মির্জা ফখরুল : দলমত নির্বিশেষে ‘গণঐক্য’ গড়ার আহ্বান

আগের সংবাদ

পরিবেশবাদীদের ক্ষোভ প: সুনামগঞ্জে একসঙ্গে ৩ হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ

পরের সংবাদ

জাতীয়তার প্রধান উপাদান ভাষা

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা উপমহাদেশীয় বিশাল বৃত্তেরই অংশ। আমাদের এই উপমহাদেশ ভেঙে তিন পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে আমরা একই ভূখণ্ডের বৃত্তে শত-সহস্র বছর একই সীমানা রেখার অভ্যন্তরে ছিলাম। বহু জাতি ও ভাষার এই উপমহাদেশ ভেঙে ছোট-বড় তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হয়েছে। আমরাই একমাত্র রাষ্ট্র- যার ভাষা-সংস্কৃতিগত জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতীয়তার ভিত্তিতে গঠিত বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র; যেটি ভাষিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জন্ম লাভ করেছে। তাই বলে বাংলাদেশ কিন্তু জাতিরাষ্ট্র নয়। কেননা আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো নৃ-জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে স্বীকার করে তাদের সমমর্যাদা প্রদানে নিজেদের প্রকৃত উদারনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করতে পারি। আমরা পাকিস্তানি রাষ্ট্র ভেঙে ছিলাম জাতি বিদ্বেষ-নিপীড়ন থেকে রক্ষায়। আজ যদি আমরাও ক্ষুদ্র ও দুর্বল ভেবে ওই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি সম্মান-মর্যাদা প্রদানে কুণ্ঠিত হই; তাহলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের নৈতিক পার্থক্য কোথায়? আমরাও জাতি-বিদ্বেষী বলেই প্রমাণিত হব। যৌক্তিক কারণে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ সব জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সবার সমমর্যাদা-সমঅধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাশাপাশি অপর জাতির প্রতি সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল নজির স্থাপন করতে পারব।
বর্তমানের বৃহৎ ভারত কিংবা পাকিস্তান বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দ্ব›দ্ব-সংঘাতের পরও জোড়াতালিতে কিংবা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে রাষ্ট্র দুটি টিকে আছে, এক জাতির কৌশল অবলম্বনে। অনেক জাতির কারাগার রূপে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ চরম জাতি বিদ্বেষ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীন বেলুচ জাতিসত্তার মানুষরাও তীব্র জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। নিষ্ঠুর নির্যাতন-দমনমূলক রক্তাক্ত পন্থায় পাকিস্তানি শাসকরা বেলুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামকে কঠোর হস্তে দমন করতে পেরেছিল। আমাদের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গণহত্যা সংঘটিত করেও শেষ রক্ষা হয়নি। আর সেটা সম্ভব হয়নি ভূখণ্ডগত দূরবর্তিতার কারণে। বেলুচিস্তানের জাতীয়তাবাদী জাগরণ দমন সম্ভব হয়েছে ভূখণ্ডগত ব্যবধান না থাকার সুযোগে। যেমন ভারতীয় বিভিন্ন জাতির জাতিগত প্রদেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শক্ত হাতে কেন্দ্র দমনে এ পর্যন্ত সফল হয়েছে। ত্যাগ-আত্মত্যাগের অজস্র নজির সৃষ্টির পরও সে সব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রামকে নানা নৃশংস উপায়ে দমন সম্ভব হয়েছে। এককেন্দ্রিক শাসনের অধীন যেমন পাকিস্তান। তেমনি ভারত। ভাষাগত জাতীয়তার বিপরীতে দেশ দুটিতে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তা এবং নিখিল ভারতীয় জাতীয়তার ধোয়া তুলে উদ্দেশ্যমূলক জাতীয়তাবাদী চেতনার কবর রচিত হয়েছে। তারপরও জাতীয়তাবাদী তৎপরতা প্রদেশ ভেদে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়নি। আর সেটা হবে বলে মনে করারও কারণ নেই।
