দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত সাংবাদিক

আগের সংবাদ

বিচার ও স্বীকৃতি যেভাবে সম্ভব : একাত্তরের গণহত্যা

পরের সংবাদ

হর্ন অব আফ্রিকা এবং জলদস্যুতা

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এই জলদস্যুতার শেকড়টি কোথায়, কেন এই দস্যুতার উদ্ভব হলো, তা খুঁজে বের না করে এই দস্যুদের পরাস্ত করার পরিকল্পনার কথাই আমরা শুনি বা শুনে আসছি দীর্ঘকাল ধরে। আর এই খাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয়ও হচ্ছে। বিশ্ববাণিজ্যের একটি বড় ক্ষতির কারণও সোমালি জলদস্যুতা। বলা যায় হর্ন অব আফ্রিকার জলপথে বাণিজ্য জাহাজগুলো নিরাপদ নয় আর। এর দুই উপকূলে এডেন বন্দর ও সোমালিয়ান কোস্ট। ম্যাপে সোমালিয়াকে দেখলে মনে হয় কনুই বাড়িয়ে দিয়েছে দেশটি। আর এই কনুইয়ের দুই পাশে জাতিগত বিরোধীদের অবস্থান।
সোমালিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট এতটাই যে তাকে দুর্ভিক্ষের সহোদর হিসেবে বর্ণনা করা যায়। সেই সঙ্গে মাছ ধরার জেলেদের এই দস্যুতায় নেমে পড়ার পেছনে সে দেশের ছিন্নভিন্ন রাজনীতি ও সরকার এবং প্রশাসনের দুর্বলতাই প্রধানত দায়ী। সোমালিয়ার জেলেরা ছোট নৌকায় করে সাগরে মাছ ধরত, জীবিকা ছিল এটাই। কিন্তু সেখানে ভিনদেশি মাছধরার ট্রলারগুলোর মাছ মেরে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই ঠেকায়নি দেশের রাজনৈতিক সরকার ও প্রশাসন। উন্নত ভিনদেশিরা তাদের শিল্পবর্জ্য ফেলায় সোমালি কোস্টের মাছ শেষ হওয়াও অন্যতম কারণ। জেলেদের পেশা হারানো ও অন্য পেশায় যোগ দেয়ার মূল এখানেই নিহিত। এই ব্যর্থতার জের ধরে বেকার হয়ে যাওয়া জেলেরা পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য তুলে নেয় অস্ত্র। আর জলদস্যুতাই তাদের আয়ের উৎস হয়ে ওঠে।
সোমালিয়ার জেলেরা গরিব। তাদের হাতে আছে জাল আর ছোট নৌকা। তাই তাদের মাছের পরিমাণ দিন দিন কমছিল। এমনকি সোমালিয়ার জেলেরা কাছাকাছি চলে গেলে ভিনদেশি মাছ ধরার ট্রলারগুলো থেকে গুলি করা হতো।
তাছাড়া বিদেশি জাহাজ থেকে সোমালিয়ার জলসীমায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ ফেলা হতো। এটাও মাছ কমে যাওয়ার বড় কারণ। এমন পরিস্থিতি মানতে পারেনি স্থানীয় জেলেরা। ক্ষোভ থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার কোস্টগার্ড অব সোমালিয়া এবং সোমালি মেরিনস নামে সংগঠন। এই নাম দুটি এখনো ব্যবহার করছে জলদস্যুরা।
তখন থেকে মাছ ধরার ট্রলার ও জাহাজ জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে শুরু করে সোমালিয়ার মানুষ। বেআইনি ব্যবসা করায় জলযানগুলোর মালিকরা আপসে মুক্তিপণ দিয়ে দিত। এভাবে শুরু, এরপর ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ জিম্মি করার পথে ঝুঁকে পড়ে জলদস্যুরা। তবে সোমালিয়ার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জাহাজ জিম্মি করা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকে জলদস্যুরা। তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বিদেশি জাহাজ। (প্র/আ ২০ মার্চ, ২৪)
শুরুটা এরকমই ছিল, এখন তা বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক অপরাধের সঙ্গে ওতপ্রোত। জলদস্যুদের পক্ষে বিনিয়োগ করছে সে দেশেরই কিছু ধনবান। তারা নিজেদের ৭২টি সংস্থা মিলে খুলেছে একটি শেয়ার বাজার। সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসার নামে তারা বিনিয়োগ করে, আর জলদস্যুদের পক্ষে কাজ করে। ফলে পুন্টল্যান্ড বন্দর অথরিটি ও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো বাধা দিতে পারে না এবং দেয়ও না বলেই মনে করা যেতে পারে। তাদের সেই শক্তিও নেই।
বাংলাদেশের এমভি আবদুল্লাহ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর আমরা জানতে পারছি কী রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি ভারত সাগরের আফ্রিকা উপকূলের নৌবাণিজ্যের ওই পথটি। যারা জাহাজ পরিচালনা করেন ও যারা জাহাজ চালান, নাবিকরাই কেবল নয়, নৌবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের সবাই জানে ভারত মহাসাগরের ওই সোমালি হর্ন কতটা অনিরাপদ। কিন্তু বিশ্বের ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক জাহাজকেই তো ওই পথে চলাচল করতে হয়। এই অনিরাপদ জলপথটিকে নিরাপদ করার জন্য বহুবারই উদ্যোগ আয়োজন করা হয়েছিল। জাতিসংঘ কয়েকটি রেজ্যুলেশন নিয়েও তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ওই উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য কমাতে তৎপর রয়েছে জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন। কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ, জোট ও সংস্থা। নিরাপত্তার জন্য বিদেশি নৌ ও বিমানশক্তি ওই অঞ্চলে টহল দেয়। এসব কারণে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু পুরোপুরি দূর হয়নি।