‘গায়েবি’ জামিনে স্থগিতাদেশ : ‘উষ্মা’ প্রকাশ করে ডিএজির ব্যাখ্যা চাইলেন হাইকোর্ট

আগের সংবাদ

দুপুরের পর ‘গাড়ি চলে না’

পরের সংবাদ

একাত্তরের বিসদৃশ কোলাজ

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজাকার বন্দনা :
২৪ নভেম্বর ১৯৭১ এপিপির খবর : (২৭ নভেম্বর ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত)
ঢাকা : করাচি পৌঁছেই বিমানবন্দরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক রাজাকারদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, তারা দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক কাজ প্রতিহত করছে। পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে এবং রাজাকাররা চমৎকার কাজ করছে। ‘তারা দেশপ্রেমিকদের জানমাল রক্ষা করছে এবং নিজেদের জীবনের বিনিময়ে রাষ্ট্র্রবিরোধী ব্যক্তিদের নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রহরা দিচ্ছে।’
এপিপি ১৩ অক্টোবরের সংবাদ : পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্বমন্ত্রী মওলানা এ কে এম ইউসুফ খুলনা জিলা স্কুল মিলনায়তনে রাজাকার সমাবেশে রাজাকারদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘রাজাকাররা শুধু অনুপ্রবেশকারীদের হামলাই সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেনি, তারা কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় ছাপমারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যে কোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে আমাদের সাহসী জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।’
২০ অক্টোবর ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান
‘রাজাকারদের প্রতি জেনারেল নিয়াজির আহ্বান’ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। সামরিক আইন শাসিত পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ওই অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি পাবনায় রাজাকার সমাবেশে তাদের নিঃস্বার্থ দেশসেবার আহ্বান জানান। সেই সমাবেশে শান্তি কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
জেনারেল নিয়াজি পাবনায় পৌঁছালে সংবাদপত্রের ভাষায় ‘উৎফুল্ল জনতা’ তাকে সংবর্ধনা জানায়। তারপর তিনি স্থানীয় ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। সমাবেশে তিনি উল্লেখ করেন রাজাকাররা দেশরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনের মহান সুযোগ পেয়েছে। এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য গভীর শৃঙ্খলাবোধ আদর্শের সঙ্গে নিঃস্বার্থ নিষ্ঠার প্রয়োজন। পাকিস্তান রক্ষা করা তাদের নিজেদের বাড়িঘর রক্ষা করার শামিল।
তিনি রাজাকারদের বলেন, মানুষের মৃৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মৃৃত্যু গৌরবের। যুদ্ধের মৃৃত্যুতে সৈনিকের সব পাপ মুছে যায় এবং সে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হয়। জেনারেল নিয়াজি পাবনা রাজশাহী আসেন এবং সেখানকার দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শত্রæর ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নস্যাৎ করে জাতি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। সেখানকার রাজাকাররা মাতৃভূমির প্রতিরক্ষায় তাদের শেখ রক্তবিন্দু বিসর্জনের শপথ গ্রহণ করে।
জেনারেল নিয়াজি রাজশাহী সেনানিবাসে সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক পরিদর্শন করেন। তিনি শুনে আশ্বস্ত হন যে বর্ষা শেষ হয়ে আসাতে দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতাও ক্রমেই কমে এসেছে।
৪ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, জেনারেল নিয়াজি রংপুর জেলার নীলফামারীর ডোমারে শান্তি কমিটির সমাবেশে বলেন, ভারত কখনো পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের শুভাকাক্সক্ষী হতে পারে না। স্বাধীনতা-পূর্বকালে হিন্দু শাসনামলে মুসলমানদের দুর্দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ভারত আবার এই প্রদেশকে পদানত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি রাজাকারদের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য মূল্যবান সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। প্রতিটি রাজাকার ইসলাম ধর্ম ও পাকিস্তানের জন্য নিবেদিত একজন মুজাহিদ।
সেখানকার কমান্ডার জেনারেল নিয়াজিকে জানান, মূলত রাজাকাররা সদা জাগ্রত ও তৎপর থাকার কারণেই ভারতীয় চর সে এলাকায় কোনো সেতু বা কালভার্ট ধ্বংস করতে পারেনি।

