গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : ভারতের সবচেয়ে নিম্নমানের প্রোডাক্ট আওয়ামী লীগ

আগের সংবাদ

বহুমাত্রিক কৌশল আ.লীগের

পরের সংবাদ

ছি ভিসি! অত্যাশ্চর্য উপাচার্য

প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভিসিরা প্রায় সবাই এমন হয়ে যাচ্ছেন কেন? নাকি ভিসিরা এমনই হন? নিয়োগই দেয়া হয় এমন দেখে দেখে? দেশে কাউকে একটু শখ করেও সম্মান দেখানোর জায়গা আর থাকছে না তাহলে? তা বঙ্গবন্ধুর নাম জড়ানো দেশের সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসালয়েও। এক সময়ের পিজি, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সংক্ষেপে বিএসএমএমইউ। নাচে-গানে বরণে এর নতুন ভিসি নামকরা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নুরুল হক একটুও শরমিন্দা নন। বরং উল্লসিত-অভিভূত। মোজ-মাস্তিতে দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন শুক্রবার দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের জানান তার এ অনুভূতির কথা। তিনি যে রোডশো করে দায়িত্ব নেননি, এটাই বা কি কম? ভিসির দায়িত্ব নিতে পরিবারের সদস্যদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ব্যান্ড বাজিয়ে, যারপরনাই নাচ-গানে বরণীয় হয়েছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাচের ফুটেজ ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়া মাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে। ভিসিবিষয়ক আলোচনায় ভিন্নমাত্রা যোগ করলেন দেশসেরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দীন মো. নুরুল হক। নিজেকে তিনি ধরে রাখতে পারেননি সময়টাতে। সংবাদ সম্মেলনের নামে বরণ অনুষ্ঠানে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ করে উচ্ছ¡াসের সঙ্গে বলেছেন, যে বর্ণাঢ্য আয়োজনে আমাকে গ্রহণ করলেন তা অবিশ্বাস্য। আমার জীবনে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমার জীবনে শ্রেষ্ঠতম দিন এটি। আসলেই ঘটনা বটে। ব্যাপক প্রস্তুতিভরা আয়োজন উপভোগের জন্য স্ত্রী, দুই ছেলে, নাতিসহ অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও নিয়ে এসেছিলেন। তার আগের ভিসি শারফুদ্দিন আহমেদের ব্যাপক ভাইরালের একটি কারণ ছিল আত্মীয়স্বজনদের পাইকারি হারে চাকরি দেয়ার ঘটনায়। এই ভিসি আবার গর্বের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমার আগের সব ভিসি পালিয়ে গেছেন। আমি তো তবু অফিস করছি।’ সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি-অনিয়মের মাঝেই নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন দীন মো. নুরুল হক। নিজেকে কোনো গ্রুপের নয়, সবার দাবি করে নুরুল হক বলেন, ‘আমার পরিচয় একটাই, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লোক।’
যেখানে নিজের যোগ্যতা-সক্ষমতার চেয়ে ‘আমি অমুকের লোক’ পরিচয় মুখ্য সেখানে তিনি এ ধারার বাইরে যাননি। পরিচয় প্রশ্নে একই ধারায় ছিলেন বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদও। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ডাক্তারদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদকেও কেয়ার করতেন না তিনি। ছেলে, ছেলের বউ ও স্ত্রীর আত্মীয়সহ হাজার দুয়েক নিয়োগের রেকর্ড গড়ার সময়ও কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকার মনে করেননি। একটু-আধটু পাত্তা দিলে তার দুর্নীতির খবরাদি এভাবে নাও ছড়াতে পারত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের গড়পড়তা জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন অধ্যাপক হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া অনন্য পর্যায়ের গৌরবের বিষয়। কিন্তু গত বছর কয়েক ধরে উপাচার্যদের বেশ কয়েকজন এমন সব ঘটনা ঘটিয়ে চলছেন যা কেবল আশ্চর্যজনক নয়, মহাশ্চর্যজনক। হালে তা আরো বেশি কিছু। পদটাকেই খেলো-হাস্যকর করার যেন এক প্রতিযোগিতা চেপে বসেছে। রীতিমতো ভেল্কি দেখানো ক্ষমতা, দুর্নীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতির ক্ষুধা তাদের। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের মাঝে চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার রেকর্ড গড়া ভিসি পর্যন্ত আছেন। অতীতে কোনো কোনো ভিসিকে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তেও হয়েছে। এ সারির কতিপয় ভিসি মহোদয় কিছু চামচা আর তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়ে একটা বলয় গড়েন। সিনিয়র বা অভিজ্ঞ শিক্ষকরাও তাদের কাছে ভিড়তে পারেন না। যখন সময় শেষ হয়, লাঞ্ছিত হওয়ার সময় দেখা যায়, আশপাশে সেই চামচা, কর্মচারী কেউ নেই। তারা নতুন জায়গায় নতুন সুরে গাইছেন। তাদের নাচনকোঁদনে মনে হয় যেন ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মাত্র ক’দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য করা হয়েছে অধ্যাপক আবু তাহেরকে। তার আগের ভিসি শিরীণ আখতার ও সহ-উপাচার্য বেনু কুমার দের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের জেরে এ নতুন নিয়োগ। ইউজিসির মাধ্যমে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গত কয়েক বছরের নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু তদন্ত হলে অনেকের মুখোশ উন্মোচন হয়ে থলে থেকে অনেক বিড়াল বের হয়ে আসতে পারে। এমন সব লোককে এ দামি চেয়ারটিতে বসানো হচ্ছে যাদের এর ভার নেয়ার ক্ষমতাই নেই। এর কিছুটা দেখিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া।