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের আওতাধীন আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক ব্যুরো (আইএমবি) প্রকাশিত ‘পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি রিপোর্ট’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জলদস্যুতার ১২০টি ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১৫০।
জলদস্যুতার কারণে বেড়েছে জাহাজের নাবিক ও ক্রুদের জীবনের হুমকি। আইএমবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জলদস্যুরা ৪১ নাবিক ও ক্রুকে জিম্মি করেছিল। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৩। গত বছর জলদস্যুরা ১৪ নাবিক ও ক্রুকে অপহরণ করেছিল। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২।
নানামুখী উদ্যোগের পরও সোমলিয়ার জলদস্যুদের পুরোপুরি নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমালিয়ার উপকূলসহ ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে গত তিন মাসে যতগুলো জলদস্যুতার ঘটনা ঘটেছে, গত ছয় বছরেও তা হয়নি। লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই) এ তথ্য জানিয়েছে।
এ বিষয়ে আইএমও বলছে, জলদস্যুদের লাগাম টানতে তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
এই যে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কথা তা কেবল কথার কথা নয়, তারা সত্যিকার অর্থেই এই সমস্যার সমাধান চান। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব, তা তারা গবেষণা করে বের করেননি। এই জলদস্যুতার মূল যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নিহিত এবং তার কুপ্রভাবেই সোমালি জেলেরা জলডাকাত হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, সেই বিষয়টি কখনোই আলোচিত হয় না। দেশটির জাতিগত সংঘাত নিরসনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দারিদ্র্য কমানো গেলে, কর্মসংস্থানের আয়োজন করতে পারলে সমুদ্রে রবারি করার মতো জীবন বিনাশী পেশায় তারা নিয়োজিত হতো না। এই বিষয়টি কেবল আলোচনা না করে কীভাবে জাহাজ উদ্ধার করা যায়, মুক্তিপণ নাকি বলপ্রয়োগ, সে ব্যাপারে উদ্যোগীদের শক্তিশালী প্রয়াস নিতে হবে। যদি জলডাকাতদের স্থলভাগে বা জলভাগেই বৈধ কাজে নিয়োগ করা যায় এবং দেশের সার্বিক স্বার্থে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেয়া যায়, তাহলে কিন্তু এই রকম সংকটে পড়তে হয় না। হয়তো এমভি আবদুল্লাহ মুক্তিপণ দিয়েই জাহাজ উদ্ধার করবে, ভাবে-সাবে সে-রকমই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাচ্ছিল। যাওয়ার পথেই তারা সোমালি কোস্ট ব্যবহার করছিল। ওই সুযোগটাই নেয় জলডাকাতরা। তারা ছোট নৌকায় করে এসে দখল নেয় জাহাজের। তারপর তাদেরই এজেন্ট, যারা স্থলভাগে জলদস্যু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তারা জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ আদায় করে। এই দস্যুবাণিজ্যটা মাছধরা জেলেদের জন্য ব্যাপকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, আর্থিকভাবে তারা লাভবান তেমনভাবে হতে পারে না। তাদের কপালে মিলিয়ন ডলার জোটে না। মুক্তিপণের যৎসামান্যই জোটে তাদের কপালে। মূল পেশা থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ বেআইনি ও ধ্বংসাত্মক পথেই জীবন নির্বাহ করতে উৎসাহী আজ। কারণ দেশে তাদের পেশার জায়গা বিদেশি ট্রলারের মাছ আহরণের ফলে তারা বেকার হয়ে পড়েছে। সরকার তাদের না পুনর্বাসন করতে পারছে, না কোস্টাল এলাকা থেকে ভিনদেশি ট্রলারের মাছ মেরে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারছে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মুক্তিপণের কড়কড়ে ডলার আর একে ৪৭ রাইফেলের ক্ষমতা ও মোহ তাদের অন্ধ করে রেখেছে। জাতিগত সংঘাত, রাজনৈতিক সরকারের দুর্বলতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা, শিক্ষাহীনতা, প্রোভার্টির মারাত্মক পরিস্থিতি সোমালি জেলেদের জন্য জীবন-মরণ পরিস্থিতিকে এই অন্যায় পথে যেতে বাধ্য করেছে।