রাজাকার সহায়তার চিঠি
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, যশোর
প্রেরক : তাজুল হক
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক যশোর
প্রতি : মহকুমা প্রশাসক
সদর/ঝিনাইদহ/মাগুরা/নড়াইল/
বিষয় : মৃত রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পরিবারের জন্য জিয়ার গম বরাদ্দ প্রসঙ্গে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে দুষ্কৃতকারীর হাতে নিহত রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের পরিবারবর্গের সহায়তার জন্য জিআর (খয়রাতি ত্রাণ) গম প্রদান করা হবে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত বণ্টন অনুযায়ী ১ হাজার মণ জিআর গম বরাদ্দ করা হয়েছে। নির্ধারিত নিয়ম অর্থাৎ পরিবারের পূর্ণ বয়স্কদের জন্য মাথাপিছু সপ্তাহে ৩ সের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দেড় সের হিসেবে মাস্টাররোল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিতরণ করা যাবে।
মহকুমা প্রশাসক সদর ৪০০ মণ
মহকুমা প্রশাসক ঝিনাইদহ ২০০ মণ
মহকুমা প্রশাসক মাগুরা ২০০ মণ
মহকুমা প্রশাসক নড়াইল ২০০ মণ
১০০০ মণ
স্বাক্ষর : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) যশোর
অনুলিপি অগ্রায়ণ করা হলো :
১. এএসএমএলএ যশোর : আমার দপ্তরে জেলা শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে আপনার সঙ্গে আলোচনার সূত্রে বরাদ্দ দেয়া হলো।
২. জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক।
৩. প্রেসিডেন্ট, জেলা শান্তি কমিটি, তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে।
৪. চেয়ারম্যান, মহকুমা শান্তি কমিটি, মাগুরা/নড়াইল/ঝিনাইদহ সদর।
৫. চেয়ারম্যান, শহর শান্তি কমিটি।
৬. জেলা অ্যাডজুট্যান্ট অব রাজাকার।

আপনার ছেলে কোথায়?

গোপনীয় পত্র
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
সেবা ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগ, শাখা-৪
প্রেরক : ঢাকা, আগস্ট ১০, ১৯৭১
এ এফ এম রহমান
অতিরিক্ত মুখ্য সচিব
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
প্রাপক :
ঢাকা শহরে কর্মরত সরকারি কর্মচারী এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীন স্বায়ত্তশায়িত সংস্থার কর্মচারীদের সন্তান-সন্ততিদের ব্যাপারে নিম্নলিখিত তথ্যাবলি সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে:
ক. সন্তানের নাম ও বয়স:
খ. কোথায় অধ্যয়রত- স্কুল/কলেজের নাম:
গ. সে নিয়মিত ক্লাস করছে কী? উত্তর না হলে, কেন না?
ঘ. সে কোথয় পড়তে যায়?
২. সরকারি, বিভাগ, দপ্তর, সংযুক্ত কার্যলয়, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের তথ্য সংগ্রহের পর বিভাগীয় প্রধান তা একত্রীকরণ করে পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্য সচিবের কাছে পাঠাবেন।
৩. বিভাগীয় কমিশনার অফিস, জেলা প্রশাসন, ঢাকা সদর উত্তর ও দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসনের আওতায় কর্মরত সবার তথ্য বোর্ড অব রেভিনিউতে প্রেরণ করবেন। বোর্ড অব রেভিনিউ এই ত্য সমন্বয় করে মুখ্য সচিবের কাছে পাঠাবে।
৪. বিষয়টি জরুরি বিবেচনা করতে হবে- কারণ এই প্রতিবেদন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ জোন বি-র সদর দপ্তরে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
স্বাক্ষর ১০.৮.৭১
(এ এফ এম রহমান)
অতিরিক্ত মুখ্য সচিব

জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধি : পাকিস্তানের পাশে চীন : নিরাপত্তা পরিষদে চীনা প্রতিনিধি বললেন, ‘সম্প্রতি ভারত সরকার প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সেনাদল পাঠিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত বৃহদাকার সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে- ফলে উপমহাদেশ তথা এশিয়ায় উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এতে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের অজুহাত তুলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত সরকার বলেছে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী প্রেরণ সম্পূর্ণভাবে তাদের জন্য আত্মরক্ষামূলক। এটা তো জঙ্গলের আইন। ঘটনাবলি প্রমাণ করে ভারতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছে, এমন নয় যে পাকিস্তান ভারতের নিরাপত্তাকে হুমকি দিচ্ছে।
ভারত সরকারের যুক্তি মানতে হলে যে কোনো দেশই আত্মরক্ষার অজুহাতে অন্য দেশ আক্রমণ করে বসতে পারে। তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের অখণ্ডতা, আর থাকল কোথায়? ভারত সরকার বলছে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করতে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ মুহূর্তে ভারতে অনেক তথাকথিত চায়নিজ তিব্বতি শরণার্থী রয়েছে। ভারত সরকার প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহীদের নেতা দালাইলামাকে প্রস্তুত করছে। ভারতীয় যুক্তি খাটিয়ে তাহলে কি এ অজুহাতে ভারত চীনকেও আক্রমণ করতে যাচ্ছে?
পাকিস্তান সরকার প্রস্তাব করেছিল, সীমান্ত থেকে উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করা হোক, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীর বিষয়টি দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব হবে। এ প্রস্তাব অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু চরম অযৌক্তিকভাবে ভারত সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে প্রমাণিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ভারতের ন্যূনতম আগ্রহ নেই এবং এটিকে পুঁজি করে একটি অজুহাত হিসেবে ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চাচ্ছে। চীনা প্রতিনিধি মনে করে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ ভারতের এই আগ্রাসনের নিন্দা জানাবে এবং দাবি জানাবে যেন ভারত সরকার অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে পাকিস্তান থেকে তার সব সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়।
সবশেষে চীন সরকারের পক্ষ থেকে আমি জানিয়ে দিতে চাই চীন সরকার ও চীনের জনগণ দৃঢ়ভাবে পাকিস্তান, পাকিস্তানের জনগণ এবং ভারত সরকার ও তাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করে। আমি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে এবং সমগ্র পৃথিবীর মানুষের সামনে দেখিয়ে দিতে চাই যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় ভারত এই আগ্রাসন চালিয়েছে- অসংখ্য ঘটনা তা প্রমাণ করে।

