মির্জা ফখরুল : দলমত নির্বিশেষে ‘গণঐক্য’ গড়ার আহ্বান

আগের সংবাদ

পরিবেশবাদীদের ক্ষোভ প: সুনামগঞ্জে একসঙ্গে ৩ হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা : পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতিও আসতে শুরু করেছে, কিন্তু পাকিস্তান তখনো মনে করছে, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সবকিছু পাল্টে দিয়ে একতা-ইমান-শৃঙ্খলার বন্ধনে পেয়ারা পাকিস্তান আবার এক হয়ে যাবে।
১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ ম্যালকম ব্রাউন রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য যে ডেসপাচটি পাঠিয়েছেন তা ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। ডেসপাচটি অনূদিত হলো :
প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সতর্ক করে দিয়েছেন তড়িঘড়ি করে যে সব দেশ বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃত দেবে পাকিস্তান তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
এই হুমকি আরো জোরদার করে দেখাতে আজ পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয় এবং তাকে জানিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তান পোলান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
পাকিস্তান মঙ্গোলিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
গতকাল (১২ জানুয়ারি ১৯৭২) পাকিস্তান বুলগেরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে তার আগে এ কাজটি করেছে ভারতের সঙ্গে। সবক্ষেত্রেই সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ সেসব দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান। সবশেষ স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশ বার্মা আজই স্বীকৃতি ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে ৭টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করল। এটা অনুমেয় পাকিস্তান শিগগিরই বার্মার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
গোটা পাকিস্তান সম্প্রচারিত লাহোরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো বিশ্ববাসীর কাছে আবেদনে বলেছেন : ‘আমাদের কিছু সময় দিন। আমি চাই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার আর একটি সুযোগ পৃথিবী আমাদের দিক।’
ভুট্টো বলেন, বড় শক্তিগুলো যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালিদের ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে পাকিস্তানের জন্য সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের কিছু সময় দিন। পূর্ব পাকিস্তান এখনো বিদেশি দখলাধীন, এই দখল প্রত্যাহার না হলে তারা তাদের প্রশাসন নিয়মিত করতে পারবে না।
তিনি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান যা বলেছেন আমরা তাই শুনেছি। আপনারাও তা শুনেলেন আমি আবারো বলি। সেটাই শেষ কথা নয়।
মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ঐক্য শেষ হয়ে গেছে।’
যখন পৃথিবীর অনেক দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান আসন্ন এমন সময় তা স্থগিত রাখতে ভুট্টো পৃথিবীর কাছে আপিল জানিয়েছেন।
মনে করা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট দেশগুলো শিগগিরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটেন ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো ঢাকা সরকারকে স্বীকৃতি দেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে তাহলে পাকিস্তান এসব দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
পূর্ব পাকিস্তানের এবং শেখ মুজিবের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে ভুট্টো আশাবাদী এ কথার পুনরুক্তি করলেন, তিনি ঢাকায় সহায়তা পাঠাতে চান বলে জানালেন। আমরা সেখানে চাল পাঠাতে চাই; গম নয়, আমাদের নিজেদের গমের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া যা কিছু প্রয়োজন আমরা নিঃশর্তভাবে তা পাঠাতে পাকিস্তান সরকার তৈরি। এটা আমাদের দায়িত্ব। পাকিস্তানে ২৮ হাজার বাঙালি পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে নিয়োজিত। তারা যদি ঢাকার নতুন প্রশাসনকে সহায়তা করতে ফিরে যেতে চান তাহলে তাদের সানন্দে যেতে দেয়া হবে।
শিগগিরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এখনো তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। তবে তারা তাদের কনসুলেট জেনারেল অফিস ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়নি। পাকিস্তানের অপর এক প্রধান মিত্র চীন ও তাদের কনসুলেট অফিস রেখে দিয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বিষয়ে একমত মনে হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারতীয় সৈন্যবাহিনী সরে যাচ্ছে এবং নতুন প্রশাসন সেখানে স্পষ্টভাবে কাজ শুরু করছে, ততক্ষণ তারা স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন না। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিয়েছে বর্ণিত শর্তগুলো শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে এবং এর মধ্যেই তারা অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক চ্যানেলে শেখ মুজিব ও তার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কচ্ছেদ যতটা না বাস্তব তার চেয়ে বেশি প্রতীকী। যদিও দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু পরস্পরের রাজধানীতে কারোই কোনো কূটনৈতিক মিশন ছিল না। এই সম্পর্কটি নিয়ন্ত্রণ করত সোভিয়েত ইউনিয়ন।