দুই.
ফেসবুকে কিছু লোক রুয়েন জাহাজের ছবি দিয়ে বলেছে এমভি আবদুল্লাহকে জলদস্যুমুক্ত করেছে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। পুরোটাই মিথ্যা। যারা এ কাজ করেছে তারা বিষয়টি না জেনেই করেছে। ২০২৩ সালে ছিনতাই হয়ে যাওয়া রুয়েন নামক জাহাজটি ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ উদ্ধার করেছে জলদস্যুদের কাছে থেকে। সেই জাহাজকেই এমভি আবদুল্লাহ বলে চালিয়ে দিয়ে যারা এটা করেছে, তারা ভারতপ্রীতিতে অন্ধই কেবল নয়, এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারের সরকারের ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতাকে ঘোলা পানিতে ফেলে দিয়েছে। এই রকম অনুচিত কাজ না করলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার সহজতর হবে। উল্লেখ করা যায় এই রুয়েন জাহাজটি জলদস্যুরা তাদের মাদার ভ্যাসেল হিসেবে ব্যবহার করত।

তিন.
যত সহজ মনে হয় এম আবদুল্লাহর উদ্ধার কাজ, তত সহজ নয়। যতটা খবর আমরা জেনেছি, তাতে জলডাকাতদের কেউবা তাদের হয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এখনো চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। যোগাযোগ হলে তারা মুক্তিপণ হিসেবে যা চায় সেই পরিমাণ অর্থ দিলে জাহাজ উদ্ধার করা যাবে। আর তা না করে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমেও কাজটা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে সামরিক শক্তির প্রয়োগ অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। জাহাজে রয়েছে কোল বা কয়লা। এই কয়লা রাখার জায়গার তাপমাত্রা প্রতিনিয়তই মেপে দেখতে হয় এবং তাপমাত্রা সহনীয় স্তরে রাখতে হয়। জলদস্যুরা এটা জানে। জাহাজের নাবিকরাও এ-কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জাহাজে খাবার ও খানি আছে মাত্র ২৫ দিনের। এই সময়ের মধ্যে সংকট থেকে জাহাজ উদ্ধার করতে হবে।

চার.
বাংলাদেশ সরকার এই জাহাজ উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। তাদের সংগঠিত হওয়া ও তৎপরতা কতটা তা বোঝা যায়নি। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংগঠিত হচ্ছে এই খবর জানার পর পুন্টল্যান্ড পুলিশ নিজেদেরও ওই অভিযানে অংশগ্রহণের আয়োজন করছে। আধা-স্বায়ত্তশাসিত এলাকা বলেই সেখানকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি দুর্বল। তারপরও তারা চেষ্টা করছে।
আমাদের অথরিটি কী কী পদক্ষেপ নেবে, দেখা যাক।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়