গত ক’দিন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় তার একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তিনি সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তাকে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন। যতগুলো ফুলের তোড়া পেয়েছেন, এসব ফুলের মাঝে বসে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে এ ছবি নিয়ে কেউ কেউ তার রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি রুচির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন।’ এ ছবিটি পোস্ট করে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান…।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে প্রশ্ন বা কোনো মন্তব্য করাও লজ্জার। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মান-ইজ্জতের চামড়া এতই শক্ত, জুতাপেটা করলেও যায় না। আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের রাতের আঁধারে পুলিশ প্রহরায় দৌড়ে ফার্স্ট হয়েও শরম লাগেনি। একজন ছাত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনের অডিও শুনে যে কারো বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার লাজশরমের চামড়া কত পোক্ত। জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিদায়টাও সুখকর হয়নি। ঘেরাও, ধাওয়া খাওয়া, আজেবাজে ঘটনায় জড়ানো ভিসিদের রূপ-বৈশিষ্ট্যে এসে ঠেকা শুধু একজন উপাচার্যকে কলঙ্কিত করছে না। সম্মানের জায়গা শেষ করে দিচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ তো ধ্বংস করছেই। কিন্তু তাদের বোধোদয় হয় না। পরে যারা স্থলাভিসিক্ত হন তারাও এ থেকে শিক্ষা নেন না।
ভিসি মানে আইকন। শিক্ষকদেরও শিক্ষক। শিক্ষাগুরু। পদটা কেবল প্রশাসনিক নয়। বিরল সম্মানের প্রতীক। সবার শ্রদ্ধাস্পদ। কিন্তু গত বছর কয়েক ধরে একের পর এক নানা অনৈতিকতা, কেলেঙ্কারিতে ছি ছি হচ্ছে ভিসিদের নিয়ে। গণমাধ্যমে হাস্যকর ট্রল হচ্ছে তাদের নিয়ে। তা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী হয়ে মেডিকেলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। ভাষা, আচরণ, রুচির অচিন্ত্যনীয় কদর্য রূপ দেখিয়ে যেন প্রমাণ করে ছাড়লেন, ভিসি মানে বেলাজ-কলঙ্কিত কিছু। একটা সময় উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, প্রশাসনিকভাবে কঠোর অথচ গ্রহণযোগ্য শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের কাছেও তারা ছিলেন সম্মানিত। মহিমান্বিত।
গত কয়েক বছর ধরে ভিন্ন চিত্র। সাধারণ নাগরিক দূরের কথা, শিক্ষক-ছাত্ররাও সম্মান করতে পারছেন না ভিসিদের। অভিযোগে আক্রান্ত সাবেক ভিসিদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। দুর্নীতি, অবৈধভাবে ভর্তি, প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনৈতিক কাণ্ডের অভিযোগ এসব সাবেক-বর্তমানের বিরুদ্ধে। দলীয় আনুগত্যসহ নানা তদবিরে নিয়োগ পাওয়া ভিসিদের নিয়ে ছি ছির শিকার সরকারও। ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয়কে বেশি বিবেচনায় নেয়ায় তারা সবকিছুকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্যও এখন ওপেন সিক্রেট। এছাড়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতি বছর বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ হয়। ভিসিরা সেখানে জড়িয়ে পড়ছেন টার্গেট নিয়ে। নিয়ম-নীতির ধার ধারতে চান না। বছর তিনেক আগে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. মাসুম হাবিবের বিরুদ্ধে ওঠে সরকারি বাড়ি ও গাড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। তার জন্য বরাদ্দকৃত বাংলোকে গেস্টহাউস হিসেবে দেখিয়ে কৌশলে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছিলেন তার ছেলে। গাড়ির তেল খরচও বহন করছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
ভিসি পদটির গৌরব-সৌন্দর্যের ওজন বোঝার সামর্থ্যও তারা রাখছেন কিনা- প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা ডুবিয়ে ছাড়ছেন সরকারকেও। কথায় কথায় নিজেদের সরকারের খাস লোক, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পরিচিত ইত্যাদি গলাবাজিতে তারা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে আসামির কাঠগড়ায় এনে ঠেকাচ্ছেন। আর কত? একটা সময় উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, প্রশাসনিকভাবে কঠোর অথচ গ্রহণযোগ্য শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের কাছেও তারা ছিলেন সম্মানিত। মহিমান্বিত। গত কয়েক বছর ধরে ভিন্ন চিত্র। সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, শিক্ষক-ছাত্ররাও সম্মান করতে পারছেন না ভিসিদের। শ্রদ্ধা-সমীহের বদলে আজেবাজে মন্তব্য করেন সরকারের গুণগানে অন্তপ্রাণ দলবাজ ভিসিদের ওপর। প্রবীণ শিক্ষাবিদদের মতে, যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় না বসানোর একটা করুণ পরিণতিই ভোগ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর জেরে ছি ছির পাত্র হচ্ছেন ভিসিরা। আবার দেশের সামগ্রিক বাস্তবতাও স্বীকার না করে পারা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে নয়। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়