আমাদের অদম্য অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

আগের সংবাদ

বাজার তদারকি দৃশ্যমান নয়

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

প্রকাশিত: মার্চ ২৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শেখ মুজিব মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন। বাংলার মানুষ আদর করে ভালোবেসে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। এই পৃথিবীতে বহু নামিদামি রাজনীতিবিদ জন্মেছেন। কিন্তু কারো মধ্যে এতসব গুণাবলি ছিল না, যা মুজিবের মধ্যে ছিল। এশিয়ার একটি ছোট্ট গরিব দেশের মানুষ হওয়ার কারণে আজো শেখ মুজিবের সত্যিকার মূল্যায়ন হয়নি। তিনি যদি আমেরিকা, লন্ডন বা ফ্রান্সের মতো দেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলির জন্য নোবেল প্রাইজসহ পৃথিবীর অন্য সেরা পুরস্কারকগুলোই শুধু পেতেন না, এরই মধ্যে তিনি হয়তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদের মর্যাদাও পেতেন। আশার কথা, ২০০৪ সালে বিবিসির বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী শ্রোতা জরিপে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। তবে অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। আমার বিশ্বাস, হাজার বছর পরে হলেও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান।
মুজিবের দূরদর্শিতার কোনো তুলনা হয় না। যুবক বয়সেই বুঝে ফেলেন পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী এবং সামরিক চক্র বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করছে। বাঙালিকে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে দেবে না ওরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস পর ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠন করেন মুজিব। এই ছাত্রলীগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন ও অবদান রাখে। স্বাধীনতাকে সামনে নিয়েই ১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে বিরোধীদলীয় নেতাদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু জাতির সামনে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় হুমকি দিয়ে বলেন, পাকিস্তান ভাঙার জন্যই ৬ দফা দিয়েছে মুজিব। সামরিক জান্তার হুমকিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুজিব মাত্র দুই মাসে চারণ কবির মতো সারাদেশ ঘুরে ৬ দফাকে বাঙালির ‘মুক্তির মন্ত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তারের পর ছাত্রলীগের আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ শত শত নেতা ৬ দফাকে নিয়ে মাঠে নামেন। তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।
হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেই থেমে থাকল না প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান। মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার জন্য আইয়ুব-মোনায়েম চক্র রাষ্ট্রবিরোধী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ফাঁসিতে হত্যা-ষড়যন্ত্রের মুখেও দমে গেলেন না সাহসের বরপুত্র মুজিব। একাধারে প্রায় চার বছর জেলে থেকেই বাংলার মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। মুজিবসহ ৩৫ জন বাঙালি সন্তানকে ফাঁসি দেয়ার কুউদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো সামরিক চক্র। ঊনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে মুজিবকে বাসায় পৌঁছে দেয় সামরিক জান্তা। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ছাত্র-জনতা তথা বাঙালি জাতির পক্ষে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ। ৬ দফা দেয়ার মাত্র ৫ বছরের মাথায় বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হয়ে যায়। ১০ বছর পরে কী হতে পারে সেটা স্থির করেই একজন রাজনীতিবিদকে কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সামনে নিয়ে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়েছিলেন দূরদর্শী শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে দেয়। কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ববিখ্যাত ১০/২০টি ভাষণের একটি। আবার কেউ কেউ ৭ মার্চের ভাষণকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহান লিংকনের ‘গেটিসবার্গ স্পিচ’, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চাচিলের যুদ্ধ-পরবর্তী ঐতিহাসিক ভাষণ ও আমেরিকার মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর কোনো নেতার ও রাষ্ট্রনায়কের কোনো ইতিহাস শ্রেষ্ঠ ভাষণকেই ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে তুলনা চলে না।
