এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ও নতুন প্রজন্মের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছর মার্চের ২৬ তারিখ বাংলাদেশে মহাধুমধামে মহান স্বাধীনতার দিবস উদযাপিত হয়। ২৬ মার্চকে এখন জাতীয় দিবস হিসেবেও উদযাপন করা হয়। মার্চ মাসকে কেন অগ্নিঝরা মার্চ বলা হয়, তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের এ ২৬ তারিখেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয় এবং সত্যিকার অর্থে এ ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনোসাইড সংঘটনের কালরাত্রির অভিজ্ঞতা প্রভৃতি মার্চ মাসকে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিশিষ্ট মাসে পরিণত করেছে। তবে ১৯৭১ সালের মার্চের ২৬ তারিখ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার কারণেই ১৯৭২ সাল থেকে মহান স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ২৬ মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র বেশ উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও অন্যথা হয়নি। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি, আধা-সরকারি এবং বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন এবং এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও স্বাধীনতা দিবসের নানান আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের সব সংবাদপত্র মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয় শহর-নগরের বিভিন্ন মিলনায়তনে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষ বিশেষ সম্মাননা প্রকাশ করে। একাত্তরের বীর শহীদদের স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের বীরোচিত অবদানকে স্মরণ করা হয় এবং যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রতি বছর প্রায় একই রীতির একই তরিকায় একাত্তরের শহীদদের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়।
কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরাও যথাযথ মর্যাদায় ও নানান আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চে মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কারণ বিদেশের মাটিতে বসবাস করেও দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত উত্তরাধিকারকে ধারণ, লালন, এবং পালন করা অবশ্যই প্রশংসনীয় কাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পররাষ্ট্রের সামনে উপস্থাপন করার একটা মওকা তৈরি করে। এভাবে দেশে এবং বিদেশে মহান স্বাধীনতা দিবস পালনের রীতি ও সংস্কৃতি অটুট থাক- সেটাই কাম্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মের সামনে কী বার্তা দিচ্ছি? আজকের প্রজন্মের সামনে আমরা কী উপস্থাপন করছি? এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আমরা কি আদৌ নতুন প্রজন্মের চিন্তায় ও চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা, বিরোচিত ইতিহাস, অতুলীয় সেক্রিফাইস এবং দেশপ্রেমের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ঐতিহ্যকে সত্যিকার অর্থে সঞ্চারিত করতে পারছি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি। আরো জোর দিয়ে বললে বলতে হয়, এ প্রশ্নগুলোকে হালকাভাবে নেয়া চলবে না। কেননা মহান স্বাধীনতার দিবস উদযাপন যেন এক ধরনের বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং সে ইতিহাসের বৃহত্তর ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান, জাতীয় চার নেতার অবস্থান, সেক্টর কমান্ডারদের অবস্থান এবং বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, নতুন প্রজন্মের সামনে যথাযথ এবং সঠিকভাবে উপস্থাপন করে যদি তাদের মনে, মননে, চিন্তায় এবং চেতনায় সঞ্চারিত করা না যায়, তাহলে মহান বিজয় দিবস উদযাপনের সব আয়োজন একটা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া এর কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে না।
আমরা জানি, ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নানানভাবে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতির ধারাবাহিকতায় বাঙালির যে গৌরবোজ্জ্বল সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সেটা যথাযথ সংরক্ষণ এবং উপস্থাপনে নানান রাজনীতি হয়েছে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাস কোন সরল ইতিহাস নয়। ১৯৭৫ সালের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। সামরিক শাসনের এ স্বাধীন রাষ্ট্র শাসিত হয় প্রায় ১৫ বছর (১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং পরে এরশাদ আমলে), সামরিক ছায়াতলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে চলে দুই বছর (ফকরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন আমল নামে পরিচিত), আবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধীন ছিল প্রায় ১০ বছর (১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬)। ফলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছিল এবং আছে মোট ২৬ বছর (১৯৭১-১৯৭৫, ১৯৯৬-২০০১, ২০০৮-২০২৪)। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের চেয়ে (২৬ বছর), সামরিক শাসক ও যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতা শেয়ার করে ক্ষমতাসীন আমলই ছিল বেশি সময় (২৭ বছর)। ফলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা ইতিহাসের বিকৃতির উৎসব দেখেছি। বহু ঘৃণিত অপচেষ্টা দেখেছি। একাত্তরের রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের নেতাদের দেখেছি গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকা উড়াতে। স্বাধীনতার ঘোষণার একজন পাঠককে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানানোর রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের মূল চরিত্রগুলোর নানানভাবে বিকৃত করার অপচেষ্টা আমরা দেখেছি ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে। তাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস ও ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ সরলরেখায় প্রবাহিত হয়নি। এ ইতিহাসও নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে এবং জানাতে হবে।
আবার ইতিহাসের ঋণশোধের ইতিহাসও আমরা দেখেছি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে এ দেশের মাটিতে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চকে দেখেছি আমরা। একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের জাগরণকেও আমরা দেখেছি শাহবাগে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য তৈরি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ দেশের মাটিতেই বিচার হয়েছে একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক ও দাদালদের। একাত্তরের রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের বিচার হয়েছে এ দেশের মাটিতেই। তাই মহান স্বাধীনতার দিবস উদযাপন শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে এ দিবস উদযাপনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে উন্মোচিত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রধান চরিত্রগুলো ভূমিকা ও যথাযথ মূল্যায়নের পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত সব কর্মকাণ্ড ও ভূমিকাও নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। যদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও এর গৌরবগাথা যথাযথভাবে তুলে ধরা যায় এবং নতুন প্রজন্মের মনে, মননে, চিন্তা ও চেতনায় সঞ্চারিত করা যায়, তবেই মহান বিজয় দিবস পালনের সব আনুষ্ঠানিকতা সত্যিকার সার্থকতা পাবে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়