পাকিস্তানি শ্বেতপত্র ১৯৭১-এর বয়ান : আওয়ামী লীগের সশস্ত্র উত্থানের ডাকে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাবেক কর্নেল ওসমানীকে বিপ্লবী বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করলেন। ওসমানীকে সরাসরি শেখ মুজিবের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সাবেক সেনাসদস্যদের সমর্থন আদায় করে তাদের তালিকাভুক্ত করতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে দায়িত্ব দিলেন। আওয়ামী লীগের সদর দপ্তরে তাদের তালিকা প্রণয়ন করে সংরক্ষণ করা হলো এবং তাদের অস্ত্রসজ্জিত করার ব্যবস্থা নেয়া হলো। আর এ জন্যই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও যশোরের অস্ত্রের দোকান লুট করা হলো।
বিদ্রোহীদের ব্যবহারের জন্য বড় বড় শহরে সঙ্গোপনে অস্ত্র স্তূপীকৃত করা হলো।
এরপর এগিয়ে এলো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ইপিআর ও ইবিআরের বিভিন্ন আউটপোস্ট ওয়ারলেস ট্রান্সমিটারে সংযুক্ত করে যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসা হলো। এক ইউনিট থেকে অন্য ইউনিটে দ্রুত সংবাদ ও নির্দেশনা পাঠানোর কাজ শুরু হয়ে গেল। সবচেয়ে বড় অপারেশন ঘাঁটিটি প্রস্তুত হলো চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে। অপারেশনের সূ²াতিসূ² পরিকল্পনা করা হলো। এমনভাবে ব্যবস্থা নেয়া হলো যাতে:
১. স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম এমনভাবে দখল করে নেবে যেন বিমান বা সমুদ্রপথে পাকিস্তানি সৈন্য অবতরণ প্রতিহত করা যায়।
২. অবশিষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্যরা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস পুলিশ ও সশস্ত্র রাজাকারদের সহায়তা করবে যাতে তারা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও স্টেশনে অবস্থানকারী সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের শেষ করে দিতে সমর্থ হয়।
৩. ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সীমান্তের সবগুলো প্রধান চৌকি দখলে রাখবে, যাতে বাইরে থেকে সাহায্যের জন্য যথাসময়ে সীমান্ত খুলে দেয়া যায়।
৪. আরো যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রয়োজন হবে তার জোগানের ব্যবস্থা যেন ভারত থেকে করা যায়।
৫. আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বাহিনী তাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অচল করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সহায়তার নামে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢুকে পড়তে পারে।
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য জিরো আওয়ার হিসেবে শুক্রবার খুব ভোর বেলাকে নির্ধারণ করা হয়। ২৫-২৬ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র অভ্যুত্থান এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই সরকারের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানালেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলো এবং ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও প্যারা-মিলিশিয়া ফোর্সের পথভ্রষ্ট নাশকতামূলক কার্যে জড়িত একটি অংশের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের আওয়ামী চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের এই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী- যারা মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে দায়িত্বরত ছিল, বিদ্রোহীদের দমন করল এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দিল। এ সময়ের মধ্যে বিদ্রোহী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সাময়িক দখলে চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানের কিছু এলাকা। আর সেসব এলাকায় ১ মার্চ ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ চালাল সন্ত্রাসের রাজত্ব। তাদের হাতে শিশু ও মহিলাসহ কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হলো। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন, যানবাহন, যোগাযোগব্যবস্থা ও শিল্পস্থাপনাগুলোর অপূরণীর ক্ষতিসাধিত হলো তাদের হাতে।
আওয়ামী লীগের ক্যাডার এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বিদ্রোহীদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শেষ পর্যন্ত গণহত্যার রূপ ধারণ করল। আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যারা একমত পোষণ করল না তারাই তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। তারা অবর্ণনীয় বর্বরতা অব্যাহত রাখল। কেবল বগুড়া জেলার শান্তাহারে ১৫ হাজারের বেশি লোককে ঘেরাও করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মহিলাদের নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে এবং মায়েদের বাধ্য করা হয়েছে তাদের সন্তানদের রক্ত পান করতে।
পাবনার সিরাজগঞ্জে ৩৫০ জন মহিলা ও শিশুকে একটি হলঘরে আটকে রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়- যাতে সবাই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ময়মনসিংহের সানকিপাড়ায় ২ হাজার লোকের একটি কলোনি আক্রমণ করা হয়। এদের বাইরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের আগে মেয়েদের নিজেদের কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের হত্যা করা হয়। শ্বেতপত্রে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করা হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঢাকাতেই ছিলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন আওয়ামী লীগ আর পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় না, বরং প্রতিষ্ঠা করতে চায় পৃথক একটি স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। আরো জানলেন, ২৬ মার্চ খুব ভোরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। এরপর তো আর বসে থাকা যায় না। পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে সরকারের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের অনেক গর্বের সেনাবাহিনীকে ডাকলেন। সেনাবাহিনী নস্যাৎ করে দিল বাঙালিদের সব চক্রান্ত। শান্তি ফিরিয়ে আনল, সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল (এবং পাকিস্তান সরকার সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করতে থাকল!)।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়