দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত সাংবাদিক

আগের সংবাদ

বিচার ও স্বীকৃতি যেভাবে সম্ভব : একাত্তরের গণহত্যা

পরের সংবাদ

স্বাধীনতা পুরস্কার কে পাচ্ছেন, কেন পাবেন?

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নিজে সংবাদ হতে পারছি না, সংবাদ জন্মও দিতে পারছি না; কিন্তু অন্যে যখন তা পারছে আমি অপমানিত বোধ করছি, যেন আমার প্রাপ্যটাই সে কেড়ে নিয়েছে! এ আক্ষেপ আমার মতো হয়তোবা অনেকের বুকেই আবর্তিত হয়; আমি খোঁজ রাখি না। পরিপার্শ্বে সংবাদের এত সমারোহ, এত হৈ-হুল্লোড়, সব কিছুকেই মনে হচ্ছে ছলনা; মনে হচ্ছে, এই সংবাদটির জন্ম না হলে পৃথিবীর কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? তারপরও নানা সংবাদের জন্ম হচ্ছে নিয়মিত; ক্ষোভ, বিরোধ-প্রতিবাদও হচ্ছে। সমাজে একদিকে স্তাবকতার চাষ যেমন বেড়েছে, তেমনি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ‘বনসাই’ আবাদ এবং সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরচর্চা পরনিন্দাও। আমাদের মনবৈকল্যের বাস্তবতা বিবেচনা করেই যেন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ভান করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট। আমরা ভারি ভদ্র, ভারি বুদ্ধিমান, কোনো বিষয়ে পাগলামি নেই। আমরা পাস করিব, রোজগার করিব ও তামাক খাইব। আমরা এগোবই না, অনুসরণ করিব, কাজ করিব না পরামর্শ দিব…!!!’
পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য যদি একটিও স্বাস্থ্যপ্রদ, উপাদেয় সন্দেশ উপহার দিতে পারতাম, তাহলে মনে করতাম, জীবনে অন্তত একটি মহৎ কর্ম সম্পাদন করলাম, যা আমাকে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত করতে পারে; হয়তো তখন মরেও শান্তি লাভ করতে পারতাম।
আপাতত মনঃকষ্টের বড় একটা কারণ হচ্ছে- মরবার বাসনা মনে আনতে পারছি না; মরব না, এমন পণ করিনি; কিন্তু পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য এ জীবনে কোনো মহৎ কাজই তো করতে পারিনি! যাদের উত্তর প্রজন্মজ্ঞানে মহৎ কর্মে ব্রতী হতে প্ররোচিত করেছিলাম; তাদের প্রায় সবাই ‘সময়ের পিশাচ’ তৈরি হয়েছে! স্বার্থচর্চায় তারা এতটাই বিভোর; ভেবে লজ্জায় নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু আমি তো পৃথিবীর জন্য মহত্তম কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্রতী! যখনই স্মরণ হয়, আমার জন্য তো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে- আমি তো হীন-দরিদ্র নই! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাস বোস, মাস্টারদা সূর্য সেন, বেগম রোকেয়া; সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহান মানুষের উত্তর প্রজন্ম আমি! ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের শৌর্যবীর্য আর রক্তের উত্তরাধিকার যখন আমার অহংকার, তাহলে কেন আমি ব্যর্থ হবো! পৃথিবীকে সুন্দর করতে কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং অজস্রের অংশগ্রহণ প্রয়োজন; যে কোনো স্বপ্নকে তাই প্রিয়জনের কাছে ছড়িয়ে দেয়া আবশ্যক মনে করি।
কারো কৃপায়, কারো দোয়ায় আমার আস্থা আছে; কিন্তু দোয়া-দাওয়ায় তো কোনো কর্মই সম্পাদিত হচ্ছে না। যা-কিছু সৃষ্টি হচ্ছে, যা-কিছু বিকশিত হচ্ছে; সবই ক্ষণস্থায়ী- সবই ওয়ানটাইম; ওয়ানটাইমেই যেন আমাদের পূর্ণ আস্থা।
মানুষের আস্থার উৎস কী? ভেবে দেখলাম, প্রথমত মানুষ হুজুগে মাতে, অতঃপর মানুষ দেখাদেখি নাচে। হুজুগ সে তো জোয়ারের পানি। যখন আসতে শুরু করে, তখন দুকূল প্লাবিয়া আসে, চোখের পলকে বদলে যায় দৃশ্যপট; যেখানে বিরান ভূমি ছিল সেখানে জল থই থই ঢেউ। হুজুগের জন্ম দিতে পারাই যেন আমাদের বড় সাফল্য। যিনি যত বড় হুজুগ সৃষ্টি করতে পারেন, তিনিই যেন জীবনে তত বড় সফলতা পেলেন। যার হুজুগের প্রভাবে আমাদের জীবন যতটা আন্দোলিত; আমরা যেন সেই হুজুগ সৃষ্টিকারীকে ততটাই মনে রাখতে চাই। আমাদের গৌরব আর অহংকারকে ‘ওয়ানটাইম’ করে তোলার চেষ্টা চলছে? ‘বনসাই’ বানাবার আয়োজন চলছে? মন তাই আকুপাকু করে কিছু বলতে।
