‘গায়েবি’ জামিনে স্থগিতাদেশ : ‘উষ্মা’ প্রকাশ করে ডিএজির ব্যাখ্যা চাইলেন হাইকোর্ট

আগের সংবাদ

দুপুরের পর ‘গাড়ি চলে না’

পরের সংবাদ

সাদি মহম্মদের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্থান

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৩, ২০২৪ , ১২:১১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সাদি মহম্মদ। রবীন্দ্রসংগীতকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া ও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য যে ক’জন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ রয়েছেন, তাদের মধ্যে সাদি মহম্মদ অন্যতম। শীর্ষস্থানীয় তো বটেই। নিভৃতচারী অত্যন্ত অমায়িক, বিনয়ী স্বভাবের এই শিল্পীসত্তার রয়েছে অসংখ্য শিষ্য, ভক্ত, অনুরাগী এবং সেটা দেশব্যাপী। বাংলাদেশের অনেক গুণী ও জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রয়েছেন, যারা সাদি মহম্মদের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার হাতে গড়া। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতকে উচ্চতর অবস্থানে নিতে একজন সাদি মহম্মদ তার জীবন উৎসর্গ করেছেন, সাধনা করে গেছেন নীরবে। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা বলতে তার উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ত, অন্তত যারা রবীন্দ্রসংগীত বোদ্ধা তাদের কাছে। নিজের প্রচার, প্রসারের চেয়ে তিনি অন্যকে এগিয়ে নিতে, এগিয়ে দিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন, তার জীবনাচরণ সে-ই কথাই বলে। তার শিষ্য, ভক্ত-অনুরাগী, স্বজন-প্রিয়জনরাও সেই কথা বলেছেন, বলে যাচ্ছেন। এই বলা এখন জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে যখন তিনি এই পার্থিব জগতের মোহ থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, চলে গেছেন। প্রায় সবাই বলছে, এ চলে যাওয়া তার বড় বেশি অভিমান।
সাদি মহম্মদ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এমন একজন সংগীত ব্যক্তিত্ব এমন একটি কাজ করবেন, করতে পারেন তা যেন ছিল অনেকের কাছে বিস্ময়কর এক ঘটনা, অনাকাক্সিক্ষত তো বটেই। তবে সবাই বলছেন, বলে যাচ্ছেন মানুষটির ভেতর থাকা চাপা অভিমানের কথা। কী সেই অভিমান? কাছের জনরা অকপটে বলছেন, তার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ার কথা, যা তিনি প্রায়ই অভিমান করে বলতেন তাদের কাছে। খুবই স্বাভাবিক বিষয়। গুণীজন তো তার গুণের কদর চাইবেন, স্বীকৃতি চাইবেন, অর্থবিত্ত তো আর নয়। চাওয়াটা খুবই যৌক্তিক এবং তিনি যদি হন সাদি মহম্মদের মতো একজন সংগীতজ্ঞ। রবীন্দ্রসংগীতে এই দেশে একজন সাদি মহম্মদের অবদান কতটা, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয়ভাবে তা পরিমাপ করার চেষ্টা হলে সম্ভবত তার সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব হতো এবং তাকে মূল্যায়ন করা সহজ হতো।
যে কোনো মূল্যায়ন তো একটা প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকেন দায়িত্বশীলরা এবং তাদেরই দায়িত্বশীল হতে হয় যারা মেধা, যোগ্যতা ও বিচার বিশ্লেষণে সর্বোত্তম। মূল্যায়নের পরই ঘটে ব্যক্তির স্বীকৃতি ও স্বীকৃতির দৃশ্যমান বস্তু, যেটা হতে পারে ‘পদক’। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় দুটি প্রধান পদক হলো, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক। বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা, যা দেশ ও জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করে, জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করে, সমৃদ্ধির পথ উন্মোচন করে ও কল্যাণ নিশ্চিত করে, স্পষ্টত বা দৃশ্যমান করে এবং সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে, তেমন ব্যক্তিই পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন বা করবেন, এটা হলো সাধারণ ধারণা। সঠিক বা যথাযথ মূল্যায়নই পদক প্রাপ্তির বিষয়টিকে নিশ্চিত করে থাকে। কেবল একজন সাদি মহম্মদ কেন, যে কোনো গুণী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিই তার কাজের স্বীকৃতি চাইবেন, এটা মানবজীবনের সহজাত প্রবৃত্তি।
