গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : ভারতের সবচেয়ে নিম্নমানের প্রোডাক্ট আওয়ামী লীগ

আগের সংবাদ

বহুমাত্রিক কৌশল আ.লীগের

পরের সংবাদ

কিশোর গ্যাং, বড় ভাই এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা

প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বছরখানেক আগে দেয়াল ঘড়ি মেরামতের জন্য যেতে হয়েছিল। মেকানিক ভদ্রলোক এক পর্যায়ে আমার পরিচয় পেয়ে খুব সকরুণ কণ্ঠে অনুযোগ করে বললেন, দাদা আপনারা সাংবাদিক অনেক কিছু নিয়ে লেখালেখি করেন। কিন্তু কিশোর অপরাধ না, কী যেন বলে সেসব নিয়ে লেখেন না কেন? চট্টগ্রাম নগরের জামাল খান, মোমিন রোড বিশেষ করে চেরাগী পাহাড়ের নাম উল্লেখ করে অভিযোগের সুরে বললেন, ওইখানে আগে লেখক, কবি, শিল্পীদের আড্ডা ছিল। এখন সেখানে কোনো ভদ্রলোক যেতে চায় না।
বললেন, একটু লিখুন দাদা। খুব কষ্ট আর অপমান থেকে বলছি, এদের পাল্লায় পড়ে আমার ছেলেটাও বরবাদ হয়ে গেল। একদম কথা শোনে না। মাঝরাতেও ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দাদা পারলে পুলিশ দিয়ে হলেও ছেলেটাকে একটু শাসিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে পুলিশ পেটাক আমি কিছু বলব না।
জিজ্ঞেস করলাম ছেলে কিসে পড়ে।
বললেন, ক্লাস নাইনে।
শুনে আমি থ। ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, একজন পিতা কতটা অসহায় হলে, কতটা নিরুপায় হলে নিজের প্রায় শিশুসন্তানকে পুলিশ দিয়ে পেটাতে চান! এমন কত লাখ লাখ অসহায় পিতা-মাতা আছেন দেশে এখন?
বছরতিনেক আগে আমরা কজন দাঁড়িয়েছিলাম চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের দক্ষিণে ফুটপাতে। তখন রাত ৮টা কি সাড়ে ৮টার মতো হবে হয়তো। হঠাৎ একযোগে অনেক গাড়ির তীব্র হর্নে চমকে উঠলাম প্রায়। দেখলাম ১৫-২০টি মোটরসাইকেল তীব্র বেগে এবং হর্ন বাজিয়ে খাস্তগীর স্কুল ক্রস করে চেরাগী পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন করে যাত্রী। সবার আচরণে উদ্ধত, দুর্বিনীত ভাব। রাস্তার সন্ত্রস্ত অন্যান্য যানবাহন তাদের দ্রুত পথ করে দিচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতে আর আতঙ্কে ভুগছি, এই বুঝি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল। দেরি নয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িগুলো আবার ফিরে আসতে দেখলাম। প্রেস ক্লাব পার হয়ে যেতে লক্ষ করলাম কারো কারো পেছনের সিটে মেয়েও আছে। একটি মেয়েকে দেখলাম, দ্রুত ও অসঙ্গতি গতির মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তাদের এই ‘উন্মাদনার দৃশ্য’ মোবাইল ফোনে ভিডিও করছে। চারপাশের আতঙ্কিত অনেকে এদের ‘লঙ্কাকাণ্ড’ দেখে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
এই কিশোররা যখন দলবেঁধে হাঁটে, মোটরসাইকেলে বেপরোয়াভাবে যায় কিংবা গোল করে কথা বলে তখন আমার ভেতরটা শুকিয়ে যায়। আমি এই প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না। কেবলই ভাবতে থাকি আমিও কি ওই বয়সে এদের মতো ছিলাম? মনে করতে পারি না। বয়সের কারণে, তারুণ্যের উন্মাদনায় কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে কিছুটা বেপরোয়া ছিলাম হয়তো, তবে এমন ছিলাম বলে মনে হয় না। এদের কাছে একজন বয়স্ক লোকের আলাদা কোনো সম্মান নেই। এমনকি এরা নারীদেরও সম্মান করে না।
সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর বয়সিদের এমন আচরণ, তাদের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সমাজবিজ্ঞানীরা। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাও এখন এ বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিশোর অপরাধীদের ভয়ংকর সব তথ্য। ২০১৭ সালে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা গোপনীয় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজধানী ও এর আশপাশে কিশোর-তরুণদের ১২টি গ্রুপ মেয়েদের উত্ত্যক্ত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা এলাকাভিত্তিক এসব গ্রুপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশপাশের এলাকায় সক্রিয় আছে। এসব গ্রুপে অছাত্রও আছে অনেক। প্রতিবেদনে, ঢাকার ১২টিসহ সারাদেশে এমন ৩৫টি গ্রুপের কথা বলা হয়েছে। কয়েক বছর আগে ঢাকার উত্তরা ও তেজগাঁওয়ে দুই কিশোর আদনান কবির ও আল আমিন খুনের পর কিশোর অপরাধ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এর কিছুদিন পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানা এলাকায় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচশর বেশি সদস্য সক্রিয় রয়েছে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের সন্তানরাও রয়েছে। এমনকি বাদ যায়নি পথশিশুরাও। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলছে তাদের অপরাধযজ্ঞ। যার পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে কথিত ‘বড় ভাই’।