যদি কথা বলি, এক দল হৈ হৈ করে বলবেন, ‘সব বিষয়ে এত কথা না বললেই কি নয়!’ যদি কিছু না বলি, ‘দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কোনো শুভ লক্ষণ নয়!’ সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ বিতর্ক’ জোরেশোরে চলছে। অযোগ্য বলে কারো কারো পুরস্কার বাতিলের দাবি উঠেছে; অন্যদিকে ঘোষিত নামের পক্ষে তার স্বজন বন্ধুরা বাখান করছেন। যদ্দুর জানি, স্বাধীনতা পুরস্কার সরকারের আমলারা নানান প্রক্রিয়ায় পুরস্কার প্রাপকদের নাম নির্বাচন এবং ঘোষণা করেন; সেখানে সাধারণের কিছু না বললেও চলে; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নাম ঘোষণার পর প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাহারের ঘটনা আমাদের সাহসী করে তুলেছে। আমি অনুভব করছি, আজকের বাস্তবতায় আমার এবং আমাদের কিছু কথা তো বলাই উচিত। স্বাধীনতা পুরস্কার জাতির সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার; এ পুরস্কারের সঙ্গে বাঙালির যুদ্ধ জয়ের গৌরব জড়িত; ৩০ লাখ মানুষের রক্তঋণ আর দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের ঋণ জড়িত; বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শৌর্য-বীর্যের স্মৃতি জড়িত, বঙ্গবন্ধু সংগ্রামের লক্ষ্য অর্জনের ইতিহাস জড়িত। প্রতিটি শাখায় পরীক্ষিতজনকেই পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা উচিত! অবস্থাদৃষ্টে সন্দেহ হয়, সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সুকৌশলে আমাদের মহান স্বাধীনতা, আমাদের শৌর্য-বীর্য, আমাদের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বারবার এ অপকৌশলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নইলে অতীতে যাদের নাম ঘোষণার পর প্রত্যাহার করা হয়েছে, অথবা ‘অরণ্য ই চিরাণ’-এর মতো মানুষের নাম কেন উচ্চারিত হবে? যেখানে ময়মনসিংহের গারো-হাজং গোষ্ঠীর মানুষ এবং খোদ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন তার নাম প্রত্যাহারের জন্য সোচ্চার অথবা ডা. হরিশংকর দাশের মতো মানুষকে কেন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে! আমলারা পুরস্কার প্রক্রিয়ার সব দায়িত্ব পালন করলেও পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে যাচ্ছে; সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রশাসন। সব দিক বিবেচনা করে আমি কতিপয় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি-
ক. স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের জন্য প্রত্যেক উপজেলা থেকে নাম সংগ্রহ করে সে নাম জেলা পর্যায়ে প্রেরণ।
খ. জেলা পর্যায় থেকে প্রতিটি শাখায় বাছাই করে সর্বোচ্চ দুটি নাম বিভাগীয় পর্যায়ে পাঠাতে হবে।
গ. বিভাগীয় পর্যায় থেকে প্রতিটি শাখায় বাছাই করে সর্বোচ্চ দুটি নাম জাতীয় পর্যায়ে পাঠাতে হবে।
ঘ. জাতীয় পর্যায়ে প্রতিটি শাখায় বাছাই করে সর্বোচ্চ দুটি নাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে হবে।
ঙ. প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদিত নাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাসময়ে ঘোষণা করবে।
চ. উপজেলা পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নাম নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কর্মরত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন পেশার সম্মানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত থাকবেন।
ছ. যে কোনো নাগরিক ইচ্ছা করলে নিজের ও নিজের পছন্দের ব্যক্তির নাম নির্দিষ্ট ছক পূরণপূর্বক সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিতে পারেন।
স্বাধীনতা পুরস্কার স্থানীয় পর্যায়ের কোনো ট্রফি নয়, এটি জাতির সর্বোচ্চ পুরস্কার, এ পরস্কার যদি কলুষিত হয় তাহলে সমগ্র জাতি লজ্জিত হয়; এ পুরস্কার কলংকিত হলে মহান মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন কলংকিত হয়; অপমানিত হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম; প্রশ্নবিদ্ধ হ’ন প্রধানমন্ত্রী; সর্বোপরি লজ্জিত হ’ন আমাদের মহান পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুতরাং বিষয়টিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই; দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়