স্বাধীন ভারতে উন্নয়নের বাতাবরণে দেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আদিবাসী ও দুর্বল জাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষদের উৎখাতে সনাতন পরিকাঠামোগুলো দূষিত ও ধ্বংস করে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উৎপাটিত করার প্রক্রিয়া আজো ক্রিয়াশীল। জঙ্গলাকীর্ণ, আকরিক সমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলোর হতদরিদ্র অসহায় জাতির ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও চলমান।
আমরা উপমহাদেশের স্বতন্ত্র বাঙালি জাতি। বাঙালি অধ্যুষিত বাংলার খণ্ডিত পশ্চিমাংশ ভারতের অধীন। আর পূর্বাংশ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। অখণ্ড দুই বাংলা প্রথম খণ্ডিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গে। ১৯১১ সালে আবার বাংলা এক হলেও ১৯৪৭-এ স্থায়ীভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার দেশভাগে। ব্রিটিশদের পাশাপাশি ক্ষমতালিপ্সু দুই প্রধান দল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ক্ষমতার পাশা খেলায় অনিবার্য করেছিল দেশভাগ। উপলক্ষ হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা। অভিন্ন জাতিগত ভূমিকে বিচ্ছিন্ন করার ধারাবাহিক রাজনীতি; তার শুরুটা উপনিবেশিক ব্রিটিশদের কারসাজিতে শুরু হলেও, ক্রমেই সেটা উপমহাদেশের ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের ক্ষমতার রাজনীতির ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখব দক্ষিণ ভারতের তামিল, তেলেগু, কন্নর ও মালয়ালম জাতিসত্তার মানুষের কম-বেশি অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি গঠন করেছিল ইংরেজ শাসক। অন্ধ্র প্রদেশের হায়দরাবাদ ছিল স্থানীয় শাসক নিজামদের কদর রাজ্য। তার অধীনে তেলেগু, কন্নর এবং মারাঠি জাতিসত্তার অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রত্যেক জাতিসত্তার অঞ্চলগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক বিভক্তির সীমানা নির্ধারণ করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্য বিভক্ত করা হয়েছিল। বাংলা প্রদেশ থেকে বাঙালি জাতিসত্তার (শ্রীহট্ট) সিলেট অঞ্চলসহ কিছু কিছু অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নও করেছিল, সেই অভিলাষে। একই জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিনাশে উদ্দেশ্যমূলক এসব পন্থা গ্রহণ করে ব্রিটিশ। কাশ্মীরি জাতি, সম্প্রদায়ে মুসলিম হলেও জাতিতে কাশ্মীরি। তাদের জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীনে। তারা পৃথক জাতিরাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হয়ে যোগ দেয়নি পাকিস্তানে। স্বতন্ত্ররূপে নিজেদের স্বাধীন অঞ্চলের অভিপ্রায়ে ভারতীয় ফাঁদে আটকে আজো তাদের চরম মাশুল দিতে হচ্ছে।
ঐক্যবদ্ধ কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার লড়াই, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম সেটা পথ হারিয়েছে। দুই আণবিক শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের অভিন্ন অভিলাষে। দেশ দুটিই চায় কাশ্মীরকে তাদের নিরঙ্কুশ দখলদারিত্বে রাখতে। কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দুই রাষ্ট্রের কেউ স্বীকার করেনি এবং করবে না। কাশ্মীরকে নিশ্চিহ্ন না করা অবধি দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই বোধকরি চালিয়ে যাবে। কাশ্মীরি জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের ন্যূনতম সহানুভূতি নেই। তাদের উভয়ের প্রয়োজন কেবলই অখণ্ড কাশ্মীর ভূখণ্ডটি।
