ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

আগের সংবাদ

অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

বিচার ও স্বীকৃতি যেভাবে সম্ভব : একাত্তরের গণহত্যা

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট’। গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রথম বিধিবদ্ধ আইন। সেদিন সংসদে প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলে ধরে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, ‘আমরা এদের (যুদ্ধাপরাধীদের) মনে করি শুধু বাংলাদেশের শত্রæ নয়, মানবতার শত্রæ। সেই হিসেবে আমরা তাদের বিচার করতে যাচ্ছি। সেই দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের কর্তব্য এদের নিন্দা করা, ঘৃণা করা, ধিক্কার দেয়া।’ ৫৩ বছর পরও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেনি গণহত্যার, বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি গণহত্যাকারীদের। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করাই এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব। গত ১৪ বছরে গণহত্যার দোসরদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু গণহত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক একটি দিবস থাকায় ২৫ মার্চের স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে না। গবেষকদের মতে, ২৫ মার্চকে সামনে রেখে একাত্তরের নয় মাসের নৃশংস গণহত্যার স্বীকৃতি এবং গণহত্যাকারীদের বিচার করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বিত পদক্ষেপ।
বিশ্লেষকদের মতে, একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে বিশ্ব সমাজের করার কিছু ছিল না। সেই সময় গণহত্যা বিচারে না ছিল আইন, না ছিল আদালত, না ছিল গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগ। তাই বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, শরণার্থী দুর্গতির মানবিক দিক নিয়ে ছিল আলোচনা ও উদ্যোগ; কিন্তু গণহত্যা ও তা প্রতিরোধ নিয়ে জাতিসংঘ ছিল নিশ্চুপ। গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাড় করানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতার অবসান ঘটেছে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে। ট্রাইব্যুনালে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিধিবদ্ধভাবে একের পর এক বিচার এবং রায় কার্যকর হচ্ছে। গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণে কোটি দীপ প্রজ্বালিত হয়েছে বাংলাদেশে। এই অগ্নিশিখা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়।
একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সেল গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি অনেক আগেই পাওয়া যেত। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর একাত্তরে কী হয়েছে, তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এখন এই স্বীকৃতির জন্য সুষ্ঠু সমন্বয় দরকার। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। পৃথিবীর অনেক জায়গায় বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে কথা হচ্ছে। যেহেতু ৫২ বছর আগের ঘটনা, সেজন্য সুষ্ঠু ডকুমেন্টেশন করা অত্যন্ত জরুরি। ভিজুুয়াল

