বৈশাখ একটি অসা¤প্রদায়িক উৎসব। মৌলবাদ ঠেকাতে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে হবে।
অন্যদিকে ‘দূর করো আত্মকেন্দ্রিকতা, আপনি জ্বালো এই তো আলো’- এই আহ্বান নিয়ে বর্ষবরণে ছায়ানটের আয়োজনে রয়েছে- ভোরের আলো ফুটতেই আহীর ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে নতুন বছর আবাহন। নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠান। ছায়ানটের এবারের আয়োজনে সম্মেলক গান থাকবে ১১টি, একক গান থাকবে ১৫টি এবং পাঠ ও আবৃত্তি থাকবে। শুরুতেই একটি রাগসংগীত থাকবে। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, আমরা মানুষের জয়গান করব। বিশ্বব্যাপী ভোগবাদ বেড়েছে, কমেছে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। ফলে ক্ষয়ে চলেছে মানবতা। ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। এই সংকটে আমরা আশাহত নই। স্বার্থপরতা নয়, মনুষ্যত্বকে পাওয়ার অভিলাষে ছায়ানটের আহ্বান- স্বাভাবিকতার সাধনা এবং স¤প্রীতির ধ্যান।
প্রাজ্ঞজনের মতে, মৌলবাদের বিস্তৃতিলাভ, তৃণমূলে ধর্মীয় উগ্রবাদ, বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক চর্চা বিমূখতার সময়ে বাংলা নববর্ষ হতে পারে সম্মিলিত প্রতিবাদের অহিংস হাতিয়ার। ধর্মান্ধ, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সম্প্রীতির বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে পয়লা বৈশাখ যার মূলমন্ত্র- বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, আমরা সবাই বাঙালি। জয় হোক বাঙালির। সবাইকে আগাম শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়