স¤প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম নগরে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। নগর পুলিশের ১৬টি থানা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সিরাও রয়েছেন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন।
ঢাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরো অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টি কিশোর গ্যাং-সংশ্লিষ্ট।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে অনেকের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এ সময়ে সঠিক শিক্ষা না পেলে যে কারো বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া উঠতি বয়সের বা তারুণ্যের একটি উদ্দামতা থাকে। অনেক সময় অ্যাডভেঞ্চার বা হিরোইজমের বশেও অনেক কিশোর-তরুণ বিপথে পরিচালিত হয়ে থাকে।
এ সময় তারা পড়াশোনায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এই ধরনের কিশোর-তরুণরা আসে সাধারণত দুই ধরনের পরিবার থেকে। ধনী পরিবারের সন্তান এবং যেসব পরিবারে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক কম, অর্থাৎ যাদের সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব আছে তেমন পরিবারের সন্তানরাই সাধারণত এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে গরিব ও শ্রমজীবী পরিবারের অনেক সন্তান রাগ, ক্ষোভ, হতাশা থেকেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আবার আমি এমন আদর্শ পরিবারও দেখেছি যে পরিবারের সন্তান মাদকাসক্ত হয়েছে ওপরে বর্ণিত কারণগুলো বিদ্যমান না থাকা সত্ত্বেও। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সন্তানের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে থাকেন। সন্তানরা বাবা-মাকে উৎপীড়ন করে। কারণ তারা জানে, এ ক্ষেত্রে বাবা-মা অসহায়।
জীবন সম্পর্কে এদের যথেষ্ট জানাশোনা না থাকায় এরা চটজলদি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তা খুনোখুনির মতো নির্মম ঘটনার বেলায়ও। এরা অপরিণামদর্শী, অদূরদর্শী। এটি আমাদের নগরায়ণের কুফল বলে বলা হলেও এমন দৃশ্য গ্রামে-গঞ্জেও কম নয়। সমস্যা হচ্ছে এদের হাত থেকে এদের মায়ের বয়সি নারীও রক্ষা পায় না। এরা ক্রমে ক্রমে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার পর নেশার খরচ জোগাতে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান ছাড়াও পথশিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা ভীষণ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দ্রুত বের করতে না পারলে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে এবং তাতে সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। কাজেই প্রশাসন ও এদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আগে আমাদের পাড়া-মহল্লায় সর্দারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছিল। পাড়ায় পাড়ায় এ ধরনের কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার মধ্যেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার কোনো ছেলে এ ধরনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়লে তার জন্য সালিশ-বিচার হতো, দোষী তরুণের পরিবারকে তার দায় নিতে হতো। এখন পাড়ায় পাড়ায় সেই সমাজবদ্ধতা নেই।
বিষয়টিকে শুধু ভাবনার এবং সমস্যার মধ্যে রেখে দিলে চলবে না। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। কাজেই এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং ও কাউন্সিলিং করতে হবে। সমাজের আলোকিত, আলোচিত ভালো মানুষদের যুক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যে কোনো অপরাধী অপরাধ করার আগে একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে এই কিশোর-তরুণদের ব্যবহার না করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। অন্যের সন্তানকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নিজের সন্তানকে নিরাপদ রাখার ভাবনা অত্যন্ত গর্হিত ও অমানবিক। তাতে শেষ পর্যন্ত নিজেকেই বিপদে ঠেলে দেয়া হবে।

কামরুল হাসান বাদল : কবি ও সাংবাদিক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়