পাকিস্তানে দৃশ্যত পাঁচ-ছয় জাতিসত্তার মানুষকে ধর্মীয় উন্মাদনায় এক কাতারে শামিল করা সম্ভব হলেও; সেটা যে স্থায়ী সমাধান নয়, এটা আত্মোলব্ধি করেই ভাষাভিত্তিক উর্দু জাতীয়তার মোড়কে একীভূত করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা যে হয়নি- বাংলাদেশের জন্মই তার প্রমাণ। অপরদিকে ভারতীয় শাসকশ্রেণির নিখিল ভারতীয় জাতীয়তার বৃত্তে ভারতীয় ভূখণ্ডের সব জাতিসত্তার মানুষকে একীভূত করার কারসাজি কতটা সফল ও ব্যর্থ সেটা সময়ই বলে দেবে। এককেন্দ্রিক ভারতীয় রাষ্ট্রে সব প্রদেশ এবং প্রাদেশিক সরকারগুলো সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রের অধীন। ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানে ভারতের সমস্ত জাতিসত্তার প্রদেশগুলো ভারত রাষ্ট্রের অধীনে শৃঙ্খলিত। ভারত যুক্তরাষ্ট্র হতে পারেনি। হয়েছে ভারত রাষ্ট্রসংঘ। সব রাজ্য এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের অধীনতা স্বীকার করে শাসন সংক্রান্ত বিষয় বা ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সমর্পণ করেছে। রাজ্যসমূহের বাস্তবিক সমস্ত অধিকার সাংবিধানিক উপায়ে খর্ব করা হয়েছে। প্রদেশের গভর্নর প্রদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে। তেমন বিধানকে জওহরলাল নেহরুর প্রস্তাবে বাতিল করে কেন্দ্র কর্তৃক গভর্নর নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়। এই গভর্নরের নির্দেশে প্রদেশের নির্বাচিত আইনসভা ও মন্ত্রিসভা বাতিলের একচ্ছত্র অধিকার সংবিধান রাজ্যপালকে দিয়েছে। প্রদেশের গভর্নরই কেবল কেন্দ্রের একমাত্র নিয়োগপ্রাপ্ত নন। শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তারা পর্যন্ত কেন্দ্রের নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাদের জবাবদিহিতাও প্রাদেশিক বা রাজ্য সরকারের নিকট নয়, কেন্দ্রের নিকট। সামরিক, আধা সামরিক বাহিনীও কেন্দ্রের অধীন। কেন্দ্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় প্রদেশের সীমানা নির্ধারণের অধিকার পর্যন্ত সংরক্ষিত। সব গুরুত্বপূর্ণ অধিকার ও নিয়ন্ত্রণে সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রের ক্ষমতা অপরিসীম। প্রদেশ বা রাজ্য সরকার প্রদেশের সীমিত অধিকার নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করে মাত্র। সাংবিধানিকভাবেই জাতিগত বিভক্তির অঞ্চলসমূহের রাজ্য সরকারগুলো কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা-সংস্কৃতির উপাদানগুলো বিনষ্টে দেবনাগরী লিপির হিন্দিভাষা একপ্রকার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বহু ভাষাভাষি জাতির ওপর। নিখিল ভারতীয় জাতীয়তার জাতি গঠনের বাতাবরণে। যেটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে উর্দু ভাষাকে কেন্দ্র করে। একই পন্থায় ভারতের জাতিগত ভাষা-সংস্কৃতি বিনাশে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক বলা হয় সমস্ত ভারতীয় এক জাতি। অথচ বাস্তবতা সেটা বলে না। ভারত বহু জাতির রাষ্ট্র। এক জাতি তত্ত্বে হিন্দির অনুপ্রবেশে প্রাদেশিক ভাষা-সংস্কৃতি বিনাস হয়ে চলেছে। প্রদেশের সীমানার বাইরে প্রত্যেক জাতির ভাষা আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদায় রয়েছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের জাতীয়তার ক্ষেত্রে দৃঢ়-শক্ত অবস্থানগত কারণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি দক্ষিণে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মোট জনসমষ্টির সংখ্যালঘু হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি বহুজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি এককেন্দ্রীভূত শাসনের সুযোগ গ্রহণ করে বৃহৎ ভারতীয় বাজারের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। ভারতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শাসকশ্রেণি এই পুঁজিপতি শ্রেণিরই প্রতিনিধি।
ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছে, যদিও ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম ছাড়াও শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পার্সিসহ আরো ধর্মাবলম্বীর মানুষ ছিল। প্রধান ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে ভারত বিভক্তির আনুষ্ঠানিক পর্বটির শুরু ইংরেজরা করলেও সমাপ্তি টেনেছিল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ। ওই দুই দলে ভাগ হওয়া ভারতীয় শীর্ষ পুঁজিপতি ঠাকুরদাস, ঘনশ্যাম দাস বিড়লা, বাজাজ প্রমুখের পাশাপাশি আদমজী, ইস্পাহানী, দাউদ, হারুণরা। যারা ব্রিটিশ মুক্ত দুদেশ ভারত-পাকিস্তানের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হয়েছে। জনতত্ত্বগত, সাংস্কৃতিক, ভাষা অর্থাৎ জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি ঘটেনি। ঘটেছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে। সে কারণেই ধর্মীয় উন্মাদনাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেবল স্বীকারই করা হয়নি। লালন-পালনও অব্যাহত ছিল এবং আছে। যে কারণে ভারত, পাকিস্তানের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীন শাসক দল রূপে দফায় দফায় ক্ষমতা ফিরে এসেছে। অপরদিকে পাকিস্তান ধর্মীয় জিগির তুলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কবর দিয়ে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে সামরিক আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছে।
উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির ভিন্নতা ক্রমেই হ্রাস পেয়ে হিন্দি ও উর্দুর আধিপত্য বিস্তার লাভ করে চলেছে। ভাষা বৈচিত্র্যের অনন্য ভারতবর্ষের পরিণতি ক্রমে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে; সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। পশ্চিম বাংলার জাতিগত সংস্কৃতির করুণ পরিণতি তারই পূর্বাভাস। ভৌগোলিক কারণে উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিগত অমিলের পরও কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরের মিল যে নেই, তা নয়। আছে। নিশ্চয় আছে। একজাতির অভিন্ন সংস্কৃতি বলে বাস্তবে কিছু নেই। শ্রেণিগত কারণে অভিন্ন জাতিতে ভিন্ন সংস্কৃতির নানা উপাদান দৃশ্যমান বাস্তবতা। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণিতে শ্রেণিতে ভিন্নতা বা বৈষম্য প্রকটভাবে প্রকাশ্য। আর সেটা সংস্কৃতিগতভাবেই সর্বাধিক প্রকাশ পায়। একটি জাতিসত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতিই জাতির সংস্কৃতি রূপে স্বীকৃত। সংখ্যালঘু অথচ সর্বাধিক ক্ষমতাধর শ্রেণির মিশ্র সংস্কৃতি কোনো জাতির সংস্কৃতির স্বীকৃতি লাভ কারতে পারে না। এটাও সত্য। যদিও প্রচার-প্রচারণায় এগিয়ে থাকে সংখ্যালঘু সুবিধাভোগী শ্রেণির সংস্কৃতি। তাদেরই কর্তৃত্বাধীনে এবং নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র ও সমাজ। কাজেই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে অবজ্ঞা করার শক্তিও নেই ক্ষমতাহীন, অধিকারহীন সংখ্যাগরিষ্ঠদের। একটি জাতির অভিন্ন সংস্কৃতি শ্রেণিহীন সমাজেই সম্ভব। শ্রেণিবিভক্ত-বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সম্ভব নয়। সংস্কৃতির ভিন্নতার মূলে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভাজন। যেটি শ্রেণিগত ভিন্নতায় বিকাশের সুযোগে ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। আমাদের অখণ্ড বাংলায়ও শ্রেণি বৈষম্য ছিল। জমিদার এবং প্রজা শ্রেণির আদলে সংস্কৃতি অভিন্ন কখনো ছিল না, আজো নেই। যেটুকু রয়েছে কেবলই প্রচারে এবং প্রকাশে। বাস্তবতা সেখানে বহুদূর।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়