যুগে যুগে খ্যাতিমান নেতারা ঠাণ্ডা মাথায় ইতিহাস সেরা ভাষণ দিয়েছেন। আবার কেউ লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। যদ্দুর জানা যায়, লিংকনের গেটিসবার্গ এডড্রেস ছিল মাত্র ৪ মিনিটের। ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব লিখিত লিংকনের সেই ভাষণকে নির্ধারিত অনুষ্ঠানে পড়ে শোনানো হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। দেশে তখন সামরিক শাসন বহাল। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ ১ মার্চ থেকে পরিচালিত হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে। মুজিবের নির্দেশে সারাদেশে প্রতিদিনই চলছে হরতাল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার পতাকা দেখা যায়। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স না দেয়ার ঘোষণা করেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের খোলা ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। দেশের জনতা তখন নেতার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উন্মুখ। ওদিকে জনসভাকে তাক করে সেনানিবাস থেকে কামান, মেশিনগানসহ আগ্নেয়াস্ত্র বসানো হয়েছে।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে কোনো রাজনীতিবিদকে প্রকাশ্যে জনসভায় লাখ লাখ লোকের সামনে ভাষণ দিতে হয়নি। কী কঠিন অবস্থা! স্বাধীনতা ঘোষণা না করলে জনগণ শুধু হতাশই হবে না, বিক্ষুব্ধও হয়ে উঠতে পারে। আর স্বাধীনতা ঘোষণা করলে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে স্বাধীনতার সাধকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হবে। সেই কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী ভাষণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি চিন্তাবিদ জেনারেল মতীনউদ্দিন তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।’ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলেই ক্ষ্যান্ত থাকেননি- তাঁকে হত্যা করা হলে কী করতে হবে সেই দিকনির্দেশনাও তিনি তাঁর ভাষণে দিয়েছিলেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীন করার জন্য প্রস্তুত করতে পারে, একটি ভাষণ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, একটি ভাষণ নতুন একটি দেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে- এমন নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন জনপ্রিয় নেতা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬২ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন লাভ করে। আর প্রাদেশিক পরিষদে পায় ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন। কোনো দলের এমনিভাবে আর কোথাও শতকরা ৯০ ভাগের বেশি আসন পাওয়ার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাত্তরের ৯ মাসে শত্রæর কারাগারে বন্দি থাকলেও শেখ মুজিবের নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
একাত্তরের ৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন জেনারেল টিক্কা খান। শেখ মুজিবের অনুমতি না থাকায় প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাননি। শুধু তাই নয়, ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলে বাঙালি বাবুর্চিরা তাকে রান্না করে খাওয়াতে অস্বীকার করেন। ৭ মার্চের ভাষণ রিলে করতে না দিলে টেলিভিশন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতার ভবন তালা দিয়ে চলে আসেন। পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় ওই ভাষণ রিলে করার মাধ্যমে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান করেন। ১ থেকে ২৫ মার্চ ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে পূর্ব বাংলা পরিচালিত হয়েছে। মুজিবের কথাই ছিল তখন আইন।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফিরে এসেছিলেন বলেই ৩ মাসের কম সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনা সদস্যরা স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন। ভারতীয় সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পর একজন বিদেশি মনীষী বলেছেন, ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশকে দুবার স্বাধীন করেছেন।’ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্যই শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছিল। বিদেশি সাংবাদিক সিরিলডন ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের একদিনের ইতিহাস নয়, ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল।’ (সোহরাব হাসানের ‘শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া’, পৃ. ১৭৪)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনন্য সাধারণ নেতৃত্বের জন্য ১৯৭১-এর ৫ এপ্রিল নিউজ উইক সাময়িকী তাঁকে ‘চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং’ অর্থাৎ ‘রাজনীতির কবি’ বলে উল্লেখ করে। পৃথিবী জন্মের শুরু থেকে অদ্যাবধি কোনো নেতার ভাগ্যেই এমন বিশেষণ জুটেনি। একজন খ্যাতিমান ঐতিহাসিক বলেছেন, ‘প্রায় বারোশ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পর বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে, যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় ও জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা।’ ওপার বাংলার কবি অন্নদা শংকর রায় লিখেছেন- ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরী বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

মোহাম্মদ শাহজাহান : সম্পাদক, বাংলাবার্তা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়