পাকিস্তান যদি সম্পর্কচ্ছেদের এই ধারাটি অব্যাহত রাখত তাহলে পাকিস্তান হয়ে উঠত পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম দেশ। যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপর পাকিস্তান ভরসা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো বাস্তবতা খণ্ডন করা সম্ভব নয় বলেই সেই দুই দেশও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছে।
একাত্তরে ঢাকার মাটিতে পাকিস্তানের পরাজয়ের একটি বাস্তব চিত্র রচনা করেছেন ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির একজন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা সেনাদপ্তরের গণসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক। ১৯ আগস্ট ১৯৮৮ সালে আমের ঝুড়িতে লুকানো বোমার বিস্ফোরণে ভূপাতিত হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে বহনকারী সেনা ১৩০ উড়োজাহাজ। বাহওয়ালপুর থেকে উড্ডয়নের আড়াই মিনিট পর বিস্ফোরিত উড়োজাহাজটি খাড়াভাবে নিচে নেমে আসে, বিস্ফোরণে নিহত হন ৩১ আরোহীর সবাই। নিহতদের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, জেনারেল আখতার আবদুর রেহমান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড লুইস ব্যাফেল, মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার হার্বার্ট ওয়াসম ও পাকিস্তান আইএসপিআর প্রধান ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক। সেই সিদ্দিক সালিকের বিবরণ :
১৪ ডিসেম্বর ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শেষ দিন। সরকার ও গভর্নমেন্ট হাউসের ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো। শত্রæদের কেবল জেনারেল নিয়াজিকে এবং তার অধীনস্থ ট্রুপসকে নিরস্ত্র করতে পারলে বাংলাদেশের ‘সিজারিয়ান বার্থ’ সম্পন্ন হবে। ততক্ষণে জেনারেল নিয়াজি বুঝতে পেরেছেন, বিদেশি সাহায্যের আর আশা নেই। তিনি আগের হতাশায় ডুবে গেলেন, কদাচিৎ তিনি তার সজ্জিত কেবিন থেকে বেরিয়েছেন। দিক ও গতির কোনো নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে না নিয়ে তিনি সময়ের রথে চড়েন।
নিয়াজি প্রকৃত অবস্থা প্রেসিডেন্টকে জানালেন (প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে কমান্ডার-ইন-চিফও) এবং সাগ্রহে নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। ১৩/১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে আমার উপস্থিতিতে তিনি জেনারেল হামিদকে (পাকিস্তানের সেনাপ্রধান) ফোন করে বললেন, ‘স্যার, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে নির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি অনুগ্রহ করে দেখবেন যেন প্রেসিডেন্ট এর ওপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।’ বহু ধরনের কর্মসূচির মধ্য থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পরদিন ‘যুদ্ধ বন্ধ ও জীবন রক্ষা করার জন্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে’ গভর্নর ও জেনারেল নিয়াজিকে আদেশ দেন।
ভারতীয় ১০১ কমিউনিকেশন জোনের মেজর জেনারেল নাগরা অগ্রগামী ভারতীয় কমান্ডো ট্রুপসকে অনুসরণ করছিলেন, তিনি মিরপুর ব্রিজ থেকে দূরে অবস্থান নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির জন্য একটি চিরকুট লিখলেন : ‘প্রিয় আব্দুল্লাহ আমি মিরপুর ব্রিজে আছি। আপনার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিন।’
সকাল ৯টার দিকে তিনি যখন এই চিরকুট পেলেন, তখন তার সঙ্গে মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফরমান এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ। ফরমান তখনো অস্ত্রবিরতির বার্তা নিয়ে আটকা পড়ে আছেন, জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি দরকষাকষির মানুষ? জেনারেল নিয়াজি কোনো মন্তব্য করলেন না। তখন স্পষ্টতই যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কথা, তা হচ্ছে তাকে বরণ করা হবে, না প্রতিহত করা হবে? তিনি তো একবারেই ঢাকার দরজায় এসে পৌঁছেছেন। মেজর জেনারেল ফরমান নিয়াজিকে বললেন, ‘আপনার কোনো রিজার্ভ আছে?’ নিয়াজি জবাব দিলেন না। তখন রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ পাঞ্জাবিতে কথাটা অনুবাদ করে বললেন, ‘আপনার খতিতে আর বিশেষ কিছু জমা আছে নাকি? নিয়াজি ঢাকার রক্ষক জামশেদের দিকে তাকালে তিনি একদিকে যেভাবে ঘাড় নাড়লেন, তার মানে- নেই, কিছুই নেই। ফরমান এবং শরিফ তখন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, এটাই যদি হয়, তাহলে যান, নাগরা যা বলে করুন।