অনেকের কাছে সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার ঘটনার চেয়েও বড় বিস্ময়কর ঘটনা ছিল, এমন একজন শিল্পীর কপালে কোনো রাষ্ট্রীয় পদক জোটেনি, এমন সংবাদটি। যেমন আমি প্রচণ্ডরকম বিস্মিত হয়েছি। সেইসঙ্গে লজ্জিত ও মর্মাহত। মাঝেসাঝে পদক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এমন অনেকের নাম শোনা যায়, যাদের চেনার জন্য, জানার জন্য অনুসন্ধান করতে হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, পদকের ওজন কিংবা ভার দিন দিন কমেছে। কমার কারণ হলো এমন সব ব্যক্তি পদক পেতে শুরু করেছে যে তাতে পদকের মহিমা, গুরুত্ব আর থাকছে না। বিশেষ করে বাঙালি জাতি, জাতীয়তা ও বাংলাদেশের কোনো কিছুতেই অবদানের স্বাক্ষর নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ছিটেফোঁটা নেই শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, পেশা ও সমাজসেবায় এমন সব ব্যক্তিকে পদকে ভূষিত করা হয়েছে বা হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। পদকের মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমাজে এমন ব্যক্তিও রয়েছে, যারা মনেপ্রাণে প্রাদেশিক চেতনায় তথা পাকিস্তানি প্রীতিতে সক্রিয় অথচ বহিরাবরণে বাংলাদেশি, এমন পোশাকি বাংলাদেশিরাও কিন্তু পদকপ্রাপ্তির জন্য মরিয়া থাকছে। কেউ কেউ পেয়েও যাচ্ছে বলে এমন অভিযোগ শোনা যায়। কোনো পদক প্রদানের জন্য আরো বিচক্ষণতার পরিচয় সংশ্লিষ্টদের দেয়া উচিত বলে কমবেশি সবারই অভিমত।
সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার বিষয়ে তার প্রিয়জন, স্বজনরা যখন বলছিলেন, পদক বা মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে তার ভেতর ভালোরকম অভিমান ছিল। তখন কেউ কেউ এমন বক্তব্যকে খণ্ডন করার চেষ্টা করতে লাগলেন। বললেন, পদকপ্রাপ্তির জন্য সাদি মহম্মদ কখনোই উদগ্রীব ছিলেন না। তাকে তার পদক না পাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যা ঠিক হচ্ছে না। এমন বক্তব্য প্রদানকারীরা সম্ভবত নিজেরাও প্রকৃত মূল্যায়নপ্রত্যাশী হয়ে আছেন, আর সাদি মহম্মদের মতো গুণী ব্যক্তি হলে তো কথাই নেই। একজন যোগ্য ব্যক্তির সঠিক মূল্যায়ন না হওয়াটা তার ভেতর সীমাহীন হতাশার জন্ম দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের চাহিদা বা প্রত্যাশা সীমিত এবং যা যথার্থ ও যৌক্তিক।
আরো একটি কষ্ট রয়ে গেছে সাদি মহম্মদের জীবনকে কেন্দ্র করে। একজন কিশোর চোখের সামনে তার বাবাকে হত্যা করতে দেখেছে। হত্যা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, স্থানীয় অবাঙালিরা। একাত্তরের ২৬ মার্চ বাবা, চাচা, ভাইদের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেখেছেন একজন সাদি মহম্মদ। তিনি ছিলেন শহীদ সন্তান। তার মা একজন শহীদজায়া। তাদের রয়েছে একাত্তরের দুর্বিষহ স্মৃতি। কী পেয়েছেন এই স্মৃতি বহন করে সাদি মহম্মদ ও তার পরিবার, প্রশ্নটা তীব্র আকারে জেগে উঠেছে এই পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বাধীনতার মাসে।
একটি রাষ্ট্রের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তার শিল্প ও সংস্কৃতি। চেতনার বড় অস্ত্রও সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কর্মীরা জাতির কৃষ্টি ও ঐতিহ্য এবং স্বপ্নকে যেভাবে ধারণ করে সমাজ পরিবর্তনে, উন্নয়নে কাজ করতে পারে, কাজ করে থাকে তা অন্য কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত, প্রমাণিত। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা নিজেদের চাওয়া ও পাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও বিভাজন। রবীন্দ্রসংগীতে আরো যাদের অবদান রয়েছে এমন ক’জন মিতা হক, পাপিয়া সারোয়ার, কাদেরী কিবরিয়া। কেমন আছেন তারা, কীভাবে তাদের মনে করা হচ্ছে, ধারণ করা হচ্ছে- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা তা কি বলতে পারেন? বোধহয় না।
আত্মহত্যা নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্য, ধারণার প্রচলন আছে সমাজে। এই ধারণা ব্যক্তিনির্ভর। তথা যিনি যেভাবে ভাবনার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখেন তিনি সেইভাবে ব্যাখ্যা দেন। তবে আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হলো, হতাশা, বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা জীবনের প্রতি ব্যক্তির অনীহা তৈরি করতে পারে এবং একটা সময়ে যা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। সাদি মহম্মদ সম্ভবত তার মূল্যায়ন যথাযথ না হওয়ায় হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছিলেন এবং এই মানসিক বৈকল্যই তাকে প্রচণ্ডরকম নিঃসঙ্গ করতে সহায়ক হয়েছিল।
কেন এমন একজন বরেণ্য শিল্পী তার যথাযথ মূল্যায়ন পেলেন না, এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমন সাংস্কৃতিক মহলের সবারই। কেউ দায় এড়াতে পারেন না। সাদি মহম্মদের এভাবে চলে যাওয়া অনেক না বলা কথা বলে গেছে, অনেক অসঙ্গতি, অনিয়মের কথা বলে গেছে। আমাদের সবার উচিত সেসব আত্মস্থ করা এবং ভুল-ত্রæটি সংশোধন করে নেয়া।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়