ডকুমেন্টেশন আমাদের বেশি নেই এবং এখন ভিজুুয়াল ডকুমেন্টেশন করাও সম্ভব নয়। প্রয়োজনে সেল গঠন করে একাত্তরের স্বীকৃতি পেতে কাজ করা হবে।
প্রয়োজন নয় মাসের ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি আদায় : বিজয়ের পর প্রায় দেড় হাজার পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানো হলেও শেষ পর্যন্ত ১৯৫ জনকে ঘিরে বিচারের দাবিটি চলমান ছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে লিখিতভাবে উল্লেখ করা হয়- ‘আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই ১৯৫ জন নিশ্চিতভাবে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাদের বিচারের ব্যাপারে সর্বজনীন ঐকমত্য রয়েছে।’ ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ওজাল বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কোর্ট গঠিত হয়েছে। এদিকে দেশের মধ্যে নানা স্থানে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি ওঠে। যাদের স্বামী নিখোঁজ বা নিহত হয়েছেন এমন ৩০ জন বিধবা ব্যাপক গণহত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত ৩৬ জন পাকিস্তানি অফিসারের তালিকা পেশ করে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের বিচারের দাবি তোলেন। ৭২-এর ৯ মে দৈনিক ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়- ‘একমাত্র ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে ৪২টি মামলা দায়ের হইয়াছে।’ ১০ মে সংবাদ সংস্থা এনা জানায়, ‘দেড় হাজার পাকিস্তানি সামরিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গঠিত হয়েছে।’ এর মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ কুয়ালালামপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রকাশ্যে হবে। ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিতে রাজি নয়।’
মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের মতে, গণহত্যার অর্ধ শতক পেরিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্ভব। বিচারও সম্ভব। ১৯৭১ সালের জেনোসাইডের অজস্র প্রমাণ এখনো আছে। সেগুলো যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করা প্রয়েজোন। জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, জেনোসাইডের অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। এটা কেউ ক্ষমাও করতে পারে না। ১৯৭১ সালে যে জেনোসাইড হয়েছে তার অজস্র প্রমাণ ও তথ্য রয়েছে। অনেক ‘টেস্টিমনি’ আছে। এখানে ঘাটতির জায়গা হলো যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব উপস্থাপন করা। এছাড়া গণহত্যা নিয়ে বই, ডকুমেন্টারি আরো প্রয়োজন। এগুলো ইংরেজি বা আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো অনেক দূর। সে জায়গায় সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, গণহত্যার বিচারও সম্ভব। আমাদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বাইরেও কাজ করতে পারি। গণহত্যাকারীদেরও প্রতীকি বিচার সম্ভব। আন্তর্জাতিকভাবেই তা সম্ভব। খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে, তা নয়। বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকরা ওই দেশে মুভমেন্ট করতে পারেন। তারা ওসব দেশের সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে গণহত্যার বিষয়টি তাদের সংসদে তুলতে পারেন। আমেরিকার দুই সিনেটর রেজ্যুলেশন দিয়েছেন। এভাবে অন্যরাও লবিং করতে পারেন।
এ ব্যাপারে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ ট্রাস্ট্রি, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি দিবস রয়েছে- তাই বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক দিবসের স্বীকৃতি অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সম্ভব। এর দুটি দিক। একটি একাডেমিক। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ অনেকেই এক্ষেত্রে কাজ করছে। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে পড়ানো হচ্ছে। ফলে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে কূটনৈতিক দিক। সরকারকে এক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যার দিনে জাতিসংঘের বিবৃতিতে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রসঙ্গটি যেন ওঠে আসে সেজন্য সরকারের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি ডিজিটালাইজড করে গুগুলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করা প্রয়োজন যেন এক চাপেই গণহত্যার চিত্র ওঠে আসে। নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।
যেভাবে সম্ভব স্বীকৃতি আদায় : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অ্যাডহক ভিত্তিতে গঠিত দুই বিচারশালা, নুরেমবার্গ ও টোকিও আদালত ছিল মানবজাতি ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ ও ব্যাপক পাশবিকতার বিচারে অভিনব পদক্ষেপ। এই অভিজ্ঞতার নির্যাস মেলে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে, যেখানে অপরাধগুলো সংজ্ঞায়িত হয় জেনোসাইড, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। এগুলো হলো- কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের একটি থাকলেই গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞে রয়েছে। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক দিবস থাকায় শুধু ২৫ মার্চের স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো নয় মাসের অত্যাচারের স্বীকৃতি আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের প্রচেষ্টা চলছে। গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি না হলেও গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন জনমত। আমরা জনমত গঠনে কাজ করছি। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে চিঠি দিচ্ছি। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো কাজ করছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা সভা সেমিনার করছি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকেই জানে। আমরা বারবার সরকারকে বলেছি। সরকার ভারত-চীনের কাছে দাবি জানাতে পারে। সরকার উদ্যোগ না নিলে আমাদের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সরকারকে আমরা একাধিকবার বলছি, আগে অধিকাংশ দেশের কাছ থেকে আমরা স্বীকৃতিটা নিই। এরপর বন্ধুদের নিয়েই আমরা জাতিসংঘে যাব। তখন জাতিসংঘেরও স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও জাতিসংঘের বিভিন্ন দলিলপত্রেও বলা হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে।
পরিকল্পিত রূপরেখা তৈরির তাগিদ : একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে দেশের বাইরে জনমত তৈরিসহ একটি পরিকল্পিত রূপরেখা তৈরির তাগিদ দিয়েছেন দেশি-বিদেশি গবেষক ও বিশিষ্টজনরা। বিশ্লেষকদের মতে, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য পরিকল্পিতভাবে এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব। কোনো গণহত্যার স্বীকৃতি না দিলে সেটির পুনরাবৃত্তি হয়। এছাড়া একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি এনে পাকিস্তানকে জবাবদিহির আওতায় আনা বাংলাদেশের সামনে বড় একটি সুযোগ আছে। একাত্তরে ঘাতকদের বিচারের তথ্য-উপাত্ত, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিল-পত্র, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, বধ্যভূমির আলামতসহ বহু উপকরণ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রয়োজন শুধু সুষ্ঠু গবেষণা আর আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরানো।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেলে ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান ও দেশটির সেনাবাহিনী জেনোসাইডের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে। বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবে। তিনি বলেন, জেনোসাইডকে বাংলায় ‘গণহত্যা’ বলা হয়। কিন্তু এটি বলা হলে আংশিক বিষয়টা আসে। জেনোসাইডের ভালো বাংলা প্রতিশব্দ উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত তিনি জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তিনি জেনোসাইড অস্বীকারকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে ‘জেনোসাইড ডিনায়াল অ্যাক্ট’ করার প্রস্তাব করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ১৯৭১ সালের জেনোসাইডের স্বীকৃতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব একেবারে নীরব, তা নয়। বেশ কিছু স্বীকৃতি এসেছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য একটি পথনকশা প্রয়োজন। তারপর ধাপে ধাপে এগোতে হবে। জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু তা অসম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণহত্যা : গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; গণহত্যা এবং মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ যে আত্মত্যাগ করেছিল এই প্রসঙ্গটিও আড়ালে পড়ে যায়। তবে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। একাত্তরের অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি কোর্স চালু রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বছরব্যাপী গণহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়