জেনারেল নিয়াজি নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন। তিনি মিরপুরে অবস্থানরত আমাদের বাহিনীকে অস্ত্রবিরতির প্রতি সম্মান দেখাতে নির্দেশ দিলেন এবং নাগরা যাতে অবাধে চলে আসতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বললেন হাতেগোনা ক’জন সৈন্য। কিন্তু বুকভরা অহংকার নিয়ে ভারতীয় জেনারেল ঢাকায় প্রবেশ করলেন।
কার্যত সেটাই ঢাকার পতন। হƒদরোগীর মতো আস্তে করে ঢাকার পতন ঘটল, তার কোনো অঙ্গ কাটা হয়নি বা শ্বাসও চেপে ধরা হয়নি। স্বাধীন শহর হিসেবে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল। সিঙ্গাপুর, প্যারিস কিংবা বার্লিন শহর পতনের পুনরাবৃত্তি এখানে ঘটেনি।
ততক্ষণে ইস্টার্ন কমান্ডের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার্স গুটিয়ে ফেলা হলো। সব অপারেশনাল মানচিত্র সরানো হলো। ভারতীয়দের অভ্যর্থনা জানাতে মূল হেডকোয়ার্টার্স ঝাড়পোছ করা হলো, ব্রিগেডিয়ার বাশার বলেছেন, এটাই বরং ভালো সাজানো-গোছানো সন্নিকটবর্তী অফিসার্স মেসকে আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া হলো অতিথিদের জন্য অতিরিক্ত খাবার লাগবে। প্রশাসনিক কাজে ব্রিগেডিয়ার বাশার বেশ দক্ষ।
মধ্যদুপুরের ঠিক পরপর ব্রিগেডিয়ার বাকার তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট মেজর জেনারেল জ্যাকবকে অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। ততক্ষণে নিয়াজি কৌতুক বলে নাগরাকে আমোদিত করছেন। সেগুলো এখানে না বলার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, কারণ এগুলো মুদ্রণের অযোগ্য।
মেজর জেনারেল জ্যাকব তার সঙ্গে আত্মসমর্পণ দলিল নিয়ে এসেছেন- জেনারেল নিয়াজি এবং তার চিফ অব স্টাফ এটাকে বলতে চাচ্ছেন খসড়া অস্ত্রবিরতি চুক্তি। জ্যাকব কাগজপত্র বাকারের হাতে অর্পণ করলেন। বাকার এগুলো দিলেন মেজর জেনারেল ফরমানকে। এতে যেখানে ‘জয়েন্ট কমান্ড অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ বলা আছে, ফরমান তাতে আপত্তি জানালেন। জ্যাকব বললেন, কিন্তু এভাবেই দিল্লি থেকে তৈরি হয়ে এসেছে। ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল খেরা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি যোগ করলেন, এটা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনারা কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। এই দলিলটি নিয়াজির কাছে দেয়া হলো, কোনো মন্তব্য ছাড়া তিনি এর ওপর চোখ বুলিয়ে টেবিলের অন্য প্রান্তে জেনারেল ফরমানের দিকে ঠেলে দিলেন। ফরমান বললেন, এটা কবুল করবেন না প্রত্যাখ্যান করবেন, তা কামান্ডারের এখতিয়ার। নিয়াজি কিছুই বললেন না- এই নীরবতাই তার সম্মতি বলে ধরে নেয়া হলো। বিকালের আগেই জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফেটন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোর্ট চলে এলেন। হেলিকপ্টারের তার স্ত্রীও এসেছেন। বাঙালি জনতার একটি অংশ তাদের মুক্তিদাতা এবং তার স্ত্রীকে মাল্য ভূষিত করতে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে এলো। নিয়াজি তাকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিলেন এবং হাত মেলালেন। এ এক মনে দাগ কাটার মতো দৃশ্য। বিজয়ী এবং পরাজিত বাঙালিদের পূর্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে অরোরার জন্য ভালোবাসা এবং নিয়াজির জন্য তীব্র ঘৃণা প্রকাশে তারা কোনো রাখঢাক করেনি।
চিৎকার ও সেøাগানের মধ্য দিয়ে তারা রমনা রেসকোর্সের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হলেন, সেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মঞ্চ ঠিক করা আছে। মাঠজুড়ে আবেগপ্রবণ বাঙালির উচ্ছ¡াস ঝরে পড়ছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলের প্রকাশ্যে অপদস্থ হওয়ার সাক্ষী থাকতে আগ্রহী। বিজয়ীকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে, পরাজিতের জন্য ভারতীয় সৈন্যদের একটি দল। আত্মসমর্পণ দলিলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এবং কুড়ি কুড়ি বিদেশি সাংবাদিকের চোখের সামনে সই করলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি। তারা দুজন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিয়াজি নিজের রিভলবার বের করলেন। ঢাকার আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তা অরোরাকে প্রদান করলেন। এভাবে পূর্ব পাকিস্তান হস্তান্তরিত হয়ে গেল। পর্যাপ্ত সংখ্যক ভারতীয় বাহিনী এসে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাকা গ্যারিসনের সৈন্যদের ব্যক্তিগত অস্ত্র সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয়া হলো। ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ক্যান্টনমেন্টের গলফ কোর্সে ঢাকা গ্যারিসন সব অস্ত্রশস্ত্রসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করল।
এভাবে পেয়ারা পাকিস্তান সমাহিত হলো ঢাকাতেই।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে
নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়